দুই
সর্বনাশ, চোরাকুঠুরির দরজা খোলা।
সব ভুলে রাজনারায়ণ চেঁচিয়ে উঠলেন, তারপর উন্মত্তের মতন টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।
অল্প কয়েকক্ষণ, তারপরই রাজনারায়ণ আবার ছুটে ওপরে উঠে এলেন।
উসকোখুসকো চুল, আরক্ত চোখ, সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে।
আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে ভৈরব, চোরাকুঠুরি থেকে ক্যাশবাক্স নিখোঁজ। কালু সর্দার আমার সর্বনাশ করেছে।
ভৈরব আর দাঁড়াল না। হুংকার দিয়ে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে নীচে নেমে গেল। কয়েকজন পাইক হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওপরের ঘরের চিৎকারের অর্থ তার ঠিক বুঝতে পারেনি। একটু শব্দ নেই, বাইরের কোনও মানুষ ভিতরে ঢোকেনি, অথচ কীসের এত গোলমাল? হুজুর এভাবে চিৎকার করছেন কেন?
রাজনারায়ণ ছুটে নিজের শোবার ঘরে এলেন। উদ্দেশ্য চাবি দিয়ে লোহার আলমারি খুলে দেখবেন, যাত্রার দলের মেকি গহনাগুলো ঠিক আছে কি না। উত্তেজনার মুহূর্তে তিনি ভুলে গেলেন যে চাবিবন্ধ অবস্থায় ভিতরের জিনিস চুরি যেতে পারে না। কিংবা এও হতে পারে, তিনি ভেবেছিলেন, কালু সর্দারের অসাধ্য কিছু নেই।
কিন্তু আলমারি আর খুলতে হল না, চাবি দিয়ে নিচু হতেই আর্তনাদ করে ছিটকে মেঝের ওপর পড়ে গেলেন।
মহামায়া রাজনারায়ণের পিছন পিছন চৌকাঠ পর্যন্ত এসেছিল, স্বামীকে ওভাবে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়তে দেখে উচ্চরোলে কেঁদে উঠল।
পরিচারিকারা এতক্ষণ ঘরের মধ্যে জড়ো হয়ে বসে মা কালীর নাম জপ করছিল, মহামায়ার কান্না কানে যেতে আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না।
প্রথমে বিরজা, পিছন পিছন অন্য পরিচারিকারা ছুটে এল।
ঠিক আলমারির সামনে রাজনারায়ণ উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। পিঠের মাঝখানে একটা তির। সারা পিঠ রক্তাক্ত। তিরের পিছনে সাদা একা কাগজ।
পাশে মহামায়া মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে।
সিঁড়িতে অনেকগুলো লোকের পায়ের শব্দ। কলরবও শোনা গেল।
বিরজা এগিয়ে দেখল, নায়েব ওপরে উঠছে। পিছনে কিছু পাইক।
সর্বনাশ হয়েছে নায়েবমশাই। বিরজা কেঁদে উঠল।
কী, কী হয়েছে?
নায়েব ওপরে উঠে এল।
বিরজা কিছু বলল না। আঙুল দিয়ে ঘরের মধ্যে দেখাল।
উঁকি দিয়ে দেখেই নায়েব আর্তস্বরে বলে উঠল, এ কী!
নায়েব ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পাইকরাও ঢুকছিল, কিন্তু ঘরের মধ্যে মহামায়া পড়ে আছে দেখে তারা চৌকাঠের ওপারে থমকে দাঁড়াল।
সাবধানে তিরটা রাজনারায়ণের পিঠ থেকে তুলতে তুলতে নায়েব বলল, তোমাদের একজন শিগগির গিয়ে কবিরাজমশাইকে ডেকে নিয়ে এসো। এখনই যাও, একটু দেরি কোরো না।
তিরটা তুলতেই রাজনারায়ণের পিঠের ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল অবিরাম ধারায়।
নায়েব একটা হাত রাজনারায়ণের নাকের তলায় রাখল। নিশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করার জন্য।
তার মুখে-চোখে হতাশার ভাব ফুটে উঠল। তারপরই দৃষ্টি পড়ল তিরের ডগার দিকে।
মনে হল একটা চিঠি। লাল কালিতে লেখা। চিঠির কোণের দিকে চোখ যেতেই নায়েব শিউরে উঠল। একটা রক্তাক্ত খাঁড়ার ছবি।
চিঠিটা খুলে নায়েব পড়তে আরম্ভ করল। একমনে।
খুব ছোটো চিঠি। লাইন চারেকের।
.
সবিনয় নিবেদন,
বাশুলি মায়ের পূজার জন্য সামান্য উপকরণ চাহিয়াছিলাম, আপনি আপনার আচরণে বুঝাইয়া দিয়াছেন যে মায়ের পূজায় কোনওরকম সাহায্য করিতে আপনি অসম্মত। শুধু তাহাই নহে, আপনি আমাদের ভুলাইবার জন্য আসল স্বর্ণালংকারের পরিবর্তে মেকি অলংকার আলমারিতে রাখিয়া দিয়াছেন। যদি সরলতাবশত আমরা ওই মেকি অলংকার মায়ের সম্মুখে নিবেদন করিতাম তাহা হইলে আমাদের সকলকে নরকস্থ হইতে হইত।
মায়ের রোষবহ্নি বিষমুখ তিরের আকার লইয়া আপনার প্রাণহরণ করিল। আপনার কৃতকর্মের ফল আপনি ভোগ করিলেন। আমি নিমিত্তমাত্র।
ইতি
বিনীত
মায়ের একান্ত সেবক— কালু।
.
চিঠিটা পড়া শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে রাজনারায়ণের দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠেই একেবারে নিস্পন্দ হয়ে গেল।
পরিচারিকারা কেউ মহামায়ার মুখে জলের ঝাপটা, কেউ তাকে বাতাস করতে ব্যস্ত ছিল, রাজনারায়ণের শেষ অবস্থা কেউই লক্ষ করল না। আধো অন্ধকারে দেখলেও বিপদের গভীরতা হয়তো উপলব্ধি করতে পারত না।
নায়েব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। বুঝতে পারল, আর কিছু করার নেই। রাজনারায়ণ সকল চিকিৎসার বাইরে।
দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো করে ভগ্নকণ্ঠে নায়েব বলল, তারা কোথায়? তারা?
নায়েব ভেবেছিল রাজনারায়ণের মৃতদেহের কাছে তারার থাকা দরকার। মহামায়ার যা অবস্থা। তাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই উচিত। নয়তো, এই চরম দুঃসংবাদ তার কানে গেলে তার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। চেতনা হলেও আবার মূর্ছিত হয়ে পড়বে।
বিরজা উঠে দাঁড়াল। নায়েবের দিকে ফিরে বলল, আমাদের সঙ্গে তারাদিদিমণি ওই ঘরেই তো ছিল। চুপচাপ বসে ছিল। ঘরের মধ্যেই আছে।
জমিদারের নায়েবকে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয়। অনেক ঝড়ঝাপটা তাকে নিতে হয় মাথা পেতে। নায়েব এগিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, তারা, তারা।
কোনও উত্তর নেই।
হঠাৎ ভিতরবাড়িতে ঢোকা সমীচীন হবে না। এত গোলমালে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে এমন অসম্ভব কল্পনা কেউ করবে না।
তবে কি মহামায়ার মতন তারাও ভয়ে অচেতন হয়ে পড়েছে?
নায়েব সরে এসে বিরজাকে ডাকল, বিরজা।
বিরজা মহামায়ার কাছ থেকে উঠে নায়েবের সামনে এসে দাঁড়াল।
নায়েব বলল, দেখ তো, তারাকে ডাকছি, সাড়া পাচ্ছি না। তারা কোথায় গেল?
বিরজা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
সেই সময় ভৈরবও এসে দাঁড়াল। তার এক হাতে জ্বলন্ত মশাল।
মশালের আলোয় অনেকটা জায়গা পরিষ্কার দেখা গেল।
সর্বনাশ হয়েছে নায়েবমশাই, চোরাকুঠুরিতে ক্যাশবাক্স নেই। জমিদারবাবু কোথায়, হুজুরকে এই সর্বনাশের খবরটা দিয়ে আসি।
নায়েব হাত তুলে বারণ করল। একটু দাঁড়াও ভৈরব। অনেক কথা আছে।
ক্যাশবাক্সের কথা রাজনারায়ণ ভৈরবকে বলেছিলেন। চোরাকুঠুরি সতর্কভাবে পাহারা দেওয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
বিরজা পাংশু মুখে বেরিয়ে এল। তারা তো ঘরের মধ্যে নেই।
নায়েবের দুটো পা-ই টলমল করে কাঁপতে লাগল। দুঃসংবাদের পর দুঃসংবাদ শুনে শুনে তার উন্মাদ হবার জোগাড়।
ভৈরবকে ডেকে বলল, ভৈরব, তুমি তারাদিদিমণিকে আগে খুঁজে দেখো। সে নিশ্চয় মন্দিরে গেছে।
নায়েবের অনুমান ঠিক। কিন্তু ভৈরব একটু দেরি করে ফেলল।
তারা গোলমাল শুনেই আস্তে আস্তে সকলের অলক্ষে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। দুটো হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে কালীমূর্তির সামনে বসে ছিল। তারপর কোলাহল একটু কমতে দেয়ালে টাঙানো কালীর একটা পট বুকের মধ্যে চেপে ধরে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।
ছোটো বাগান। বেশির ভাগই ফুলের গাছ। এই বাগানটুকু পার হতে পারলেই অন্তঃপুরে যাবার সিঁড়ি।
তারা সেইদিক লক্ষ করেই এগোচ্ছিল।
হঠাৎ গন্ধরাজের ঝোপটা ভীষণভাবে নড়ে উঠল। তারার মনে হল লোহার মতন শক্ত একটা হাত এসে তার মুখ চেপে ধরল, তারপর অবলীলাক্রমে তাকে কাঁধে ফেলে সেই দৈত্যাকার শক্তি ছুটতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ তারার চেতনা ছিল, তার মধ্যেই সে কঠিন হাতে লোকটার চুলের গোছা চেপে ধরেছিল, তারপর একটু একটু করে চেতনা বিলুপ্ত হতে, তার মুঠি আলগা হয়ে এল।
খুব অস্পষ্ট ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল। গালে একটা মানুষের উত্তপ্ত নিশ্বাস, মাঝে মাঝে ঘামের ধারাও ঝরে পড়ল।
তারপর তারার আর কিছু মনে নেই।
যখন তারার জ্ঞান হল তখন ভোর হয়ে আসছে।
সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, দেহে রীতিমতো উত্তাপ। তারা চোখ মেলেই চমকে উঠল।
অজগর বন। চার কোণে চারটে মশাল পোঁতা। দু-একটা পাখির কাকলির জন্য বোঝা যাচ্ছে ভোর হয়েছে, তা না হলে অরণ্যে এখনও গভীর অন্ধকার।
মাঝখানে মাটির একটা বেদি। তার ওপর দীর্ঘ সবল একটি লোক বসে। তার দু-পাশে বর্শাধারী দুজন শরীররক্ষী। ইতস্তত আরও অনেকে জটলা করছে।
ঘাসের শয্যা। তার ওপর মাদুর পাতা। খড়ের বালিশ।
তারা উঠে বসল। কালীর পট তখনও তার বুকে ঝুলছে। পটটা সে হারের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছিল।
তারা বেদির ওপর বসা লোকটার দিকে একবার দেখল, তারপর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, কে তোমরা? কেন আমাকে এখানে এভাবে ধরে এনেছ?
লোকটি তীক্ষ্নদৃষ্টিতে একবার তারার আপাদমস্তক দেখল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, আমার অনুচর তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে মা! তার জন্য আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
তারা আশ্চর্য হয়ে গেল।
এরা যে ডাকাত, এটা যে ডাকাতের আস্তানা সেটা বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ডাকাতের কাছ থেকে এমন কোমল কণ্ঠস্বর সে প্রত্যাশা করেনি।
আমি বাড়ি যাব। তারা উঠে দাঁড়াল।
সঙ্গে সঙ্গে সামনের লোকটিও দাঁড়িয়ে উঠল। বলল, মা, তোমার শরীর এখনও ক্লান্ত। এতটা পথ ঘোড়ার পিঠে যাওয়াও তোমার পক্ষে কষ্টকর। তুমি বিশ্রাম করো। কিছু আহার করো। আমি কালু সর্দার, আমি কথা দিচ্ছি, তুমি যেখানে বলবে, আমি নিজে তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেব।
এই কালু সর্দার? সারা বাংলার ত্রাস? যার নামে কোম্পানি পর্যন্ত বিচলিত হয়?
তারার বয়স দশ বছর কিন্তু বয়সের অনুপাতে তার বুদ্ধি অনেক প্রখর। সে বুঝতে পারল, যেমন করেই হোক এদের এলাকা থেকে সরে না গেলে নিস্তার নেই।
তাই সে বলল, তোমাদের এখানে কিছু খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। চুরির জিনিস স্পর্শ করলেও পাপ হয়। তুমি এখনই আমাকে নিয়ে চলো।
পলকের জন্য কালুর দুটি চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল, তারপরই সে সংযত করল নিজেকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল, এখানকার গাছে অজস্র ফল আছে। এ গাছ কারো সম্পত্তি নয়। তুমি নিজে ফল পেড়ে না হয় আহার করো। তাতে আশা করি তোমাকে পাপ স্পর্শ করবে না।
না, তারা মাথা নাড়ল, তারপর দৃঢ়স্বরে বলল, আমি একদণ্ড এখানে থাকব না। এখনই আমায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।
বেশ। কালু এগিয়ে এসে সজোরে হাততালি দিল।
দুজন সশস্ত্র অনুচর এসে সামনে দাঁড়াল।
কালু নিচু গলায় তাদের কী বলল, তারপর তারার দিকে চেয়ে বলল, এসো মা।
একটু দূরে একটা বট গাছের ডালে একটা ঘোড়া বাঁধা ছিল। তার কাছে এসে কালু বলল, ছোটো ঘোড়া, তোমার উঠতে কোনও অসুবিধা হবে না। আমি তোমার পাশে পাশেই রইলাম। কোনও ভয় নেই।
ভয় যে তারার একেবারে হয়নি, তা নয়, কিন্তু কালুর সামনে কোনওরকম দুর্বলতা প্রকাশ করল না।
বট গাছের নিচু ডালে পা রেখে আস্তে আস্তে ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়ল। শক্ত হাতে লাগাম ধরতেই ঘোড়াটা ঠুক ঠুক করে এগিয়ে চলল। পাশে পাশে কালু সর্দার।
তোমার সঙ্গে আমার এক জায়গায় কিন্তু খুব মিল আছে তারা। কালু সর্দার বলল।
বিস্মিত তারা প্রশ্ন করল, তুমি, আমার নাম জানলে কী করে?
কালু হাসল, বলল, তুমি-আমি দুজনেই মা কালীর ভক্ত।
তারা ভ্রূকুঞ্চিত করে কালুর দিকে চেয়ে বলল, আমি তোমার মতন নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার করি না। খুন করি না তাদের।
কালু একটু বিচলিত হল। সব ঘটনাটা মনে মনে একবার স্মরণ করার চেষ্টা করল।
কালু যখন পাতার আড়ালে আম গাছের ডালে তির নিক্ষেপ করার জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই লক্ষ করেছে, তারা ছুটে মন্দিরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। তারপর রাজনারায়ণের দেহে বিষাক্ত তির নিক্ষেপ করে অন্ধকারের সুযোগে মন্দিরের সামনে দিয়ে কালু যখন দৌড়ে পালাচ্ছিল, তখনও লক্ষ করেছে মন্দিরের দরজা বন্ধ।
তার অনেক পরে অনুচর ফটিক তারাকে হরণ করে নিয়ে এসেছে। তার জন্য ফটিককে অবশ্য শাস্তিও পেতে হয়েছে।
চাবুকের ঘায়ে তার সর্বশরীর রক্তাক্ত হয়ে গেছে। অন্তত সাত দিন সে উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
নারী, শিশু, গাভীকে স্পর্শ করা বা আঘাত করা কালু সর্দারের নিষেধ।
তারার কথার কালু কোনও উত্তর দিল না। ঘোড়ার পাশে পাশে চলতে লাগল।
পায়ে-চলা পথ। মাঝে মাঝে গাছপালার জন্য তারাকে মাথা নিচু করতে হল। যাতে গাছের ডাল মাথায় না লেগে যায়।
একেবারে বনের প্রান্তে এসে কালু থামল। তারাকেও থামাল।
বলল, আমি আর জঙ্গলের বাইরে যাব না। তুমি চলে যাও। একটু গিয়েই একটা দোকান পাবে, সেখানে আমার লোক থাকবে। যদি আমার লোক না পৌঁছে থাকে, তুমি একটু অপেক্ষা করো। লোক দুজন পৌঁছে যাবে।
তারা খুব সাবধানে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। কালু ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরে রইল।
তারা বন থেকে বেরিয়ে চলতে আরম্ভ করল।
পরিশ্রমে আর মানসিক দুশ্চিন্তায় তারার শরীর খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে খুব ধীরপায়ে হাঁটতে লাগল।
যেখানে বন শেষ হয়েছে সেখানেই একটা মুদির দোকান। দোকানে কোনও লোক নেই, শুধু মুদি বসে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে।
তারা গিয়ে সামনের বেঞ্চে বসল।
মুদি হাতপাখা থামিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে দেখল।
জমিদারের মেয়েকে তার দেখার সুযোগ হয়নি, কারণ পালপার্বণ ছাড়া তারা কোনওদিনই প্রজাদের সামনে আসেনি। মুদি অন্তত তাকে কোনওদিন দেখেনি।
তবে তারাকে জঙ্গল থেকে এভাবে বের হতে দেখেই অবাক হল বেশি। তারা যে বড়ো ঘরের মেয়ে সেটা বুঝতে তার দেরি হল না। এত বড়ো বাড়ির মেয়ে এভাবে পথেঘাটে বের হয় না।
মুদি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে তারাই বলল, একটু জল খাব।
মুদি শশব্যস্ত হয়ে মাটির গেলাসে জল আর শালপাতায় দুটো বাতাসা দিল।
তারা বাতাসা ছুঁল না, ঢকঢক করে জল খেল।
তুমি কোথায় যাচ্ছ মা? এলেই বা কোথা থেকে?
মুদির কথার উত্তর দিতে গিয়েই তারা থেমে গেল।
গৌর হে, কৃপা করো! মৃদু খঞ্জনির শব্দ। মুখে গান।
তারা পিছন ফিরে দেখল, দুটি বৈষ্ণব এসে দাঁড়িয়েছে। নাকে তিলক, কপালে ফোঁটা, গায়ে নামাবলি। একজনের হাতে খঞ্জনি, আর-একজনের গলায় ঝোলানো মৃদঙ্গ।
কই হে, গৌরাঙ্গর সেবার জন্য কিছু দাও।
মুদি হাতপাখা রেখে উঠে পড়ল। পাশের দরমার দরজা খুলে বাইরে চলে গেল।
মুদি সরে যেতেই, একজন বৈষ্ণব তারার কাছে এসে দাঁড়াল।
মৃদুকণ্ঠে বলল, আমরা কালু সর্দারের লোক। চলো, তোমাকে জমিদারবাড়ি রেখে আসি। সর্দার তা-ই বলে দিয়েছে।
তারা একদৃষ্টে কিছুক্ষণ দুজনের দিকে চেয়ে দেখলে, তারপর উঠে দাঁড়াল।
আর-একজন বৈষ্ণব বলল, দাঁড়াও, মুদির কাছ থেকে ভিক্ষাটা নিই আগে।
কথার সঙ্গে সঙ্গেই মুদি একটা মাটির সরায় চাল, আলু আর পটোল নিয়ে এসে দাঁড়াল।
কই, এসো বাছা, এগিয়ে এসো।
একজন বৈষ্ণব থলির মধ্যে ভিক্ষার জিনিসগুলো নিল। তারপর তারার দিকে চেয়ে বলল, তুমিও তো জমিদারবাড়ির দিকে যাবে বলছিলে? চলো তাহলে।
তারা উঠে দাঁড়াল। বৈষ্ণব দুজন আগে আগে, একটু ব্যবধান রেখে তারা তাদের অনুসরণ করল।
.