উপন্যাস
গল্প

অরণ্য-বিভীষিকা – ১১

এগারো

জমিদারের আর্তস্বর শোনা যেতেই পালকির দরজা খুলে গেল। গৌরবর্ণের এক প্রৌঢ়া মুখ বের করে জমিদারের অবস্থা দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠল।

পালকি থেকে জমিদার গড়িয়ে রাস্তার ওপর পড়েছে। গৈরিক বসন রক্তাপ্লুত। মুখটা আকাশের দিকে। দুটো চোখ বিস্ফারিত। অন্তিম যন্ত্রণায় ঠোঁটের দুটি প্রান্ত কুঞ্চিত।

পলকের জন্য চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে তারা পালকির দিকে মুখ ফেরাল। ডাকাতের দলের দুজন মশাল নিয়ে পালকির কাছে দাঁড়িয়েছে। বাকি দুজন অর্থসংগ্রহে ব্যস্ত।

সেই মশালের আলোয় তারা স্পষ্ট দেখতে পেল, প্রৌঢ়াও তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। তারা একবার নিহত জমিদারের দিকে আর একবার প্রৌঢ়ার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েই চিৎকার করে উঠল। তারপর ঝোপঝাড় ভেদ করে বিদ্যুদবেগে জঙ্গলের দিকে ছুটতে শুরু করল।

মেঘা, সাধু, চৈতন, রতন সবাই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একবার ভাবল পিছনে বোধহয় পাইক-বরকন্দাজের দল আসছে, কিন্তু এদিক-ওদিক চেয়েও কাউকে দেখতে পেল না। আবার ভাবল, তারার কি কোথাও চোট লেগেছে? তা-ই বা কী করে হবে? তারাই তো জমিদারের পিঠে বর্শার ফলা গে�থে দিয়েছে। তার নিজের দেহে তো আঁচড়টি লাগেনি।

তবে?

সর্দারনি যখন সরে গেছে, তখন দলের অন্য সকলের থাকাটা সমীচীন নয়। তাই যতটুকু অর্থ সংগ্রহ করেছে ততটুকু নিয়েই সকলে ছুটতে আরম্ভ করল।

সকলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে দেখল ঘোড়া নেই। তার মানে তারা ঘোড়ায় চড়ে আগেই চলে গেছে। দলের কারো জন্য অপেক্ষা করেনি।

সব ব্যাপারটাই কেমন অস্বাভাবিক। এমন কী হল তারার যে লুঠের মাল ভালোভাবে কুড়োবার অবসর না দিয়ে এভাবে পালিয়ে এল?

দলের সকলেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। জোরপায়ে ঘাঁটির দিকে চলতে আরম্ভ করল।

বাশুলির মন্দিরে তারা নেই। তার কুঁড়েতেও খোঁজা হল, তারাকে পাওয়া গেল না।

মেঘা মাথায় হাত দিয়ে পথের ওপরই বসে পড়ল।

সর্বনাশ, তারা-মা গেল কোথায়?

.

তারা আস্তানায় ফেরেনি। আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে বাঁশবনে শুয়ে পড়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল।

মা বাশুলি, এ কী করলে মা! আমি সত্যিই মহাপাতকী হলাম। কীসে আমার প্রায়শ্চিত্ত হবে!

পালকিতে বসা ভীতা-সন্ত্রস্তা প্রৌঢ়াকে একনজরেই তারা চিনতে পেরেছিল। এত বছরের অদর্শন সত্ত্বেও। প্রৌঢ়াও যে মেয়েকে চিনতে পেরেছে সে বিষয়ে তারার কোনও সন্দেহই নেই।

আর তারার বর্শার আঘাতে যে জমিদার প্রাণ হারিয়ে পথের ওপর লুটিয়ে পড়েছিল, তাকেও চিনতে পেরেছে তারা। মায়ের সহোদর ভাই। জমিদার শশীকান্ত রায়।

মনে পড়ছে ছোটোবেলায় এই মামা কতবার এসেছেন তারাদের বাড়িতে। তারাকে কোলেপিঠে করে কত আদর করেছেন। কত রঙিন খেলনা এনেছেন তার জন্য।

সেই মামাকে তারা নিজের হাতে শেষ করে দিয়ে এল।

চরের কাছ থেকে আর-একটু বিশদভাবে খোঁজ নিলে বোধহয় এ বিপদ ঘটত না। জমিদার আসছে প্রচুর অর্থ নিয়ে এইটুকু খবর শুনেই তারা লোভে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। ছি ছি!

আঁচলে চোখ মুছে তারা উঠে দাঁড়াল। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকে নিজেই করতে হবে। এ ছাড়া আর অন্য পথ নেই।

নিজের কুটিরের সামনে এসে দেখল দলের প্রধানরা সব গোল হয়ে বসে রয়েছে।

তারাকে দেখে সকলে উঠে দাঁড়াল।

সাধু বলল, কোথায় ছিলে তারা মা? আমরা চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম।

তারা কোনও উত্তর দিল না। পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল।

পিছন পিছন আর সকলে ঢুকে পড়ল।

তারা মেঝের ওপর বসে পড়ে বলল, আমি এবার তোমাদের কাছে বিদায় নেব। আর কারো ওপর দলের ভার দাও।

সবাই অবাক। পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল।

মেঘা বলল, এ কী কথা তারা মা? কালু সর্দার আমাদের ভার তোমার ওপর দিয়ে গেছে। আমাদের ফেলে তুমি কোথায় যাবে?

আমার প্রায়শ্চিত্ত করার দরকার মেঘা। আমি ঘোরতর অন্যায় করেছি।

অন্যায়?

এ পথই হয়তো অন্যায়ের পথ। লোভ আর উত্তেজনার জন্য এতদিন এ কথাটা ভাবিনি। মানুষ মেরেছি নির্বিবাদে। লোকের জীবন আর টাকাপয়সা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি কিন্তু আজ নিজের মামাকে বর্শাবিদ্ধ করে বুঝতে পেরেছি, যাদের মেরেছি, যাদের কপর্দকহীন করেছি, তাদের আত্মীয়স্বজনের মনের অবস্থার কথা। নিজের মামার রক্ত আর মায়ের চোখের জল আমাকে সবকিছু নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। এ পাপের আমি প্রায়শ্চিত্ত করব।

প্রায়শ্চিত্ত? কী প্রায়শ্চিত্ত করবে?

আমি ধরা দেব।

এবার দলের সকলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।

সে কী তারা-মা, ধরা দেবে কী? আমরা বেঁচে থাকতে কার সাধ্য তোমায় স্পর্শ করে!

না, পরান, আমি অনেক ভেবেছি। বাশুলি-মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করেছি, এ ছাড়া আমার আর অন্য পথ নেই। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে সাধু।

বলো তারা-মা।

আমার একটা চিঠি নিয়ে ইংরেজের তাঁবুতে দিয়ে আসতে হবে। যদি রবার্ট সাহেবকে দিতে পারো তো ভালোই হয়।

কী লেখা থাকবে চিঠিতে?

লেখা থাকবে বাশুলি-মায়ের মন্দিরের চাতালে আমি অপেক্ষা করব। রবার্ট সাহেব এসে যেন আমাকে ধরে নিয়ে যান।

মেঘা মুচকি হাসল।

তোমার কী ধারণা সাহেবরা এ কথা বিশ্বাস করবে তারা-মা? তারা ভাববে এটা তাদের বিপদে ফেলার নতুন একটা জাল।

বিশ্বাস করা-না-করা তাদের খুশি। যদি সাহেবদের এ জঙ্গলে ঢুকতে ভয় করে, তাহলে তাদের অধীনে যত সিপাই আছে নিয়ে আসতে পারে। সিপাই, গোলাগুলি, কামান। আমাদের কোথাও কোনও লোক থাকবে না। কেউ বাধা দেবে না।

কিন্তু তোমাকে ধরার পর যদি নির্যাতন শুরু করে?

তুমি বৃথা ভয় পাচ্ছ পরান, যতই নির্যাতন করুক, আমাদের দলের সম্বন্ধে একটি কথাও জানতে পারবে না। আমি বাশুলি-মায়ের সেবিকা। আমার দ্বারা দলের কোনও অনিষ্ট হবে না।

পরান জিভ কাটল, না তারা-মা, সে কথা আমি একবারও মনে আনিনি। আমি বলছিলাম, সাহেবরা তোমায় দারুণ কষ্ট দেবে।

তারা হাসল, কষ্টই তো পেতে চাই। মানুষকে অযথা অনেক দুঃখ দিয়েছি, অনেক কষ্ট দিয়েছি।

আর কোনও কথা হল না। সারাটা রাত তারা চুপচাপ বসে রইল। তাকে ঘিরে দলের আর সবাই।

.

ভোর হতে তারা উঠে দাঁড়াল। এলোচুল। উদাস দৃষ্টি। মুখ-চোখের ভাব দেখে মনে হল যেন অনেকদিন রোগভোগের পরে সবে উঠেছে।

আমি বাশুলি-মায়ের মন্দিরে যাচ্ছি। কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। সমস্ত দিন সেখানে থাকব। বিকালে একবার জনমেজয়কে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।

জনমেজয় চিঠিপত্র সব লিখে দেয়। দলের লোকেরা বুঝতে পারল, আজ বিকালেই তারা চিঠি লেখার কাজ শেষ করবে। তারপর সেই চিঠি নিয়ে সাধুকে ইংরেজের তাঁবুতে যেতে হবে।

সত্যিই সারাটা দিন তারা মন্দিরেই রইল। নিজের হাতে মালা গেঁথে বাশুলি-মায়ের গলায় পরিয়ে দিল। ধূপধুনো জ্বেলে আরতি করল। তারপর মূর্তির পায়ের কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। মাঝে মাঝে শুধু কান্নার বেগে তার দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠল।

বিকালে মন্দিরের দরজা খুলে যখন তারা বের হয়ে এল, তখন তার চেহারা অনেক শান্ত। চোখে জল নেই। গলায় বাশুলি-মায়ের প্রসাদি মালা।

সিঁড়ির চাতালে সবাই অপেক্ষা করছিল। জনমেজয়ও। তারা সিঁড়ির চাতালে তাদের মাঝখানে এসে বসল।

জনমেজয়, লেখো।

জনমেজয় তৈরি ছিল। লিখতে শুরু করল।

পরের দিন ভোরে চিঠি নিয়ে সাধু রওনা হল বাউলের বেশে। ইতিমধ্যে এটুকু খবর সংগ্রহ করেছিল সে, রাতের ডাকাতির খবর ইংরেজদের কানে পৌঁছেছে। রবার্ট সাহেব তার সিপাই-বরকন্দাজ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। জমিদারের বোনকে মূর্ছিত অবস্থায় পেয়েছে। জমিদারের দেহ তুলে নিয়ে গেছে। একটা ব্যাপারে রবার্ট সাহেব খুব আশ্চর্য হয়েছে। টাকাপয়সা-সোনাদানা সব ডাকাতরা লুঠ করেনি। মনে হয়েছে লুঠ করতে করতে হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে পালিয়েছে। জঙ্গলের এধারে-ওধারে বেশ কিছু টাকাপয়সা ছড়ানো ছিল।

এবার রবার্ট তাঁবু পেতে বসল ঠিক এই জায়গায়। কলকাতা থেকে কড়া নির্দেশ এসেছে যেমন করে হোক এইসব ডাকাতদের দলকে উচ্ছেদ করতেই হবে। এর জন্য যত সৈন্যসামন্ত প্রয়োজন, সরকার দিতে প্রস্তুত।

লাটসাহেব বেন্টিঙ্ক আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। দেশের বুকে শান্তি আনতেই হবে।

শুধু দুর্গাপুরের জঙ্গলেই নয়, সুন্দরবনে, গঙ্গা নদীর ওপর জলদস্যুর অত্যাচার বন্ধ করার জন্য অভিযান শুরু হয়েছে। প্রলোভন দেখিয়ে ডাকাতের দলের লোককে ইংরেজ সরকার সিপাই করে নিচ্ছে। ভালো মাইনে, ভালো পোশাক, নিশ্চিন্ত জীবন।

বাউলবেশে সাধু যখন ইংরেজের তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছাল, তখন রবার্ট সাহেব বসে বসে তামাক টানছে। পাশে হুঁকোবরদার হাজির। দুজন সিপাই বিরাট আকারের তালপাখা দিয়ে বাতাস করছে।

গোপীযন্ত্রের শব্দ শুনে রবার্ট নল থেকে মুখ সরাল।

কে বাজাচ্ছে?

পাখা রেখে একজন সিপাই বাইরে থেকে দেখে এসে বলল, একজন বাউল হুজুর, গান শোনাতে চায়।

নিয়ে এসো।

সাধু সামনে এসে আভূমি নত হয়ে প্রণাম করল।

কী খবর?

একটা গান বেঁধেছি। হুজুরকে শোনাব।

রবার্ট সরিয়ে রাখা নলটা আবার মুখে তুলে বলল, শোনাও।

সাধু গোপীযন্ত্র বাজিয়ে গান শুরু করল। ইংরেজের বন্দনাগান। ইংরেজরা নবরূপী দেবতা। লোকের দুঃখ মোচন করতে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছে। শান্তি ও সম্পদের দূত।

গান শেষ করে সাধু হাত পেতে দাঁড়াল।

বকশিশ হুজুর।

রবার্ট চেয়ারে হেলান দিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বলল, সিপাই।

দু-দিক থেকে দুজন সিপাই এসে দাঁড়াল।

এই বাউলকে আটক করে চাবুক লাগাও।

এর জন্য সাধু তৈরি ছিল না। পালাবার আগেই সিপাই দুজন বাঘের মতন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর টানতে টানতে তাকে রবার্টের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

আধ ঘণ্টা পর রবার্ট যখন আহারে ব্যস্ত, তখন একজন সিপাই এসে দাঁড়াল।

হুজুর, ওই বাউলের পোশাকের ভিতর থেকে এই চিঠিটা পাওয়া গেছে।

রবার্ট হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। চিঠির ওপর তার নাম লেখা।

ফোর্ট উইলিয়ামে পণ্ডিতদের কাছে রবার্ট কিছুটা বাংলা পড়েছে। চিঠি পড়তে তার কোনও অসুবিধা হল না।

.

মান্যবর ইংরেজ বাহাদুর রবার্ট সাহেব,

আমাদের শাস্ত্রে পাপ করিলে প্রায়শ্চিত্ত করার বিধি আছে। আমি স্বজনহত্যার পাপ করিয়াছি। তজ্জন্য প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ নিজেকে আপনার হাতে অর্পণ করিতে চাই। আগামীকাল বাশুলি-মায়ের মন্দিরের চাতালে আমি একাকিনী থাকিব, আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করিবেন।

 ইতি

 বাশুলি-মায়ের সেবিকা

 তারা।

অনেকবার রবার্ট চিঠিটা পড়ল। পড়তে পড়তে তার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। খাঁজ পড়ল দুটি ভ্রূ-র মাঝখানে।

আহার ছেড়ে উঠে পড়ে বলল, সেই বাউল কোথায়?

দিঘির পাড়ে একটা তাল গাছের সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।

সিপাইয়ের সঙ্গে রবার্ট দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়াল।

সর্বাঙ্গে চাবুকের রক্তাক্ত দাগ। অর্ধ অচেতন সাধু গাছতলায় পড়ে আছে।

রবার্ট কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, এবার নিগারটাকে চাঙ্গা করে তোলো। কাল ওকে আমাদের প্রয়োজন হবে।

রবার্ট মনে মনে ঠিক বুঝতে পেরেছিল ডাকাতের দলের সর্দারনির এ একটা কায়দা। বোধহয় ভেবেছে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে রবার্ট একলাই, কিংবা জন দুয়েক সঙ্গী নিয়ে জঙ্গলে ঢুকবে, আর ডাকাতের দল সুবিধামতো তাদের ঘেরাও করে ফেলবে।

সেরাত্রেই রবার্ট ব্যাপারটা লিখে একজন বিশেষ বাহককে দিয়ে চিঠিটা কলকাতায় পাঠিয়ে দিল।

তারপর সিপাই-বরকন্দাজদের নিয়ে বৈঠকে বসল। পরামর্শ করতে।

পরের দিন বিকাল হতেই রবার্ট বরকন্দাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করল। একটা ঘোড়ার ওপর সাধুকে বসিয়ে দিল। পিছমোড়া করে বেঁধে। ঠিক তার পিছনে দুজন সিপাই। তাদের দুটো বন্দুকের নল একেবারে সাধুর পিঠে ঠেকানো। আশপাশে বন্দুক, বল্লম, বর্শা নিয়ে অসংখ্য বরকন্দাজ।

মাঝখানে কালো ঘোড়ার ওপর রবার্ট। হাতে বন্দুক।

ব্যাপার দেখে মনে হল যেন সব লড়াইয়ে চলেছে।

ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেই রবার্ট একটা টিনের চোঙা মুখে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ডাকাতরা যদি আক্রমণের কোনও চেষ্টা করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এই ডাকাতকে গুলি করে মারা হবে। খুব সাবধান।

জঙ্গলের ভিতর অনেকটা প্রবেশ করার পরও কোনওদিক থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। গাছের ডালে ঝিমিয়ে-পড়া পাখিগুলো শুধু ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে গেল।

আর-একটু এগোতেই জঙ্গল অনেক ফাঁকা হয়ে গেল। মশালের আলোয় বাশুলির মন্দিরের কাঠামোটা দেখা গেল।

রবার্ট দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সমস্ত সিপাই-বরকন্দাজ।

ওই তো মন্দির? রবার্ট সাধুকে প্রশ্ন করল।

নির্জীব সাধু কোনওরকমে ঘাড় নাড়ল।

রবার্ট কয়েক পা এগিয়ে চোখ কুঁচকে দেখল। মন্দিরের চাতালে কেউ অপেক্ষা করছে না। চাতাল ফাঁকা।

তার মানে মিথ্যা হয়রানি করিয়েছে তাকে। বলা যায় না, হয়তো কৌশল করে সব সিপাই-বরকন্দাজদের এদিকে সরিয়ে এনে ডাকাতের দল অন্যদিকে ডাকাতি করতে বেরিয়েছে।

নিজেকে রবার্টের বড়ো বোকা মনে হল। ছি ছি, একটা মেয়েছেলের ধাপ্পাবাজিতে ভুলল! ঊর্ধ্বতন সাহেবরা হাসাহাসি করবে এই নিয়ে। শ্লিম্যান তাকে অপদার্থ ভাববে।

এতটা যখন এসেছে তখন শেষ দেখে যাবে।

রবার্ট আদেশ দিল বরকন্দাজদের, মন্দির ঘিরে ফেলো।

সাধুকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে দুজন সিপাই পাহারায় রইল। বাকি সবাই ঘিরে ফেলল বাশুলির মন্দির।

রবার্ট আর-একবার সাবধান করে দিল।

গাছের ওপরেও চোখ রেখো। গাছের ডাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়াও কিছু বিচিত্র নয়।

রবার্ট দুজন সিপাইকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

সিঁড়ির দু-পাশে দুটো মশাল মাটির মধ্যে পোঁতা। সমস্ত জায়গাটা আলোয় ভরে গেছে। কোথাও ছিটেফোঁটা অন্ধকার নেই।

চাতালে কেউ নেই, রবার্ট সেটা আগেই দেখেছিল। তবু একবার এদিক-ওদিক দেখল।

তারপর একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল।

ঠিক চৌকাঠের ওপর। মাথাটা মূর্তির দিকে। এলোচুল মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। পরনে লালপাড় শাড়ি। গলায় জবা ফুলের মালা। বুকের মাঝখানে শাড়িটা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।

রবার্ট উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, একটা মশাল এদিকে নিয়ে এসো।

মশাল নিয়ে একজন রবার্টের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

নিচু হয়ে রবার্ট নিরীক্ষণ করে দেখল।

একটু দূরে রক্ত-মাখা খাঁড়া পড়ে রয়েছে। শুধু বুকে নয়, মন্দিরের দেয়ালেও রক্তের ছোপ।

রবার্ট বিস্মিত হয়ে গেল। ডাকাতরা নৃশংসভাবে মেয়েটিকে হত্যা করে রেখে গেছে আর এই নারকীয় দৃশ্য দেখবার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

রবার্ট আবার চেঁচাল, শয়তানকে নিয়ে এসো এখানে।

দুজন সিপাই দড়ি-বাঁধা অবস্থায় সাধুকে এনে দাঁড় করাল।

কর্কশকণ্ঠে রবার্ট বলল, দেখ নিগার, তোদের দলের কীর্তি। কচি একটা মেয়েকে মূর্তির সামনে বলি দিয়ে গেছে।

সাধু একবার দেখেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। আছড়ে পড়ল চৌকাঠের পাশে।

এ কে, চিনিস একে তুই?

সাধু মুখ তুলল না। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল, আমাদের মা, আমাদের তারা-মা। দলের প্রাণ, দলের শক্তি।

এই তারা। দুর্ধর্ষ একটা দলের নেত্রী। এত কম বয়স!

তাহলে তারা কথা রেখেছে। বাশুলির মন্দিরে নিজেকে অর্পণ করার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। অনায়াসেই রবার্ট তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে।

.

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। অনেক বছর। রক্তের পথ পার হয়ে, অনেক প্রাণ অর্ঘ্য দিয়ে দেশে স্বাধীনতা এসেছে।

জননেতারা দেশকে নবরূপে গড়ে তোলবার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। দুর্গম অরণ্য বুলডোজারের আঘাতে নিশ্চিহ্ন করে নানা জায়গায় জেগে উঠেছে কলকারখানা। জাতীয় শিল্পপ্রচেষ্টার বাস্তব রূপ।

দুর্গাপুরের জঙ্গলও পরিষ্কার করা শুরু হল। গাছপালা উধাও, বিল, সায়র, জলা ভরাট হল। জোনাকির আলোর বদলে নিয়নের বিদ্যুৎ-দীপ্তি।

জঙ্গল সাফ করতে করতে কুলিমজুররা দেখল, ভাঙা জরাজীর্ণ এক মন্দির। গাছপালা সমাচ্ছন্ন। বিগ্রহ নেই। মন্দিরের তিনদিকের দেয়াল ভেঙে পড়েছে। শুধু সামনের দেয়ালের কিছুটা আছে। সে দেয়ালে গাঢ় রক্তের ছোপ।

কুলিরা পিছিয়ে গেল, ভাঙতে পারব না সাহেব। ঠিকাদারের দিকে চেয়ে বলল, দেয়ালের ওই রক্তের দাগ তারা-মা-র রক্তের। বাপ-ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছি, এই সেই মন্দির যেখানে তারা-মা নিজেকে নিবেদন করে প্রায়শ্চিত্ত করেছিল।

সে মন্দিরও আর নেই। ঠিকাদাররা অন্য প্রদেশ থেকে কুলি আনিয়ে বেশি টাকা রোজ দিয়ে, সে মন্দির ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

আজ সেখানে দুর্গাপুর কারখানার বিরাট একটা ফার্নেস বসানো হয়েছে। রক্তের চেয়েও লাল আগুনের আভা তার বুকে।

.

‘রক্ত দেউল’ নামে ‘শুকতারা’ এপ্রিল ১৯৬৮ ধারাবাহিক