দশ
সকাল সাতটার সময় দুইজনে বাহির হইলাম। ব্যোমকেশ গায়ে একটা উড়ানিচাদর জড়াইয়া লইল, যাহাতে পকেটের পিস্তলটা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে।
গঞ্জ-গোলার কর্মতৎপরতা এখনও পুরাদমে আরম্ভ হয় নাই, দুই-চারিটা গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার ট্রাক চলিতে শুরু করিয়াছে। আমরা বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর মিল-এ প্রবেশ করিলাম।
বদ্রিদাস দাওয়ায় উবু হইয়া বসিয়া দাঁতন করিতেছিলেন, পাশে জলভরা ঘটি। আমাদের প্রথমটা দেখিতে পান নাই, একেবারে কাছে পৌঁছিলে দেখিতে পাইয়া তাঁহার চক্ষু দু’টি খাঁচার পাখির মত ঝট্পট করিয়া এদিক ওদিক ছুটাছুটি করিতে লাগিল, হাত হইতে দাঁতন পড়িয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শেঠজি, আপনাকে একবার আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’
বদ্রিদাস উবু অবস্থা হইতে অর্ধোত্থিত হইয়া আবার বসিয়া পড়িলেন, ‘ক্যা—ক্যা!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমরা এক জায়গায় খানাতল্লাশ করতে যাচ্ছি, আপনি এখানকার গণ্যমান্য লোক, আপনাকে সাক্ষী মানতে চাই।’
‘নেহি, নেহি’—বলিতে বলিতে তিনি জলভরা ঘটিটা তুলিয়া লইয়া দ্রুতপদে বিশেষ একটি স্থানের উদ্দেশে প্রস্থান করিলেন।
আমরা আবার বাহির হইলাম। বিশ্বনাথ মল্লিকের মিল-এ পৌঁছিতে পাঁচ মিনিট লাগিল।
ফটকের কাছে নায়েব-সরকার নীলকণ্ঠ অধিকারীর সঙ্গে দেখা হইল। নীলকণ্ঠ ভক্তিভরে যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া বলিল, ‘এত সকালে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার কর্তা কোথায়?’
‘নিজের ঘরে আছেন। চা খাচ্ছেন।’
‘চলুন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসি।’
‘আসুন।’
বিশ্বনাথ মল্লিক নিজের ঘরে টেবিলে বসিয়া পাউরুটি, মাখন ও অর্ধসিদ্ধ ডিম্ব সহযোগে প্রাতরাশ সম্পন্ন করিতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া তাঁহার চোয়ালের চর্বণক্রিয়া বন্ধ হইল। গলা হইতে অস্বাভাবিক স্বর নির্গত হইল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’
ব্যোমকেশ বলিল, সকালবেলাই আসতে হল। কিন্তু তাড়া নেই, আপনি খাওয়া শেষ করে নিন।’
বিশুবাবু ডিমের প্লেট সরাইয়া দিয়া জড়িতস্বরে বলিলেন, ‘কি দরকার?’ দেখিলাম তাঁহার অস্থিসার মুখখানা ধীরে ধীরে বিবর্ণ হইয়া যাইতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল ভেবেছিলাম আপনার মিল খানাতল্লাশ করে কোনও লাভ নেই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে লাভ থাকতেও পারে।’
বিশুবাবুর রগের শিরা ফুলিয়া উঁচু হইয়া উঠিল, মনে হইল তিনি বিস্ফোরকের মত ফাটিয়া পড়িবেন। কিন্তু তিনি অতি যত্নে নিজেকে সংবরণ করিলেন, তাঁহার ঠোঁটে হাসির মত একটা ভঙ্গিমা দেখা দিল। তিনি বলিলেন, ‘হঠাৎ মত বদলে ফেললেন কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, কারণ ঘটেছে। কাল বিকেলে আমি রামডিহি যাইনি, আপনাদের ওই জঙ্গলে শিমুলগাছের কাছে লুকিয়ে ছিলাম। আমার সঙ্গে গাঁয়ের তিনটি ছেলে ছিল। আমরা কাল রাত্রে যা দেখেছি তার ফলে মত বদলাতে হয়েছে, বিশ্বনাথবাবু।’
বিশ্বনাথবাবুর চোখদু’টা একবার জ্বলিয়া উঠিয়াই নিভিয়া গেল। তিনি কম্পিতহস্তে একটা সিগারেট ধরাইলেন, অলসভাবে বুক-পকেট হইতে একটা চাবির রিঙ বাহির করিয়া আঙুলে ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিলেন, ‘আমি যদি আমার মিল খানাতল্লাশ করতে না দিই?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার ইচ্ছের ওপর কিছুই নির্ভর করছে না। আমি তল্লাশী পরোয়ানা এনেছি।
‘কৈ, দেখি পরোয়ানা।’
ব্যোমকেশ পকেটে হাত দিল, বিশুবাবু বিদ্যুৎবেগে চাবি দিয়া দেরাজ খুলিবার উপক্রম করিলেন। ব্যোমকেশ পকেট হইতে হাত বাহির করিল, হাতে পিস্তল। সে বলিল, ‘দেরাজ খুলবেন না।’
কোণ-ঠাসা বনবিড়ালের মত বিশু মল্লিক ঘাড় ফিরাইলেন; ব্যোমকেশের হাতে পিস্তল দেখিয়া তিনি দেরাজ খোলার চেষ্টা ত্যাগ করিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া শীৎকারের মত একটা তর্জন-শ্বাস বাহির হইল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, বাঁশী বাজাও।’
পুলিসের বাঁশী পকেটে লইয়া আমি প্রস্তুত ছিলাম, এখন সবেগে তাহাতে ফুৎকার দিলাম।
মিনিটখানেকের মধ্যে দারোগা সুখময় সামন্ত ও তাঁহার অনুচরবর্গে ঘর ভরিয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ইন্সপেক্টর সামন্ত, বিশ্বনাথ মল্লিককে অ্যারেস্ট করুন, হাতে হাতকড়া পরান। ওঁর হাতে চাবি আছে, চাবি দিয়ে দেরাজ খুলুন। সাবধানে খুলবেন, অস্ত্রগুলো দেরাজের মধ্যেই আছে।’
বিশ্বনাথ মল্লিককে সহজে গ্রেপ্তার করা গেল না, তিনি বনবিড়ালের মতই আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া লড়াই করিলেন। অবশেষে পাঁচ-ছয় জন মিলিয়া তাঁহাকে চাপিয়া ধরিয়া হাতে হাতকড়া পরাইল। তারপর টেবিলের দেরাজ খুলিয়া দেখা গেল তাহাতে ছাব্বিশটি .৩৮ অটোম্যাটিক, অসংখ্য কার্তুজ এবং চৌদ্দটি হ্যান্ড-গ্রিনেড আছে। কালাবাজারে এগুলির দাম অন্তত বিশ হাজার টাকা।
বিশ্বনাথ মল্লিক পুলিস পরিবৃত হইয়া দাঁড়াইয়া নিষ্ফল ক্রোধে ফুলিতেছিলেন, হঠাৎ উগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ‘বেশ, আমি চোরা-হাতিয়ারের কারবার করি। কিন্তু অমৃতকে আর সদানন্দ সুরকে খুন করেছি তার কোনো প্রমাণ আছে?’
ব্যোমকেশ শান্তকণ্ঠে বলিল, ‘প্রমাণ আছে কিনা সে-বিচার আদালত করবেন। কিন্তু মোটিভ যথেষ্ট ছিল। আর আপনি যে-পিস্তল দিয়ে অমৃতকে মেরেছিলেন সে-পিস্তলটা এর মধ্যেই আছে। গুলিটা অমৃতের শরীরের মধ্যে পাওয়া গেছে। Ballistic পরীক্ষায় সেটা প্রমাণ করা শক্ত হবে না।’
বিশ্বনাথ মল্লিকের চোখদু’টা ঘোলা হইয়া গেল, তিনি হাতকড়াসুদ্ধ দুই হাত দিয়া নিজের কপালে সজোরে আঘাত করিয়া এলাইয়া পড়িলেন।