উপন্যাস
গল্প

অরণ্য-বিভীষিকা – ১০

দশ

মাঝরাতের একটু পরেই পতাকীর ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে দারুণ একটা হট্টগোল। চোখ চেয়ে দেখল মশালের আলোয় আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। একবার মনে ভাবল তার বরকন্দাজরা বোধহয় ডাকাতদের শায়েস্তা করে ফিরছে। তারপরই কিন্তু জয়ধ্বনির ভাষা শুনে চমকে উঠল।

তারা মায়িকি জয়! হা রে রে রে!

বিছানা থেকে উঠে বাইরে এসেই পতাকী চিৎকার করে উঠল।

দু-পাশে বর্শাধারী দুজন ডাকাত। মাঝখানে খুব কমবয়সি একটি মেয়ে। কপালে মস্ত বড়ো সিঁদুরের টিপ। এলোখোঁপা। চওড়া লালপাড় শাড়ি গাছকোমর বাঁধা। হাতে বন্দুক। বন্দুক ঠিক পতাকীর বুকের দিকে উদ্যত।

কে, কে তোমরা?

মেয়েটা মুচকি হাসল, বাশুলি-মায়ের দাসী। এরাও মায়ের অনুচর।

কী চাই আমার কাছে?

তোমার গোলাঘরের চাবি।

তারা বন্দুক আরও এগিয়ে আনল। তাহলে আর আমার দোষ নেই। ভেবেছিলাম বিনা রক্তপাতেই কাজ হবে। এক দুই তিন বলব। এর মধ্যে যদি চাবি না পাই, তাহলে ঘোড়া টিপতে বাধ্য হব।

পতাকী আর দ্বিরুক্তি না করে কোমরে বাঁধা চাবির গোছাটা ফেলে দিয়ে বলল, লাল সুতো-বাঁধা বড়ো চাবিটা।

তারা বন্দুক সরাল না। মুখও ঘোরাল না। পতাকীর দিকে চোখ রেখেই বলল, মেঘা, চাবিটা তুলে নিয়ে চলে যাও। আমরা এখানে রইলাম। যদি ভুল চাবি দিয়ে থাকে, খবর দিয়ো, পাষণ্ডকে এক গুলিতে নিকেশ করে দেব।

মেঘা নিচু হয়ে চাবির থোলো কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে নীচে নেমে গেল। মেঘার জায়গায় আর-একজন বল্লমধারী এসে দাঁড়াল।

মিনিট কুড়ি পরেই বাইরে দারুণ চিৎকার শোনা গেল। অনেকগুলো কণ্ঠের সম্মিলিত চিৎকার।

তারা-মায়ের জয়! আমাদের প্রাণ বাঁচালে মা।

তারা বুঝতে পারল গাঁয়ের লোকেরা ধান নিয়ে যাচ্ছে গুদাম থেকে। তাদের আগেই বলে রাখা হয়েছিল।

পাছে কেউ তাদের চিনতে পারে, তাই সবাইকে মুখে কালিঝুলি মেখে আসতে বলা হয়েছিল। তারা তাই এসেছে। পতাকী ঘোষালের পাইকরা তাদের দেখে চিনতে পারবে এমন ভরসা কম। তা ছাড়া কিছু পাইক আহত হয়েছে, বাকি সবাইকে বেঁধে ডাকাতরা এক জায়গায় ফেলে রেখেছে।

গাঁয়ের চাষিদের চেনবার সুযোগও তারা পাবে না।

আওয়াজটা একেবারে মিলিয়ে যেতে তারা বলল, এবার জমিদারের ব্যবস্থা করো।

দুজন লোক দু-দিক থেকে এগিয়ে এসে মোটা দড়ি দিয়ে পতাকীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধল। তারপর তাকে টানতে টানতে শোবার ঘরে এনে পালঙ্কের পায়ার সঙ্গে মোক্ষমভাবে বাঁধল। তার পরনের ধুতির কিছুটা খুলে মুখে গুঁজে দিল। যাতে সহজে না চেঁচাতে পারে।

বাঁধাছাঁদা শেষ হতে ডাকাতের দলের সাধুচরণ এগিয়ে গিয়ে বলল, পেন্নাম হই কত্তা। কেমন সাহেব সেজেছিলাম বলুন? একেবারে খাস ইংরেজ। আপনার পাইক- বরকন্দাজরা জঙ্গলে বিশ্রাম করছে। কাল ভোরে ফিরবে। আসি কত্তা।

পতাকী দুটো চোখ বিস্ফারিত করে শুধু চেয়ে রইল। মুখ বাঁধা না থাকলে বোধহয় বিস্ময়ে চেঁচিয়েই উঠত।

তারাকে মাঝখানে নিয়ে দলটা দেউড়ি পার হয়ে গেল।

পতাকী অনেক চেষ্টা করেও বাঁধন খুলতে পারল না। সে শুধু একটা কথা ভেবে আশ্চর্য হল, বাড়িতে এত সোনাদানা, মোহর, জহরত থাকতে ডাকাতদের ধানের গোলার ওপর লোভ কেন?

সম্ভবত খাবার নেই। পয়সা দিলেই বা ডাকাতদের কে ধান বিক্রি করবে। কিন্তু পতাকীর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করল। চালের দর দু-টাকা মন উঠেছে, আরও হয়তো কিছু উঠত। কলকাতায় চালান দিতে পারলে বেশ লাভ হত। পতাকীর একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেল।

এদিকে রাইপুরের চাষিরা দু-হাত তুলে তারার জয়ধ্বনি করতে লাগল।

তারা তাদের বোঝাল, খুব সাবধান, এমন ভান করবে যেন এখনও তোমরা অভাবগ্রস্ত। জমিদারের কাছে দরবার করবে। না হলেই তোমাদের সন্দেহ করবে। জানতে পারলে অত্যাচারের শেষ থাকবে না।

চাষিরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেল।

তারপর দিন কুড়ি আবার সব চুপচাপ।

এ পথ দিয়ে লোকচলাচল বেশ কমে গেল। মনে হল ইংরেজরা সবাইকে সাবধান করে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে পথের বিপদের কথা। হয়তো এমন কথাও বলেছে, শীঘ্রই এসব জঞ্জাল দূর করে দেবে। ডাকাতদের সম্পূর্ণরূপে শায়েস্তা করবে, তারপর এসব পথ দিয়ে লোকেরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবে।

.

কিছুদিন পরেই আর-এক দুঃসংবাদ এল।

তারা ঘুমাচ্ছিল, হঠাৎ দরজায় শব্দ।

তারার ঘুম খুব সজাগ। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে পড়ল।

দরজার গোড়ায় ভৈরব শুয়ে থাকে। কাছে বর্শা নিয়ে। সে-ও উঠে বসল।

কী ব্যাপার, এত রাত্রে দরজা ঠেলাঠেলি কেন?

ইংরেজরা আস্তানা ঘিরে ফেলল না তো!

ভৈরব দরজা খুলে সরে দাঁড়াল।

দরজার ওপারে মেঘা।

কী খবর মেঘা? তারা প্রশ্ন করল।

বড়ো খারাপ খবর মা।

এসো, ভিতরে এসো।

মেঘা চৌকাঠ পার হয়ে মেঝের ওপর বসল।

তারা প্রদীপের সলতেটা উসকে দিল। ঘরটা কিছু আলোকিত হল।

কী বলো?

মেঘা বিরসকণ্ঠে বলল, ফটিকচরণকে খতম করে দিয়েছে।

খতম করে দিয়েছে? কে?

সাহেবরা।

কী করে?

বন্দুকের গুলিতে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলল না।

অনেক পরে তারা খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করল, সাহেবরা জঙ্গল ঘিরে ফেলেছিল নাকি?

না, তা ঘেরেনি। তবে অনেক সিপাই-সান্ত্রি নিয়ে ফটিকচরণের দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছিল। শুধু ফটিকচরণই নয়, তার দলের আরও দশ-পনেরোজন খতম।

আগে থেকে কেউ বুঝতে পারেনি?

বোধহয় না। অন্ধকার রাত্রে গুঁড়ি মেরে সিপাইরা এসেছিল। তাদের সঙ্গে রবার্ট সাহেব।

রবার্ট কে?

ওই যে লাটসাহেবের অনুচর ছিরিমান না কে?

শ্লিম্যান।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে-ই রবার্ট সাহেবকে নিয়োগ করেছে এ তল্লাট থেকে ডাকাতদের উৎখাত করতে।

তারা বসে ছিল। উঠে দাঁড়াল।

পায়চারি করতে করতে বলল, এবার তাহলে আমি বাকি, মানে আমরা। তাহলেই দুর্গাপুরের জঙ্গল সকলের পক্ষে নিরাপদ হয়, তা-ই না?

মেঘা মাথা নিচু করে বসে রইল। কোনও উত্তর দিল না।

একটু পরে তারা বলল, এটা কবেকার ঘটনা?

পরশু রাতের। আজ একটু আগে ফটিকচরণের দলের দুজন লোক এসেছিল, তারা বলল।

লোক দুজন কি আমাদের দলে আসতে চায়?

না, আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা রাজি হল না।

রাজি হল না?

উঁহু। বলল, আর ডাকাতি নয়। ইংরেজরা যেরকম উঠে-পড়ে লেগেছে, এ দেশে ডাকাতি করে আর খেতে হবে না। তারা নিজেদের দেশে ফিরে গেল। চাষবাস করবে।

রবার্ট সাহেবের দল কি এবার আমাদের দিকে আসছে?

না, ফটিকচরণের লাশ নিয়ে তারা বর্ধমান ফিরে গেছে। সেখান থেকে কলকাতা যাবে।

এতক্ষণে ভৈরব কথা বলল, তা লাশটা নিয়ে গেল কেন?

মেঘা উত্তর দিল, লাশটা দেখালে কোম্পানির কাছ থেকে বকশিশ পাবে। নাম হবে রবার্ট সাহেবের।

এবার আমরা কী করব বলো?

তারার কণ্ঠে হতাশার সুর।

মেঘা বলল, তোমাকে আমি আর কী মতলব দেব তারা-মা। তুমি নিজে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখো।

আমার মনে হয় লুঠের মালগুলো আমাদের সরিয়ে ফেলা উচিত। সেসবের সাহেবরা খোঁজ না পায়।

তা না হয় করা যাবে। এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা ভগ্নস্তূপ আছে। কোনওকালে বোধহয় কোনও জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল। এখন সাপখোপের আড্ডা। সবকিছু সেখানে সরিয়ে রাখা যেতে পারে।

ভগ্নস্তূপ?

হ্যাঁ, লোকেরা বলে, বর্গিরা জমিদারবাড়ি আক্রমণ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। অনেককাল আগে। রতন সর্দারের আমলে মুসলমানদের ভয়ে একবার ধনরত্ন সব সেখানে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। গোলমালের আশঙ্কা কমতে আবার সেসব এখানে নিয়ে আসা হয়। এবারেও না হয় তা-ই করা যাবে, কিন্তু আমাদের কী ব্যবস্থা হবে?

আমরা একজোট হয়ে থাকব না। ছড়িয়ে থাকব। যদি কেউ নিজেদের গাঁয়ে ফিরে যেতে চায়, বাধা দিয়ো না। যেতে দিয়ো। তারপর বিপদ কেটে গেলে আবার আমরা একসঙ্গে হব। শুধু তোমরা, মানে দলের প্রধান যারা, তারা আমার সঙ্গে থাকো। পরামর্শ করার জন্য দরকার হবে। তবে আমার মনে হয়, আমাদেরও ঠাঁই বদল করা দরকার। আমাদের যেমন চর আছে, তেমনই ইংরেজেরও গুপ্তচর আছে। আমাদের ঘাঁটির সন্ধান রাখছে। কাজেই এখান থেকে সরে আমাদের আরও ভিতরে চলে যেতে হবে।

মেঘা ঘাড় নাড়ল, ভালো ব্যবস্থা। তাহলে কাল থেকেই মাল সরাবার আয়োজন করি। তারপর নিজেদের আস্তানা সরিয়ে নিয়ে যাব।

তা-ই হল। লুঠের মাল সব সরিয়ে ফেলা হল। দলের সবাইকে ডেকে বলে দেওয়া হল, যাদের যাবার জায়গা আছে, তারা যেন চলে যায়। দল বেঁধে এক জায়গায় থাকাটা বর্তমান অবস্থায় বিপজ্জনক, কারণ ইংরেজরা ডাকাতদের উচ্ছেদ করার জন্য বদ্ধপরিকর।

এ কথাও বলে দেওয়া হল সময় একটু অনুকূল হলেই আবার তাদের ডেকে আনা হবে।

যাবার সময় তাদের প্রত্যেককে নতুন ধুতি, উড়ানি আর অর্থ দেওয়া হল। তারাকে প্রণাম করার দিন থেকে খুঁটিনাটি অনেক কথা তার মনে পড়ল। কালু সর্দার নিজে হাতে তাকে সবকিছু শিখিয়েছিল। দলের ভার যাতে নিতে পারে তার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিল। গোটা দলকে তারা যেমন ভালোবাসত, তেমনই দলের সকলের ভালোবাসাও সে অর্জন করেছিল।

কিন্তু এখন চারদিকের আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে দল রাখা হয়তো আর সম্ভব হবে না। এতদিন ইংরেজরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার চিন্তায় ব্যস্ত ছিল, অন্য কোনওদিকে নজর দিতে পারেনি। এখন ইংরেজ এ দেশের বুকে আসন কায়েমি করে নিয়েছে, কাজেই যা কিছু উৎপাত বলে মনে করে, সব সরাবার চেষ্টা করবে।

এখন আমরা কী করব তারা-মা?

পাশেই চৈতন দাঁড়িয়ে ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল।

চারদিকে চর পাঠিয়ে সন্ধান রাখতে হবে। ইংরেজরা কী করছে, কী তাদের মতলব, সেটা আগেভাগে জেনে নিতে হবে আমাদের। ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করা হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, কারণ ওরা সংখ্যায় অনেক। হাতিয়ারও প্রচুর। তবে এটা ঠিক, আমরা কেউ জীবন্ত ধরা দেব না। ওদের নাস্তানাবুদ করে তুলব।

দলের আর যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা কেউই কোনও কথা বলল না। সবাইয়েরই কেমন বিষণ্ণ ভাব। মনোবল যেন ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে তিলককে গ্রেপ্তার আর ফটিকচরণের মৃত্যুর সংবাদে এরা অসহায় হয়ে গেছে।

সারা দুর্গাপুরের জঙ্গলে এখন শুধু তারা-মায়ের দল। ইংরেজ এই দলকে ছেড়ে দেবে এমন আশা দুরাশা।

অনেকদিন চরেরা কোনও খবর আনল না। সব চুপচাপ। সিপাইদের খোঁজ পাওয়া গেল না। সবাই সরে গেছে জঙ্গল থেকে। এটা তাদের কোনও কৌশল কি না বোঝা গেল না। অবশ্য এমনও হতে পারে, রাজধানীতে তাদের জরুরি ডাক পড়েছে। তাই আপাতত ডাকাতদের চিন্তা ছেড়ে অন্য কাজে চলে যেতে হয়েছে।

তবে চর সজাগ রইল। ইংরেজদের গতিবিধির সামান্য খবর পেলেই যাতে তারাকে জানাতে পারে।

ঠিক এই সময় তারার কাছে একদিন একটি প্রৌঢ়া এসে দাঁড়াল। পরনে আধময়লা থান। রুক্ষ চুল। মুখ দেখে মনে হয় প্রৌঢ়া খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

তারা গাছের তলায় চুপচাপ বসে ছিল।

আচমকা প্রৌঢ়াকে সামনে দেখে বলল। কে? কে তুমি?

প্রৌঢ়া হাঁটু মুড়ে একেবারে তারার পায়ের কাছে বসে পড়ল।

আমাকে তুমি চিনবে না মা। আমি নিরুপায় হয়ে তোমাকে বিরক্ত করতে এসেছি।

সময় খুব খারাপ। শত্রুরা চারদিকে জাল পেতেছে। ছলেবলেকৌশলে তারাকে ধরাই তাদের উদ্দেশ্য।

তারা একবার এদিক-ওদিক দেখল।

একটু দূরে চৈতন দাঁড়িয়ে ছিল। তার দৃষ্টি তারার দিকে।

তারা গম্ভীরকণ্ঠে বলল, আমার কাছে তোমার কী দরকার?

এবার প্রৌঢ়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

তুমি গরিবের মা। তোমার কথা চারপাশের সবাই জানে। তুমি আমাকে বাঁচাও।

প্রৌঢ়ার ভণিতায় তারা বিরক্ত হল।

আসল কথাটা কী বলো-না? কেবল তো কাঁদুনি গাইছ।

তারার ধমকে কাজ হল।

প্রৌঢ়া আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল, বলছি মা, বলছি। সব কথা তোমাকে বলবার জন্যই তো এসেছি।

প্রৌঢ়া ভালো হয়ে বসল মাটির ওপর। আস্তে আস্তে বলল, আমার একটিমাত্র মেয়ে মা। বারো বছর প্রায় বয়স হতে চলল, এখনও বিয়ে দিতে পারলাম না। আমাকে যে নরকে যেতে হবে।

তা, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ না কেন?

কী করে দেব মা? দেবার মুরোদ কোথায়?

তারা অল্পক্ষণ কী ভাবল, তারপর বলল, বেশ, কত টাকা লাগবে বলো, আমি সাহায্য করার চেষ্টা করব।

শুধু টাকার জন্য আটকাচ্ছে না।

তবে?

তোমার যদি সময় থাকে তাহলে সব কথা বলি মা।

বলো।

তারা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল।

প্রৌঢ়ার ভাবভঙ্গি দেখে তারা বুঝতে পারল তার কাহিনি অল্প কথায় শেষ হবে না।

ঠিক তা-ই।

প্রৌঢ়া সবিস্তারে বলতে শুরু করল।

আমার ওই একটিমাত্র সন্তান মা। ওর বয়স যখন ছ-বছর, তখন ওর বাপ কলেরায় মারা যায়। সেই থেকে বুকে করে মেয়েকে মানুষ করেছি। সংসারের কুটোটি নাড়তে দিইনি।

নাম কী তোমার মেয়ের?

মেয়ের নাম থাকমণি। কী বলব মা, মেয়ে যেন সোনার প্রতিমা। যেমন রং তেমনই নাক, মুখ, চোখ আর চুলের ঢাল।

এই পর্যন্ত বলেই প্রৌঢ়া থেমে গেল।

আড়চোখে একবার তারার দিকে চেয়ে বলল, অবশ্য রূপে তোমার পায়ের যোগ্য নয় মা। আমাদের ঘরের তুলনায় সুন্দরী।

তারা একটু বিব্রত হয়ে বলল, ঠিক আছে। বলে যাও।

হ্যাঁ, বলছি মা। রোজগারের কোনও উপায় নেই। পরের বাড়ি ধান ভেনে, মুড়ি ভেজে কোনওরকমে মা-মেয়ের ভরণপোষণ চালাতাম। আকাল এল। চারদিকে নেই নেই রব। লোকেরই পেট চলে না। আমাকে কাজ দেবে কী!

এইখানে প্রৌঢ়া থেমে আঁচল দিয়ে কপাল মুছল। তারপর বলল, সেই সময় ভদ্রাসনটুকু বাঁধা পড়ল, মানে বাঁধা দিতে হল। এ ছাড়া আর উপায়ও ছিল না।

কার কাছে বাঁধা দিলে?

প্রৌঢ়া যেন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।

এই অবেলায় তার নাম কী করে করি বলো তো মা।

কেন?

আর কেন? তার নাম করলে হাঁড়ি ফাটে। সবাই তাকে বলে একাদশী ঘোষাল।

তারা হেসে ফেলল। বাঃ, বেশ নাম রেখেছ তো।

হ্যাঁ মা, নাম করলে সেদিন আর পেটে অন্ন জোটে না। একাদশীর উপোস করতে হয়। তার কাছে সব বাঁধা দিলাম। ব্যাস, সেই সর্বনাশের শুরু। এখন একাদশী ঘোষাল উলটো চাপ দিচ্ছে।

কীসের উলটো চাপ?

রোজ দু-বেলা এসে তাগাদা দিচ্ছে। দেনা শোধ করো।

প্রৌঢ়া আকুল দৃষ্টি মেলে তারার দিকে দেখল, তারপর বলল, কোথা থেকে শোধ দেব বলো তো মা? হাতে কি একটা কানাকড়ি আছে? আবার কী বলছে জানো?

কী?

বলছে, যদি আমার কথা শোনো, তাহলে তোমায় একটি পয়সা ধার শোধের জন্য দিতে হবে না।

বটে? তারা এবারে সোজা হয়ে বসল।

হ্যাঁ মা, কিন্তু নচ্ছার কী বলে জানো?

তারা কোনও কথা বলল না।

প্রৌঢ়া বলে গেল বলে, থাকর সঙ্গে আমার বিয়ে দাও, তাহলে বন্ধকি কাগজপত্র সব ছিঁড়ে ফেলব। তোমার বাড়ি-জমি তোমারই থাকবে।

তারা রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে উঠল।

বেশ তো তা-ই দাও-না। তোমার মেয়েরও তো বয়স হচ্ছে।

প্রৌঢ়া সশব্দে একটা হাত নিজের কপাল ঠুকল।

মুখপোড়ার বয়স ষাটের কম নয়। বাড়িতে তিন-তিনটে বউ। আর চেহারা কী বলব মা, ঠিক যেন বুড়ো চামচিকে।

তবে তো মুশকিল।

তাই তো বলছি মা, আমার হয়েছে উভয়সংকট। ওরকম একটা লোকের হাতে মেয়েকে দিতে পারি না, আবার না দিলে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে পথে দাঁড় করাবে।

কত টাকা তোমার দরকার?

একশো টাকা ধার নিয়েছিলাম, একাদশী ঘোষাল বলছে সুদে-আসলে তা-ই নাকি আড়াইশো টাকাতে দাঁড়িয়েছে।

বেশ, তুমি কাল এসে টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যেয়ো।

কিন্তু তারার আশ্বাসবাণীতেও প্রৌঢ়ার মুখ থেকে ভয়ের ছাপ গেল না।

সে বলল, সমস্যা তো এতে মিটবে না মা।

কেন?

একাদশী ঘোষাল টাকা নিতে যদি অস্বীকার করে?

তারা বিস্মিত হল।

কেন, অস্বীকার করবে কেন? টাকা ধার দিয়েছে, সুদসুদ্ধ টাকা শোধ দিয়ে দিচ্ছ। ব্যাস, হয়ে গেল।

তার ঝোঁক আমার মেয়েকে বিয়ে করার দিকে।

তুমি যদি বিয়ে না দাও তার সঙ্গে তো কী করবে?

একাদশী ঘোষালকে তুমি চেনো না মা। সে সব পারে। তার হাতে অনেক লেঠেল। আমার মেয়ের বিয়েই বন্ধ করে দেবে। জোর করে মেয়েকে বিয়ের রাতে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।

পলকের জন্য তারার চোখ জ্বলে উঠল। দুটি ভ্রূ-র মাঝখানে বিরক্তির আঁচড়।

গম্ভীরকণ্ঠে বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করো। তারপর আমি আছি।

এবার প্রৌঢ়া আসল কথা বলল, বিয়ের কথাবার্তা কিছুটা হয়েই আছে মা।

তা-ই নাকি? কোথায়?

গোবিন্দপুরের রাখালের সঙ্গে। ছেলেটা চাষবাস করে, বয়সও বেশি নয়।

বেশ, তুমি বিয়ের দিন ঠিক করে আমাকে জানিয়ে যেয়ো।

প্রৌঢ়ার সন্দেহ গেল না।

কিন্তু বিয়ে দিতে কি পারব মা?

আমি নিজে যাব তোমার মেয়ের বিয়েতে। দেখি কে বিয়ে আটকায়।

এবার প্রৌঢ়ার মুখে হাসি ফুটল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে মা। আমি কালই একাদশী ঘোষালের কাছে যাব। সে টাকার কথা কী বলে তোমাকে জানিয়ে যাব।

আর-একবার প্রণাম করে প্রৌঢ়া মেঠোপথ ধরে এগিয়ে গেল।

প্রৌঢ়া পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যেতেই চৈতন তারার কাছে এসে দাঁড়াল।

এতক্ষণ কী বকবক করছিল মেয়েছেলেটা?

তারা সব বলল। তারপর চৈতনকে প্রশ্ন করল, তুমি একটা কাজ করতে পারবে চৈতন?

চৈতন অপ্রস্তুত হল। লাঠিটা তারার পায়ের কাছে রেখে বলল, এ আবার কী কথা মা? আদেশ করো, কী করতে হবে।

তারা বলল, আমরা যেরকম অবস্থার মধ্যে রয়েছি, তাতে কাকেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। কিছুই বলা যায় না, এ মেয়েছেলেটা হয়তো ইংরেজের চর। ফাঁদ পেতে আমাকে ধরার চেষ্টা করছে।

ঠিক বলেছ মা, কাউকে বিশ্বাস নেই। চারদিকে দুশমনের চর ঘুরছে।

তুমি এক কাজ করো চৈতন!

বলো।

মেয়েছেলেটা বেশি দূর যেতে পারেনি, তুমি ওর পিছন পিছন যাও। খোঁজ নিয়ে এসো, যা বলে গেল, সব সত্যি কি না।

ঠিক আছে মা। ওই মেয়েছেলেটার বাড়ি ধারেকাছেই হবে। আমি আজ রাতেই তোমার কাছে সব খবর নিয়ে আসব।

চৈতন কোমরের গামছা মাথায় বাঁধল। তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল।

তারা কিছুক্ষণ চৈতনের দিকে দেখে বিপরীতদিকে চলতে আরম্ভ করল।

.

খাওয়াদাওয়া সেরে তারা উঠানে বসে ছিল, ঠিক সেই সময় চৈতন এসে দাঁড়াল।

এসে গেছি মা।

কী খবর চৈতন বলো?

চৈতন একটু ব্যবধান রেখে তারার সামনে বসল।

মেয়েছেলেটা মিথ্যা বলেনি মা।

তা-ই নাকি?

হ্যাঁ, এখান থেকে এক ক্রোশ দূরে রতনপুরে থাকে। বাড়িতে শুধু ওর একটি মেয়ে। আর কেউ নেই। গিয়ে মেয়ের কাছে সব কথা বলছিল, আমি জানলায় কান রেখে সব শুনেছি।

কী বলছিল?

তোমার কথা মা। তারা-মা অভয় দিয়েছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েটা কিন্তু অঝোরধারায় কেবল কাঁদছিল, আর বলছিল, আমার বড্ড ভয় করছে মা। লাঠিয়াল দিয়ে যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায়। তোমাকে ছেড়ে আমি কী করে বাঁচব মা?

আহা, বেচারা। তারা সহানুভূতির সুরে বলল।

ওর মা ওকে অনেক বোঝাল। এমন সময় এক কাণ্ড।

কী কাণ্ড?

সেই মহাদেব ঘোষাল এসে হাজির।

কে মহাদেব ঘোষাল?

ওই যে যার কাছে এদের ভিটেমাটি সব বাঁধা।

একাদশী ঘোষাল?

হ্যাঁ, গাঁয়ের মুদির কাছে খবর পেলাম সবাই ওকে ওই নামেই ডাকে। একেবারে হাড়কৃপণ আর চামারের বেহদ্দ। এসেই লাঠি ঠুকে চিৎকার।

মেয়েছেলেটা বেরিয়ে এসে বোঝাল যে তিন দিনের মধ্যে ঘোষালের দেনা শোধ করে দেবে।

তা-ই শুনে ঘোষাল একটু যেন থমকে গেল।

চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, দেবে যে, টাকাটা কি আশমান ফুঁড়ে আসবে?

মেয়েছেলেটা বলল, সে খোঁজে তো আপনার দরকার নেই। আপনার টাকা পেলেই হল।

ঘোষাল বলল, হুঁ। তারপর মেয়ের বিয়ের কী করলে?

মেয়ের বিয়ে এখন দেব না।

তা-ই শুনে লাঠি ঠুকে যেতে যেতে ঘোষাল বলল, বুঝতে পেরেছি, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। ঠিক আছে, মহাদেব ঘোষালের চোখে কী করে ধুলো দাও ঠাকরুন, আমিও দেখব। মেয়েটা সুখে থাকত, ভালো ঘরে-বরে পড়ত, সেটা তাহলে ইচ্ছা নয়। ঠিক আছে। ঠিক আছে।

তারা বলল, চৈতন, তুমি এবার যাও। বিশ্রাম করো। বোঝা যাচ্ছে মেয়েছেলেটা সত্যি কথাই বলেছে।

চৈতন চলে যেতে তারা বাড়ির মধ্যে ঢুকল।

খাবার নিয়ে মাসি অপেক্ষা করছিল।

তারা ঢুকতে বলল, কী গো বাছা, বিয়ে বিয়ে করে কী বলছিলে? কানে যেন এল।

তারা হাসল। আমার বিয়ে গো মাসি।

তারার কথা শুনে মাসি অবাক।

ও মা সে কী গো? কবে? কার সঙ্গে?

কবে এখন বলতে পারছি না মাসি। দিনক্ষণ দেখতে হবে। আর বিয়ে বোধহয় ইংরেজের সঙ্গে।

মাসি এবার একটু সরে এসে বসল।

কী মশকরা করছ?

মশকরা কেন হবে? ইংরেজের সঙ্গে বিয়ে বলেই তো সরকারের লোক আমার এত খোঁজ করছে। দেখতে পেলেই হাতে মালা জড়িয়ে, পায়ে মল পরিয়ে টেনে নিয়ে যাবে।

শেষদিকে তারার গলাটা যেন ভারী ঠেকল।

নাও বাছা খেতে বোসো। রাত অনেক হল! মাসি হাই তুলতে তুলতে বলল।

তারা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

শুল বটে কিন্তু ঘুম এল না। বাইরে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

দলের দুজন সারারাত কুটির পাহারা দেয়।

দিনকাল খারাপ। শত্রুর শক্তি প্রবল। কোথা দিয়ে কী হয়ে যায় বলা যায় না।

তারাও বালিশের নীচে দা দিয়ে শোয়। মাথার কাছে দেয়ালে বন্দুক ঝোলানো থাকে। কখন কোনটার দরকার হয় কে জানে।

দু-দিন পরে প্রৌঢ়া এসে দাঁড়াল।

খাওয়াদাওয়ার পর তারা চুল খুলে রোদে বসে ছিল।

সামনে ছায়া পড়তেই চোখ তুলে দেখল, প্রৌঢ়া দাঁড়িয়ে।

তারা মুখ তুলতেই প্রৌঢ়া তারাকে প্রণাম করল।

কী খবর?

প্রৌঢ়া বসল।

খবর তো এদিকে ভালোই মা। পাত্রের খুড়ো এসে মেয়ে পছন্দ করে গেছে। বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে সামনের মাসের দোসরা।

দোসরা? তাহলে হাতে আর কদিন আছে?

আজ হল গিয়ে তোমার সতেরোই। আর দিন পনেরো।

তাহলে তো আর দিনও বেশি নেই।

না মা, একলা মানুষ তো। সবই আমাকে করতে হবে।

তুমি কি টাকাটা আজ নিয়ে যাবে?

তুমি যদি দয়া করো, নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে মা।

আবার কী হল?

একাদশী ঘোষাল রাজি হচ্ছে না।

কীসে রাজি হচ্ছে না?

টাকা নিয়ে আমার জমিজমা ছেড়ে দিতে।

সে কী?

হ্যাঁ মা, ঘোষাল বলছে, টাকার তার দরকার নেই। মেয়ে দিতে হবে তাকে। গাঁয়ে একাদশী ঘোষালের চর চারদিকে মা। আমার মেয়েকে যে দেখতে এসেছিল, সে কথা ঠিক তার কানে গিয়েছে। আমাকে কী বললে জানো মা?

কী বললে?

বললে, এসব কায়দা করতে যেয়ো না ঠাকরুন, বিপদে পড়বে। আমি বেঁচে থাকতে, তোমার মেয়েকে কেউ গাঁয়ের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না।

একটু বোসো, আমি আসছি। তারা উঠে ভিতরে চলে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল একটা তোড়া হাতে করে।

এই নাও, এর মধ্যে আড়াইশো টাকা আছে। গুনে নাও।

এ আর কী গুনব মা। তুমি দয়া করে দিচ্ছ, মাথায় করে নিচ্ছি।

প্রৌঢ়া দু-হাতে টাকার তোড়াটা বুকে তুলে নিল।

প্রৌঢ়া চলতে শুরু করতেই তারা বলল, দাঁড়াও।

প্রৌঢ়া থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

এতগুলো টাকা নিয়ে তোমার এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি একজন লোক সঙ্গে দিচ্ছি।

দলের একজন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তারা তাকে হাততালি দিয়ে ডাকল।

সে কাছে এসে দাঁড়াতে বলল, তুমি এর সঙ্গে যাও। একেবারে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। প্রৌঢ়ার দিকে ফিরে তারা বলল, আর শোনো।

বলো মা।

মেয়ের বিয়ের ঠিক আগের দিন আমাকে খবর দিয়ে যাবে। বিয়ের দিন আমি যাব।

তুমি যাবে মা?

কথাটা প্রৌঢ়ার যেন বিশ্বাসই হল না।

যাব বই কী। যদি তোমাদের ঘোষাল মশাই গোলমাল করে, ঠেকাতে হবে তো।

হ্যাঁ, মা, আমার আর কেউ নেই। মনে হচ্ছে একাদশী ঘোষাল গোলমাল করবেই।

ঠিক আছে, তুমি আর দেরি কোরো না। অনেকটা পথ যেতে হবে।

হ্যাঁ, যাই মা।

প্রৌঢ়া আর-একবার তারাকে প্রণাম করে চলতে শুরু করল। তারার লোকটি ঠিক তার পিছনে পিছনে রইল।

প্রৌঢ়া চলে যেতে তারা উঠে দাঁড়াল। কে আছ?

ধারেকাছে কেউ ছিল না। কেউ উত্তর দিল না।

তারা একটু এগিয়ে গেল।

একটা বাবলা গাছের নীচে জনা চারেক বসে ছিল। তারাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল।

এই, একবার মেঘাকে খবর দাও তো। বলো, খুব জরুরি দরকার, এখনই যেন দেখা করে।

দুজন লোক ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল। মিনিট পনেরোর মধ্যে মেঘা এসে দাঁড়াল।

ঘরের মধ্যে তারা চাটাই পেতে শুয়েছিল, ঘুমায়নি। মেঘার ডাকে তারা উঠে বসল।

ভিতরে এসো।

মেঘা ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

বোসো এখানে।

তারা চাটাইয়ের একটা কোণ দেখিয়ে দিল।

মেঘা কিন্তু চাটাইয়ের ওপর বসল না। মাটির ওপর বসল।

কী মা? কোথাও ডাকাতি করতে যেতে হবে? কোনও খবর আছে?

তারা মাথা নাড়ল। না।

অস্ত্রশস্ত্রগুলো যে মরচে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল মা। আমরা অকেজো হয়ে যাচ্ছি।

তুমি তো জানো মেঘা, সময় আমাদের অনুকূল নয়। এখন কিছু করতে যাওয়া নিরাপদ হবে না। ইংরেজরা প্রতিজ্ঞা করেছে আমাদের উচ্ছেদ করবেই। আমরা নাকি দেশের শত্রু, সকলের শত্রু। শেষদিকে গলার আওয়াজ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে উঠল।

তারা নিজেকে সংযত করে বলল। শোনো মেঘা, তোমাকে বিয়ের নিমন্ত্রণে যেতে হবে।

মেঘা অবাক।

বিয়ের নিমন্ত্রণে? কোথায়? আমাদের আবার কে নিমন্ত্রণ করবে?

রতনপুরে।

কিছু বুঝতে পারছি না মা। রতনপুরে আমাদের কী আছে?

সব কথাটা খুলে না বললে বুঝতে পারবে না।

তারা চাপা গলায় অনেকক্ষণ ধরে মেঘাকে বোঝাল।

সব শোনার পর মেঘা হাসতে লাগল।

ঠিক আছে মা। লাঠি ধরবার জন্য হাত নিশপিশ করছে। আমি দলের সবাইকে একবার বলে আসি। মেঘা বেরিয়ে গেল।

.

ঠিক সময়ে প্রৌঢ়া এসে হাজির। মা, এইবার যে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে?

হ্যাঁ মা। কালই বিয়ে। আজ আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না মা। এখনই উঠব। কী যে হবে কিছু বুঝতে পারছি না।

কেন?

কাল থেকে একাদশী ঘোষালের লোক বাড়ির আশপাশে ঘুরছে।

তা-ই নাকি?

হ্যাঁ মা। আমরা যা করছি সবকিছুর ওপর নজর রাখছে।

রাখুক। তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি তোমার কাজ করে যাও।

প্রৌঢ়া বলল। সবই তো করে যাচ্ছি মা, তবে ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে।

বিয়ের লগ্ন কখন?

মাঝরাতে। আরও একটা মুশকিলে পড়ছি মা।

কী আবার মুশকিল?

কোনও ভটচাজ আসতে চাইছে না একাদশী ঘোষালের ভয়ে।

ঠিক আছে, ভটচাজ আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।

তুমি কখন যাবে মা?

আমি কাল বিকালের দিকে যাব।

বাড়ি চিনবে কী করে?

আমার যে লোক তোমার সঙ্গে টাকার তোড়া নিয়ে গিয়েছিল, সে-ই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে।

তাহলে অভয় দিচ্ছ মা?

আমি অভয় দেবার কে? তুমি বাশুলি-মা-কে ডাকো। তিনিই রক্ষা করবার মালিক। যা করবার, তিনিই করবেন।

প্রৌঢ়া বাশুলি-মায়ের উদ্দেশে কপালে দুটো হাত ঠেকিয়ে শূন্যে প্রণাম করল, তারপর বলল, তাহলে ঠিক সময়ে যেয়ো মা। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব।

প্রৌঢ়া চলে গেল।

তারা অনেকক্ষণ দুটো হাত কোলের ওপর রেখে চুপচাপ বসে রইল।

হয়তো এই ব্যাপারের পর ইংরেজরা আরও তৎপর হবে। তারাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, কিন্তু যা-ই হোক, কথা যখন দিয়েছে, তখন তারাকে প্রতিশ্রুতি রাখতেই হবে।

পরের দিন বিকাল হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা পালকি এসে দাঁড়াল। তারার উঠানের ওপর। দুজন বেয়ারা বয়ে নিয়ে এল। সঙ্গে আর দুজন।

মিনিট পনেরোর মধ্যে তারা বেরিয়ে এল।

পরনে লালপাড় গরদের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। কপালে সিঁদুরের টিপ। দু-পায়ে আলতা।

শাড়ির ফাঁকে লুকানো ছোরাটা অবশ্য দেখা গেল না।

তারা পালকির কাছে এসে দাঁড়াতেই বেয়ারাগুলো একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, জয়, তারা মায়িকি জয়।

তারা হেসে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল।

না, না, আমি এখন তারা মায়ি নয়, আমি চৌধুরীদের ছোটোবউ। আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ার মেয়ের বিয়েতে চলেছি।

একজন বেয়ারা মাথা চুলকে বলল, তাহলে কী বলে জয়ধ্বনি করব মা?

কিছু বলতে হবে না। যা বলবার ঠাকুরমশাই বলবেন।

পাশেই পুরোহিত দাঁড়িয়ে ছিল। বাশুলি মন্দিরের পুরোহিত।

পরনে নামাবলি। টিকিতে জবা ফুল বাঁধা।

পুরোহিত হাত নেড়ে বলল। তোমাদের কিছু বলতে হবে না বাপু, কেউ খোঁজ নিলে, যা বলবার আমিই বলব।

তারা পালকিতে ওঠবার আগে একবার ফিরে দাঁড়াল।

একটু দূরে মেঘা দাঁড়িয়ে ছিল।

তারা তার দিকে দেখতেই সে এগিয়ে এল।

কিছু বলবে মা?

সব ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, সব ঠিক। সন্ধ্যার একটু আগেই আমরা রওনা হয়ে যাব। রতনপুরে সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই গিয়ে পৌঁছাব।

তাহলে আমি চলি।

তারা পালকিতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল।

হুম, হুম, হুমনা শব্দ করতে করতে বেয়ারা দুজন পালকি নিয়ে ছুটল। পিছন পিছন বাকি দুজন বেয়ারা আর পুরোহিত।

একটু চলার পরেই পুরোহিত চেঁচাল, ওরে বাবাসকল, একটু আস্তে। আমি বুড়ো মানুষ কি ওরকম দৌড়াতে পারি?

পথে কোনও বাধা হল না।

নির্বিঘ্নে পালকি চলল।

রতনপুর গাঁয়ে ঢোকবার মুখে একটা বিরাট অশথ গাছ। বাঁধানো বেদি।

পালকি যখন অশথতলা পার হচ্ছে তখন শব্দ এল।

কে যায়?

পালকি-বেয়ারা দুজন পালকি থামাল না, গতি মৃদু করল।

পুরোহিত বলল, বাঁশখালির চৌধুরী বাড়ির ছোটোবউ, কেন?

এই সময় তারা দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখল।

বাঁধানো বেদির ওপর একটি কুৎসিত চেহারার বৃদ্ধ। হাতে হুঁকা। তার দু-পাশে আরও দুটি লোক বসে আছে।

তারা বুঝতে পারল এই হচ্ছে মহাদেব ঘোষাল।

ঘোষাল আবার প্রশ্ন করল, কাদের বাড়ি?

এবার পুরোহিত কোনও উত্তর দিল না। চলতে আরম্ভ করল।

কী হে, কথা কানে গেল না?

এবারও পুরোহিত কোনও কথা বলল না।

পিছন থেকে ঘোষাল বলল, বৃথাই যাচ্ছ। পালকি ফেরাও, ও বিয়ে হবে না।

কথা শেষ করে ঘোষাল উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের লোক দুটোও।

তারা আস্তে আস্তে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। তার সারা মুখ আরক্ত হয়ে উঠল।

পালকি প্রৌঢ়ার বাড়ির কাছে যেতেই প্রৌঢ়া ছুটে এল।

পালকি থামল। দরজা খুলে তারা বেরিয়ে এল।

গাঁয়ের যে কজন ঝি-বউ এসে জড়ো হয়েছিল, তারা উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল।

তারা প্রৌঢ়াকে একান্তে টেনে নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বলল, শোনো, আমার আসল পরিচয় কাউকে দিয়ো না।

না মা, তা দেব না, কিন্তু কী বলব?

কিছু একটা বলো।

প্রৌঢ়া কী ভেবে বলল, মাসির মেয়ে বলব? আমার এক মাসির মেয়ে দূরে থাকে।

বলো।

প্রৌঢ়া তারাকে কোণের ঘরে নিয়ে বসাল।

এ ঘরে একটা আসনের ওপর কনে বসে আছে।

বিরস মুখ, যেন ভয়ার্ত মনে হল।

তারা তার কাছে যেতেই মেয়েটি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল।

তারা অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখল।

অপরূপ মুখশ্রী। রং খুব ফরসা নয়, কিন্তু কালো চুলের ঢাল কোমর ছাপিয়ে পড়েছে। নিটোল গড়ন।

তারা মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে বলল, তোমার নাম কী?

থাক, থাকমণি।

ও, তোমার মা-র কাছে শুনেছিলাম নামটা, মনে ছিল না।

তারা একবার এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল।

পাড়ার বউ-ঝি-রা কেউ ধারেকাছে নেই। যে যার কাজে লেগে গেছে।

তারা নিশ্চিন্ত হয়ে বসল।

আমাকে চেনো?

থাক মাথা নাড়ল, না।

তোমার মা আমার কথা কিছু বলেনি তোমায়?

বলেছিল, কে একজন আসবেন। খুব দূর সম্পর্কের আত্মীয়া।

নিজের মেয়ের কাছেও যে প্রৌঢ়া তারার পরিচয় দেয়নি, এ কথা ভেবে তারা খুব খুশিই হল।

আজ তোমার বিয়ে, কিন্তু তোমার মুখটা এত শুকনো কেন?

থাক ঘাড় নিচু করে রইল। তারা থাকর কাঁধে একটা হাত রাখল। কী, বলো?

আমার বড়ো ভয় করছে।

কীসের ভয়?

মনে হচ্ছে আমার বিয়ের সময় একটা গোলমাল হবে।

কীসের গোলমাল?

থাক একবার তারার দিকে চেয়েই মুখ নামাল।

মা-কে জিজ্ঞেস করবেন। মা বলবে আপনাকে।

তুমি একাদশী ঘোষালের কথা বলছ তো?

থাক চমকে উঠল, আপনি জানেন সব?

কিছু কিছু জানি। তোমার মা বলেছে। আমি বলছি শোনো, কোনও ভয় নেই। একাদশী ঘোষাল তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।

থাকর চোখে অবিশ্বাসের ছায়া ফুটে উঠল।

সেটা তারার চোখ এড়াল না। তারা বলল, আমার কথা বিশ্বাস করো থাক, কিছু হবে না। তোমার আঁচলে আমি বাশুলি-মায়ের পূজার ফুল বেঁধে দিচ্ছি, কোনও অমঙ্গল তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

তারা সত্যি সত্যিই নিজের আঁচল থেকে ফুল আর বেলপাতা নিয়ে থাকর মাথায় ছুঁইয়ে তার আঁচলে বেঁধে দিল।

রাত একটু হতেই কনেকে সাজাবার উদ্যোগ শুরু হল।

প্রৌঢ়া তারাকে বলল, তুমিই থাককে সাজিয়ে দাও মা।

তারা মাথা নাড়ল।

না, আমার কিছু করা ঠিক হবে না। আমি সংসারী নই, এসব শুভকাজে আমার থাকা উচিত নয়। আমি এসেছি শুধু তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য।

তারা জানলার ধারে চুপচাপ বসে রইল।

কনে সাজানো তখনও শেষ হয়নি, হঠাৎ গোলমাল শুরু হল।

একটা লোক ছুটতে ছুটতে উঠানে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করল।

থাকর মা, ও থাকর মা।

প্রৌঢ়া বোধহয় এইরকম একটা সংবাদের অপেক্ষায় উদবিগ্ন হয়েছিল। ছুটে বেরিয়ে এল। কী হয়েছে তারক?

সর্বনাশ হয়েছে থাকর মা। একাদশী ঘোষালের লোক জামাইয়ের পালকি আটকেছে।

ও মা, কী সর্বনাশ হল গো!

প্রৌঢ়া উঠানের ওপর আছড়ে গিয়ে পড়ল।

সব কথাগুলোই তারার কানে গিয়েছিল। সে-ও বাইরে এসে দাঁড়াল।

কোথায় আটকেছে পালকি?

একেবারে গাঁয়ের মুখে অশথতলায়।

লোক কজন?

তা প্রায় জন ছয়-সাত লেঠেল হবে।

তারা ফিরে এল।

বাড়ির পিছনদিকে শরবন, আসশেওড়া আর ঘোড়ানিম গাছের জঙ্গল। কোমর থেকে ছোটো একটা রামশিঙা বের করে তারা বাজাল।

একবার, দুবার, তিনবার।

শরবন দুলে উঠল। আসশেওড়া আর ঘোড়ানিমের ডাল থেকে ঝুপঝাপ শব্দ।

ঝাঁকড়া চুল, মাথায় লাল কাপড়ের ফেটি বাঁধা, হাতে কারো ভোজালি, কারো বর্শা। জন কুড়ি-পঁচিশ অনুচর তারাকে ঘিরে দাঁড়াল।

চলো, গোলমাল শুরু হয়ে গেছে।

বাশুলি মায়িকি জয়। তারা মায়িকি জয়।

গাছপালা, ঝোপঝাড়, রাত্রের আকাশও কেঁপে উঠল।

চলো।

তারার মাথায় ঘোমটা নেই। আঁচল কোমরে বাঁধা। চুল খোলা। হাতে ঝকঝকে ছোরা।

আগে তারা, পিছনে যমদূতের মতন অনুচরের দল। বাতাসের বেগে বেরিয়ে গেল।

সেই অশথতলার একটু আগে।

পালকি পথের ওপর। পালকি ঘিরে জন চারেক লাঠিয়াল। বাঁধানো বেদির ওপর মহাদেব ঘোষাল নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে তামাক খাচ্ছে।

হা রে রে রে।

তারার অনুচররা লাঠিয়ালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তারা মায়িকি জয়।

লড়াই আর হল না। তারার নাম শুনেই লাঠিয়ালদের হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল। মাথার ওপর বর্শার খোঁচা লাগতেই সবাই পথের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

তারা নিজে গিয়ে দাঁড়াল মহাদেব ঘোষালের সামনে।

গম্ভীরকণ্ঠে বলল, চলো, বিয়ের লগ্নের আর দেরি নেই।

মহাদেব ঘোষাল কাঁপতে কাঁপতে সটান শুয়ে পড়ে তারার দুটো পা জড়িয়ে ধরল। দোহাই মা, আমি কিছু জানি না। আমি বুড়ো মানুষ, বসে তামাক খাচ্ছিলাম, হঠাৎ এই হাঙ্গামা।

তারা ডান হাতটা তুলল।

অন্ধকারের মধ্যেও ঝকঝক করে ছোরার ফলা জ্বলে উঠল।

একটা কথা নয়। চলো আমাদের সঙ্গে।

মহাদেব ঘোষালের কোঁচার খুঁটটা গায়ে জড়ানো ছিল, তারা সেটা পাকিয়ে তার গলায় টেনে দিল।

বাঁচাও মা, আমি নিরপরাধ।

মেঘা।

আর কিছু বলতে হল না। মেঘা ছুটে এসে সবেগে ঘোষালের গালে একটা চড় বসাল।

ঘোষাল ছিটকে পড়ল হুঁকার ওপর। কলকে থেকে আগুন ছিটকে তার গায়ে গিয়ে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে পরিত্রাহি চিৎকার।

ওরে বাবা রে পুড়ে মলুম। তোমার দুটো পায়ে পড়ছি মা, আমি এর বিন্দুবিসর্গ কিছু জানি না।

তারার দুজন অনুচর ঘোষালকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে চলল।

প্রৌঢ়ার উঠানে আর তিলধারণের জায়গা নেই। খবর পেয়ে এপাশ-ওপাশ থেকে বহু লোক এসে জড়ো হয়েছে।

একেবারে প্রথমে মহাদেব ঘোষাল। দু-পাশে মেঘা আর চৈতন। তাকে ঠেলা দিতে দিতে নিয়ে আসছে।

পিছনে তারা। হাতে ছোরা।

তারপর পালকি। পালকিতে বর আর বরের খুড়ো। পালকি ঘিরে তারার অনুচরবৃন্দ।

উঠানের ওপর দাঁড়িয়ে তারা বলল, কই গো তোমরা শাঁখ বাজাও, উলু দাও, একাদশী ঘোষাল এসেছে বিয়ে করতে।

সবাই হেসে উঠল।

যতক্ষণ বিয়ে হল, মহাদেব ঘোষালকে উঠানের পাশে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হল। বিয়ের পর তারা বাসরঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।

রাখালকে ডেকে বলল, শোনো।

রাখাল তারার সামনে এসে দাঁড়াল।

তোমার দেশে কে আছে?

রাখাল বলল, কেউ নেই, শুধু এই খুড়ো। খুড়ি দু-বছর আগে মারা গেছে।

তাহলে এক কাজ করো, তোমার শাশুড়িকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। বুঝতেই তো পারছ, ঘোষাল এ গাঁয়ে তোমার শাশুড়িকে থাকতে দেবে না। অত্যাচার করবে। বার বার তো আর আমার আসা সম্ভব নয়।

রাখাল খুশি।

তাহলে তো ভালোই হয়। মা যদি আমাদের সঙ্গে যায়, তাহলে সংসারের ভাবনা আর থাকে না। এ বাড়িঘর তো ঘোষাল মশাইয়ের কাছে বাঁধা। এ বাড়িঘর ছাড়তেই তো হবে।

হ্যাঁ, তা হবে। অবশ্য সে ব্যবস্থাও আমি করতে পারি। একাদশী ঘোষালকে টাকা দিয়ে বাড়ি-জমি ছাড়িয়ে নেওয়াও যায়, কিন্তু বললাম যে, তোমার শাশুড়ির এখানে থাকা মুশকিল।

রাখাল বলল। ঠিক আছে, মা আমাদের সঙ্গেই যাবে।

এবার তারা প্রৌঢ়ার কাছে গেল।

আমি চলি।

ও মা সে কী কথা, তুমি কিছু মুখে দিলে না মা। রাত ভোর হোক, তখন যাবে।

আমি আর কিছু খাব না। একটু মিষ্টি হাতে দাও। বরং আমার দলের যারা এসেছে, সম্ভব হলে তাদের খাইয়ে দাও।

প্রৌঢ়া বলল, তাদের খাইয়ে দিয়েছি, তুমি একটু বোসো মা, তোমার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারব না।

প্রৌঢ়া পাশের ঘরে গিয়ে আবার বেরিয়ে এল। হাতে কলাপাতার ওপর কিছু মিষ্টি।

খেতে খেতে তারা বলল, আমি তোমার জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। তুমি কাল মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে চলে যাও। বুঝতেই পারছ, এরপর তোমার এখানে থাকতে অসুবিধা হবে।

প্রৌঢ়া একগাল হেসে বলল, তাহলে তো বেঁচে যাই মা। একটিমাত্র মেয়ে, তাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

তারা যখন খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল, তখন প্রৌঢ়া তার হাতে একটা পুঁটলি দিল।

এটা কী?

ওই আড়াইশো টাকা, যেটা তুমি দিয়েছিলে। আমি যখন গাঁ ছেড়েই চলে যাচ্ছি, তখন তো আর ও টাকাটা দরকার হচ্ছে না।

তারা পুঁটলিটা প্রৌঢ়ার হাতে ফেরত দিয়ে বলল, ও টাকাটা আমি তোমার মেয়ে-জামাইকে যৌতুক দিলাম। তুমি এটা রেখে দাও।

প্রৌঢ়া পুঁটলিটা বুকে চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, তোমার দয়া আমি জীবনে ভুলব না। যাবার আগে একবার আমার মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করে যাও মা। এরা যেন সুখী হয়।

বেশ, চলো। তারা বাসরঘরের চৌকাঠের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

থাক একপাশে ঘুমাচ্ছে। মুখে কনেচন্দন আঁকা। ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস।

রাখাল দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তারও দুটি চোখ বন্ধ।

প্রৌঢ়া ওদের জাগাতে যাচ্ছিল, তারা বারণ করল। না, না, ছেলেমানুষ, ঘুমিয়ে পড়েছে, ওদের ডেকো না। আমি এখান থেকেই আশীর্বাদ করছি।

এরপর তারা উঠানে এসে দাঁড়াল মহাদেব ঘোষালের সামনে।

এবার আমাকে ছেড়ে দাও মা। বাঁধ খুলে দাও, তোমার সামনে নাক-কান মলছি। আর জীবনে এ কাজ করব না।

তারা ঘোষালের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মেঘার দিকে ফিরে বলল, তোমরা কজন থাকো। মেয়ে-জামাই আর মেয়ের মা গাঁ পার হয়ে গেলে, তবে বুড়োকে ছাড়বে।

তারা পালকিতে উঠল।

দলের কয়েকজন আর পুরোহিত পিছনে রয়ে গেল। মেয়ে-জামাই রওনা হলে তবে আসবে।

সারাটা পথ তারা চিন্তামগ্ন রইল।

চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠল থাকমণির বধূর বেশ।

এভাবে ডাকাতেরা যদি তাকে হরণ করে নিয়ে না আসত, তাহলে কবে তারার বিয়ে হয়ে যেত।

এইরকম ইংরেজের ভয়ে বনের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকতে হত না।

কিছুক্ষণ পরেই তারা মাথাটা ঝেড়ে চিন্তা দূর করার চেষ্টা করল।

ছি, ছি, এসব কী ভাবছে।

কালু সর্দার তাকে দলের ভার দিয়ে গেছে। বাশুলি-মায়ের পা ছুঁয়ে তারা এই দায়িত্ব মাথায় নিয়েছে। সমস্ত দলের মঙ্গল-অমঙ্গল চিন্তা তার।

এই দলের প্রত্যেকটি মানুষ তারার একটি কথায় প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে।

দলের চিন্তা ছেড়ে তারা নিজের চিন্তা করছে।

তারা বাশুলি-মায়ের নাম জপ করতে শুরু করল। যাতে অন্য চিন্তা ধারেকাছে না আসে।

পরের দিনই তারা দলের সর্দারদের ডেকে পাঠাল।

তারা আসতে বলল, সত্যিই আমরা বড়ো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি। আবার জোর দিয়ে তোমরা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, বন্দুকের তাগ শুরু করো।

মেঘা বলল, এই সময় হইহই করাটা কি ঠিক হবে তারা-মা? আপাতত ইংরেজের চর ধারেকাছে নেই বটে, কিন্তু কখন কোথা দিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক আছে?

তারা গম্ভীরকণ্ঠে বলল, একদিন তো মরতেই হবে মেঘা। ইংরেজ তাড়া করে টুঁটি চেপে ধরে বন্দুকের গুলিতে মারবে, তার চেয়ে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করতে করতে মরব। আমরা বাশুলি-মায়ের আশ্রিত। মরতে আমাদের ভয় নেই।

সারা দল আবার মেতে উঠল।

মাঝে মাঝে তারাও নেমে যেত তাদের সঙ্গে।

পাকা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলত, নাও, তোমরা ঢেলা ছোড়ো। লাগাও আমার গায়ে, দেখি।

চারদিক থেকে ঢিল পড়ত, কিন্তু একটাও তারার শরীর ছুঁতে পারত না। লাঠির ঘায়ে সব গুঁড়িয়ে যেত।

সারাটা দিন তীব্র উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাটত, কিন্তু রাত হলেই তারা একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়ত।

বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করত। ঘুম আসত না। অদ্ভুত সব ছবি চোখের সামনে ভাসত।

দিনকয়েক পরেই তারা বলল, এবার ঘটা করে বাশুলি-মায়ের পূজা করব।

পুরোহিত বলল, কিন্তু মা, এ তো মায়ের পূজার সময় নয়।

তারা একটু ইতস্তত করে বলল, কাল রাত্রে মা স্বপ্ন দিয়েছেন। পূজা চান।

এর ওপর আর কথা চলে না।

পুরোহিত বলল, ঠিক আছে মা, সামনের অমাবস্যাতেই ব্যবস্থা করব।

তবে একটা কথা।

পুরোহিত ফিরে দাঁড়াল। কী মা?

এবার আর চারপাশের গাঁয়ের লোকদের বলার দরকার নেই। দিনকাল খারাপ। ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে শত্রুর চর ঢুকে পড়া বিচিত্র নয়।

তা-ই ঠিক হল। মায়ের পূজায় এবার আর অতিথিভোজন হবে না। শুধু মন্দিরের মধ্যে পূজার উৎসব।

সকাল থেকে তারা একলা পূজার সব কাজকর্ম করল। মালা গাঁথা, ফল কাটা, নৈবেদ্য সাজানো।

তারপর পুরোহিত যখন পূজায় বসল, তখন তারা তার পাশে বসল। দুটি চোখ নিমীলিত, দুটি হাত বুকের উপর জড়ো করা।

মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে তারার শরীর দুলতে লাগল। চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল।

আশপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, মেঘা, চৈতন, পরান তারা সবাই অবাক হয়ে গেল।

পূজা শেষ হবার পরও তারা আবিষ্টের মতন চুপচাপ বসে রইল।

তারপর একসময়ে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই, একজন চর এসে নমস্কার করে বললে, খবর আছে মা।

খবর? কীসের খবর?

এক জমিদার শ্রীক্ষেত্র যাচ্ছেন। সঙ্গে অনুচরের সংখ্যা খুব কম। তবে গোপনে প্রচুর অর্থ নিয়ে চলেছেন। নিজে একেবারে গৈরিক পোশাক পরেছেন। গলায়, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। সঙ্গে বিগ্রহ। বিগ্রহ শ্রীক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছেন। জগন্নাথদেবকে স্পর্শ করিয়ে ফিরিয়ে এনে নিজের জমিদারিতে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

বোধহয় শ্রীক্ষেত্রে পূজা দেবার উদ্দেশ্যেই প্রচুর অর্থ নিয়ে চলেছেন। অনেকগুলো ঢোলকের মধ্যে অর্থ ভরে নেওয়া হয়েছে। যাতে কেউ সন্দেহ না করে।

তারা দলের চাঁইদের সঙ্গে বৈঠকে বসল।

খুব সম্ভবত জমিদারের ধারণা হয়েছে যে দুর্গাপুরে ডাকাতদের উৎপাত আর নেই। ইংরেজরা তাকে হয়তো এই কথাই বুঝিয়েছে। সেইজন্যই সঙ্গে জমিদার বেশি অনুচর নেয়নি।

এই আমাদের অপূর্ব সুযোগ। কোম্পানির বরকন্দাজ যে-কোনও কারণেই হোক সরে গেছে। এতগুলো টাকা নির্বিবাদে আমাদের এলাকা পার হয়ে যাবে, এ কিছুতেই হতে দেওয়া উচিত নয়।

দলের সবাই চিৎকার করে তারাকে সমর্থন করল।

তারা বলল, চরের মুখে খবর পেলাম পুরন্দরপুরের চটিতে রাত কাটিয়ে জমিদার ভোরবেলা রওনা হবে। তার মানে এখান দিয়ে যাবে রাতের দ্বিতীয় প্রহরে। তোমরা সব তৈরি হয়ে নাও। এবার আর কোনও কৌশল নয়। সদলে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। তবে এ অভিযানের পুরোভাগে থাকব আমি।

এবারেও চাঁইরা হাতের লাঠি আকাশে তুলে তারার জয়ধ্বনি করল।

সন্ধ্যার একটু পর থেকেই সবাই তৈরি হতে শুরু করল। দলের আর সবাই মুখে কালি-ভুসো মেখে নিল, কেবল তারা ছাড়া।

সে হেসে বলল, না, আমি কিছু মাখব না। ওসব মেখেও নিজেকে লুকাতে পারব না। সবাই বুঝতে পারবে আমি মেয়ে। আর দুর্গাপুরের জঙ্গলে মেয়ে ডাকাত এই একজনই আছে, তারা।

বেশ একটু অন্ধকার হতে সবাই রওনা হল।

ঘোড়ার পিঠে তারা। তাকে ঘিরে আর সবাই। প্রায় সকলের হাতেই বন্দুক, কোমরে ছোরা। শত্রু খুব কাছে এসে গেলে বন্দুকে সুবিধা হয় না, তখন ছোরাই ভালো। শুধু তারা হাতে বর্শা নিল। অবশ্য তার কোমরেও ছোরা।

আজ প্রায় সারাদুপুর তারা বাশুলির মন্দিরে কাটিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতজোড় করে বসে থেকেছে মূর্তির সামনে। পুজো দিয়েছে।

এতদিনের গড়ে-তোলা একটা দলের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তার কারণ শুরু হয়েছে। তারার অধিনায়কত্বের সময় যদি দল ভেঙে দিতে হয়, বা দল ধরা পড়ে তাহলে তারার লজ্জা সবচেয়ে বেশি।

সেই অপমান যেন তার জীবনে না আসে, তারা বাশুলি-মায়ের কাছে সেই প্রার্থনাই জানিয়েছিল।

ঝোপের পিছনে সবাই বসল।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। এধারে-ওধারে শুধু জোনাকির মেলা। একটু দূরে দূরে শেয়াল ডেকে চলেছে। মশার উৎপাতও বড়ো কম নয়। দলের প্রায় সবাই গায়ে বেশ করে সরষের তেল মেখে আসে। মশা যাতে গায়ে বসতে না পারে। আর-একটা কারণও আছে। কেউ ধরলে যাতে পিছলে যেতে পারে।

শুধু একটা জিনিসে তাদের একটু ভয়। সাপ। এ জঙ্গল বিষধর সাপের আস্তানা। যাদের স্পর্শে মৃত্যু। তাই মাঝে মাঝে সবাই বন্দুকের বাঁট মাটিতে ঠুকছিল। শব্দে যাতে বিষধর না আসে।

অনেকক্ষণ পরে পথের বাঁকে আলো দেখা গেল। মশালের আলো। সবাই টান হয়ে দাঁড়াল।

তার একটু পরেই বট আর পাকুড় গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল দুজন মশালধারী ছুটে আসছে। তার পিছনে গোটা চারেক অস্ত্রধারী পাইক। তাদের মাঝখানে পর পর দুটো পালকি।

দুটো পালকি দেখে তারা একটু চিন্তিত হল। দুটো কেন? একটায় সম্ভবত জমিদার, আর-একটায়?

এমন তো নয়, একটা পালকিতে ইংরেজের সশস্ত্র সৈনিক কিংবা রবার্ট সাহেব নিজেই রয়েছে বন্দুক উঁচিয়ে।

এতখানি এগিয়ে এসব চিন্তা করার কোনও মানে হয় না। এখান থেকে ফিরে যাওয়া মানে অপমানের চূড়ান্ত। দলের লোকরা মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু মনে মনে টিটকারি দেবে এমন সর্দারকে যে পিছিয়ে আসে। পিছিয়ে আসার মানেই বেইজ্জত হওয়া।

তারা বলল, তোমাদের বন্দুকে গুলি ভরা আছে তো?

সবাই ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ আছে।

ওই দেখো পর পর দুটো পালকি আসছে। এমনও হতে পারে একটাতে বন্দুক নিয়ে ইংরেজ সিপাই বা খোদ রবার্ট সাহেবও থাকতে পারে। আমাদের খুব সাবধানে আক্রমণ করতে হবে। শোনো, কাছাকাছি গিয়ে আমরা যেমন হুংকার ছাড়ি, তেমনই ছাড়ব। দেখা যাক, পালকির দরজা খুলে কেউ উঁকি দেয় কি না।

তা-ই হল, সড়কের কাছাকাছি গিয়েই সবাই বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল।

বাশুলি-মায়ের জয়! তারা-মায়ের জয়!

কাজ হল। অনুচরগুলো থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মশালধারীরা জোরে জোরে পা ফেলে রাস্তা ছেড়ে নাবাল জমি বেয়ে চলতে আরম্ভ করল।

প্রথম পালকির দরজা খুলে গেল।

গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, রামলাল আমাকে বন্দুকটা দাও।

পাশের অনুচর বন্দুকটা পালকির দরজার দিকে এগিয়ে দিল।

বোঝা গেল প্রথম পালকিতে জমিদার। কিন্তু পরের পালকির দরজা খুলল না।

তারার সন্দেহ দৃঢ়তর হল। সাধারণত ডাকাতদের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সবাই পালকির দরজা খুলে ব্যাপারটা জানবার চেষ্টা করে, কোন দিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে। যারা আক্রমণ করছে তারা সংখ্যায় কতজন।

তারা ফিসফিস করে বলল, তোমরা বন্দুক নিয়ে দ্বিতীয় পালকিটা ঘিরে ফেলো। আমার মনে হচ্ছে ভিতরে গোলমেলে ব্যাপার আছে। দুজন শুধু আমার সঙ্গে এসো। জমিদারকে আমি শায়েস্তা করতে পারব।

একসঙ্গে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তারা বর্শা দিয়ে প্রবলবেগে জমিদারের কবজির ওপর আঘাত হানল। তার বন্দুকটা ছিটকে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে গেল।

জমিদার চিৎকার করে উঠল, খবরদার আমার বিগ্রহ কেউ স্পর্শ করবে না। তোমরা নীচ, মহাপাতকী, তোমরা বিগ্রহ স্পর্শ করলে বিগ্রহ অপবিত্র হয়ে যাবে। সে বিগ্রহ আমি প্রতিষ্ঠা করতে পারব না।

জমিদার বিগ্রহ আগলে পালকির মধ্যে উপুড় হয়ে রইল।

তার হাতের ফাঁক দিয়ে তারা স্পষ্ট দেখতে পেল, শুধু বিগ্রহ নয়, গোটা তিনেক বড়ো আকারের ঢোলকও রয়েছে পাশাপাশি।

তাহলে চর মোটেই ভুল খবর দেয়নি। ওই ঢোলক ভরতি সোনা আর টাকা।

সরে যাও, নইলে খতম করে দেব।

নিজের কণ্ঠের কর্কশতায় তারা নিজেই বিস্মিত হল। যেভাবে জমিদার তাদের নীচ, মহাপাতকী বলে গালিগালাজ করেছে, তাতে এমনিতেই তার মেজাজ রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর বিগ্রহ সামলানোর নাম করে জমিদারের অর্থ বাঁচাবার চেষ্টা দেখে তারা ধৈর্য হারাল।

না, কিছুতেই নয়। আমাকে না মেরে আমার বিগ্রহ ছুঁতে পারবে না।

বেশ, তা-ই হোক।

তারা সবলে হাতের বর্শা জমিদারের পিঠে ঢুকিয়ে দিল। একটা আর্তনাদ, ফিনকি দিয়ে রক্তস্রোত ছুটল। তারার শাড়ি ভিজে গেল সেই রক্তে। এতক্ষণ বাহকরা পালকি ধরে থরথর করে কাঁপছিল, এবার পালকি ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারল তিরবেগে ছুটতে লাগল।

পিছনের পালকিটা বাহকরা আগেই রাস্তার ওপর রেখে পালিয়েছিল। ডাকাতের দল পালকিটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল আর মাঝে মাঝে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পালকির গায়ে আঘাত করছিল। সাহেব বেরিয়ে আসবে এই আশায়।

.