সাত
বিশু মল্লিকের খাস কামরাটি আধুনিক প্রথায় টেবিল চেয়ার দিয়া সাজানো, বেশ ফিটফাট। আমরা উপবেশন করিলে তিনি টেবিলের দেরাজ হইতে সিগারেটের টিন বাহির করিয়া দিলেন।
বিশু মল্লিকের চেহারাটি অকিঞ্চিৎকর বটে, কিন্তু তাঁহার আচার-ব্যবহারে বেশ একটি আত্মপ্রত্যয়শীল ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, চোখ দু’টির অন্তরালে সজাগ শক্তিশালী মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলিতেছে তাহাও বুঝিতে কষ্ট হয় না। আমাদের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিয়া তিনি নিজে সিগারেট ধরাইলেন। টেবিলের সামনের দিকে বসিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, আপনি কি জন্যে সান্তালগোলায় এসেছেন তা আমি জানি। বোধহয় এখানকার সকলেই জানে। এখন বলুন আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। অবশ্য নীলকণ্ঠের কাছে আমার সম্বন্ধে সব কথাই শুনেছেন। যদি আমাকেই গোলাবারুদের আসামী বলে সন্দেহ করেন তাহলে আমার মিল খুঁজে দেখতে পারেন, আমার কোনও আপত্তি নেই।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘খোঁজাখুঁজির কথা পরে হবে। এখন আমার একটি ব্যক্তিগত কৌতূহল চরিতার্থ করুন। জকির কাজ ছেড়ে চালের কল করলেন কেন? যতদূর জানি জকির কাজে পয়সা আছে।’
বিশুবাবু বলিলেন, ‘পয়সা অবশ্য আছে কিন্তু বড় কড়াকড়ির জীবন, ব্যোমকেশবাবু। কখন ওজন বেড়ে যাবে এই ভয়ে আধ-পেটা খেয়ে জীবন কাটাতে হয়। আরও অনেক বায়নাক্কা আছে। আমার পোষাল না। কিছু টাকা জমিয়েছিলাম, তাই দিয়ে যুদ্ধের আগে এই মিল খুলে বসলাম। তা, বলতে নেই, মন্দ চলছে না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু ঘোড়ার মোহ ছাড়তে পারলেন না। এখানেও অনেকগুলি ঘোড়া পুষেছেন দেখলাম।’
বিশুবাবু ঈষৎ গাঢ়স্বরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ। আমি ঘোড়া ভালবাসি। অমন বুদ্ধিমান প্রভুভক্ত জানোয়ার আর নেই। মানুষের প্রকৃত বন্ধু যদি কেউ থাকে সে কুকুর নয়, ঘোড়া।’
‘তা বটে।’ ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল, ‘আমারও কুকুরের চেয়ে ঘোড়া ভাল লাগে। কত রঙের ঘোড়াই আছে; লাল সাদা কালো। তবে এদেশে লাল ঘোড়াই বেশি দেখা যায়, সাদা কালো তত বেশি নয়। এই দেখুন না, সান্তালগোলাতেই কত ঘোড়া চোখে পড়ল, কিন্তু সাদা বা কালো ঘোড়া একটাও দেখলাম না।’
বিশুবাবু বলিলেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। সাদা ঘোড়া এখানে একটাও নেই। তবে একটা কালো ঘোড়া আছে। বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর।’
‘বদ্রিদাস—সে কে?’
‘এখানে আর-একটা চালের কল আছে, তার মালিক বদ্রিদাস গিরধরলাল। তার কয়েকটা ঘোড়া আছে, তাদের মধ্যে একটা ঘোড়া কালো।’
ব্যোমকেশ সিগারেটের শেষাংশ অ্যাশ-ট্রেতে ঘসিয়া নিভাইয়া দিল। ঘোড়া সম্বন্ধে তাহার কৌতূহল নিবৃত্ত হইয়াছে এমনি নিরুৎসুক স্বরে বলিল, ‘কালো ঘোড়া আছে তাহলে। —যাক, এবার কাজের কথা বলি। আপনার কর্মচারীর কাছে কিছু খবর পেয়েছি, সে-সব কথা আবার জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করব না। সদানন্দ সুরের মৃত্যু-সংবাদ আপনি পেয়েছেন। ঘটনাক্রমে আমি তখন বাঘমারি গ্রামে ছিলাম। ভয়াবহ মৃত্যু।’
বিশুবাবু বলিলেন, ‘শুনেছি বোমা ফেটে মৃত্যু হয়েছে। আপনি দেখেছিলেন?’
ব্যোমকেশ সংক্ষেপে মৃত্যুর বিবরণ দিয়া বলিল, ‘এখন শুধু সদানন্দ সুরের মৃত্যুর কিনারা নয়, বোমারও কিনারা করতে হবে। আপনি বুদ্ধিমান লোক, এবিষয়ে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন।’
‘কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।’
‘আপনি এখানে অনেক দিন আছেন, এখানকার ঘাঁৎঘোঁৎ জানা আছে। মার্কিন সিপাহীর দল যখন এখানে ছিল, তখন আপনিও ছিলেন। আপনি বলতে পারেন কারা মার্কিন সিপাহীদের ছাউনিতে যাতায়াত করত?’
বিশুবাবু কিছুক্ষণ নতনেত্রে চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘মার্কিন সিপাহীদের ছাউনিতে কারুর যাতায়াত ছিল কিনা আমি বলতে পারি না, কিন্তু তাদের সর্বত্র যাতায়াত ছিল। ভারি মিশুক লোক ছিল তারা, আমার মিল-এও অনেকবার এসেছে।’
‘হুঁ। তারা আপনার কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করবার চেষ্টা করেছিল কি?’
বিশুবাবু একটু গম্ভীর হাসিলেন, ‘করেছিল। একজন সার্জেন্ট একটা পিস্তল বিক্রি করবার চেষ্টা করেছিল। আমি কিনিনি।’
‘আপনি কেনেননি, আর কেউ কিনেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, লোকটা কে। আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’
‘কিছু না। আন্দাজ করতে পারলে অনেক আগেই আপনাদের খবর দিতাম, ব্যোমকেশবাবু।’
ব্যোমকেশ আর একটা সিগারেট ধরাইয়া কিছুক্ষণ নীরবে টানিল, ‘আচ্ছা, আর একটা কথা। সান্তালগোলা ছোট জায়গা, এখানে মারণাস্ত্রগুলো যদি কেউ লুকিয়ে রাখতে চায় তাহলে কোথায় লুকিয়ে রাখবে আপনি অনুমান করতে পারেন?’
বিশুবাবু আবার কিছুক্ষণ চক্ষু নত করিয়া চিন্তা করিলেন, শেষে বলিলেন, ‘আপনার বিশ্বাস মারণাস্ত্রগুলো সান্তালগোলাতেই আছে। কিন্তু তা নাও হতে পারে।’
‘মনে করুন সান্তালগোলাতেই আছে।’
‘বেশ, মনে করলাম। কিন্তু অস্ত্রগুলোর আয়তন কতখানি, ক’টা বন্দুক ক’টা বোমা, এসব তো কিছুই জানি না। কি করে অনুমান করব? আমার মনে হয় পুলিস যদি সান্তালগোলার সমস্ত বাড়ি, সমস্ত গোলা আর চালের কল একসঙ্গে খানাতল্লাশ করে তাহলে হয়তো অস্ত্রগুলো বেরুতে পারে।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল, ‘তা কি সম্ভব! আর যদি সম্ভব হত তাহলেও একটা কথা ভেবে দেখুন। যে-ব্যক্তি এই কাজ করছে সে নির্বোধ নয়, সে কি এমন জায়গায় মাল রাখবে যেখানে পুলিস সহজেই খুঁজে বার করতে পারে? আমার তা মনে হয় না। লোকটি যদি এত নির্বোধ হত তাহলে অনেক আগেই ধরা পড়ে যেত।’
বিশুবাবু উৎসুক স্বরে বলিলেন, ‘তাহলে আপনার কী মনে হয়? কোথায় লুকিয়ে রাখতে পারে?’
ব্যোমকেশ খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘এমন জায়গায় রেখেছে যেখানে কারুর যেতে মানা নেই, অথচ কেউ যায় না, যেখানে দৈবাৎ মাল পাওয়া গেলেও প্রমাণ করা যাবে না কে রেখেছে?’
বিশুবাবু চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, ‘অর্থাৎ—?
ব্যোমকেশ পিছনের খোলা জানলা দিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিল, অর্থাৎ ওই জঙ্গল। ওখানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটা পিস্তল আর হ্যান্ড-গ্রিনেড পুঁতে রাখা খুব শক্ত কাজ নয়, কিন্তু খুঁজে বার করা অসম্ভব। যদি বা খুঁজে বার করলেন, কে পুঁতেছে কি করে প্রমাণ করবেন?’
বিশুবাবু উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন, ‘ঠিক, ঠিক। জঙ্গলের কথাটা আমার মাথায় আসেনি। নিশ্চয় জঙ্গলে কোথাও পোঁতা আছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু ভুল হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।’
বিশুবাবু বলিলেন, ‘না ব্যোমকেশবাবু, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার বিশ্বাস আর দেরি না। করে জঙ্গলটা খুঁজে দেখা দরকার।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই করতে হবে। তবে জঙ্গল তো একটুখানি জায়গা নয়, খুঁজতে সময় লাগবে। অনেক লোকও লাগবে। আজ আর হবে না, কাল—‘
এই পর্যন্ত বলিয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল। এতক্ষণ সে অসতর্কভাবে কথা বলিতেছিল, এখন যেন রাশ টানিয়া নিজেকে সংযত করিল; বিশুবাবুর পানে তীক্ষ্ণভাবে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘বিশ্বনাথবাবু, আজ আপনাকে বিশ্বাস করে এমন কথা কিছু বললাম যা বাইরের লোকের কাছে বক্তব্য নয়। আপনি বিশ্বাসযোগ্য লোক বলেই বলেছি। আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।’
বিশ্বনাথবাবু বলিলেন, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুবে না। উঠছেন নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, আজ উঠি। একবার ঐ মাড়োয়ারী—কি নাম? বদ্রিদাসের মিল-এ যাব। দেখি যদি ওর কাছে কিছু খবর পাওয়া যায়। বিকেলে আবার রামডিহি যেতে হবে, সেখানে সদানন্দ সুরের ভগিনীপতি থাকেন। —আচ্ছা, সদানন্দবাবু যে আপনার কাছে পাঁচশো টাকা ধার নিয়েছিলেন, কি জন্যে ধার চান কিছু বলেছিলেন কি?’
বিশুবাবু বলিলেন, ‘তাঁর ইচ্ছে ছিল এখানে কবিরাজী ওষুধের একটা দোকান খোলা। কিন্তু তাঁর মূলধন ছিল না, আমার কাছে ধার চেয়েছিলেন। লোকটি গরীব হলেও সজ্জন ছিলেন, আমি টাকা দিয়েছিলাম। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় টাকা শোধ দিতেন, কিন্তু—! যাকগে, ও-ক’টা টাকার জন্যে আমার দুঃখ নেই। আমি শুধু ভাবছি, সদানন্দবাবুর মতো নিরীহ লোককে কে খুন করল? কেন খুন করল? তবে কি তাঁর একটা প্রচ্ছন্ন জীবন ছিল? বাইরে থেকে যা দেখা যেত সেটা তাঁর প্রকৃত স্বরূপ নয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হয়তো তাই। এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আজ বিকেলে তাঁর ভগিনীপতির সঙ্গে দেখা হলে হয়তো তাঁর প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে। আচ্ছা, আজ চলি, আবার দেখা হবে।’
দ্বার পর্যন্ত আসিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া গেল, বিশুবাবুর পাশে দাঁড়াইয়া হ্রস্বকণ্ঠে বলিল, ‘একটা কথা জিগ্যেস করা হয়নি। আপনি কি সম্প্রতি কোনো বেনামী চিঠি পেয়েছেন?’
বিশুবাবু চকিতে মুখ তুলিলেন, ‘পেয়েছি। আপনি কি করে জানলেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আরও দু’একজন পেয়েছে, তাই মনে হল হয়তো আপনিও পেয়েছেন। কী আছে বেনামী চিঠিতে? ভয় দেখানো?’
‘এই-যে দেখুন না’—বলিয়া বিশুবাবু দেরাজ হইতে আমাদেরই লেখা চিঠি বাহির করিয়া দিলেন।
ব্যোমকেশ মনোযোগ দিয়া চিঠি পড়িল, তারপর চিঠি ফেরত দিয়া বলিল, ‘হুঁ। কে লিখেছে কিছু আন্দাজ করতে পারেন না?’
বিশুবাবু বলিলেন, ‘কিছু না। আমার জীবনে এমন কোনও গুপ্তকথা নেই যা ভাঙিয়ে কেউ লাভ করতে পারে?’
‘আপনার শত্রু কেউ আছে?’
‘অনেক। ব্যবসাদারের সবাই শত্রু।’
‘তাহলে তারাই কেউ হয়তো নিছক mischief করবার জন্যে চিঠি দিয়েছে। —চলি এবার। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
বিশুবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘আমার মিল তাহলে সার্চ করছেন না?’
ব্যোমকেশও হাসিল, ‘অনর্থক পণ্ডশ্রম করে লাভ কি, বিশ্বনাথবাবু?’
‘আর জঙ্গল?’
‘সেটাও আজ নয়—জঙ্গল আপাদমস্তক খুঁজতে অনেক কাঠ-খড় চাই। এস অজিত, রোদ ক্রমেই কড়া হচ্ছে। বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর সঙ্গে দুটো কথা বলে চট্পট আস্তানায় ফিরতে হবে।’