উপন্যাস
গল্প

অরণ্য-বিভীষিকা – ৪

চার

দিন তিন-চার পরে আবার কালু এসে তারার দরজায় দাঁড়াল।

মা।

জানলায় মাথা রেখে তারা চুপচাপ বসে ছিল। তার ধারণা ছিল এ অঞ্চলে কেবল বুঝি পুরুষের দলই আছে। মেয়ে সে একলাই। কিন্তু আগের দিন আধবুড়ি একজন তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

বলেছে, আমাকে কালু তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলে।

তার কথায় তারা একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এখানে কেউ অমনভাবে নাম ধরে ডাকে না। সবাই বলে সর্দার।

আমার কাছে?

হ্যাঁ, আমি তোমার কাছে থাকব। দেখাশোনা করব।

তারার ভালো লেগেছে। তবু কথা বলবার একজন লোক পাওয়া গেল। এভাবে দিনের পর দিন মুখ বুজে থাকতে পারছিল না।

বুড়ির নাম সুখদা। সে এসেই তারার খুব যত্ন করতে আরম্ভ করেছে। চুলের জট ছাড়িয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছে। গায়ে খড়ি উঠছিল, ভালো করে তেল মাখিয়ে দিয়েছে। বসে বসে অনেক গল্প করেছে।

সেই সময় বলেছে। সুখদা কালুর মাসি। কালুর যখন মা মারা যায় তখন কালুর বয়স বছর চারেক। ভালো করে কিছু বুঝতেই পারেনি। বাপ যখন গেল, তখন কালু দশ বছরের। অনেক টাকা খাজনা বাকি ছিল, জমিদারের পাইক এসে মড়া আটকাল।

যত জিনিসপত্র টেনে টেনে বের করে উঠানে ফেলে দিল। যেসব লোক দাহ করার জন্য এসে জড়ো হয়েছিল, তাদের গালাগালি দিয়ে সরিয়ে দিল। কালু চুপচাপ দাওয়ার ওপর বসে দেখছিল। তারপর যখন একজন পাইক পা দিয়ে তার বাবার দেহটা নাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ব্যাটা সত্যি মরেছে তো, না খাজনার ভয়ে মটকা মেরে পড়ে আছে, তখন সে আর চুপ করে থাকতে পারেনি।

ঘরের কোণ থেকে লাঠি তুলে নিয়ে পাইকদের এলোপাথাড়ি মারতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু যমদূতের মতন পাইকদের সঙ্গে ওইটুকু ছেলে আর কতক্ষণ লড়বে। আধমরা কালুকে টানতে টানতে পাইকরা জমিদারবাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থামে বেঁধে কী প্রচণ্ড মার। চোখে দেখা যায় না। চামড়া কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল।

সন্ধ্যার দিকে আমিই কোলে করে কালুকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। সারা গায়ে ব্যথা। নড়াচড়া করতে পারে না। ছেলে জ্বরে বেহুঁশ। বাড়িঘর-জমিজমা সব জমিদারের কবলে, তাই কালুকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম।

সেরে উঠেই কালু রুখে দাঁড়াল।

আমাকে বলল, দেখো মাসি, এ অত্যাচারের প্রতিশোধ আমি নেবই। জমিদারকে ঠিক অমনি করে গাছে বেঁধে আমি চাবকাব।

তারপর কালু নিখোঁজ। কোথাও তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। পনেরো বছর পরে এক অন্ধকার রাত্রে কালু যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সে কালু ডাকাত। তার নামে জমিদাররা থরথর করে কাঁপে।

কালু আমাকে এখানে নিয়ে এসে প্রথমেই মায়ের মন্দিরের সামনের বাজ-পড়া তাল গাছটার কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

বলেছিল, মাসি, এই গাছে পিছমোড়া করে বেঁধে রতনপুরের জমিদারকে আমি চাবুক মেরেছি। দুধ-ঘি-খাওয়া চেহারা কিনা, তাই সহ্য করতে পারল না। ঘণ্টাখানেক পরেই একেবারে খতম হয়ে গেল।

চুপ করে রইলাম। রতনপুরের জমিদারের দেহ জমিদারবাড়ির ফটকের সামনে পাওয়া গিয়েছিল, সে কথা জানি। কার কাজ তাও সবাই জানতে পেরেছিল, কারণ জমিদারের কপালে খাঁড়ার চিহ্ন আঁকা ছিল। তখন কি আর আমি জানি, সেটা আমাদের কালুর কীর্তি।

দু-গালে দুটো হাত রেখে তারা চুপচাপ বসে বসে শুনেছে। সব ব্যাপারের একটা কারণ থাকে। একটা ইতিহাস।

আজ জমিদারদের ওপর, বড়োলোকদের ওপর কালু সর্দারের এই যে ঘৃণা আর আক্রোশ তার কারণ তারা জানতে পারল, বুঝতে পারল।

কালু সর্দারের গলার স্বর কানে যেতেই তারা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

মাসি কই?

স্নান করতে গেছে।

কথা বলতে বলতেই মাসি ভিজে কাপড়ে এসে ঢুকল।

এই যে মাসি, তুমি মা-কে ভালো করে স্নান করিয়ে মন্দিরে নিয়ে এসো। দেরি কোরো না।

তারা আর থাকতে পারল না। জিজ্ঞাসা করে ফেলল, কেন? এত সকালে মন্দিরে কেন?

আজ তোমার শুদ্ধি মা। আজ তুমি আমাদের দলের মা হবে।

কথাটা তারা বুঝতে পারল না, কিন্তু জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই। কথাটা বলেই কালু চলে গেছে। খুব দ্রুতপায়ে। তাকে দেখে খুব ব্যস্ত বলে মনে হল।

মাসি তারার হাত ধরে বলল, চলো পুকুরঘাটে চলো। আমি তেল আর গামছা নিয়ে যাচ্ছি।

স্নান সেরে ফিরে এসে তারা দেখল একটা থালার ওপর লালপাড় গরদের শাড়ি। এক কৌটা সিঁদুর।

শাড়িটা পরে কপালে সিঁদুরের টিপ এঁকে তারা তৈরি হয়ে নিল।

জনা তিন-চার লোক তারাকে সঙ্গে করে বিশালাক্ষীর মন্দিরে নিয়ে গেল। মন্দিরের সামনে গিয়েই তারা অবাক।

সামনের জমিতে ত্রিপল খাটানো হয়েছে। তার নীচে বাজনদারের দল। এপাশে-ওপাশে বহু লোক। বট গাছের তলায় একপাল ছাগল বাঁধা।

তারা যেতেই কালু এগিয়ে এল।

এসো মা, আমরা সবাই তোমার অপেক্ষা করছি। ছ-টায় লগ্ন। তার আগে আমাদের পূজায় বসতে হবে।

তারা ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারল না, কিন্তু প্রতিবাদ করল না। বুঝতে পারল প্রতিবাদ করে লাভ নেই। তা ছাড়া সবাই এখন এত ব্যস্ত যে তার প্রশ্নের উত্তর দেবার সময়ও কারো নেই।

মূর্তির সামনে তারাকে বসানো হল। একপাশে কালু, আর-একপাশে পুরোহিত। অনেকক্ষণ ধরে মন্ত্র পড়া হল। ফাঁকে ফাঁকে বাজনার শব্দ।

পূজা শেষ হতে পুরোহিতকে তারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। পুরোহিত তারার কপালে সিঁদুরের রেখা টেনে দিল।

বাইরে সকলে চিৎকার করে উঠল, তারা মায়িকি জয়।

তারাকে নিয়ে কালু মন্দিরের বাইরে এল। চাতালে একটি লোক অপেক্ষা করছিল, তার কাছে এসে কালু বলল, এইখানে একটু বোসো মা। তোমার ডান হাতটা বাড়িয়ে দাও।

তারা নিজের ডান হাত প্রসারিত করে দিল।

লোকটা নিপুণ হাতে তারার কবজির একটু ওপরে সুচ ফুটিয়ে একটা খাঁড়া এঁকে দিল। এবার তারার মনে পড়ল, ঠিক এইরকম উলকি সে কালু থেকে শুরু করে তার অনুচরদের হাতেও দেখেছে। এমনকী কালুর মাসির হাতেও।

উলকির কাজ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রচণ্ড বেগে বাজনা বেজে উঠল। রামশিঙা, ঢাক-ঢোল-কাঁসি।

কালু বলল, মা, এবার থেকে তুমিও আমাদের দলের লোক হলে। আমাদের এক জীবন, এক উদ্দেশ্য।

তারা বিস্ফারিত দুটো চোখের দৃষ্টি কালুর ওপর ন্যস্ত করে বলল, তার মানে, আজ থেকে আমিও ডাকাত হলাম! মানুষ খুনজখম করা আমারও পেশা হল?

কিছুক্ষণ কালু চুপ করে রইল। বোধহয় কী বলবে মনে মনে তা-ই ভেবে ঠিক করতে লাগল। তারপর বলল, অপ্রয়োজনে মানুষকে খুনজখম আমরা করি না মা। প্রজাদের রক্ত শুষে জমিদার যে সম্পদ গড়ে তোলে, আমরা তার সেই সম্পদ অপহরণ করি। কোম্পানি দেশের লোকের বুক নিংড়ে কর আদায় করে নিজেদের ভোগবিলাসিতার জন্য খরচ করে, নিজেদের দেশে চালান দেয়, সেই অর্থ লুটে নিয়ে আসি। আমাদের এই অন্যায় কাজে যারা বাধা দেয়, তাদের শাস্তিবিধান করতে হয়। তারা মরে, আহত হয়। আমরা মায়ের সেবক। এই অর্থ মায়ের পূজায় ব্যয় করি। দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করি। তুমি লক্ষ করে থাকবে, আমরা বিলাসিতার জীবন যাপন করি না।

চুপ করে তারা শুনল। কোনও উত্তর দিল না। সব কথাগুলো যে বুঝতে পারল এমন নয়। হাতে উলকি পরার সঙ্গে তার সারা শরীরে একটা আতঙ্কের শিহরন বয়ে গেল। ভালো-মন্দবোধও যেন লোপ পেয়ে গেল।

এবার এদিকে এসো মা।

মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে কালু নেমে এল। পিছন পিছন তারা।

মাঠের মাঝখানে যমদূতের মতন একটি লোক দাঁড়িয়ে। ঝাঁকড়া চুলে লাল কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা। করমচার মতন লাল দুটি চোখ। পরনে খাটো লাল রঙের কাপড়। হাতে তেল-চুকচুকে মোটা বাঁশের লাঠি।

এই নিশি ওস্তাদ। তোমাকে লাঠি আর ছোরা খেলা শেখানোর ভার এর ওপর।

এইবার তারা চমকে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা?

হ্যাঁ, মা। তুমি আজ থেকে আমাদের একজন হলে, তাই সবই তোমাকে শিখতে হবে। তির-ধনুক আর বন্দুক ছোড়া আমি নিজে তোমায় একসময়ে শিখিয়ে দেব।

এবার নিশি কথা বলল। যেমন চেহারা, তেমনই কণ্ঠস্বর।

বাজখাঁই আওয়াজে বলল, এসো লাঠিখেলা দিয়েই শুরু করি।

কালু একটু দূরে একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে বসল। একটা অনুচর লাঠির গোছা এনে তারার সামনে ফেলে দিল।

নিশি তার মধ্য থেকে বেছে বেছে ছোটো মজবুত একটা লাঠি তুলে নিয়ে তারার হাতে দিল।

তারপর শুরু হল লাঠিখেলা শেখানোর আদিপর্ব। তামেচা, বাহেরা, শির।

তারা আঁচলটা শক্ত করে কোমরে জড়িয়ে নিল। চুলের রাশ বেঁধে নিল। ওস্তাদের নির্দেশক্রমে লাঠি চালাতে লাগল।

প্রায় আধ ঘণ্টার ওপর কসরত চলল। তারার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। লাল হয়ে উঠল দুটি গাল। ক্লান্ত দুটি পা টলতে লাগল।

নিশি বলল, থাক মা, আজ এই পর্যন্ত। আবার কাল ভোরে হবে।

হাতের লাঠিটা ছুড়ে ফেলে তারা বসে পড়ল।

ঠিক পিছনেই মাসি দাঁড়িয়ে ছিল।

সে বলল, এবার চলো, বেলা হয়েছে, খাওয়াদাওয়া সেরে বিশ্রাম করবে।

মাসির সঙ্গে কুটিরে ফিরতে গিয়েই তারা অবাক হয়ে গেল।

তার যাবার পথের দু-পাশে ডাকাতরা সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দুটি হাত বুকের ওপর জোড় করা।

তারা তাদের সামনে যেতেই তারা নমস্কার করল। আস্তে আস্তে বলল, সন্তানদের আশীর্বাদ করো মা।

কুটিরে ফিরে তারা মাসিকে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে এরা দলে নিতে চায় কেন বলো তো? আমি কি পুরুষমানুষ? এদের মতন অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি কি ডাকাতি করতে পারি?

পুরুতমশাই তোমাকে দেখেই বলেছেন, তোমার দেবী অংশে জন্ম। তুমি যে দলে থাকবে, যাদের সহায় হবে, তাদের কখনো বিনাশ হবে না।

তারা এত আশ্চর্য হয়ে গেল যে অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারল না।

মাসি বলল, তা ছাড়া কালু তোমাকে স্বপ্নও দেখেছে।

আমাকে স্বপ্ন দেখেছে?

হ্যাঁ, তোমাকে ধরে নিয়ে আসার কদিন আগে বাশুলিদেবী বলেছেন, কালু, ঘটনাচক্রে যে আসবে তাকে যত্ন করবি। সে সাধারণ মানুষ নয়। সে এলে তোর দল অজেয় হয়ে উঠবে। তোর প্রতিপত্তি বাড়বে। তারপরই তুমি এলে।

তারা গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

.