সাত
সারাটা রাত একভাবে কাটল। সবাই জেগে বসে রইল কালুকে ঘিরে।
পরের দিন ভোরে কালু চোখ মেলল। মুখ-চোখের ভাব যেন একটু পরিষ্কার।
তারা বাশুলির পুজো দিতে বেরিয়ে পড়ল। মাসিকে সঙ্গে নিয়ে।
ফিরল যখন বেশ বেলা হয়েছে। কাছাকাছি এসেই থমকে দাঁড়াল। দলের প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে। কেউ ঘরের মধ্যে, কেউ উঠানে, কেউ বাগানে বসে আছে।
সামনে নিধিরামকে দেখে তারা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?
নিধিরাম মাথা নিচু করে বলল, সর্দারের অবস্থা ভালো নয়।
লোক ঠেলে তারা ভিতরে গেল। পুজোর সিঁদুর কালুর কপালে পরিয়ে দিল। সাবধানে তাকে হাঁ করিয়ে চরণামৃত ঢেলে দিল মুখে।
ইঙ্গিতে কালু তারাকে কাছে বসতে বলল।
তারা বসল।
দলের চাঁইরা সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে। ক্লান্ত দৃষ্টি বুলিয়ে কালু একবার সকলের দিকে দেখল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি বুঝতে পারছি আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। মা বাশুলির ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। আমি যখন থাকব না, তখন দল চালাবার ভার দিয়ে গেলাম তারা-মায়ের ওপর। আমাকে যেমন সম্মান দেখাতে, একেও তেমনই দেখাবে। জীবন দিয়ে এর সেবা করবে।
কালু মেঘাকে ইঙ্গিত করল। মেঘা কোণ থেকে রুপো-বাঁধানো কালুর লাঠিটা এনে তারার দিকে এগিয়ে দিল। তারা লাঠিটা কপালে ঠেকাল।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই চেঁচিয়ে উঠল, তারা মায়িকি জয়!
কালুর ক্লান্ত মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল।
কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল তারা বুঝতে পারল না। তার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে অশ্রান্ত দাপাদাপি। এত বড়ো একটা দলের সে অধিনায়িকা। এ গুরুদায়িত্ব বহন করার তার শক্তি কোথায়!
কালু একটা হাত রাখল তারার মাথায়। তারা নিচু হয়ে কালুকে প্রণাম করল।
তারা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। একদৃষ্টে সে কালুর দিকে চেয়ে রইল।
কালুর দুটি চোখ নিমীলিত। ঠোঁট দুটো অল্প অল্প কাঁপছে। মনে হল দেবতার নাম জপ করছে।
সেরাত এমনিভাবেই কাটল।
পরের দিন খুব ভোরে উঠে তারাকে স্নান সেরে নিতে হল। স্নান সেরে চওড়া লালপাড় নতুন শাড়ি অঙ্গে জড়াল। তারপর দলের দুজনের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে দেখল দরজার গোড়ায় পালকি দাঁড়িয়ে।
এ কী পালকি কেন?
তোমাকে মায়ের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে। হেঁটে যাবার দরকার নেই।
তারা আর কথা বলল না। পালকির মধ্যে গিয়ে বসল।
মন্দিরের সামনে দলের প্রায় সকলেই এসে জুটেছে। কাঁসরঘণ্টা বাজছে। পুরোহিত খুব ব্যস্ত।
তারাকে মূর্তির সামনে পাতা কার্পেটের একটা আসনে বসতে হল।
সংস্কৃত তারা একবিন্দুও বোঝে না, কিন্তু পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বার বার তার সারা দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তারপর পুরোহিত মন্ত্র থামিয়ে বাংলায় যখন তাকে বুঝিয়ে দিল যে সামনে যে বিরাট শক্তি রয়েছে তারা সেই বাশুলি-মায়েরই শক্তির অংশ, অমিত বীর্যের অধিকারিণী, তখন শুনতে শুনতে তারার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল, সত্যিই যেন মা বাশুলি নিজের শক্তির কিছুটা তাকে অর্পণ করেছেন।
শেষকালে পুরোহিত বলল, এবার শোণিত দাও মা।
শোণিত? তারা একটু চমকে উঠল। কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না।
পুরোহিত আবার বলল, তোমার অভিষেকের দিনে মা-কে রক্ত অর্ঘ্য দিতে হয়।
তারা বিস্মিত দৃষ্টি মেলে পুরোহিতের দিকে চেয়ে রইল।
পুরোহিত তারার ডান হাতটা টেনে নিল নিজের দিকে, তারপর পাশে রাখা চকচকে একটা ছোরা তুলে নিয়ে অনামিকার ওপর আস্তে বসিয়ে দিল।
ফিনকি দিয়ে তাজা রক্তের স্রোত ছুটল।
পুরোহিত তারার হাতটা টেনে মূর্তির পায়ের ওপর রাখল। টপটপ করে রক্তের ফোঁটা বাশুলি-মায়ের পায়ের ওপর ঝরে পড়তে লাগল।
ফেরার সময় পালকিতে নয়, তারাকে মাঝখানে রেখে দলের সবাই জয়ধ্বনি করতে করতে চলল।
বাড়ির কাছ বরাবর এসেই সবাই থেমে গেল। কালুর কাছে মাসি ছিল, আর দরজায় একজন অনুচর।
দুপুরের থমথমে আবহাওয়া ছাপিয়ে মাসির কান্নার সুর ভেসে উঠল।
তারার হাতে কলাপাতায় মোড়া প্রসাদ ছিল। কান্নার শব্দ কানে যেতেই সে প্রসাদ বুকের মধ্যে চেপে ধরে ছুটতে আরম্ভ করল।
পিছন পিছন দলের আর সবাই।
কালু সর্দার চিত হয়ে শুয়ে আছে। দুটো হাত বুকের ওপর। যন্ত্রণায় মুখটা কিছুটা বিকৃত। মাথার কাছে বসে মাসি চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে।
প্রসাদটা পাশে রেখে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল কালুর শরীরের ওপর। দলের সবাই কালুর প্রাণহীন দেহ ঘিরে দাঁড়াল মাথা নিচু করে।
তারার খেয়াল ছিল না। হাতের আঙুল থেকে বিন্দু বিন্দু রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেল আবার। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত কালুর কপালে রক্তচন্দনের মতন শোভা পেতে লাগল।
দলের সবাই চেঁচিয়ে উঠল, কালু সর্দারের জয়! তারা মায়িকি জয়!
বিকালের দিকে কালু সর্দারকে নিয়ে যাওয়া হল। দলের প্রত্যেকের হাতে লাঠি। তারার হাতেও।
মাইল তিনেক দূরে শ্মশান। শুধু দলের লোকই নয়, কোথা থেকে খবর পেয়ে কাছাকাছি গ্রাম থেকে অনেক লোক এসে জুটল।
কেউ কেউ এগিয়ে এসে তারাকে প্রণাম করল।
বলল, রানিমা, এবার আপনি ভরসা। সন্তানদের দেখবেন।
.
প্রথম প্রথম তারার একটু ভয় হয়েছিল। কী জানি তার এভাবে দলের সর্দার হওয়াটা দলের অন্য সবাই হয়তো তেমন পছন্দ করবে না। বিশেষ করে চাঁইরা।
কিন্তু দিনের পর দিন কেউ একটু প্রতিবাদ করল না। বরং মেঘা, চরণ, মনা এরা সব অন্য কথা বলল।
জানো তারা-মা, সর্দার স্বপ্ন পেয়েছিল। একবার, দুবার নয়, বার বার তিনবার।
কী স্বপ্ন? তারা জিজ্ঞাসা করেছিল।
বাশুলি-মা স্বপ্ন দিয়েছিল, এবার আমার দেহ থেকে অংশ দেব তোদের। আমার শক্তির অংশ। আর কোনও ভয় থাকবে না।
কথাগুলো শুনতে শুনতে তারার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শরীরের রক্ত যেন ফুটতে লাগল টগবগিয়ে। সত্যিই বুঝি সে বাশুলি-মায়ের প্রেরিত।
তারপরই তুমি এলে। তোমাকে দেখেই সর্দার বলেছিল আমাদের, মা-র লোক এসে গেছে রে। এবার আমার যাবার পালা। একে ভালো করে সব শিখিয়ে দে। আর তোদের মার নেই।
তারা আর কিছু বলেনি। দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে। নিজের মধ্যে সত্যিই একটা শক্তির উৎস অনুভব করেছে। মনে হয়েছে দুনিয়ার কোনও বাধাই তার প্রতিবন্ধক হতে পারবে না। তারা মায়ির দল অজেয়, অক্ষয়।
দিন তিনেকের মধ্যে খবর এল।
তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দলের লাঠিখেলা দেখছিল, একজন বৈরাগী এসে প্রণাম করে পিছনে দাঁড়াল।
খবর আছে মা।
তারা পিছিয়ে এল।
কী খবর?
পরশু মাঝরাতের কিছু পরে শক্তিগড়ের লোচন রায়ের গোমস্তা এই পথ দিয়ে যাবে কলকাতার সেরেস্তায় টাকা জমা দিতে।
সঙ্গে লোক কত?
এবার এক নতুন কায়দা করেছে মা। লোকজন নিয়ে হইচই করে যাবে না।
তবে?
এক পুরোহিত যাবে নারায়ণ কোলে করে। সঙ্গে জন চারেক লাঠিয়াল।
টাকা?
পুরোহিত আর লাঠিয়ালদের কোমরে থাকবে।
ঠিক আছে, যদি টাকা আমাদের কবলে আসে, পরে দেখা কোরো, পুরস্কার পাবে।
লোকটা আবার প্রণাম করে বিনীতকণ্ঠে বলল, গরিবকে মনে রাখবেন মা। অধীনের নাম নফর সামন্ত। নসিপুরের বাসিন্দা।
তারা ঘাড় নাড়ল।
লোকটা মাঠ পার হয়ে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতে, তারা মেঘার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, একটা খবর আছে। সন্ধ্যার পর তোমরা আমার সঙ্গে দেখা কোরো।
দলের পাঁচজন চাঁই ঠিক সন্ধ্যার পর তার ঘরে গিয়ে ঢুকল।
তারা সবে পূজা শেষ করে দেবীর পটের সামনে আরতি করছিল, মেঘাদের ঢুকতে দেখে ইঙ্গিতে বসতে বলল।
আরতি শেষ করে তাদের কাছে বসে নফর সামন্তর দেওয়া খবরের কথা বলল।
মনা বলল, লোক যদি এত কম হয় তো আমরা জন চারেক গিয়েই তো কাজ হাসিল করতে পারি। বেশি লোকজন নিয়ে হইচই করার কী দরকার। কী বলো?
সমর্থনের আশায় মনা সকলের মুখের দিকে দেখে শেষকালে তারার দিকে চোখ ফেরাল।
তারা কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর চাপা গলায় বলল, আমি ভাবছি, আর-একটা কাজ করলে হয়।
মেঘা বলল, কী?
বিনা রক্তপাতে কাজ উদ্ধার করা যায় না?
কী করে?
তারা খুব ফিসফিস করে মতলবটা দলের কাছে বলল। শুনে হাসির হল্লা উঠল।
চৈতন মাথা নেড়ে বলল, বুদ্ধি বটে তারা মায়ির!
ঠিক দিনে শক্তিগড়ের গোমস্তা আসবার পথের ধারে এক বিরাট জিয়ল গাছের নীচে জটাজূটধারী এক সন্ন্যাসীকে দেখা গেল। সামনে ধুনি জ্বলছে। এধারে-ওধারে ছড়ানো নরকঙ্কাল। সন্ন্যাসীর সামনে এক নরকরোটিতে রক্তাভ পানীয়। সন্ন্যাসীর পরনে রক্তাম্বর। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে রুদ্রাক্ষের বলয়।
মধ্যযাম পার হতেই পথের বাঁকে দুটো মশালের আলো দেখা যায়। তার মানে, শক্তিগড়ের লোকেরা আসছে। কাছে আসতেই বোঝা গেল সবাই বেশ দ্রুত পদক্ষেপে চলেছে। কোনওরকমে এ অঞ্চলটা পার হতে পারলেই ভোরের দিকে সেবায়েতপুরের চটিতে আশ্রয় নিতে পারবে। মাঝপথে যে চটি আছে, সেটা খুব নিরাপদ নয়।
সন্ন্যাসীর কাছাকাছি আসতেই সন্ন্যাসী বজ্রকণ্ঠে হুংকার ছাড়ল, কে যায়?
আচমকা আওয়াজে সমস্ত দলটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
পুরোহিত পিছনের লোকগুলোর দিকে ফিরে বলল, সর্বনাশ, কাপালিকের পাল্লায় পড়লাম যে!
এত রাতে এ পথ দিয়ে কোথায়?
পুরোহিত জোড়হাত করে সন্ন্যাসীর সামনে বসে পড়ল।
আজ্ঞে, আসছি শক্তিগড় থেকে, যাব কলকাতা। কলকাতার শোভাবাজারের হুজুরদের নতুন বাড়িতে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবে, তাই গৃহদেবতাকে নিয়ে চলেছি।
কে হুজুর?
আজ্ঞে লোচন রায়। তাড়াতাড়ি ছুটছি, এলাকাটা তো ভালো নয়। কালু সর্দারের এলাকা।
সন্ন্যাসী ভ্রূ কুঞ্চিত করে পুরোহিতের দিকে একবার দেখল।
কালু সর্দার তো মারা গিয়েছে।
মারা গিয়েছে?
হ্যাঁ, যেমন কর্ম, তেমনই ফল। ইংরেজের বন্দুকের গুলিতে খতম।
তার দল?
ছড়িয়ে পড়েছে এধার-ওধার। তা ছাড়া তোমাদের সঙ্গে নারায়ণ রয়েছে, তোমাদের কী ভয়?
সেইজন্যই তো আরও ভয় প্রভু। কী জানি দুর্বৃত্তের দল যদি ঠাকুরকে অপবিত্র করে!
মূর্খ, সন্ন্যাসী গর্জন করে উঠল, ভগবানকে অপবিত্র করে কার সাধ্য! এই নাও কারণবারি।
সন্ন্যাসী নরকরোটি এগিয়ে দিল পুরোহিতের হাতে।
পুরো দলটাই সন্ন্যাসীকে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়েছিল। পথশ্রমের ক্লান্তি কিছুটা দূর হবে। তা ছাড়া, এমন নির্জন অরণ্যে কাপালিক যেন একটা ভরসা।
পুরোহিতের হাত থেকে দলের সবাই নরকরোটি নিয়ে সেই রক্তাভ পদার্থ পান করল। একের পর এক।
সন্ন্যাসী ধুনির পাশ থেকে ছাই তুলে নিয়ে সকলের কপালে টিপ পরিয়ে দিতে দিতে বলল, যা, এবার যাত্রা শুরু কর। সব অমঙ্গল কাটিয়ে দিলাম। কারো সাধ্য নেই তোদের স্পর্শ করে।
কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড, উঠে দাঁড়ানোর বদলে সবাই পথের ওপর নেতিয়ে পড়ল। চেতনাহীন।
ঠিক সেই সময় আশপাশের গাছের ডালগুলো দুলে উঠল।
প্রথমে তারা, তারপর মনা, চৈতন আর গোকুল। এক-এক করে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল।
তারা হাসল, কী, কেমন মতলব দিয়েছিলাম?
সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, তারা মায়িকি জয়!
ঠিক আছে, এবার দেখো কী আছে। সাবধান, বিগ্রহের যেন কোনও ক্ষতি না হয়!
সবাই একটু সরে দাঁড়াল। সন্ন্যাসীরূপী মেঘা পুরোহিত আর সঙ্গীদের দেহ তন্ন তন্ন করে তল্লাশ করে নোট আর টাকার থলি বের করে নিল।
ধুনির আগুন নিভিয়ে সবাই অরণ্যের মধ্যে গা-ঢাকা দিল।
কিছুটা গিয়ে মনা বলল, টাকা লুঠ করা হল বটে, কিন্তু এতে গা গরম হল না তারা মা।
তারা চলতে চলতে বলল, আপশোসের কী আছে মনা, এক মাঘে কি আর শীত পালায়। দিন আসবে।
সেরাত্রেই মন্দিরের চাতালে বসে গোনা হল। নোটে টাকায় মিলে নগদ ত্রিশ হাজার টাকা। বিনা রক্তপাতে খুব ভালো উপার্জন।
চৈতনই বলল, আরও কিছু গাদাবন্দুক আমাদের দরকার তারা-মা। সর্দার বন্দুকের গুলিতে মারা গেল, এ দুঃখ আমাদের যাবার নয়। আমাদের হাতে কয়েকটা বন্দুক থাকলে লালমুখোদের সাধ্য কী আমাদের আক্রমণ করার সাহস পায়।
তারা বলল, কিন্তু বন্দুক অতগুলো জোগাড় হবে কী করে? এ তো এমন নয় যে পয়সা ফেললেই মুড়ি-বাতাসার মতন দোকান থেকে কিনতে পারব। এক উপায়, ইংরেজরা যখন এ তল্লাট দিয়ে যাবে, তখন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টাকার সঙ্গে বন্দুকও কেড়ে নেওয়া।
আজকাল শুনছি নাকি ইংরেজরা টাকা নিয়ে জলপথে যাচ্ছে। সে পথেও অবশ্য ছিপ নিয়ে জলদস্যুরা বসে আছে, আর তা ছাড়া সময়ও অনেক বেশি লাগে।
দেখা যাক। অপেক্ষায় থাকো। বাশুলি-মা সুযোগ দিলে ঠিক কাজ হাসিল হয়ে যাবে।
দিন সাতেক পরেই চৈতন একটা লোককে তারার কাছে নিয়ে এল। এ লোকটাকে তারা আগেও দেখেছে। জনমেজয় মিত্তির। এখানকার সব ক্রিয়াকলাপের হিসাবনিকাশ, লেখাপড়ার কাজ এ-ই করে। অনেক সময় জমির সীমানা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির ব্যাপার গাঁয়ের লোকেরা মিটমাটের জন্য কালু সর্দারের কাছে নিয়ে আসত। আইন-আদালতের ওপর তাদের আস্থা নেই। কালু সর্দার যা করবে, যা বলবে, তা-ই শিরোধার্য। তখন এই জনমেজয় মিত্তির দলিল-দস্তাবেজ সব পড়ে কালু সর্দারকে জমির সীমানার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিত। দলের মধ্যে লেখাপড়া-জানা লোক আর ছিল না। তারা অবশ্য দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত পড়েছে। তাও ভালো করে নয়। ছাপা লেখা যা-ও বা পড়তে পারে, হাতের লেখা পারে না।
কী হল? তারা বল্লমের ফলাটা শানে ঘষে চকচকে করতে করতে প্রশ্ন করল।
ব্যাপারটা বলো-না জনমেজয়। চৈতন লোকটাকে বলল।
জনমেজয় উড়ুনিতে বাঁধা হলদে রঙের ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল, তারপর সুতো-বাঁধা চশমাটা চোখে দিয়ে একবার তারার দিকে চেয়ে বলল, পড়ি?
বিস্মিতভাবে তারা মাথা নাড়ল।
জনমেজয় পড়তে আরম্ভ করল।
এতদ্দ্বারা জ্ঞাত হয় যে দেশের স্থানে স্থানে স্থলদস্যু ও জলদস্যুদের আপদ ইংরাজ সুশাসনের পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ। আশা করা যায় সকলেই এ ধরনের বিঘ্ন উৎপাটিত করার জন্য যত্নবান হইবেক। গবর্নর বাহাদুরের অনুমতিক্রমে ইহা জ্ঞাপিত হইল যে দুর্গাপুর অরণ্যের তিলক সর্দার, তারা মায়ি আর ফটিকচরণকে যে বা যাহারা নিধন করিতে পারিবেক, তাহাদের সরকারের সেরেস্তা হইতে নগদ দুই হাজার টাকা পারিতোষিক দেওয়া হইবেক। জলদস্যু রামবাহাদুর ও পর্তুগিজ পিড্রজকে নিধন করিতে পারিলেও অনুরূপ অর্থ প্রদত্ত হইবেক। এ বিষয়ে সরকারও যথাসাধ্য তৎপর হইবেক।
পড়া শেষ করে জনমেজয় কাগজটা ভাঁজ করে আবার রেখে দিল।
এ ইস্তাহার কারা দিয়েছে? তারা গম্ভীর গলায় জনমেজয়কে জিজ্ঞাসা করল।
বর্ধমানের নরিশ সায়েব। কালেক্টর। শুনলাম বিরাট দলবল নিয়ে এদিকে আসবে, উদ্দেশ্য দুর্গাপুরের জঙ্গল পরিষ্কার করা।
হাঁটুর ওপর মুখটা রেখে তারা চুপচাপ বসে রইল। সামনাসামনি লড়াইয়ে এদের সঙ্গে পেরে ওঠা দুষ্কর। সঙ্গে প্রচুর বন্দুক-বারুদ থাকে। শিক্ষিত সৈন্যের সংখ্যাও কম নয়, একমাত্র ভরসা এ জঙ্গল এদের নখদর্পণে নয়। আচমকা পিছন থেকে আক্রমণ করে ঘায়েল করতে হবে। বন্দুক ছোড়ার সুযোগ না দিয়ে।
কিছুক্ষণ পর তারা চৈতনের দিকে ফিরল। একটা কাজ করতে হবে চৈতন।
বলো।
এখনই রনপা দিয়ে দুজন লোককে তিলক আর ফটিকের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে।
তারার কথা শুনে চৈতন অবাক হয়ে গেল।
.