উপন্যাস
গল্প

অরণ্য-বিভীষিকা – ৬

ছয়

তারার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। দু-হাতে গাছের একটা ডাল ধরে না থাকলে সে বোধহয় ঠিকরে মাটিতেই পড়ে যেত।

কোম্পানির লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে নানা দিকে ছুটতে শুরু করল। মশালের আগুনে পালকিটা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। অবশ্য তার আগে ডাকাতরা টাকার থলিগুলো বের করে এনেছে।

ফেরার মুখে সবাই এসে গাছতলায় জড়ো হল। কালু সর্দার প্রথমেই চিৎকার করে উঠল, তারা মায়িকি জয়!

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বনভূমি প্রতিধ্বনিত করে সুর উঠল, তারা মায়িকি জয়!

কালু কাঁধে করে তারাকে গাছ থেকে নামাল।

তখনও তারার চেতনা নেই। দু-হাতে কালুর মাথাটা আঁকড়ে ধরে নিঝুম হয়ে বসে রইল।

চলতে শুরু করার আগে কালু পাশে দাঁড়ানো অনুচরকে বলল, এই মেঘা, সাহেবের বন্দুকটা নিয়ে আয়। ও বন্দুক মা-র পাওনা।

অনেকটা পথ গিয়ে তারার চেতনা হল।

আস্তে আস্তে বলল, আমাকে নামিয়ে দাও।

কালু তারাকে মাটির ওপর নামিয়ে দিল।

হাঁটতে গিয়েই তারা অনুভব করল তার দুটো পা ঠকঠক করে কাঁপছে। খুব দুর্বল বোধ হচ্ছে শরীর। হেঁটে চলার শক্তি তার নেই।

কালু সেটা বুঝতে পারল। বলল। মা, তুমি আমার শরীরে ভর দিয়ে চলো। আর মাইলখানেক গেলেই ঘোড়া পাওয়া যাবে।

সত্যিই কিছুটা পথ যেতেই দেখা গেল একটা গাছের ডালে গোটা তিনেক ঘোড়া বাঁধা রয়েছে।

টাকার থলিগুলো নিয়ে একজন একটা ঘোড়ায় উঠল। কালু তারাকে সামনে নিয়ে আর-একটায় উঠল। বাকি ঘোড়ার ওপর দুজন জখম অনুচরকে চাপানো হল।

যখন আস্তানায় গিয়ে পৌঁছাল, তখন অন্ধকার কিছুটা তরল হতে শুরু হয়েছে। ভোর হবার আর বাকি নেই।

মাসি কুটিরের দরজায় অপেক্ষা করছিল।

তারার অবস্থা দেখেই আঁতকে উঠল।

এ কী রে, মেয়ের শরীর যে রক্তে ভেসে গেছে। এ সর্বনাশ কী করে হল?

কালু হাসল, নিজের রক্ত নয়, মাসি, দুশমনের রক্ত। প্রথম রাতেই মা একটা সাহেব খতম করেছে বল্লমের ঘায়ে। তুমি কাপড়চোপড় ছাড়িয়ে অন্য কাপড় পরিয়ে দাও। শরীর সাফ করে দাও। খুব ক্লান্ত। এখন ঘুমানো দরকার।

তারাকে কালু খুব সাবধানে নামিয়ে মাসির কাছে দিল।

কতক্ষণ তারার খেয়াল নেই। ঘুম যখন ভাঙল, তখন সর্বাঙ্গে ব্যথা, দেহে ভীষণ উত্তাপ।

উঃ মা গো! তারা চিৎকার করে উঠল।

মাসি পাশেই বসে ছিল। তারার কপালে, গালে হাত দিয়ে উত্তাপ পরীক্ষা করেই চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাইরে প্রহরারত অনুচরকে ডেকে ফিসফিস করে কী বলল।

তারপর আবার যখন তারা চোখ মেলল দেখল, পাশে কালু সর্দার আর একজন মোটা বেঁটে লোক দাঁড়িয়ে। তাদের কথাবার্তাও তারার কানে এল।

কোবরেজমশাই, ভয়ের কিছু নেই তো?

না, না, ভয়ের কিছু নেই। আমি যে পাঁচনটা দিয়ে গেলাম ওটা খাইয়ে দিয়ো। আর এই শিশির তেলটা সর্বাঙ্গে মালিশ করতে হবে। তাজা খুন, তাও আবার মানুষের, চোখের সামনে দেখলে কত জোয়ানও ভিরমি যায়, এ তো বাচ্চা মেয়ে। কীরকম থাকে, পরশু নাগাদ আমাকে একবার খবর দিয়ো।

কালু ঘাড় নাড়তে, কবিরাজ বেরিয়ে গেল।

কালু বসে বসে তারার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। দিন চারেক পরই তারা উঠে বসল।

উঠেই দেখল তার মাথার কাছে দেয়ালে বন্দুকটা ঝুলছে। বন্দুকের বাঁটে সিঁদুর মাখানো। তার মানে বাশুলিদেবীর কাছে বন্দুকটা উৎসর্গ করা হয়েছিল। ম্লেচ্ছের বন্দুক ব্যবহার করতে যাতে অসুবিধা না হয়। পাপ না স্পর্শ করে।

আরও দিন তিন-চারের মধ্যেই তারার শরীর ঠিক হয়ে গেল।

কালু রোজই তাকে দেখতে আসত। তারা সেরে উঠতেই বলল, কাল একটা উৎসব আছে। কদিন আগেই উৎসবটা হত, কিন্তু তুমি অসুস্থ বলে দিন পিছিয়ে দিয়েছিলাম।

কীসের উৎসব?

এখন বলব না। কাল টের পাবে। কাল ভোরে উঠে স্নান সেরে নিয়ো, আমার লোক এসে তোমায় নিয়ে যাবে।

তা-ই হল। প্রায় রাত থাকতে উঠে তারা স্নান সেরে নিল। বেশ শীত পড়েছে। ভোরের দিকে কাঁপিয়ে দেয়।

তারার সঙ্গে মাসিও স্নান করল। নতুন চওড়া লালপাড় কাপড় পরে দুজনে রওনা হল। তারা ভেবেছিল মন্দিরে যেতে হবে। সেখানে কোনও পূজার ব্যাপার আছে।

কিন্তু মাসি সেদিকে গেল না। পায়ে-চলা আঁকাবাঁকা পথ ধরে দুজনে জঙ্গলের বাইরে চলে এল।

ফাঁকা এবড়োখেবড়ো মাঠ। কাশ আর ঘেঁটু ফুলে বোঝাই। চারপাশে আসশেওড়া আর ঘোড়ানিমের গাছ। একেবারে এককোণে বাঁশের খুঁটির ওপর একটা গোলপাতার ছাউনি। দেখলেই বোঝা যায় ছাউনিটা সদ্য তৈরি হয়েছে।

ছাউনির তলায় কারা ঘোরাফেরা করছে। আধো অন্ধকারে তারা ঠিক বুঝতে পারল না।

একটু এগোতেই কালু সামনে এসে দাঁড়াল।

এসো, এসো মা এসো।

তারা জিজ্ঞাসা করল, এখানে কীসের উৎসব? এই মাঠের মাঝখানে?

কালু হাসল, আসল উৎসব মা। একটু পরেই দেখতে পাবে।

রোদ উঠতেই তারা অবাক হয়ে গেল। ঝোপঝাড়ের অন্তরাল থেকে পিলপিল করে লোক এসে মাঠের ওপর বসল। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে। সকলেরই শীর্ণ, পাঁজরাসম্বল চেহারা।

কালু পিছনদিকে আঙুল দিয়ে দেখাল।

তারা দেখল, পর পর তিনটে গোরুর গাড়ি আসছে। তার ভিতরে মাটির হাঁড়ি, কলসি আর পোঁটলা।

এরা সব আশপাশের গাঁয়ের লোক, খেতে না পেয়ে কীরকম চেহারা হয়েছে দেখো। জমিদারের খাজনা দিতে দিতে পাঁজরা কখানা ছাড়া এদের সব গেছে। নিজেরা চাষি, অথচ ঘরে এক কণা চাল নেই। কয়েকজন পেটের দায়ে হালের গোরু পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে।

শেষদিকে কালুর কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে উঠল।

জমিদাররা এভাবে খাজনা চায় কেন? তারা জিজ্ঞাসা করল।

জমিদাররা বলে কোম্পানি খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিক সময়ে তাদের খাজনা কোম্পানির ঘরে জমা না দিলে, জমিদারি নিলামে উঠিয়ে দেবে। ফলে, এ বেচারিদের মুখে রক্ত উঠছে।

তারা চুপ করে শুনল। সে-ও জমিদারের মেয়ে। অন্তত একসময়ে ছিল। কীভাবে খাজনা আদায় হত, প্রজাদের দেহ নিংড়ে কি না, সেটা তার জানা নেই। কোনওদিন জানার সুযোগ হয়নি। সে বেশির ভাগ সময় মন্দিরেই পড়ে থাকত। পূজা-অর্চনা নিয়ে।

ইতিমধ্যে লোকগুলো সার দিয়ে বসেছে। কালুর অনুচরেরা সকলের সামনে শালপাতা পেতে দিল।

এবার কালু তারাকে ডাকল, এসো মা, এবার তোমার কাজ শুরু।

কালুর পিছন পিছন তারা এগিয়ে গেল।

গোরুর গাড়ি থেকে হাঁড়ি-বালতি সব নামানো হয়েছে। ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি।

কালু বলল, হাতায় করে ভাত নিয়ে সকলের পাতে দাও। অবশ্য সকলের পাতে দিতে পারবে না, যতগুলো পারো দাও, তারপর আমার লোকেরা দেবে।

তারা আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিল। চুলগুলো পিঠের ওপর খোলা অবস্থায় ছিল, হাত দিয়ে এলোখোঁপা করে নিল। তারপর হাতায় ভাত নিয়ে পরিবেশন আরম্ভ করে দিল।

কালু তারার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চিৎকার করে বলল, আমার মা। আমাদের সকলের মা।

লোকগুলো মুখ তুলে দেখল। চওড়া লালপাড় শাড়ি পরা। কপালে সিঁদুরের টিপ। টানা টানা দুটি চোখ। ডান হাতে হাতার মধ্যে ভাতের স্তূপ।

একসঙ্গে অনেকগুলো লোক চেঁচিয়ে উঠল, জয়, অন্নপূর্ণা মায়ের জয়!

তারপরই যত লোক খেতে বসেছিল, সবাই সমস্বরে চিৎকার করল, অন্নপূর্ণা মায়ের জয়!

লজ্জায় তারা অনেকক্ষণ মুখ তুলতে পারল না।

সব লোককে পরিবেশন করা তারার পক্ষে সম্ভব হল না। তাও প্রায় একশোজনের পাতে সে ভাত দিল, তারপর ক্লান্ত হয়ে মাঠের ওপরই বসে পড়ল।

খাওয়া শেষ হতে সবাই পুকুরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এল, তারপর লাইন বেঁধে দাঁড়াল।

এবার পোঁটলাগুলো খোলা হল। ধুতি আর শাড়ি। পুরুষদের ধুতি আর মেয়েদের শাড়ি। কালু ধুতি আর শাড়ি একখানা একখানা করে তারার হাতে তুলে দিল। তারা বিলি করতে লাগল।

আবার জঙ্গল কাঁপিয়ে তারার জয়ধ্বনি উঠল।

সব শেষ হতে বেলা গড়িয়ে পড়ল। তারা ফিরল গোরুর গাড়িতে। শুধু তারা নয়, দলের সবাই অভুক্ত।

মন্দিরের চাতালে বাশুলিকে প্রণাম করে সবাই খেতে বসল।

রাত্রিবেলা মাসি তারাকে বলল, এইরকম বছরে চার-পাঁচবার কালু লোকজনদের খাওয়ায়, কাপড় বিলোয়। যে ডাকাতিতে তুমি সাহেবকে খতম করলে, সেটাতে বিশ হাজার টাকা লুঠ করে পেয়েছিল। এত টাকা কালু অনেকদিন পায়নি। এই রকমের বড়ো কিছু পাবার পরই কালু উৎসব করে।

চুপ করে বসে তারা শুনল।

চিরকাল তারা জানত, ডাকাতরা নির্মম, মানুষ খুন করে, আচমকা পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের টাকাপয়সা লুঠপাট করে নেয়। কিন্তু ডাকাতরা যে এভাবে গরিবদের উপকার করে, বিপদে সাহায্য করে, সেটা তার জানা ছিল না।

কালুর কাছ থেকে তারা অনেক কিছু শুনল।

এই যে সেদিন কোম্পানির টাকাটা লুঠ করলাম, দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে কালু একদিন বলল। তারা পাথরের ওপর ছোরার ফলা শান দিচ্ছিল।

মানভূম থেকে টাকাটা আসছিল বর্ধমানের খাজাঞ্চিখানায়। প্রজাদের রক্তশোষা টাকা। আজ তিন বছর অজন্মা চলেছে মানভূমে। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই, এক ছটাক শস্য হয়নি। ঘরে ঘরে কান্নাগোল উঠেছে। লোকে পেটের ছেলে-মেয়ে বিক্রি করছে সেখানে। গাছের শেকড় খেয়ে ভেদবমি হয়ে মারা যাচ্ছে। গাঁ-কে গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। খাজনা মকুব করার জন্য লাটের দরবারে দরখাস্ত পর্যন্ত পাঠিয়েছিল।

কী হল সে দরখাস্ত? তারা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

সে দরখাস্ত লাট অবধি পৌঁছায়নি। আমলারাই ছিঁড়ে ফেলেছে। লোকের বসতবাটী, চাষের জমি সব নিলামে উঠিয়ে লোকেদের ভিখারি করে খাজনা আদায় করা চলল। সে দরখাস্ত যেমন লাট অবধি পৌঁছায়নি, সে খাজনার টাকাও তেমনি বর্ধমান অবধি আসেনি। কালু সর্দারের খপ্পরে পড়ে গেল।

কথা শেষ করে কালু বিকট গলায় হেসে উঠল।

সেই হাসির শব্দে তারা চমকে উঠেই নিজেকে সামলে নিল।

সাহেবের পিঠে বল্লম ফোঁড়ার দৃশ্যটা আবার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল।

কালুকে বলল, আচ্ছা যে সাহেবটাকে খতম করলাম সে কে?

কোম্পানির কর্মচারী। নামটাম জানি না। চলো, কাল রাতে আবার বের হতে হবে।

কাল আবার কোথায়?

আজ সকালে চর সন্ধান এনেছে মুকুন্দপুরের জমিদার কাশী যাচ্ছে। সঙ্গে লোকলশকর যেমন আছে, তেমনি কাঁচা টাকাও নিয়ে যাচ্ছে। বাপের নামে বুঝি মন্দির করবে। এই জঙ্গলের পাশ দিয়েই যাবে। আমাদের তৈরি থাকতে হবে।

মেঘা লাঠি হাতে দরজার বাইরে বসে ছিল। সে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, হ্যাঁ সর্দার, রাত্তিরবেলা জমিদার পথ চলবে তো? কোনও চটিতে হয়তো রাত কাটাবে।

না, কালু মাথা নাড়ল, খবর এসেছে চটিতে থামবে না, দেরি হয়ে যাবে। দু-একটা বড়ো বড়ো শহরে রাত কাটাবে। তিন মাসের মধ্যে কাশী পৌঁছাতেই হবে। মন্দির স্থাপনের ভালো দিন আছে। তা ছাড়া, সঙ্গে অঢেল লোকলশকর রয়েছে বলে সাহসও হয়েছে। দেখা যাক। আজ উঠি মা।

কালু উঠে দাঁড়াল।

আশ্চর্য, তারার প্রথমটা একটু ভয় করছিল। সেরাতের মতন আবার হইহল্লা, চিৎকার, আর্তনাদ। মৃত্যুর হোলিখেলা। কিন্তু একটু পরেই কেমন উত্তেজনা বোধ করল। এই তো জীবন। চুপচাপ ঘরের কোণে বসে থাকার কোনও মানে হয়? দেহে- মনে যেন শ্যাওলা পড়ে যায়।

এ অন্যায় নয়। একটু আগেই কালুর কথায় তারা বুঝতে পেরেছে লোকদের বঞ্চিত করে যে টাকা সংগৃহীত হয়, সেটা ছিনিয়ে নিলে পাপ হয় না।

উপাস্য দেবী বাশুলির হাতে খর্পর। অত্যাচারীকে, শোষককে হত্যা করলে অন্যায় হয় না।

পরের দিন সন্ধ্যায় সকলে মাঠে জড়ো হল। এবারের অভিযানে লোক অনেক কম। এবারে বল নয়, কৌশল। সমস্ত ব্যাপারটা কালু সকলকে বুঝিয়ে দিল।

রাত খুব অন্ধকার নয়। ফিকে জ্যোৎস্নার একটা আস্তরণ সারা জঙ্গলের ওপর। এক-একজন এক-একটা গাছের নীচে আত্মগোপন করে রইল।

প্রায় মধ্যরাতে মশালের আলো দেখা গেল। সামনে-পিছনে অনেক লোক। মাঝখানে সুদৃশ্য পালকি।

কোনও চিৎকার নেই। সবাই নিঃশব্দে এই সর্বনেশে জায়গাটা পার হবার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ করছে।

হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে একটা আর্তস্বর। তারপর একটানা গোঙানি।

সামনের লোকগুলো থেমে গেল। মশাল নিচু করে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে নজরে পড়ে গেল।

পথের একপাশে একটা লোক শুয়ে কাতরাচ্ছে। গায়ে নামাবলি, বুকে পইতার গোছা। চোখে-মুখে কালশিটের দাগ।

কীহয়েছে?

লোকটা গোঙাতে গোঙাতে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবারা। আমার যথাসর্বস্ব ডাকাতরা লুটে নিয়েছে। পায়ে লাঠির চোট মেরেছে, উঠে দাঁড়াবার উপায় নেই।

ঠাকুরমশাই, কতক্ষণ আগে?

মিনিট পনেরো হবে। ওই ঝোপের মধ্যে পালিয়েছে। আমার সর্বস্ব নিয়ে গেছে। পথের ভিখারি করে দিয়েছে আমাকে।

লোকটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

গোটা তিনেক লশকর লোকটাকে সাবধানে তুলে পালকির মধ্যে নিয়ে গেল আর বেশির ভাগ বল্লম, সড়কি উঁচিয়ে ঝোপটা ঘিরে ফেলল।

পালকির মধ্যে জমিদার বসে ছিল। কোলের ওপর টাকার থলি।

বেশির ভাগ লোক ঝোপের মধ্যে ঢুকতেই পলকে এক কাণ্ড হয়ে গেল। আহত লোকটা চোখের নিমেষে টাকার থলিটা তুলে নিয়ে পাশের অশ্বারোহীকে সবেগে পদাঘাত করল। তারপর সে মাটিতে পড়ে যেতেই একলাফে ঘোড়ার ওপর চড়ে বসে বিদ্যুদবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।

সমস্ত ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে দলের লোকেরা কিছুক্ষণের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

কিন্তু একটু পরেই গুড়ুম গুড়ুম করে বন্দুকের শব্দ। পালকির ভিতর থেকে জমিদার বন্দুক ছুড়েছে।

কাজ শেষ। ডাকাতের দল পিছিয়ে গিয়ে ঘন জঙ্গলে মিশিয়ে গেল। পরিকল্পনা ঠিক এইরকমই ছিল। কালু সর্দার আহত ব্রাহ্মণ সেজে কৌশলের আশ্রয় নেবে।

আস্তানার কাছে গিয়ে সবাই দেখল ঘোড়াটা একটা সুপুরি গাছের সঙ্গে বাঁধা। কালু ধারেকাছে কোথাও নেই।

একটু এগোতেই নিধের সঙ্গে দেখা হল। কালুর তদারক করে এই নিধিরাম।

সে বলল, সর্দার চোট খেয়েছে। বন্দুকের গুলির চোট।

সে কী?

সবাই চমকে উঠল।

কই, সর্দার কোথায়?

শুয়ে আছে ঘরে। আমি কোবরেজমশাইকে একবার খবর দিয়ে আসি।

একটা গাছের নীচে দুটো বড়ো বড়ো বাঁশ শোয়ানো ছিল। নিধি সে দুটো তুলে নিল। বাঁশ নয়, রনপা। তার ওপর উঠে নিধি তিরবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সবাই ছুটল কালুর কুঁড়ের দিকে।

বিছানার ওপর কালু শুয়ে রয়েছে। সারাটা রাস্তায়, ঘরের মেঝের ওপর ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। বিছানাতেও রক্তের ছোপ।

কী হল সর্দার?

একজন কালুর দিকে ঝুঁকে পড়ল।

কালু চোখ খুলল। সারা মুখ আরক্ত। যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টায় গালের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে।

জমিদারব্যাটার হাতের টিপ দারুণ। অন্ধকারেও ঠিক পিঠে একটা গুলি বিঁধিয়েছে।

বোঝা গেল এই ক-টা কথা বলতেই কালুর বেশ কষ্ট হল।

মাথার কাছে মাসি বসে ছিল। তারা পায়ের কাছে গিয়ে বসল।

কালু তারার দিকে একবার চোখ ফিরিয়ে দেখে ম্লান হাসল।

কবিরাজ এল প্রায় এক ঘণ্টা পরে। ঘোড়ায় চড়েই এসেছে।

কালুকে উপুড় করে ফেলে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। পিঠের কাছে বেশ বড়ো একটা গর্ত। গর্তের চারপাশে বারুদের কালো দাগ।

হামানদিস্তাতে একটা ওষুধ বেটে পিঠে লাগিয়ে দেওয়া হল।

কবিরাজ বের হয়ে যাবার সময় তারা গিয়ে দাঁড়াল।

কেমন দেখলেন?

সবই বাশুলি-মায়ের ইচ্ছা। আমাদের শক্তি আর কতটুকু।

কবিরাজ আর দাঁড়াল না। ঘোড়ার ওপর গিয়ে উঠল।

তারা ধীরপায়ে কালুর বিছানার কাছে ফিরে এল।

কালু চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

একটু পরেই কালু কথা বলল, তারা-মা।

বলো।

লুটের টাকাটা মাসির কাছে রয়েছে। তুমি থলিটা নাও। রঘু, মেঘাকে বলো উৎসবের আয়োজন করতে। গাঁয়ে গাঁয়ে খবর দিতে। শীত আসছে, সবাইকে একখানা করে যেন গরম গায়ের কাপড় দেওয়া হয়।

তারা বলল, তাড়ার কী আছে। তুমি সেরে ওঠো, তখন ব্যবস্থা করা যাবে।

কালু ম্লান হাসল, আমি আর সেরে উঠব না তারা-মা।

তারা চমকে উঠল, সে কী অলক্ষুনে কথা! কী এমন হয়েছে, তুমি সেরে উঠবে না?

ঘা বিষিয়ে উঠেছে। বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আমি জানি এবার আমার নিস্তার নেই। বাশুলি-মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে সেই কথা বলে গেছেন।

তারা এগিয়ে এসে কালুর শিয়রে বসল। একটা হাত তার মাথার চুলের ওপর রাখল। নরম গলায় বলল, তুমি ঘুমোবার চেষ্টা করো তো। এসব কথা তোমায় ভাবতে হবে না।

কালু আর কথা বলল না। চোখ দুটো বন্ধ করল।

সেইরাত থেকেই কিন্তু জ্বরে কালুর গা যেন পুড়ে যেতে লাগল। কেমন আচ্ছন্ন ভাব। বার বার ডাকলে কোনওরকমে একবার ক্ষীণকণ্ঠে সাড়া দেয়।

রাত বাড়তে তারা কবিরাজকে খবর দিল। মেঘাকে পাঠিয়ে।

ঘুম থেকে কবিরাজকে উঠিয়ে আনতে বেশ সময় নিল। তারা ছটফট করতে লাগল।

কালুকে পরীক্ষা করে কবিরাজের মুখ রীতিমতো গম্ভীর হয়ে উঠল। এককোণে এগিয়ে এসে বলল, আমি বাপু কালুর অবস্থাটা ভালো বুঝছি না। ওষুধ তো কোনও কাজ করছে না। আর এইরকম জ্বরের তাপ, মনে হচ্ছে শরীরের মধ্যে বিষ কাজ করতে আরম্ভ করেছে।

তাহলে?

দুটো হাত জড়ো করে কবিরাজ কপালে ঠেকাল। সবই বাশুলি-মায়ের ইচ্ছা।

.