উপন্যাস
গল্প

অরণ্য-বিভীষিকা – ১

এক

লোহার আলমারিটা খোলবার আগে রাজনারায়ণ ঘরের দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিলেন। বাইরের কোনও লোক দেখতে না পায়। ঘরের মধ্যে শুধু দুজন। রাজনারায়ণ আর তাঁর স্ত্রী মহামায়া।

পইতায় বাঁধা চাবিটা দিয়ে রাজনারায়ণ আলমারি খুললেন, তারপর ছোটো একটা ড্রয়ার খুলে মাঝারি সাইজের ক্যাশবাক্স বের করলেন।

মহামায়ার দিকে ফিরে বললেন, এসো, এগিয়ে এসো। নায়েব দুপুরবেলা কলকাতা থেকে সব নিয়ে এসেছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে তোমাকে তখন আর ডাকিনি। আলমারির ভিতর তুলে রেখেছি।

মহামায়া এগিয়ে এসে আলমারির সামনে পা মুড়ে বসল।

রাজনারায়ণ এক-এক করে ক্যাশবাক্স থেকে নামিয়ে সিল্কের কাপড়ের ওপর রাখলেন।

সীতাহার, রতনচূড়, মান্তাশা, কঙ্কণ, হাঙরমুখো অনন্ত, চন্দ্রহার, কান, সিঁথিমৌর, তোড়া। ঝাড়লন্ঠনের আলোয় গহনাগুলো ঝকঝক করে উঠল। মহামায়া খুব খুশি।

পশুপতি স্যাকরার হাতের কাজ ভারী চমৎকার। সোনা তো নয় যেন আগুন। কী ঝকঝকে পালিশ। আমার তো মনে হয় সূর্যকান্তবাবুরা গহনা দেখে খুবই আনন্দ পাবে।

রাজনারায়ণ মাথা নাড়লেন।

এর ওপর করকরে মোহর আছে। সেগুলো থলিতে মজুত। সম্প্রদানের সময় বাবাজির সামনে রাখব। তা ছাড়া আরও একটা জিনিস—

খুট করে একটা শব্দ।

বাইরের বারান্দায় কী একটা এসে পড়ল।

রাজনারায়ণ তাড়াতাড়ি গহনাপত্র আলমারিতে তুলে ফেললেন। চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিলেন আলমারি। কী হল? মহামায়া অবাক হয়ে গেল।

কী একটা আওয়াজ হল বারান্দায়। দেখে আসি। দরজা খুলে রাজনারায়ণ বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। মহামায়া চুপচাপ বসে রইল ঘরের মধ্যে।

মিনিট পাঁচেক পরে রাজনারায়ণ যখন ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন, তখন তাঁকে দেখে মহামায়া চমকে উঠল।

পাংশু মুখ, বিস্ফারিত দুটি চোখ, ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। কী হল?

রাজনারায়ণ কোনও উত্তর দিলেন না। একটা হাত মহামায়ার দিকে এগিয়ে দিলেন। হাতের মুঠোয় একটা তির। তিরের আগায় একটা কাগজের টুকরো।

মহামায়া ঠিক কিছু বুঝতে পারল না। চিঠিটাই বা কীসের? কালু সর্দারের চিঠি।

বিরাট ঘরে রাজনারায়ণের গম্ভীর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

আর কিছু বলতে হল না। আর কিছু বলার দরকারও ছিল না।

কালু সর্দারের নামেতেই বিশখানা গাঁয়ের লোক থরথরিয়ে কাঁপত। কোনও শক্তি নেই কালুকে বাধা দিতে পারে। কোনও অস্ত্র নেই যাতে কালুর পরমায়ু হরণ করতে পারে। এটাই ছিল সকলের বিশ্বাস।

কালু সর্দার কোথাও আসবার আগে চিঠি লিখে তার দিনক্ষণ জানাত। পাইক, বরকন্দাজ, লোকলশকর যতই তৈরি থাক, কালু সর্দারের দল ঠিক কাজ হাসিল করে যাবেই। তাকে কেউ আটকাতে পারত না।

আটকাতে যে পারত না, তার কারণও ছিল। সবাই বলে কালু মা বাশুলির পুত্র। মায়ের পুজো দিয়ে, পূজার সিঁদুর কপালে নিয়ে সে ডাকাতিতে বের হত, সেইজন্য সে ছিল অবধ্য। কোনও অস্ত্র তার ত্রিসীমানায় আসতে পারত না।

রনপায় ভর দিয়ে কালু চলাফেরা করত। এক-একরাতে বিশ-ত্রিশ মাইল দূরে ডাকাতি করে নির্বিঘ্নে নিজের আস্তানায় ফিরে আসত। গায়ে একটা আঁচড়ও লাগত না।

এখন যেখানে দুর্গাপুরের কারখানা, জমজমাট শহর, অনেক বছর আগে সেখানে অজগর বন ছিল। দিনের বেলাও সূর্যের আলো প্রবেশ করত না। অবিশ্রাম ঝিঁঝি ডাকত। ভয়ংকর জন্তুজানোয়ার তো ছিলই, তার চেয়েও মারাত্মক ছিল ডাকাত আর ঠ্যাঙাড়ের দল।

কেউ পথ ভুলে সে জঙ্গলে ঢুকলে প্রাণ নিয়ে আর বের হতে পারত না।

দুর্গাপুরের সেই গভীর জঙ্গল ছিল কালু সর্দারের ডেরা।

অনেককালের পুরোনো এক বিশালাক্ষীর মন্দির ছিল। আশপাশের লোকেরা বলত বাশুলির মন্দির। বিরাট আটহাত কালীমূর্তি। মূর্তির দুটো চোখ আর লকলকে জিভ দেখলে অনেক সাহসী লোকেরও বুকের রক্ত হিম হয়ে যেত। তারই কাছে কালু সর্দার থাকত।

কালু একলা নয়, তার সঙ্গে থাকত তার একশো অনুচর। বেশির ভাগই বাগদি আর আগুরি। তাদের লাঠি হাতে থাকলে বন্দুকের গুলিও দেহ ছুঁতে পারত না।

অনেকবার কালু কোম্পানির টাকা লুঠ করেছে।

অবশ্য চিঠি দিয়ে নয়, আচমকা। বিহার থেকে বাংলায় খাজনার টাকা আসছিল, পালকিতে, চারপাশে অশ্বারোহী সিপাই। হাতে গাদা বন্দুক। এ ছাড়াও বর্শা হাতে আরও লোক থাকত।

পাশে গভীর জলা, জঙ্গল। ছোটো ছোটো টিলা।

হঠাৎ একেবারে ‘বাশুলি মায়িকি জয়’ বলে বন্যার স্রোতের মতন কালু সর্দারের দল দু-দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

বন্দুকধারী সিপাইরা অবসরই পায়নি। তারা সচেতন হবার আগেই ভোজালি আর বর্শায় কারো মুণ্ড দেহচ্যুত, কারো বা শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল।

তারপর কালু সর্দারের অনুচরদের পক্ষে টাকার থলি নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়া মোটেই শক্ত হয়নি।

একবার শুধু কোম্পানি খেপে গিয়েছিল।

সেবার পালকির মধ্যে টাকা আগলে নিয়ে যাচ্ছিল এক লালমুখো সাহেব। মিস্টার কানিংহাম।

গোলমাল শুরু হতেই কানিংহাম দু-হাতে দুটো পিস্তল নিয়ে পালকি থেকে লাফিয়ে পড়েছিল।

অসীম সাহস ভদ্রলোকের, তেমনি অদ্ভুত লক্ষ্য।

কালু সর্দারের ডান হাত গগন দলুই। খুব ভালো তলোয়ার খেলত। পিস্তলের এক গুলিতে তার চোয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল কানিংহাম। তারপর আর-একটা গুলিতে বিজয় সামন্ত মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল। বিখ্যাত লাঠিয়াল বিজয়।

কালু সর্দার একটু দূরে রনপার ওপর ভর দিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। ব্যাপার দেখে রনপা চড়েই হুংকার দিয়ে কানিংহামের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

এত আচমকা যে কানিংহাম একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।

কালু সর্দার তার মাথার অনেক ওপরে।

পিস্তল উঁচু করার আগেই কালু খাঁড়া দিয়ে কানিংহামের মাথাটা দু-ফাঁক করে দিয়েছিল।

তারপর কোম্পানির সিপাই আর কেউ দাঁড়ায়নি। ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পেরেছিল, পালিয়েছে। সেই সময় কোম্পানি খেপে উঠেছিল।

কলকাতা থেকে একগাদা সিপাই এসেছিল বন্দুক, বল্লম, সড়কি নিয়ে।

ওপরওয়ালার হুকুম ছিল যেমন করে হোক সাহেব মারার প্রতিশোধ নিতেই হবে।

কোম্পানির সিপাই কিন্তু বনের মধ্যে কিছুটা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

শুধু ঝিঁঝি আর তক্ষকের আওয়াজ। মাঝে মাঝে বানরদের এক ডাল থেকে আর-এক ডালে লাফিয়ে পড়ার শব্দ। কোথাও জনমানব নেই। দিনের বেলাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। বার বার পায়ে বুনো লতা জড়িয়ে গেল।

যেসব সিপাইরা ঘোড়ায় চড়ে ভিতরে ঢুকেছিল, তাদের ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে সামনের পা তুলে চিঁহি করে উঠল।

হিন্দু সিপাইরা বলল, এ জঙ্গলে ভূত আছে হুজুর। আমরা আর এগোব না। মুসলমান সিপাইরা বলল, এটা শয়তানের এলাকা। আমরা ফিরছি। সবাই ফিরে এসেছিল।

সেই কালু সর্দার, যাকে লোকে যমের দোসর বলে মনে করে, সে চিঠি পাঠিয়েছে রাজনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি।

ব্যাপারটা যথেষ্ট ভয়ের তো বটেই। মহামায়া প্রশ্ন করল, কী লিখেছে চিঠিতে?

একটু কেশে রাজনারায়ণ গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন।

বাতির তলায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে চিঠিটা পড়তে লাগলেন।

.

যথাবিহিত সম্মানপুরঃসর নিবেদনমেতৎ,

মহাশয়,

আগামী অমাবস্যার রাত্রে বাশুলি মায়ের পূজার আয়োজন করিয়াছি। আমি মায়ের দীন সেবক। মায়ের পূজার ব্যয় বহন করিবার সামর্থ্য আমার নাই। সেইজন্য আপনার নিকট ভিক্ষা চাহিতেছি। অমাবস্যার আগের রাত্রি দ্বিপ্রহরে আপনার আলয়ে উপস্থিত হইব, আপনি অনুগ্রহপূর্বক অর্থ, রত্ন, অলংকারাদি লইয়া প্রস্তুত থাকিবেন। মায়ের কর্মে বাধা প্রদান করিয়া কোনওরূপ অশান্তি সৃষ্টি করিবেন না বলিয়াই বিশ্বাস করি।

দীনের প্রণাম গ্রহণ করিবেন।

 বিনীত

 বাশুলি মায়ের সেবায়েত

 কালু।

.

একবারে নয়, থেমে থেমে রাজনারায়ণ চিঠি পড়া শেষ করলেন।

মহামায়া প্রস্তরমূর্তির মতন পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

রাজনারায়ণ থামতে মহামায়া বলল, এই কি ডাকাতির চিঠি?

হ্যাঁ, কালু সর্দার এইভাবেই সকলকে চিঠি লেখে। পূজার সাহায্য চেয়ে। আমার মনে হয়, তারার বিয়ের জন্য কলকাতা থেকে গহনাগাটি এনেছি, মহাল থেকে কাঁচা টাকা, সবই কালু জানতে পেরেছে। তার চর সর্বত্র। সেইজন্যই এ বাড়িতে চড়াও হতে চায়।

কী হবে? এবার মহামায়ার কণ্ঠে কান্নার সুর।

মহামায়ার কথার কোনও উত্তর রাজনারায়ণ দিলেন না। দরজা দিয়ে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন, ভৈরব, ভৈরব।

মিনিটকয়েক পরেই সামনের সিঁড়ি দিয়ে এক লাঠিয়াল উঠে এল। কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল। গলায় লাল পাথরের মালা। লাল পাথরের মতনই আরক্ত দুটি চোখ। হাঁটু পর্যন্ত খাটো হলুদ রঙের ধুতি। কোমরে গামছা। হাতে তেল-চুকচুকে লাঠি।

বারান্দায় এসেই লাঠিটা রাজনারায়ণের পায়ের কাছে রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, ডেকেছেন হুজুর?

নায়েবমশাইকে একবার ডেকে দে। সদরে আসতে বল।

ভৈরব নেমে যেতে খড়ম পায়ে দিয়ে রাজনারায়ণও নেমে গেলেন। একতলায়, সদরে।

বিরাট তক্তপোশ পাতা। ইতস্তত কয়েকটা তাকিয়া। একপাশে একটা আলবোলা। দেয়ালে অনেকগুলো তৈলচিত্র। রাজনারায়ণের পূর্বপুরুষদের।

রাজনারায়ণ তক্তপোশের ওপর একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসলেন।

থানা এখান থেকে প্রায় বিশ ক্রোশ। সেখান থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে এমন আশা দুরাশা। একটি দারোগা আর গুটি দুই-তিন সিপাই, এরা আর বিপদে কি সাহায্য করতে পারে?

অমাবস্যার আর ঠিক পাঁচ দিন বাকি। তার মানে কালু সর্দার আসবে চার দিন পরেই। যা কিছু ব্যবস্থা এর মধ্যেই করে ফেলতে হবে।

রাজনারায়ণ একবার ভাবলেন, অলংকার, অর্থ সমস্ত কলকাতায় সরিয়ে ফেলবেন, কিন্তু তারপরই মনে হল, তাতে বিপদ আরও বেশি। কালু সর্দারের চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি। টাকা আর অলংকার কোনওদিনই কলকাতায় পৌঁছাবে না। পথেই কালু সর্দারের লোকের হাতে পড়বে।

কী ব্যাপার, এমন অসময়ে ডেকেছেন? নায়েব এসে তক্তপোশের পাশে দাঁড়াল।

রাজনারায়ণ মুখ তুলে দেখলেন, তারপর বললেন, বসুন নায়েবমশাই। আপনি আজই কলকাতা থেকে ফিরেছেন, নিশ্চয় খুব ক্লান্ত।

নায়েব স্বীকার করল, একটু পরিশ্রান্ত বোধ করছি অবশ্য। সারাটা পথ নৌকায়। গঙ্গার অবস্থাও খুব শান্ত ছিল না। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো গহনাপত্রের কি কোনও গরমিল হয়েছে? আমি তো দু-দুবার তালিকা দেখে মিলিয়ে নিয়েছি।

না, না, রাজনারায়ণ হাত নাড়লেন, সেসব কিছু নয়। গহনাপত্র ঠিক আছে। আপনার কাজ চিরদিনই নিখুঁত। এটা দেখুন।

তাকিয়ার তলা থেকে রাজনারায়ণ তিরবিদ্ধ চিঠিটা বের করে নায়েবের দিকে এগিয়ে দিলেন।

একবার ঝুঁকে চিঠির কোণে রক্তাক্ত খাঁড়ার চিহ্ন দেখেই নায়েব শিউরে উঠল, সর্বনাশ, এ তো কালু সর্দারের চিঠি। এ আপনি কোথা থেকে পেলেন?

একটু আগে তিরটা ওপরের বারান্দায় এসে পড়ল। বাইরে থেকে কেউ ছুড়েছে।

নায়েব পিরানের পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে লাগিয়ে নিল। অনেকক্ষণ ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ল।

তারপর রাজনারায়ণের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, এখন উপায়?

উপায়ের ব্যাপারেই তো আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।

নায়েব গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, আমাদের তৈরি থাকা ছাড়া আর কী উপায় আছে?

কিন্তু কালু সর্দারের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কেউই তো তৈরি থেকেও পার পায়নি। কালু যা বলেছে, তা করেছে।

তা বলে নিশ্চেষ্ট হয়ে ফটক খুলে তাকে তো আর আহ্বান জানানো যায় না। আমাদের ভিল, সাঁওতাল আর যত লেঠেল প্রজা আছে সব এখানে এনে জড়ো করব, পাহারা দেবার জন্য। তারা আপনার জন্য জান দেবে। দেখি কী করে কালু এখানে ঢোকে। আর ধন-অলংকারের আপনি অন্য ব্যবস্থা করুন।

কী ব্যবস্থা?

নায়েব আস্তে আস্তে উঠে বাইরে গেল। তীক্ষ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে এদিক-ওদিক দেখল তারপর আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে চাপাকণ্ঠে বলল, আপনি সবকিছু চোরাকুঠুরিতে চালান দিন। আর পূজার সময় বারোয়ারি যাত্রাদলের যে মেকি গহনা আমাদের কাছে আছে, সেইগুলোই আপনার আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে হবে।

রাজনারায়ণের মুখ দেখে মনে হল নায়েবের এ ব্যবস্থায় তিনি কিছুটা সন্তাোষ লাভ করেছেন।

বললেন, বেশ, আপনার কথামতোই ব্যবস্থা করে দেখি। আর-একটা কথা নায়েবমশাই।

বলুন।

এ চিঠির কথা আপনি পাঁচকান করবেন না। কে শত্রু কে মিত্র চেনা দুষ্কর।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন হুজুর। দ্বিতীয় ব্যক্তি এ সম্বন্ধে কিছু জানবে না।

নায়েব বেরিয়ে যেতে রাজনারায়ণ উঠে পড়লেন।

ওঠবার মুখেই বিপত্তি।

অন্দরের পরিচারিকা বিরজা দ্বারপথে এসে দাঁড়াল।

হুজুর, একবার শিগগির ওপরে আসুন।

রাজনারায়ণ একটু অন্যমনস্ক ছিলেন। বিরজার চিৎকারে চমকে উঠলেন।

কী, কী হল?

মা-র ফিট হয়েছে।

ফিট! বিরজার পিছন পিছন রাজনারায়ণ দ্রুতপায়ে ওপরে উঠে এলেন।

ঘরের মাঝখানে মহামায়া শুয়ে। তাকে ঘিরে আরও দুজন পরিচারিকা। বোধহয় মহামায়ার মাথায় জল ঢালা হয়েছিল। ঘরের মেঝে জলে ভরতি।

এমন ফিট মহামায়ার মাঝে মাঝে হয়। কোনও শোক বা ভয় পেলে। এবার অনেকদিন হয়নি।

কবিরাজ একটা ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু সে ওষুধ খাওয়ানোই মুশকিল। এই সময় দাঁতে দাঁতে এমন আটকে যায়, মুখই খোলা যায় না।

রাজনারায়ণ ওষুধটা এনে বিরজার হাতে দিয়ে বললেন, এখনই এটা খাইয়ে দাও। তারা কোথায়, তারা?

একজন পরিচারিকা বলল, দিদিমণি ঠাকুরঘরে।

এত রাত পর্যন্ত ঠাকুরঘরে?

কথাটা বলেই রাজনারায়ণ বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি। রাজনারায়ণের গৃহদেবী। দু-বেলা পূজা হয়, আরতি।

পুরোহিতের সঙ্গে তারাই থাকে। সব ব্যবস্থা করে দেয়।

গৃহদেবীর সঙ্গে মিল রেখেই রাজনারায়ণ মেয়ের নাম রেখেছিলেন তারা। মেয়ে সামান্য শ্যামাঙ্গী, কিন্তু অপরূপ লাবণ্যময়ী। দীর্ঘকেশ, আয়তলোচন।

পণ্ডিতরা গণনা করে বলেছেন, তারার দেবী অংশে জন্ম। এ মেয়ে ঐশী সম্পদের অধিকারিণী।

তারা যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়াল, তখন মহামায়া উঠে বসেছে। পরিচারিকারা সরে গেছে সে ঘর থেকে। তারা একবার মা-র দিকে চেয়ে বাবাকে প্রশ্ন করল।

মা-র কী হয়েছে বাবা?

হঠাৎ আবার ফিট হল আজকে।

কেন? আজ হল কেন?

কেন হল, তার উত্তর মেয়েকে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই তিনি শুধু বললেন, কী জানি, বুঝতে পারছি না। রাত অনেক হয়েছে, তোমরা শুতে যাও।

মহামায়াকে ধরে তারা বাইরে চলে গেল।

রাজনারায়ণ বারান্দায় গিয়ে এদিক-ওদিক দেখলেন। পাশেই আমবাগান। নিঝুম অন্ধকার। শুধু এখানে-ওখানে জোনাকির চুমকি। দেউড়িতে লাঠি হাতে ভৈরব পায়চারি করছে।

বারান্দায় দরজা বন্ধ করে রাজনারায়ণ আবার আলমারি খুললেন। ক্যাশবাক্সটা সাবধানে বের করে নিয়ে এদিকের দরজা দিয়ে বাইরে এলেন।

ঘোরানো সিঁড়ির কাছে দেয়ালের গায়ে বিরাট এক তৈলচিত্র। অশ্বারোহী এক যোদ্ধার। রাজনারায়ণের পূর্বপুরুষদের একজন, যিনি একসময়ে বর্গির আক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।

রাজনারায়ণ এদিক-ওদিক দেখে চিত্রের পায়ের কাছে জুতার ওপর সজোরে টিপে ধরলেন।

খট করে একটা শব্দ। তৈলচিত্র দরজার মতন খুলে গেল। ভিতরে আবছা সিঁড়ির থাক দেখা গেল। ক্যাশবাক্স বগলে করে রাজনারায়ণ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।

কিছুটা গিয়েই বেশ অন্ধকার। আর দেখা যায় না। রাজনারায়ণ হাতড়ে হাতড়ে পাশের কুলুঙ্গি থেকে চকমকি পাথর বের করলেন, তারপর পাথরে পাথরে ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে সিঁড়ির এককোণে রাখা মশাল ধরালেন।

সামনেই চোরাদরজা দেখা গেল। দরজা ঠেলে রাজনারায়ণ ভিতরে ঢুকলেন।

দেয়ালের গায়ে বিরাট সব গর্ত। তারই একটার মধ্যে ক্যাশবাক্সটা ঠেলে রেখে দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ঠুকঠুক করে কোথায় একটা আওয়াজ হল। ভ্রূ কুঞ্চিত করে রাজনারায়ণ ফিরে দাঁড়ালেন। পরিশ্রমে, উত্তেজনায় তাঁর কপাল বেয়ে দরদর করে ঘামের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। চওড়া বুক ওঠানামা করছে।

পায়ের শব্দ বলেই যেন মনে হল, কিন্তু এ চোরাকুঠুরিতে কোথা থেকে পায়ের শব্দ আসবে। এ চোরাকুঠুরির কথা জমিদারির দু-একজন শুধু জানে। রাজনারায়ণ, নায়েব আর ভৈরব। পরিবারবর্গের মধ্যে একমাত্র মহামায়া। তারাও জানে না।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেই রাজনারায়ণ বুঝতে পারলেন, সবই তাঁর মনের ভুল। নিজের বুকের স্পন্দনই তিনি শুনেছেন। বাইরের কোনও আওয়াজ নয়।

সিঁড়ি বেয়ে রাজনারায়ণ ওপরে উঠে এলেন।

তৈলচিত্র দেয়ালের সঙ্গে লেপটে ছিল। উলটোদিক থেকে হাতল ঘোরাতেই চিত্রটি খুলে গেল। রাজনারায়ণ এদিকে এসে আবার তৈলচিত্র আটকে দিলেন।

নিস্তব্ধ রাত্রি। কেউ কোথাও নেই। শুধু অন্ধকার আর স্তব্ধতা চিরে মাঝে মাঝে ভৈরবের হুংকার শোনা যাচ্ছে, হুঁশিয়ার!

এই চোরাকুঠুরি নির্মিত হয়েছিল বহুকাল আগে। যখন পাঠানদের অত্যাচারে মানুষের প্রাণ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কোনও কারণ নেই, প্ররোচনা নয়, হঠাৎ সৈন্যের দল ঘোড়া ছুটিয়ে জমিদারির মধ্যে ঢুকে পড়ত। শিশু-নারী-বৃদ্ধ তাদের অত্যাচারের কাছে কেউ রেহাই পেত না। ধনরত্ন তো ছিনিয়ে নিতই, প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলত।

সেই সময় বাড়ির মেয়েরা এই চোরাকুঠুরিতে আশ্রয় নিত। শিশুরাও। পুরুষরা দেউড়ি পাহারা দিত। প্রাণ দিত।

পাঠানের অত্যাচার থামতে, মোগলের গণ্ডগোল কিছুদিন শুরু হয়েছিল, কিন্তু সে খুব তীব্র নয়। শেষদিকে আরম্ভ হয়েছিল বর্গিদের তাণ্ডব। তখন আবার চোরাকুঠুরির প্রয়োজন হয়েছিল।

তারপর সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে কোম্পানি এল ব্যাবসা করতে। দাঁড়িপাল্লা হাতে এল বটে, কিন্তু নজর মসনদের ওপর।

তবে একটা কথা, দেশে কিছুটা শান্তি ফিরে এল। অহেতুক অত্যাচার বন্ধ হল।

কিন্তু একেবারেই কি বন্ধ হল? ডাকাতের দল উঠল। রঘু ডাকাত, বিশে ডাকাত, কেনারাম, সবশেষে এই কালু সর্দার। মানুষের ত্রাস।

এদের হাত থেকে রক্ষা পাবার কোনও উপায় কোম্পানি করতে পারল না। কোম্পানির লোক নিজেরাই এদের হাতে নাজেহাল হয়ে গেল। রাজনারায়ণ চোখ বন্ধ করলেন।

.

সকাল থেকে একটা ব্যস্ততার ভাব। অমাবস্যার আগের দিন।

তারার প্রথম নজরে পড়ল। খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে কালীর মন্দিরে যায় পূজার আয়োজন করতে। জবা ফুল তুলে মালা গেঁথে রাখে। ধূপ-ধুনো জ্বালায়। তারপর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত এসে হাজির হয়।

আবছা অন্ধকারে মন্দিরে যেতে যেতেই তারা লক্ষ করল সদর ফটক দিয়ে পিলপিল করে লোক ঢুকছে। পালপার্বণে যেমন আসে।

চোখ কুঁচকে ভালো করে দেখল, কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে টাঙ্গি, কারো বর্শা, কারো বল্লম। সকলেরই খালি গা। কাপড় মালকোঁচা দেওয়া। তারা অবাক হয়ে গেল।

এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেরাতেই দেখতে পেল ওপরের বারান্দায় রাজনারায়ণ দাঁড়িয়ে আছেন।

তারা ঘুরে বাপের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একদম কাছে নয়। কারণ স্নান সেরে এসেছে, এখন আর ঘরের মধ্যে ঢোকা উচিত হবে না।

বাবা!

কে রে?

আমি তারা।

কী খবর মা? রাজনারায়ণ অপুত্রক। একটিমাত্র সন্তান তারা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন।

তার ওপর আর কিছুদিন পরেই তারা পরের বাড়িতে চলে যাবে। জমিদার সূর্যকান্তবাবুর বাড়ি। এখান থেকে অনেক মাইলের পথ। তখন আর ইচ্ছা করলেই রাজনারায়ণ মেয়েকে দেখতে পাবেন না।

এত লোক এখানে ঢুকছে কেন বাবা? এত ভোরে?

রাজনারায়ণ প্রথমে ভাবলেন, মেয়েকে কিছু একটা মনগড়া কথা বলবেন, যাতে তারা ভয় না পায়। তারপর ভাবলেন, সত্যি কথাটা বলে দেওয়াই ভালো। তাতে মেয়ে মন শক্ত করে নিতে পারে।

রাজনারায়ণ মেয়ের দিকে একটু এগিয়ে কালু সর্দারের চিঠির কথাটা বলে দিলেন। আজ মাঝরাতে যে কালুর আসবার কথা আছে, তাও বললেন।

তারা মন দিয়ে সব শুনল, তারপর বলল, এসব হাঙ্গামা না করলেই তো ভালো ছিল বাবা।

হাঙ্গামা! মেয়ের কথা শুনে রাজনারায়ণ অবাক হয়ে গেলেন।

মিছামিছি হয়তো কতকগুলো প্রাণহানি হবে, তার চেয়ে কালু সর্দার যা চাইছে সেটা তাকে দিয়ে দিলেই হত। অলংকার আর অর্থ।

রাজনারায়ণ একবার তারার দিকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ফেরালেন। তারা এমনই মেয়ে। সাজসজ্জার দিকে কোনওদিন ঝোঁক নেই। টাকাপয়সা সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল নয়। মায়ের পূজা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পালপার্বণে উৎসবে কোমর বেঁধে প্রজাদের সেবায় মাতে।

দশ বছরের মেয়ে হলে হবে কী, চালচলনে আধবুড়িদের মতন। ধর্মের কথা শুনতে খুব ভালোবাসে। তার মুখেই এমন কথা শোভা পায়।

রাজনারায়ণ আর কিছু বললেন না। দুটো হাত পিছনে রেখে পায়চারি করতে লাগলেন। তারা আস্তে আস্তে সরে গেল বাপের সামনে থেকে।

বিকালবেলা মহামায়া এসে দাঁড়াল। বিবর্ণ, পাংশু মুখ।

আমরা কি চোরাকুঠুরির মধ্যে চলে যাব?

রাজনারায়ণ একটু খুশিই ছিলেন। প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুব পাকা হয়েছে। কালু সর্দার আর তার দল বিশেষ কিছু করতে পারবে এমন ভরসা কম।

জমিদারবাড়ির এলাকা লাঠিয়ালে ঘিরে ফেলেছে। প্রচুর মশালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দরকার হলে সব ক-টা জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।

রাজনারায়ণ গাদাবন্দুক হাতে সারারাত বারান্দায় পাহারা দেবেন। সঙ্গে নায়েবও থাকবে।

স্ত্রী-র দিকে মুখ তুলে বললেন, চোরাকুঠুরিতে এখন আশ্রয় নেবার কোনও দরকার নেই। সেরকম অবস্থা হলে আমি তোমাকে বলব। তুমি আর তারা পরিচারিকাদের নিয়ে শোবার ঘরে থেকো। সব জানলা-দরজা বন্ধ করে দিয়ো। চিৎকার-গোলমাল যদি কিছু শোনো, খবরদার বাইরে এসো না।

মহামায়া ঘাড় নেড়ে ভিতরে চলে গেল।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে সারা জমিদারবাড়িতে মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল। একটা ছুঁচ পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যায়। মানুষের নিশ্বাসের আওয়াজও যেন থেমে গেল।

রাত বাড়ল। প্রহরে প্রহরে শিয়ালের ডাক শোনা গেল। দ্বিপ্রহর পার হয়ে গেল।

ঠিক যে মুহূর্তে বারান্দায় বসে নিশ্চিন্ত নিশ্বাস ফেলে রাজনারায়ণ ভাবলেন, এই প্রথম বোধহয় কালু সর্দার কথা রাখতে পারল না, তখনই পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে উঠল। একটানা অনেকগুলো লোকের চিৎকার ছাপিয়ে হুংকার শোনা গেল, ‘বাশুলি মায়িকি জয়!’

রাজনারায়ণ বন্দুক হাতে টান হয়ে দাঁড়ালেন। পাশে নায়েব দাঁড়িয়ে পড়ে ইতস্তত দেখতে লাগল।

নীচে পাইকদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা। সবাই ফটকের কাছে এসে জড়ো হল।

একটু পরেই কে একজন খবর আনল, কালু সর্দারের দল নায়েবের ঘরে আগুন লাগিয়ে লুঠপাট শুরু করেছে।

নায়েব ব্যাকুলকণ্ঠে চিৎকার আরম্ভ করল, বাঁচান হুজুর, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আমার মেয়ে-জামাই কাল রাতে এসেছে। গয়নাগাটি তো রয়েইছে, তা ছাড়া কালু সর্দারের কাছে প্রাণের কোনও দাম নেই। এতক্ষণে বোধহয় সব শেষ করে দিল।

নায়েব দ্রুতপায়ে নীচে নেমে এল। পিছন পিছন রাজনারায়ণ।

নামতে নামতেই রাজনারায়ণ ভাবতে লাগলেন, সবটাই কালু সর্দারের চালাকি। জমিদারবাড়ি আক্রমণ করার ভয় দেখিয়ে নায়েববাড়ি চড়াও হয়েছে। লোকলশকর সব জমিদারবাড়িতে, নায়েবের বাড়ি একেবারে অরক্ষিত। কালু সর্দার সেই সুযোগের সদব্যবহার করতে চায়।

রাজনারায়ণের নির্দেশে পাইকের দল মশাল জ্বালিয়ে নায়েবের বাড়ির দিকে ছুটে গেল। আগে আগে নায়েব পাগলের মতন দু-হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে দৌড়োতে লাগল।

ঠিক সেই মুহূর্তে উত্তেজনার মুখে কেউ লক্ষ করল না, ঝাঁকড়া আম গাছের যে ডালগুলো জমিদারবাড়ির ছাদের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, সেই ডালগুলো বেয়ে কালো কালো কয়েকটা মূর্তি টুপটুপ করে ছাদের ওপর লাফিয়ে পড়ল।

রাজনারায়ণ নায়েবের বাড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ছাদের ওপর উঠলেন। মনে হল আগুন অনেকটা স্তিমিত, হল্লার শব্দও যেন কিছুটা কম।

তিনি যখন দূরের আকাশের দিকে চেয়ে ছিলেন, তখন লক্ষ করলেন না, যে একদল মুখোশ-আঁটা মানুষ নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।

যদিও মহামায়াকে নিষেধ করা হয়েছিল, হাজার গোলমালের আওয়াজেও সে যেন ঘর ছেড়ে না বের হয়, কিন্তু আর সে কৌতূহল দমন করতে পারল না।

পা টিপে টিপে চৌকাঠের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দেয়ালে লাগানো তৈলচিত্রটা ঠেলে কারা যেন চোরাসিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। আধো-অন্ধকারে মহামায়া তাদের ঠিক চিনতে পারল না।

চিৎকার করতে গেল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনও স্বর বের হল না। একটু পরেই দেখল লোকগুলো আবার তৈলচিত্র খুলে বেরিয়ে আসছে। মনে হল একজনের বগলে যেন ক্যাশবাক্সের মতন কী একটা রয়েছে।

এবার প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে মহামায়া চেঁচিয়ে উঠল, কে?

কোনও উত্তর নেই।

কে তোমরা? আবার মহামায়া চিৎকার করল।

ছায়ামূর্তিগুলো নক্ষত্রবেগে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।

এবার মহামায়া বেশ বুঝতে পারল কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। ক্যাশবাক্স নিয়ে দুর্বৃত্তরা সরে পড়ার চেষ্টা করছে।

মহামায়া সাহস করে ছাদের সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এল। যতটা সম্ভব উচ্চকণ্ঠে চেঁচাতে লাগল, ডাকাত পড়েছে, ডাকাত।

মহামায়ার চিৎকার এইবার ছাদে দাঁড়ানো রাজনারায়ণের কানে গেল।

তিনি ছুটে নামতে লাগলেন। কী হল? কী হল?

মহামায়ার আর চিৎকার করার শক্তি নেই। সেইখানেই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল।

ইচ্ছা করেই সেদিন সব বাতিদানে আলো দেওয়া হয়নি। যাতে কেউ আক্রমণ করলে কোথায় কোন ঘর তার হদিশ না পায়।

অন্ধকার রাত। তবু সেই অন্ধকারে মহামায়ার সাদা শাড়ির কিছুটা রাজনারায়ণের চোখে পড়ল। কে, মহামায়া?

মহামায়ার কণ্ঠ আর-একজনও শুনতে পেয়েছিল। সে ভৈরব। মশাল হাতে ভৈরব ছুটে ওপরে চলে এল।

সেই মশালের আলোতেই রাজনারায়ণ দেখতে পেলেন, তৈলচিত্রটি সরানো। চোরাকুঠুরির দরজা একেবারে খোলা।

.