তিন
জমিদারবাড়ির কাছাকাছি যখন তিনজনে এসে পৌঁছল, তখন রোদ বেশ চড়া। ফটকের সামনে নায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার কাছে দাঁড়িয়ে জমিদারবাড়ির পুরোহিত পঞ্চানন তর্কতীর্থ।
একটা ঝাঁকড়া বট গাছের নীচে বৈষ্ণব দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারাকে বলল, যাও, তুমি চলে যাও। আমরা আর এগোব না। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তুমি ফটকের মধ্যে ঢুকলে আমরা ফিরে যাব। সর্দারের তা-ই নির্দেশ।
তারা কোনও উত্তর দিল না। উত্তর দেবার মতন মনের অবস্থা তার ছিল না। সে ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।
নায়েবের কাছাকাছি যেতেই নায়েব চমকে উঠল। মানুষ ভূত দেখে যেমন চমকায়, ঠিক তেমনই। আমি এসেছি নায়েবকাকা।
নায়েব তারার কথার কোনও উত্তর দিল না। ফিসফিস করে পুরোহিতের সঙ্গে কী আলোচনা করল, তারপর তারা আর-একটু এগোতেই দুটো হাত প্রসারিত করে তাকে বাধা দিল। তারা, দাঁড়াও।
তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তোমাকে ডাকাতরা হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল, তুমি তো এ বাড়িতে আর ঢুকতে পারবে না। তোমাকে বাড়িতে স্থান দিলে আমরা সবাই সমাজে পতিত হব।
এমন কথা তারা আশাও করেনি। সব ভুলে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
তাহলে আমি কোথায় যাব নায়েবকাকা? তা ছাড়া আমাকে যে ডাকাতে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, সে কি আমার দোষ? এত পাইক-বরকন্দাজ রেখেও তো তোমরা আমাকে বাঁচাতে পারলে না।
নায়েব এসব কথার কোনও উত্তর দিল না। হয়তো এসব কথার উত্তর তার জানা নেই। একটু পিছিয়ে লোহার ফটকটা সজোরে বন্ধ করে দিল।
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে এবার তারা বেশ জোরেই কেঁদে উঠল।
তোমার পায়ে পড়ি নায়েবকাকা, আমাকে ঢুকতে দাও। নইলে পথে পথে আমি কোথায় ঘুরে বেড়াব? কে আমায় আশ্রয় দেবে? আমি বাবা আর মা-র সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
এবার পুরোহিত কথা বলল। রুক্ষ, কর্কশ কণ্ঠস্বর।
জমিদারমশাই ডাকাতদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। তোমার জাত গিয়েছে। এ বাড়িতে তোমার ঠাঁই হতে পারে না।
বাবা নেই?
তারা পথের ধুলার ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে যখন চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল দেখল সামনে কেউ নেই। লোহার কঠিন ফটকটা পথরোধ করে রয়েছে। অনেক দূরে কয়েকজন প্রজা দাঁড়িয়ে রয়েছে। জাত-হারানো মেয়ের কাছে আসার সাহস তাদের নেই।
কাপড় দিয়ে তারা ঘষে ঘষে চোখের জল মুছে ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িটার দিকে একবার চেয়ে দেখল। সব জানলা-দরজা বন্ধ। কোথাও কোনও প্রাণের চিহ্ন নেই।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
মনে মনে বিড়বিড় করে তারা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর জোরে জোরে পা ফেলে যেদিক থেকে এসেছিল, সেইদিকেই চলতে শুরু করল।
কোথায় চলেছে তা সে নিজেই জানে না। বার বার চোখের জলে সামনের পথ ঝাপসা হয়ে গেল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে চলার গতি আরও দ্রুত করল। কোনও কিছু চিন্তা করার শক্তি তার নেই, শুধু এইটুকু বুঝতে পারল, নিজের গাঁয়ে, নিজের বাড়িতে তার স্থান নেই। সম্পূর্ণ বিনা দোষে।
তারা। তারা। তারা চমকে ফিরে দেখল।
বট গাছের তলায় সেই বৈষ্ণব দুজন তখনও বসে রয়েছে। তাদের একজন তারাকে ডাকছে।
তারা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এখন কোথায় যাবে?
জানি না।
তারা মাথা হেঁট করল।
বৈষ্ণব দুজন উঠে দাঁড়াল। চলো আমাদের সঙ্গে।
কোথায়?
সর্দারের কাছে। ভ্রূ কুঁচকে তারা চেয়ে রইল।
এমন যে হবে সর্দার জানত। সেইজন্যই আমাদের অপেক্ষা করতে বলেছিল। তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।
তারা কোনও প্রতিবাদ করল না। বুঝল প্রতিবাদ করে লাভ নেই। এ গাঁয়ে কেউ তাকে আশ্রয় দেবে না। দেখাই যাক ডাকাতের সর্দার কী বলে। কী ব্যবস্থা করে তার জন্য।
জঙ্গলের মধ্যে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দেখল একটা পাকুড় গাছের নিচু ডালে একটা ঘোড়া বাঁধা। যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে তারা জঙ্গলের বাইরে এসেছিল, সেই ঘোড়া।
তার মানে, তারার ফেরার সমস্ত বন্দোবস্ত সর্দার করে রেখেছে।
ঘোড়ায় চড়তে গিয়েই কথাটা তারার মনে পড়ে গেল। সে সরে দাঁড়িয়ে বলল, না, আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না।
কেন?
তোমরা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছ। পিতৃহন্তার আশ্রয়ে আমার প্রয়োজন নেই।
ততক্ষণে বৈষ্ণব দুজন তাদের ফোঁটা তিলক মুছে ফেলেছে। পোশাক বদলেছে। ডাকাতের অনুচর বলে এবার চেনা যাচ্ছে।
একজন গম্ভীরকণ্ঠে বলল, সব কথা সর্দারের কাছে শুনতে পাবে। চলো।
তারার আর কোনও কথা বলার সাহস হল না। আস্তে আস্তে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল।
পথে একটিও কথা হল না। কথা বলার ইচ্ছাও তারার হল না। সারাক্ষণ কেবল বাপের মুখ মনের মধ্যে ভাসতে লাগল। মা-র অসহায় অবস্থা।
অনেকক্ষণ পর ক্লান্তিতে, পরিশ্রমে যখন তারার দুটো চোখ বুজে এসেছে তখন শাঁখ-ঘণ্টার আওয়াজে সে সোজা হয়ে বসল।
ঘোড়ার দু-পাশে দুজন অনুচর চলেছে।
তারা জিজ্ঞাসা করল, কী হচ্ছে?
মা-র পুজো।
একটু এগিয়ে তারাকে ঘোড়া থেকে নামানো হল।
সামনেই মন্দির। শাঁখ-ঘণ্টার শব্দ সেখান থেকেই আসছে।
মন্দিরের চাতালে গিয়ে তারা দাঁড়াল।
বিরাট বাশুলিমূর্তি। লোলরসনা। হাতে খর্পর।
সামনে রক্তাম্বর পরে কালু সর্দার পূজা করছে। দু-পাশে অনুচররা, কেউ চামর দোলাচ্ছে, কেউ শাঁখ, ঘণ্টা, কাঁসর বাজাচ্ছে।
দু-হাত জোড় করে প্রণাম করে তারা মন্দিরের চাতালে উঠতে গিয়েই বাধা পেল।
একজন অনুচর সামনে এসে দাঁড়াল।
মন্দিরে যেয়ো না।
কেন?
তুমি অস্নাত। তা ছাড়া তোমার এখন অশৌচ।
অশৌচ কথাটা কানে যেতেই তারার বুকটা আবার যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে উঠল। আঁচল দিয়ে দুটো চোখ চেপে তারা আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল।
অনুচরের নির্দেশে পুকুরে স্নান সেরে তারা ফলমূল আহার করে নিল। ছোটো একটা পর্ণকুটিরে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। শয্যায় শোয়ামাত্র তার চোখে গভীর ঘুম নেমে এল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল তারার খেয়াল নেই, হঠাৎ কানে অস্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর যেতেই সে ধড়মড় করে উঠে পড়ল।
উঠে বসতে কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট হল। আরও গম্ভীর।
মা, মা।
কুটিরের দরজায় দাঁড়িয়ে কে ডাকছে। কিন্তু তারাকে এমন সম্বোধন কে করবে?
তারা দরজার কাছে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল।
কালু সর্দার দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে রক্তাম্বর। কপালে প্রকাণ্ড সিঁদুরের টিপ। হাতে মোটা লাঠি।
তুমি আমায় ডেকেছ মা? আমি এতক্ষণ পূজায় ব্যস্ত ছিলাম।
কিছুক্ষণ তারা কোনও কথা বলতে পারল না। কালু সর্দারকে কখন ডেকেছে মনে করতে লাগল।
মনে করতে করতেই তারার মুখ-চোখ আরক্তিম হয়ে উঠল।
বলল, তোমরা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছ?
মানুষ মানুষকে মারতে পারে না তারা-মা। আমরা উপলক্ষমাত্র। নিজের অন্যায়ের জন্যই তোমার বাবা নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন। নিজের চরম বিপদ।
নিজের অন্যায়ের জন্য? তারা বিস্মিত হল।
হ্যাঁ, দেব-দেবীর সঙ্গে ছলনা করা পাপ, অন্যায়।
তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারল না।
কালু সর্দারের কণ্ঠ এবার আরও গম্ভীর।
মায়ের পূজার জন্য তোমার বাবার কাছে অর্থ আর অলংকার সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। তিনি অর্থ লুকিয়ে ফেলেছিলেন। স্বর্ণালংকার সরিয়ে সেই জায়গায় মেকি অলংকার রেখে দেবীকে বঞ্চনা করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রবঞ্চনা আর অন্যায়ের শাস্তি মৃত্যু। সেই মৃত্যুই তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছিল। যাক মা, আসল কথাটা শোনো।
কথাটা বলবার আগে কালু তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে তারার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল, তারপর বলল, তোমার কথা আমি সব শুনেছি। এমন ব্যাপার যে হবে সেটা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। হিন্দুসমাজ শুধু বাইরের কাঠামোটা আঁকড়ে ধরে আছে। ভিতরে কোনও সারবস্তু নেই। মানুষকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, অথচ তাকে বর্জন করতে একটুও দ্বিধা করে না। এ ভালোই হয়েছে মা। কালুর মা নেই। আমার একজন মায়ের প্রয়োজন ছিল। সমস্ত রাত পরিশ্রম করে এসে একজনের কাছে বিশ্রাম করার জন্য। তুমি এখানে থাকো, আমার মা হয়ে। দেখবে, বাইরের লোক তোমার ছেলের যতটা বদনাম করে, আমি ততটা খারাপ নই।
এরপর কালু এক আশ্চর্য কাণ্ড করল।
লাঠিটা পাশে রেখে তারার পায়ের কাছে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।
সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে তারা বেশ সময় নিল। এত বড়ো ডাকাত— সারাটা এলাকা যার নামে থরথরিয়ে কাঁপে, সে এভাবে তাকে প্রণাম করল! নিজের লোক বিনা অপরাধে তাকে তাড়িয়ে দিল বাড়ির দরজা থেকে, আর নিঃসম্পর্কীয় এই দস্যু এমনভাবে তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে চাইছে।
শুধু আশ্রয় দেওয়া নয়, নিজেকে নিবেদন করছে তার পায়ের তলায়।
কালু সর্দার উঠে দাঁড়াল। লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, এসো মা, আজ থেকে তুমি আমার কাছে থাকবে। মা-ব্যাটা একঠাঁই থাকব। আমি যখন তোমার ছেলে, তখন গোটা দলেরই তুমি মা। এসো আমার সঙ্গে।
কালু আগে আগে, তারা তাকে অনুসরণ করল।
অরণ্যের আরও অন্ধকারে পাশাপাশি দুটি কুটির। মাটির দেয়াল। খড়ের চাল।
সেই কুটিরের সামনে এসে কালু থামল।
এই আমার আস্তানা মা। এখন থেকে আমরা দুজনে এখানে থাকব।
কুটিরের সামনে দুজন অনুচর বর্শা হাতে পায়চারি করছিল, কালুকে দেখেই অভিবাদন করে স্থির হয়ে দাঁড়াল।
আজ থেকে মা আমার কাছে থাকবে। এদিকের এই কুটিরে তার থাকার ব্যবস্থা করে দাও।
অনুচর দুজন সেখান থেকে সরে গেল।
কালু তারাকে সঙ্গে নিয়ে এদিকের কুটিরে ঢুকল।
দেয়ালের গায়ে বিরাট একটা কালীর পট। গোটা দুয়েক জলচৌকি। একটা কাঠের আলনা। এদিকে নিচু তক্তপোশে একটা বিছানা। বিছানার ওপর বাঘের ছাল পাতা।
মা। কালু তারার দিকে ফিরে বলল।
বলো।
সকাল থেকে আমি অভুক্ত। ওই পাশে আমার খাবার রয়েছে। আসন করে দাও।
তারা আসন পেতে দিল। কোণের মাটির হাঁড়ি থেকে জল গড়িয়ে গ্লাসে রাখল। এদিক-ওদিক চোখ ফেরাতেই নজরে পড়ল কলাপাতা-ঢাকা একটা থালা।
সাবধানে থালাটা তুলে তারা আসনের সামনে রাখল।
কলাপাতা সরিয়েই দেখল ফলমূল সাজানো।
তুমি এই অবেলায় শুধু ফলমূল খাবে?
আজ রাত্রে কাজে বের হতে হবে, সেইজন্যই পুজোর এত ঘটা। যেরাতে কাজে বের হই, সেদিন ফলমূল ছাড়া কিছু খাই না।
কালু খেতে বসতেই বাইরে থেকে একটা অনুচর এসে পাখা নেড়ে বাতাস করতে লাগল।
দু-এক মুহূর্ত। তারপরই তারা তার হাত থেকে পাখাটা চেয়ে নিল।
পাখাটা আমায় দাও। আমি বাতাস করছি।
অনুচর একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে কালুর দিকে দেখল, তারপর কালু ইঙ্গিত করতে পাখাটা তারার হাতে দিয়ে আস্তে আস্তে বাইরে চলে গেল।
তারা বাতাস করতে লাগল।
একটু পরেই কালু বলল, থাক মা, আর বাতাস করার প্রয়োজন নেই। তুমি এমনিতেই আজ ক্লান্ত। যাও, পাশের কুটিরে গিয়ে বিশ্রাম করো।
তারা সত্যিই খুব পরিশ্রান্ত বোধ করছিল। পাখাটা রেখে দিয়ে পাশের কুটিরে চলে গেল।
কুটিরের মধ্যে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল।
একপাশে তক্তপোশে বিছানা পাতা। আলনায় সার সার নতুন শাড়ি আর শেমিজ। কুটিরের দেয়ালে ছোটো একটি কালীর পট। যেটা তারা নিয়ে এসেছিল।
যে অনুচরটি কুটিরের দরজায় পাহারায় ছিল সে তারাকে বলল, তুমি নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ো। আমি দরজায় রইলাম। আমার নাম দিনু। কোনও দরকার হলে আমাকে ডেকো।
তারা বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভেবেছিল শোবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসবে, কিন্তু ঘুম এল না, পরিবর্তে রাজ্যের চিন্তা এসে তাকে ঘিরে ধরল।
এ কী করছে সে? মা বলে ডেকেছে বলেই পিতৃঘাতীদের দলে মিশে গেছে! তাদের সেবা করছে, তদবির-তদারক।
পরমুহূর্তেই মনে হল, এ ছাড়া সে কী-ই বা করতে পারত? বাবা নেই। থাকলেও সমাজের বিধানের কাছে বাবা অসহায়। তারাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া তাঁর পক্ষেও সম্ভব হত না। বাবা নেই, মা-র অবস্থা তো আরও করুণ। পুরোহিত যে নির্দেশ দেবে সেটা তাকে মানতেই হবে।
জোর করে জমিদারবাড়িতে তারাকে স্থান দিলে প্রজারা খেপে উঠবে।
কাজেই তারার একমাত্র আশ্রয় এই অরণ্য। নির্ভর অরণ্যের চেয়েও ভয়ংকর এই মানুষের দল। একবার যখন এদের কবলে এসেছে তখন পালাবার পথও বন্ধ। একটু সন্দেহ হলেই এরা রেহাই দেবে না।
.
কতক্ষণ তারা ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেই, দারুণ একটা কোলাহলে তার ঘুম ভেঙে গেল।
ঠিক কুটিরের বাইরে প্রচণ্ড চিৎকার। বাশুলি মায়িকি জয়।
তারার বুকটা কেঁপে উঠল। কিছু বলা যায় না। পরিচারিকাদের কাছে শুনেছিল, কালু সর্দার কালীর কাছে নরবলি দেয়। তারাকে এত তোয়াজ করে এখানে রাখার উদ্দেশ্যই হয়তো তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে। মন্দিরের সামনে একজোড়া হাড়িকাঠ সে দেখেছে।
মা। মা।
সব কোলাহল ছাপিয়ে কালুর বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল।
তারা তক্তপোশ থেকে নামল। কুটিরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকলেই যে সে বাঁচতে পারবে এমন ভরসা কম। ওরা ঘরের মধ্যে ঢুকে টানতে টানতে ওকে বের করে নিয়ে যাবে।
দরজার কাছে গিয়েই দেখল বাইরেটা মশালের আলোয় উজ্জ্বল। একটা নয়, অনেকগুলো মশাল জ্বলছে।
সেই আলোতে তারা দেখল দেয়ালে টাঙানো কালীর পট।
পটটা খুলে বুকে চেপে নিল।
মনে পড়ে গেল, গতকাল বিপদের সময় এমনইভাবে কালীর পট বুকে চেপে ধরেছিল, কিন্তু বাঁচতে পারেনি। ডাকাতের হাতে ধরা পড়েছিল।
তা পড়ুক, তবু বিপদের সময় মায়ের সান্নিধ্য সে ছাড়তে পারবে না। যদি মৃত্যু আসে, যদি এরা তাকে টেনে নিয়ে মায়ের মন্দিরে বলি দেয়, তাহলে কালীর এই পট বুকে জড়িয়েই সে মরবে।
মা, মা। আবার কালু সর্দারের কণ্ঠ। এবার আরও উদবিগ্ন।
তারা বুঝতে পারল সে বাইরে না এলে কালুই ভিতরে ঢুকবে।
কালীর নাম জপ করতে করতে তারা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
অনেক মশালের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল তারাকে। উসকোখুসকো চুল বাতাসে উড়ছে। বিস্ফারিত দুটি চোখ। ঠোঁট দুটো থরথরিয়ে কাঁপছে। বুকে দুলছে কালীর পট।
তারা মায়িকি জয়।
প্রথমে কালুর গলা, তারপর পিছনে দাঁড়ানো সমস্ত অনুচর তার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাল।
কালু সর্দার হাঁটু মুড়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অনুচরবৃন্দ।
মায়ের কাজে বের হচ্ছি মা। তোমার আশীর্বাদের জন্য এসেছি।
তারার চাঞ্চল্যের অবসান হল। তাহলে এরা তাকে ধরতে আসেনি। কোথায় ডাকাতি করতে যাবে তাই আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এসেছে।
কোথা থেকে কী হল তারা নিজেই জানে না। নিজের ডান হাত প্রসারিত করে সে কালুর মাথার ওপর রাখল।
সঙ্গে সঙ্গে অনুচরেরা আবার জয়ধ্বনি করে উঠল।
যতক্ষণ না শেষ ডাকাত অরণ্যের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, ততক্ষণ তারা চুপচাপ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বোধহয় একটু দূরে কোথাও অনেকগুলো ঘোড়া রাখা ছিল, কারণ একটু পরেই সম্মিলিত ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল।
সব শব্দ মিলিয়ে যেতে তারা চোখ ফেরাল। দেখল বর্শা হাতে অনুচরটি পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
দিনু।
মা।
এরা কোথায় গেল ডাকাতি করতে?
তা তো জানি না মা। সর্দার, আর দু-একজন চাঁই ছাড়া কেউ জানে না।
একটু চুপ করে থেকে অনুচর আবার বলল। তোমার খাবার সময় হলে বোলো, খাবার এনে দেব।
কোনও উত্তর না দিয়ে তারা কুটিরের মধ্যে ঢুকল। একটু পরেই ছোটো একটা ছেলে এসে পিলসুজের প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
বাইরে ঘন অন্ধকার। মাঝে মাঝে জোনাকির ঝাঁক দেখা যাচ্ছে। কুটিরের মধ্যে সামান্য আলো। সেই আলোটিকে সম্বল করে তারা দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসল।
প্রত্যেক রাতে এরা এমনই ডাকাতি করতে বেরিয়ে যাবে। ডাকাতি করতে বেরোনো মানেই একজনের সর্বনাশ করা। মানুষ খুনজখম করবে, টাকাপয়সা লুঠ করবে, তারার মতন এমনই কত লোকের চরম বিপদ হবে।
এমন একটা আসন্ন সর্বনাশকে তারা কী করে নির্বিবাদে আশীর্বাদ করল? এতক্ষণ পরে তারার খেয়াল হল, তার বুকে তখনও কালীর পটটা ঝুলছে।
পটটা তারা আস্তে আস্তে খুলে ফেলল। চোখের সামনে রেখে নিরীক্ষণ করে দেখল। ভীষণদর্শনা মূর্তি নয়, দুটি চোখে যেন প্রচ্ছন্ন হাসির আভাস।
.