ছয়
কাছেই থানা। সেই দিকে যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুখময় দারোগা কি রকম ফিচেল দেখেছ? হাটের মাঝখানে কনস্টেবল পাঠিয়েছে, যাতে কারুর জানতে বাকি না থাকে যে পুলিসের সঙ্গে আমার ভারি দহরম মহরম।’
‘হুঁ। কিন্তু তলব কিসের জন্যে?’
‘বোধ হয় অমৃতের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসেছে।’
থানায় পদার্পণ করিতেই সুখময় দারোগা মুখে মধুর রসের ফোয়ারা ছুটাইয়া দিলেন, ‘আসুন, আসুন ব্যোমকেশবাবু, আসুন অজিতবাবু, বসুন বসুন। ব্যোমকেশবাবু, আপনি এই চেয়ারটাতে বসুন। আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ নজরে পড়ল আপনারা এদিকে আসছেন। হে-হে, এই নিন অমৃতের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট। বুদ্ধি বটে আপনার; ঠিক ধরেছিলেন, বন্দুকের গুলিতেই মরেছে।’ বলিয়া ডাক্তারের রিপোর্ট ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।
বিচিত্র জীব এই সুখময়বাবু। এইরূপ চরিত্র আমরা সকলেই দেখিয়াছি এবং মনে মনে সহিংস তারিফ করিয়াছি। কিন্তু ভালবাসিতে পারি নাই। ইঁহারা কেবল পুলিস-বিভাগে নয়, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছড়াইয়া আছেন।
রিপোর্ট পড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘গুলিটা শরীরের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে দেখছি। কোথায় সেটা?’
‘এই যে!’ একটা নম্বর-আঁটা টিনের কৌটা হইতে মাষকলাইয়ের মত একটি সীসার টুকরা লইয়া সুখময়বাবু তাহার হাতে দিলেন।
করতলে গুলিটি রাখিয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সেটিকে সমীক্ষণ করিল, তারপর সুখময়বাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ থেকে কিছু বুঝলেন?’
সুখময়বাবু বলিলেন, ‘আজ্ঞে, গুলি দেখে বোঝা যাচ্ছে পিস্তল কিংবা রিভলবারের গুলি। এ ছাড়া বোঝবার আর কিছু আছে কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আছে বৈকি। গুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে ৩৮ অটোম্যাটিক থেকে গুলি বেরিয়েছে, যে ৩৮ অটোম্যাটিক যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্য ব্যবহার করত। অর্থাৎ—’ ব্যোমকেশ থামিল।
সুখময়বাবু বলিলেন, ‘অর্থাৎ অমৃতকে যে খুন করেছে এবং আপনি যাকে খুঁজতে এসেছেন তাদের মধ্যে যোগাযোগ আছে, এমন কি তারা একই লোক হতে পারে। কেমন?’
ব্যোমকেশ গুলিটি তাঁহাকে ফেরত দিয়া বলিল, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু না বলাই ভালো। আপনার কাজ অমৃতের হত্যাকারীকে ধরা, সে-কাজ আপনি করবেন। আমার কাজ অন্য।’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই। হ্যাঁ ভালো কথা, সদানন্দ সুরের লাশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি, রিপোর্ট এলেই আপনাকে দেখাব।’
‘আমাকে সদানন্দ সুরের রিপোর্ট দেখানোর দরকার নেই। এটাও আপনারই কেস্, আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমি রুই-কাতলা ধরতে এসেছি, চুনোপুঁটিতে আমার দরকার কি বলুন।’
সুখময়বাবুর চক্ষু দুটি ধূর্ত কৌতুকে ভরিয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, ‘সে-কথা একশো বার। কিন্তু ব্যোমকেশবাবু, আপনার জালে যখন রুই-কাতলা উঠবে তখন আমার চুনোপুঁটিও সেই জালেই উঠবে; আমাকে আলাদা জাল ফেলতে হবে না। হে হে হে হে। চললেন নাকি? আচ্ছা, নমস্কার।’
বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশ আমার পানে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল। লোকটার দুষ্টবুদ্ধির শেষ নাই, অথচ তাহার কার্যকলাপে না হাসিয়াও থাকা যায় না। ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখনও রোদ চড়েনি, চলো চালের কল দুটো দেখে যাই।’
রাস্তা দিয়া ঘুরিয়া বিশ্বনাথ রাইস মিল-এর সম্মুখে উপস্থিত হইতে পাঁচ মিনিট লাগিল। বেশ বড় চালের কল, পাঁচ-ছয় বিঘা জমির উপর প্রসারিত; কাঁটা-তারের বেড়া দিয়া ঘেরা। গুর্খা-রক্ষিত ফটক দিয়া প্রবেশ করিলে প্রথমেই সামনে প্রকাণ্ড শান-বাঁধানো চাতাল চোখে পড়ে। চাতালের ওপারে একটি পুকুর, বাঁ পাশে ইঞ্জিন-ঘর ও ধান-ভানার করোগেটের ছাউনি; ডান পাশে গুদাম, দপ্তর ও মালিকের থাকিবার জন্য একসারি কক্ষ। সকালবেলা কাজ চালু আছে, ধান-ভানার ছাউনি হইতে ছড়্ ছড়্ ছর্র্র শব্দ আসিতেছে। কুলি-মজুরেরা কাজে ব্যস্ত, গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার ট্রাক হইতে বস্তা ওঠা-নামা হইতেছে।
চাল কলের মালিকের নাম বিশ্বনাথ মল্লিক। থানা হইতে তাঁহার নাম সংগ্রহ করিলেও এবং বেনামী চিঠি পাঠাইলেও চাক্ষুষ পরিচয় এখনও হয় নাই। আমরা গুর্খার মারফত এত্তালা পাঠাইয়া মিল-এ প্রবেশ করিলাম। দপ্তরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম বিশ্বনাথবাবু সেখানে নাই, একজন মুহুরী গোছের লোক গদিতে বসিয়া খাতাপত্র লিখিতেছে।
‘কী চান?’
‘বিশ্বনাথবাবু আছেন? আমরা পুলিসের পক্ষ থেকে আসছি।’
লোকটি তটস্থ হইয়া উঠিল, ‘আসুন আসুন, বসতে আজ্ঞা হোক। কর্তা মিল-এর কাজ তদারক করতে গেছেন, এখনি আসবেন। তাঁকে খবর পাঠাব কি?’
ঘরের অর্ধেক মেঝে জুড়িয়া গদির বিছানা, আমরা গদির উপর উপবেশন করিলাম। সত্য কথা বলিতে কি, আধুনিক চেয়ার-সোফার চেয়ে সাবেক গদি-ফরাশ ঢের বেশি আরামের। ব্যোমকেশ একটি সুপুষ্ট তাকিয়া কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘না না, তাঁকে ডেকে পাঠানোর দরকার নেই। সামান্য দু’-চারটে কথা জিজ্ঞেস করার আছে, তা সে আপনিই বলতে পারবেন। আপনি বুঝি মিল-এর হিসেব রাখেন?’
লোকটি সবিনয়ে হস্তঘর্ষণ করিয়া বলিল, ‘আজ্ঞে, আমি মিল-এর নায়েব-সরকার। অধীনের নাম নীলকণ্ঠ অধিকারী। আপনি কি ব্যোমকেশ বক্সী মশাই?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া ঘাড় নাড়িল। নীলকণ্ঠ অধিকারী ভক্তি-তদ্গত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। এমন লোক আছে পুলিসের নাম শুনিলে যাহাদের হৃদয় বিগলিত হয়। উপরন্তু তাহারা যদি ব্যোমকেশ বক্সীর নাম শুনিতে পায় তাহা হইলে তাহাদের হৃদয়াবেগ বাঁধ-ভাঙা বন্যার মত দু’কূল ছাপাইয়া প্রবাহিত হইতে থাকে, তখন আর তাহাদের ঠেকাইয়া রাখা যায় না। নীলকণ্ঠ অধিকারী সেই জাতীয় লোক। তাহার মুখ দেখিয়া বুঝিলাম, ব্যোমকেশকে অদেয় তাহার কিছুই নাই; প্রশ্নের উত্তর সে দিবেই, এমন কি, প্রশ্ন না করিলেও সে উত্তর দিবে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকে দেখে কাজের লোক মনে হচ্ছে। মিল-এর সব কাজ আপনিই দেখেন?’
নীলকণ্ঠ সহর্ষে হস্তঘর্ষণ করিল, ‘আজ্ঞে, কর্তাও দেখেন। উনি যখন থাকেন না তখন আমার ওপরেই সব ভার পড়ে।’
‘কর্তা—মানে বিশ্বনাথবাবু—এখানে থাকেন না?’
‘আজ্ঞে, এখানেই থাকেন। তবে মিল-এর কাজকর্ম যখন কম থাকে তখন দু’চার দিনের জন্য কলকাতা যান। কলকাতায় কর্তার ফ্যামিলি থাকেন।’
‘বুঝেছি। তা কর্তা কতদিন কলকাতা যাননি?’
‘মাসখানেক হবে। এখন কাজের চাপ বেশি—’
‘আচ্ছা, ও-কথা থাক। অমৃত নামে বাঘমারি গ্রামের একটি ছোকরা সম্প্রতি মারা গেছে তাকে। আপনি চিনতেন?’
নীলকণ্ঠ উৎসুক স্বরে বলিল, ‘চিনতাম বৈকি। অমৃত প্রায়ই কর্তার কাছে চাকরির জন্য দরবার করতে আসত। কিন্তু—’
‘সদানন্দ সুরকেও আপনি চিনতেন?’
নীলকণ্ঠ সংহত স্বরে বলিল, ‘সদানন্দবাবু কাল রাত্রে বোমা ফেটে মারা গেছেন, আজ সকালে খবর পেয়েছি। সদানন্দবাবুকে ভালোরকম চিনতাম। আমাদের এখানে তাঁর খুব যাতায়াত ছিল।’
‘কী উপলক্ষে যাতায়াত ছিল?’
‘উপলক্ষ—কর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাঝে মাঝে গদিতে এসে বসতেন, তামাক খেতেন, কর্তার সঙ্গে দু’দণ্ড বসে গল্পগাছা করতেন। এর বেশি উপলক্ষ কিছু ছিল না। তবে—’ বলিয়া নীলকণ্ঠ থামিল।
‘অর্থাৎ মোসায়েবি করতেন। তবে কি?’
‘দিন দশেক আগে তিনি কর্তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন।’
‘তাই নাকি! কত টাকা?’
‘পাঁচশো।’
‘হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার নিয়েছিলেন?’
‘আজ্ঞে না। কর্তা সদানন্দবাবুকে বিশ্বাস করতেন, বহিখাতায় সদানন্দবাবুর নামে পাঁচশো টাকা কর্জ লিখে টাকা দেওয়া হয়েছিল। টাকাটা বোধহয় ডুবল।’ বলিয়া নীলকণ্ঠ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িল।
ব্যোমকেশ গালে হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল। কি ভাবিল জানি না, কিন্তু খানিক পরে বাহির হইতে ঘোড়ার চিঁহি-চিঁহি শব্দ শুনিয়া তাহার চমক ভাঙিল। সে মুখ তুলিয়া বলিল, ‘ভালো কথা, অনেকগুলো ঘোড়া দেখলাম। সবগুলোই কি আপনাদের?’
নীলকণ্ঠ সোৎসাহে বলিল, ‘আজ্ঞে, সব আমাদের। কর্তার খুব ঘোড়ার শখ। ন’টা ঘোড়া আছে।’
‘তাই নাকি! এতগুলো ঘোড়া কি করে? ট্রাক টানে?’
‘ট্রাক তো টানেই। তা ছাড়া কর্তা নিজে ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসেন। উনি কমবয়সে জকি ছিলেন কিনা—’
‘নীলকণ্ঠ!—’
শব্দটা আমাদের পিছন দিক হইতে চাবুকের মত আসিয়া নীলকণ্ঠের মুখে পড়িল। নীলকণ্ঠ ভীতমুখে চুপ করিল, আমরা একসঙ্গে পিছনে ঘাড় ফিরাইলাম।
দ্বারের সম্মুখে একটি লোক দাঁড়াইয়া আছে। বয়স আন্দাজ চল্লিশ, ক্ষীণ-খর্ব চেহারা, অস্থিসার মুখে বড় বড় চোখ, হাফ-প্যান্ট ও হাফ-শার্ট পরা শরীরে বিকলতা কিছু না থাকিলেও, জঙ্ঘার হাড়-দু’টি ধনুকের মতো বাঁকা। ইনিই যে মিল-এর মালিক ভূতপূর্ব জকি বিশ্বনাথ মল্লিক তাহা নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিলাম।
বিশ্বনাথ মল্লিক নীলকণ্ঠের দিকেই চাহিয়া ছিলেন, পলকের জন্যও আমাদের দিকে চক্ষু ফিরান নাই। এখন তিনি ঘরের মধ্যে দুই পা অগ্রসর হইয়া আগের মতই শাণিত কণ্ঠে নীলকণ্ঠকে বলিলেন, ‘ইস্টিশানে মাল চালান যাচ্ছে, তুমি তদারক করো গিয়ে।’
নীলকণ্ঠ কশাহত ঘোড়ার মত ছুটিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
এইবার বিশ্বনাথ মল্লিক আমাদের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন। তাঁহার মুখ হইতে মালিক-সুলভ কঠোরতা অপগত হইয়া একটু হাসির আভাস দেখা দিল। তিনি সহজ সুরে বলিলেন, ‘নীলকণ্ঠ বড় বেশি কথা কয়। আমি আগে জকি ছিলাম, সেই খবর আপনাদের শোনাচ্ছিল বুঝি?’
ব্যোমকেশ একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, ‘ঘোড়ার কথা থেকে জকির কথা উঠে পড়ল।’
বিশ্বনাথবাবু মুখে সহাস্য ভঙ্গী করিলেন, ‘নিজের লজ্জাকর অতীতের কথা সবাই চাপা দিতে চায়, আমার কিন্তু লজ্জা নেই। ববং দুঃখ আছে, যদি জকির কাজ ছেড়ে না দিতাম, এতদিনে হয়তো খীম সিং কি খাদে হয়ে দাঁড়াতাম। কিন্তু ও-কথা যাক। আপনি ব্যোমকেশবাবু—না? সদানন্দ সুরের মৃত্যু সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে এসেছেন? আসুন, আমার বসবার ঘরে যাওয়া যাক।’