এগারো
সেদিন বেলা তৃতীয় প্রহরে মধ্যাহ্ন-ভোজন সম্পন্ন করিয়া আমরা বিশ্রান্তিগৃহের দুইটি খাটে লম্বমান হইয়াছিলাম। পটল, দাশু ও গোপাল বারংবার ব্যোমকেশের পদধূলি গ্রহণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। দারোগা সুখময় সামন্ত আসামীকে সদরে চালান দিয়া স্তূপীকৃত হাঁসের ডিমের বড়া খাইতে খাইতে থানার অন্যান্য কর্মচারীদের নিকট ইহাই প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছেন যে, আসামীর গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তাঁহার কৃতিত্বও কম নয়। গঞ্জের কর্মতৎপরতা ক্ষণকালের জন্য মন্দীভূত হইলেও আবার পুরাদমে চালু হইয়াছে : রামে রাম দুয়ে দুই। অমৃত এবং সদানন্দ সুর নামক দুটি অখ্যাত ব্যক্তির অকালমৃত্যু ঘটিয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে জীবনের নিত্যস্রোত ব্যাহত হয় নাই। এবং তাহাদের আততায়ী ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিলেও ব্যাহত হইবে না। রামে রাম দুয়ে দুই। …রাম নাম সত্য হ্যায়। …
ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বদিকে চাহিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল; বলিল, ‘সদানন্দ সুরের মৃত্যুতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু অমৃত ছেলেটা নেহাত অকারণেই মারা গেল।’
আমি একটা নূতন সিগারেট ধরাইয়া বলিলাম, ‘গোড়া থেকে বলো।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এ কাহিনীর গোড়া হচ্ছেন সদানন্দ সুর। তিনি না থাকলে আমরা চোরাকারবারী আসামীকে ধরতে পারতাম না। তাঁকে দিয়েই কাহিনী শুরু করা যেতে পারে।
সদানন্দ সুরের চরিত্র যতটুকু বুঝেছি, তিনি ছিলেন কৃপণ এবং সংবৃতমন্ত্র। নিজের হাঁড়ির খবর কাউকে দিতে ভালবাসতেন না। অবস্থাও ছিল অত্যন্ত সাধারণ। বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে বিয়ে করেননি। পৈতৃক ভিটে এবং দু’চার বিঘে জমি; সান্তালগোলার বাজারে দু’চার মণ ধান-চালের দালালি; কবিরাজী ওষুধ বিক্রি করে দু’চার পয়সা লাভ;—এই ছিল তাঁর অবলম্বন। একলা মানুষ, তাই কোনও রকমে চলে যেত।
কিন্তু তাঁর মনে ভোগতৃষ্ণা ছিল। কৃপণেরা গাঁটের পয়সা খরচা করে ভোগতৃষ্ণা মেটাতে চায় না বটে, তাই বলে তাদের ভোগতৃষ্ণা নেই এ-কথা কেউ বলবে না। সদানন্দবাবুর সাধ ছিল, সাধ্য ছিল না। হয়তো তিনি তাঁর ক্ষুদ্র রোজগার থেকে দু’চার পয়সা বাঁচাতেন, কিন্তু তা নিয়ে ফুর্তি করার মত চরিত্র তাঁর নয়। এইভাবে জীবন কাটছিল। বয়স বাড়ছে, শক্তি-সামর্থ্য ফুরিয়ে আসছে। হয়তো এমনি বুভুক্ষু অবস্থাতেই তাঁর জীবন শেষ হত। হঠাৎ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে একটা মস্ত সুযোগ জুটে গেল।
বিশ্বনাথ মল্লিকের কাছে সদানন্দবাবুর যাতায়াত ছিল। বিশ্বনাথ মল্লিকের দেরাজে কবিরাজী মোদকের শিশি পাওয়া গেছে, নিশ্চয় সদানন্দবাবু যোগান দিতেন। এই সূত্রেই ঘনিষ্ঠতা। তারপর হঠাৎ একদিন সদানন্দবাবু বিশু মল্লিকের জীবনের গোপনতম কথাটি জানতে পারলেন। বিশু মল্লিক চোরা-অস্ত্রশস্ত্রের কারবারী। কি করে জানতে পারলেন বলা যায় না, সম্ভবত তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন কোথায় বিশু মল্লিক তার অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখে। শিমুলগাছটা তাঁর বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, হয়তো হঠাৎ বিশু মল্লিককে সেখানে দেখে ফেলেছিলেন।
সদানন্দবাবু গুপ্তস্থান থেকে বোমা-বন্দুক চুরি করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সে-পথ দিয়ে গেলেন না। বোমা-বন্দুক কি করে কালাবাজারে চালাতে হয়, পাড়াগেঁয়ে মানুষ সদানন্দ সুর তা জানতেন না। তিনি অন্য রাস্তা ধরলেন। বিশু মল্লিককে বললেন, টাকা দাও, নইলে সব ফাঁস করে দেব। অর্থাৎ সোজাসুজি ব্ল্যাকমেল।
বিশু মল্লিক নিরুপায়। পাঁচশো টাকা বার করতে হল। সেই টাকা নিয়ে সদানন্দবাবু বাড়ি ফিরে এলেন। ফুর্তির বয়স শেষ হয়ে আসছে, আর দেরি করা চলে না। তিনি স্থির করলেন কলকাতা যাবেন।
কিন্তু তিনি ভারি হিসেবী লোক, সব টাকা নিয়ে কলকাতা যাওয়া তাঁর মনোমত নয়। অথচ বাঘমারির শূন্যবাড়িতে টাকা রেখে গেলেও ভয় আছে, চোর এসে সর্বস্ব নিয়ে যেতে পারে। তিনি একটি কাজ করলেন।
আমি তোমাকে যে বলছি অধিকাংশই আন্দাজ, কিন্তু এলোমেলো আন্দাজ নয়। সদানন্দ সুর একটি স্টীলের ট্রাঙ্কে বেশির ভাগ টাকা রাখলেন, সঞ্চিত যা ছিল তা রাখলেন, হয়তো সাবেক কালের কিছু গয়নাগাঁটি ছিল তাও রাখলেন। তারপর একহাতে স্টীল-ট্রাঙ্ক এবং অন্যহাতে নিজের ব্যবহারের ক্যাম্বিস ব্যাগ নিয়ে যাত্রা করলেন। রামডিহি স্টেশনে তাঁর বোন-ভগিনীপতি আছে, তাদের জিম্মায় ট্রাঙ্ক রেখে কলকাতায় যাবেন ফুর্তি করতে।
সদানন্দ সুর তো চলে গেলেন, এদিকে ফাঁপরে পড়েছে বিশু মল্লিক। এতদিন সে বেশ নিরুপদ্রবেই ব্যবসা চালাচ্ছিল, এখন দেখল সে বিষম ফাঁদে ধরা পড়েছে। সদানন্দ সুর যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার উদ্ধার নেই, সদানন্দ সুর তাকে শোষণ করবে। সে ঠিক করল সদানন্দ সুরকে সরাতে হবে; তার মাথায় বুদ্ধি আছে, হাতে আছে মারাত্মক অস্ত্র। সদানন্দকে সরানো শক্ত কাজ নয়।
সদানন্দ ভগিনীপতির বাসায় তোরঙ্গ রেখে কলকাতায় গিয়ে বোধকরি ফুর্তিই করছেন, এদিকে বিশু মল্লিক একদিন সন্ধ্যের পর ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে ঢুকল, শিমুলগাছ থেকে একটি হ্যান্ড-গ্রিনেড নিয়ে সদানন্দর বাড়িতে বুবি-ট্র্যাপ পেতে এল। সদানন্দ কলকাতা থেকে যেই বাড়িতে ঢুকতে যাবেন অমনি বোমা ফাটবে।
কিন্তু সদানন্দ সুর কলকাতা থেকে ফিরে আসবার আগেই কিছু কিছু ব্যাপার ঘটতে আরম্ভ করেছিল। বিশু মল্লিকের যখনই অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রি করবার দরকার হত তখনই সে ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে যেত। একদিন রাত্রি দশটার সময় অমৃত বাছুর খুঁজতে এসে ঘোড়াটাকে দেখে ফেলল। সে ভাবল ঘোড়া-ভূত। তারপর যখন সে বন্ধুদের খোঁচায় আবার জঙ্গলে ঢুকল তখন শুধু ঘোড়া নয়, শিমুলতলায় ঘোড়ার সওয়ারের সঙ্গেও তার দেখা হয়ে গেল।
বিশু মল্লিক সেদিন বোধহয় সদানন্দ সুরের বুবি-ট্র্যাপ পেতে ফিরে যাচ্ছিল। দু’জনেই দু’জনকে চেনে; অমৃত চাকরির জন্য বিশু মল্লিকের কাছে দরবার করছিল। বিশু মল্লিক দেখল, এর পর যখন বুবি-ট্র্যাপ ফাটবে তখন অমৃত সাক্ষী দেবে যে, সে বিশু মল্লিককে রাত্তিরে সদানন্দ সুরের বাড়ির পিছনে দেখেছে; হয়তো বিশু মল্লিক যখন সদানন্দ সুরের পাঁচিল টপ্কে বেরুচ্ছিল তখন দেখেছে। অতএব অমৃতের বেঁচে থাকা নিরাপদ নয়। বিশু মল্লিকের কাছে অটোম্যাটিক পিস্তল ছিল, সে অমৃতকে খুন করে ঘোড়ার পিঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি যখন প্রথম অকুস্থলে এসে তদন্ত আরম্ভ করলাম তখন সবচেয়ে আশ্চর্য মনে হল—ঘোড়া। অমৃত ঘোড়া-ভূত দেখেছিল, আমি দেখলাম জলজ্যান্ত ঘোড়ার খুরের দাগ। একটা ঘোড়া এই মামলার সঙ্গে জড়িত আছে। তখনও আমরা আসামীকে চিনি না, কিন্তু সে যেই হোক, ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে আসে। কেন?
ঘোড়ায় চড়ে শীগ্গির যাতায়াত করা যায়, কিন্তু আবার সহজেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যে-লোক দুষ্কার্য করতে বেরিয়েছে সে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় না; তবে এ-ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে আসে কেন? নিশ্চয় কোনও বিশেষ সুবিধে আছে। কী সুবিধে? সদানন্দ সুরের পাঁচিল টপ্কানো? ঘোড়ার পিঠ থেকে পাঁচিল টপ্কানোর সুবিধে হয়, ওদিকে নামবার জন্যে পেয়ারাগাছ আছে। কিন্তু শুধু কি এই? না, অন্য কিছুও আছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম কাল রাত্রে। কিন্তু সে পরের কথা।
যথাসময়ে সদানন্দ সুর ফিরে এলেন। তোরঙ্গটা তিনি ফিরিয়ে আনেননি, বোধহয় ইচ্ছে ছিল বাড়িতে দু’দিন বিশ্রাম করে ভগিনীপতির বাসা থেকে তোরঙ্গ নিয়ে আসবেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হল না। নিজের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে প্রায় আমাদের চোখের সামনে তিনি মারা গেলেন।
সদানন্দ সুরের মৃত্যুর পর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। আমি যাকে ধরতে এসেছি সে-ই মেরেছে অমৃত আর সদানন্দ সুরকে। যারা আগ্নেয়াস্ত্র কেনে তারা বাইরের লোক, হত্যাকারী বাইরের লোক নয়; অমৃত আর সদানন্দ সুরের চেনা লোক। অমৃত তাকে দেখে ফেলেছিল এবং সদানন্দ সুর তাকে দোহন করতে শুরু করেছিল। কেবল দুটো কথা তখনও অজ্ঞাত ছিল—লোকটা কে? এবং কালো ঘোড়ায় চড়ে আসে কেন?
অমৃত বলেছিল, কালো ঘোড়া-ভূত, নাক দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। সবটাই তার উত্তপ্ত কল্পনা হতে পারে। আবার খানিকটা সত্যি হতে পারে। সুতরাং কালো ঘোড়ার খোঁজ নেওয়া দরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল সান্তালগোলায় কেবল একটি কালো ঘোড়া আছে, তার মালিক বদ্রিদাস মাড়োয়ারী। তবে কি বদ্রিদাস-ই আমার আসামী? বদ্রিদাস লোকটি পাঁকাল মাছের মত পিছল; তিনি ধান-চালে প্রচুর কাঁকর মেশাতে পারেন, স্বজাতির প্রতি তাঁর অসীম পক্ষপাত থাকতে পারে; কিন্তু তিনি দু-দুটো মানুষকে খুন করতে পারেন এত সাহস নেই। তাছাড়া তাঁকে ঘোড়সওয়ার রূপে কল্পনা করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
আমি বেনামী চিঠি পাঠানোর ফলে একটা কাজ হয়েছিল, সন্দেহভাজনদের দল থেকে জনকতক লোককে বাদ দেওয়া গিয়েছিল। যমুনাদাস গঙ্গারাম বেনামী চিঠি পুলিসকে দেখিয়েছিল, সুতরাং সে নয়। নফর কুণ্ডুর ওপর প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল তার ঘোড়া নেই। পরের ঘোড়া ধার করে কেউ খুন করতে যায় না। প্রাণকেষ্ট পালকে অবশ্য আমি গোড়া থেকে বাদ দিয়েছিলাম। ট্রলিতে চড়ে বাঘমারি গ্রামের কাছাকাছি যাওয়া যায় বটে, কিন্তু ট্রলিতে কুলি থাকে, তাদের চোখ এড়িয়ে খুন করার সুবিধে নেই। আমার শুধু জানবার কৌতূহল ছিল, সদানন্দ সুরের ট্রাঙ্কে কী আছে।
যাহোক, সন্দেহভাজনের দলকে ছাঁটাই করে মাত্র তিনজন দাঁড়াল—বদ্রিদাস মাড়োয়ারী, বিশু মল্লিক আর সুখময় দারোগা। সুখময় দারোগাকে বাদ দিতে পারিনি; তার একটা ঘোড়া আছে, যদিও সেটা কালো নয়। এবং তার পক্ষে এইজাতীয় কারবার চালানো যত সহজ এমন আর কারুর পক্ষে নয়। প্রদীপের নিচেই অন্ধকার বেশি।
অবশ্যি যখন জানতে পারলাম বিশু মল্লিক একসময় জকি ছিল, তখন সব সন্দেহই তার ওপর গিয়ে পড়ল। উপরন্তু জানা গেল, বিশু মল্লিক সদানন্দ সুরকে পাঁচশো টাকা ধার দিয়েছে। আসলে ওটা ধার নয়—ঘুষ। সদানন্দ সুরের মত নিঃস্ব লোককে কোনও ব্যবসাদার শুধু-হাতে ধার দেবে না।
আমি বিশু মল্লিকের জন্যে টোপ ফেললাম, আমার মনের প্রাণের কথা সব তাকে বলে ফেললাম। জঙ্গলে যে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখা সম্ভব এ-চিন্তা আমার গোড়া থেকেই ছিল। আমি ভেবেছিলাম শিমুলগাছের কাছাকাছি কোথাও মাটিতে পোঁতা আছে। বিশু মল্লিক যখন শুনল আমরা জঙ্গল খানাতল্লাশ করবার মতলব করেছি, তখন সে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। অস্ত্রগুলো অবশ্য খুবই যত্ন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে; কিন্তু বলা যায় না, পুলিস খুঁজে বার করতে পারে। তখন বিশু মল্লিককে অবশ্য ধরা যাবে না, কিন্তু অনেক টাকার মাল বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। বিশু মল্লিক লোভে পড়ে গেল।
কাল বিকেলে আমি যখন রামডিহি যাবার জন্যে ট্রেনে চড়লাম তখন বিশু মল্লিক এসে দেখে গেল আমি সত্যি যাচ্ছি কিনা। আমার অবশ্য রামডিহি পর্যন্ত যাবার প্ল্যান ছিল না, স্থির করেছিলাম পরের স্টেশনে নেমে বাঘমারিতে ফিরে আসব। কিন্তু দৈব অনুকূল, ঠিক বাঘমারি গ্রামের গায়ে ট্রেন থেমে গেল।
গ্রামে গিয়ে পটল, দাশু আর গোপালকে যোগাড় করলাম; তাদের নিয়ে জঙ্গলে গেলাম। সারা জঙ্গল তল্লাশ করা অসম্ভব; কিন্তু সদানন্দ সুরের পাঁচিলের পাশে যেখানে ঘোড়ার খুরের দাগ পাওয়া গিয়েছিল সেখান থেকে শিমুলগাছের গোড়া পর্যন্ত খুঁজে দেখলাম, যদি কোথাও সদ্য-খোঁড়া মাটি দেখতে পাই। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না।
এখন কি করা যায়! সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। জঙ্গলে বসে সিগারেট টানতে টানতে মতলব ঠিক করে নিলাম। পটলদের বললাম, ‘চলো, সান্তালগোলার দিকে যাওয়া যাক।’
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সান্তালগোলার কিনারায় পৌঁছলাম। এখানে জঙ্গল প্রায় দেড়শো গজ চওড়া; একপ্রান্তে স্টেশন, অন্যপ্রান্তে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক, মাঝামাঝি বিশু মল্লিকের মিল। মিল-এর এটা পিছন দিক্, কাঁটা-তারের বেড়ায় ছোট খিড়কির ফটক আছে। আমি পটলদের আমার প্ল্যান বুঝিয়ে দিলাম। তারা জঙ্গলের কিনারায় সম-ব্যবধানে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকবে এবং লক্ষ্য করবে ঘোড়ায় চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে কেউ জঙ্গলে ঢোকে কিনা। লোকটাকে চেনবার চেষ্টা করবে, কিন্তু কোনও অবস্থাতেই ধরবার চেষ্টা করবে না।
পটল উঠল বিশু মল্লিকের মিল-এর সরাসরি একটা গাছে, দাশু গেল স্টেশনের দিকে, আর গোপাল ব্যাঙ্কের দিকে। আকাশে আজও চাঁদ আছে; রাত হলেও, এদের চোখ এড়িয়ে কেউ জঙ্গলে ঢুকতে পারবে না।
ওদের গাছে তুলে দিয়ে আমি ফিরে চললাম শিমুলগাছের কাছে। ওই গাছটা আমার মনে ঘোর সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিল। অমৃতের মৃত্যু হয় ঐ গাছের তলায়। এ-রহস্যের চাবিকাঠি যদি জঙ্গলের মধ্যে থাকে তবে নিশ্চয় ঐ শিমুলগাছের কাছাকাছি কোথাও আছে।
যখন শিমুলতলায় ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে, চাঁদের আলো ফুটেছে। শিমুলগাছ থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে একটা ঝাঁকড়া গোছের গাছ ছিল, আমি তাতে উঠে পড়লাম। এইখানে বসে বাঘ-শিকারীর মত অপেক্ষা করব। আমার সঙ্গে অস্ত্র নেই, আমি এসেছি শুধু ব্যাঘ্র-মশাইকে দেখতে। তিনি আসবেন কিনা জানি না, কিন্তু যদি আসেন, ন’টার আগেই আসবেন।
শিমুলগাছের সব পাতাই প্রায় ঝরে গেছে, গাছের তলায় ছায়া নেই। চাঁদ যত উঁচুতে উঠছে আলো তত পরিষ্কার হচ্ছে। হঠাৎ কাছের একটা গাছ থেকে কোকিল ডেকে উঠল। বিচিত্র পরিস্থিতি। আমি বসে আছি একটা নৃশংস নরহন্তাকে দেখব বলে, আর—কোকিল ডাকছে! আজব দুনিয়া!
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। চোখের কাছে হাত এনে ঘড়ি দেখলাম, পৌনে আটটা। সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে একটা আওয়াজ কানে এল, শুক্নো পাতার ওপর পায়ের মচমচ শব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, ঘন ছায়ার ভিতর থেকে ধীর-মন্থর গমনে একটা ঘোড়া বেরিয়ে আসছে। কালো ঘোড়া। তার পিঠে বসে আছে কালো-পোশাক পরা একটা মানুষ। মানুষটার মুখ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সে জকির মত সামনে ঝুঁকে বসেছে আর সতর্কভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
ঘোড়াটা সোজা গিয়ে শিমুলগাছের বিরাট গুঁড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়াল, পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যা দেখলাম তা একেবারে সার্কাসের খেলা। ঘোড়ার সওয়ার টপ্ করে ঘোড়ার পিঠে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাত বাড়িয়ে শিমুলগাছের গুঁড়িতে একটা ফোকরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলে। মাটি থেকে দশ হাত উঁচুতে যেখানে ডালপালা বেরিয়েছে সেখানে একটা খোপের মত ফুটো আছে। অচিন পাখির বাসা!
ঘোড়ার পিঠে আসামী কেন জঙ্গলে আসে এখন বুঝতে পারছ? অস্ত্রগুলো মাটিতে পোঁতা নেই, আছে গাছের ফোকরের মধ্যে, মাটি থেকে দশ হাত উঁচুতে। শিমুলগাছের গায়ে শক্ত-শক্ত মোটা মোটা কাঁটা থাকে; শিমুলগাছে মানুষ ওঠে না, এমন কি কাঠবেরালি পর্যন্ত ওঠে না। এমন নিরাপদ গুপ্তস্থান আর নেই। অবশ্য মই লাগিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু কে মই লাগাবে? আর যিনি জানেন তিনি যদি মই ঘাড়ে করে জঙ্গলে আসেন তাহলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তার চেয়ে ঘোড়া ঢের নিরাপদ; বিশেষত যদি জকির হাতের শিক্ষিত ঘোড়া হয়।
যাহোক, ঘোড়সওয়ারের বাঁ হাতে একটা থলি আছে; সে খোপের মধ্যে ডান হাত ঢুকিয়ে একটি একটি করে অস্ত্রগুলি বার করছে আর থলিতে রাখছে। এতক্ষণে ঘোড়সওয়ারকে চিনতে পেরেছি—বিশু মল্লিক। মুখ চিনতে না পারলেও, ঐ রোগা বেঁটে শরীর আর ধনুকের মত বাঁকা ঠ্যাং ভুল হবার নয়। আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু একটা ধোঁকা তখনও কাটেনি; বিশু মল্লিক কালো ঘোড়া পেল কোত্থেকে? সে ভারি হুঁশিয়ার লোক, তার যদি কালো ঘোড়া থাকত সে কখনই আমার কাছে মিথ্যেকথা বলত না। আসলে আমি যখন তাকে কালো ঘোড়া সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম তখন সে আমার প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। এ-মামলার সঙ্গে কালো ঘোড়ার যে কোনও সম্বন্ধ আছে তা সে কল্পনা করতেই পারেনি। আমি কালো ঘোড়ার রহস্য বুঝলাম কাল দুপুর-রাত্রে, বাসায় ফিরে এসে।
সে যাক, বিশু মল্লিক থলি ভরে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে নেমে বসল, তারপর মন্দমন্থর চালে ফিরে চলল। সে জঙ্গলের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে যাবার পর আমি গাছ থেকে থেকে নামলাম। ঘড়িতে তখন সওয়া আটটা। আমি আবার পটলদের উদ্দেশে ফিরে চললাম। আমার প্ল্যান ঠিকই ফলেছে; পুলিস কাল জঙ্গল তল্লাশ করবে, তাই আজ বিশু মল্লিক অস্ত্রগুলো জঙ্গল থেকে সরিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অস্ত্রগুলোকে সে রাখবে কোথায়? কারণ, কেবল মানুষটাকে ধরলে চলবে না, অস্ত্রগুলোও চাই। বস্তুত, অস্ত্রগুলো না পেলে মানুষটাকে ধরে কোনও লাভ নেই।
আমি যখন জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছলাম তখনও পটলেরা গাছ থেকে নামেনি, আমাকে দেখে নেমে এল। তিনজনেই ভীষণ উত্তেজিত; তারা ঘোড়সওয়ারকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছে এবং চিনতে পেরেছে। বিশু মল্লিক তার রাইস্ মিল-এর খিড়কি-ফটক দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেরিয়ে এল, পটলের গাছের প্রায় পাশ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকল। চল্লিশ মিনিট পরে আবার ফিরে ফটক দিয়ে মিল-এ চলে গেল।
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘ঠিক দেখেছ নিজের ফটকে ঢুকেছে? অন্য কোথাও যায়নি?’
পটল বলল, ‘আজ্ঞে না, অন্য কোথাও যায়নি।’
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। অস্ত্রগুলো বিশু মল্লিক মিলেই রাখবে, অন্তত যতদিন না পুলিস জঙ্গল-তল্লাশ শেষ করে। আমি সকালবেলা তাকে বলেছিলাম মিল খানাতল্লাশ করব না, আমার কথায় সে বিশ্বাস করেছে। আমাকে বিশু মল্লিক বোধ হয় খুবই সরলপ্রকৃতির লোক বলে মনে করেছিল।
আমি তখন পটল, দাশু আর গোপালের পিঠ ঠুকে দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের জন্যে অমৃতের মৃত্যুর কিনারা করতে পারলাম। কিন্তু আজ আর বেশি কৌতূহল প্রকাশ কোরো না; কাল সকাল ন’টার সময় এসো, তখন সব জানতে পারবে। কিন্তু সাবধান, কাউকে একটি কথা বলবে না।’
তারা গ্রামে ফিরে গেল। আমি থানায় গেলাম। সুখময় দারোগার কাছে পিস্তলটা যোগাড় করে স্টেশনে গেলাম। স্টেশন থেকে কাজকর্ম সেরে যখন ফিরে এলাম তখন রাত দুপুর, তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ।
তোমাকে জাগালাম না, পিছনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি, জানালার বাইরে কয়েকটা জন্তু বসে আছে। প্রথমটা আমিও ভেবেছিলাম কালো কুকুর, তারপর লক্ষ্য করে দেখলাম, কুকুর নয়—শেয়াল। ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে কালো ঘোড়ার রহস্য ভেদ হয়ে গেল। বুঝতে পারলে না? অত্যন্ত সহজ, এমন কি, হাস্যকর। কেন যে কথাটা মাথায় আসেনি জানি না। —শেয়ালের গায়ের রঙ কালো নয়, পাটকিলে। অথচ আমরা দেখলাম কালো। ঘোড়াটাও কালো ছিল না, ছিল গাঢ় বাদামী রঙের; ইংরেজিতে যাকে বলে চেস্ট্নাট। চাঁদের আলোয় সব গাঢ় রঙই দূর থেকে কালো দেখায়। তাই অমৃত কালো ঘোড়া-ভূত দেখেছিল, আমিও কালো ঘোড়া দেখেছিলাম। এই হল কালো ঘোড়ার রহস্য। রহস্য না বলে যদি পরিহাস বলতে চাও তাতেও আপত্তি নেই।
রাত্রে খেতে বসে তুমি সস্ত্রীক প্রাণকেষ্ট পালের উপাখ্যান বললে। ওদের গলদ কোথায় বুঝতে বেশি কষ্ট হয় না। প্রাণকেষ্ট পাল নিজের কাজে বেশ দক্ষ, কিন্তু ঘরে জারিজুরি চলে না, স্ত্রীর কাছে কেঁচো। সদানন্দ সুর বোনের কাছে তোরঙ্গ রেখে গিয়েছিলেন ঠিকই। তোরঙ্গ গোড়ায় ভাঙ্গা হয়নি; কিন্তু যখন তাঁর মৃত্যু-সংবাদ এল, তখন ভগিনী সুশীলা আর দ্বিধা করলেন না, তোরঙ্গের তালা ভাঙলেন এবং যা পেলেন আত্মসাৎ করলেন। হয়তো দাদার বিষয়সম্পত্তি সবই তিনি শেষ পর্যন্ত পাবেন, কিন্তু আইনের কথা কিছু বলা যায় না। হাতে যা পাওয়া গেছে তা হজম করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই হচ্ছে ভগিনী সুশীলার মনস্তত্ত্ব। প্রাণকেষ্ট পাল কিন্তু পুরুষমানুষ, হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান আছে, তাই তোমাকে দেখে তিনি বেজায় নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। —
তারপর আর কি? এবার বেদব্যাসের বিশ্রাম। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে বিশু মল্লিকের মত আরও কত মহাজন নীরবে তপস্যা করছেন কে তার খবর রাখে!’
ব্যোমকেশ প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া পাশ ফিরিল; বলিল, ‘জাগি পোহাল বিভাবরী। এইবেলা একটুকু ঘুমিয়ে নাও, আজ রাত্রেই কলকাতা ফিরব। হে হে।’