আট
ওপরে উঠতেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল ওদের। সর্বনাশ, সাইকেলদুটো তো এখানেই ছিল। গেল কোথায়? ভাড়া করা পরের সাইকেল। কে নিল? দু’-দুটো সাইকেলের দাম নেহাত কম নয়। এখন গুণাগার দিতে হলেই তো ফর্সা। তা হলে?
ওরা সাইকেলের দাগ ধরে এদিক সেদিক লক্ষ করতে করতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। চোখের সামনে ওটা কী ও? দেখেই ভয়ে চিৎকার করে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল প্রাণপণে। আর থর থর করে কাঁপতে লাগল। দু’জনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে কনকনে একটা হিমস্রোত।
একটা চিতাবাঘ কপিলধারার কাছে উঁচু একটা পাথরের ওপর দিব্যি আয়েশ করে শুয়ে আছে, আর ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ পিট পিটিয়ে দেখছে। এই দৃশ্য দেখলে কার না হাত-পা ঠান্ডা হয়? যদিও বাঘটা খুব একটা বড়সড় নয়। অ্যালসেশিয়ান কুকুরের সাইজ। তবু বাঘ তো?
কথায় বলে সাপের লেখা বাঘের দেখা। কিন্তু বরাত ভাল হলে যমেও পরে আসব বলে কেটে পড়ে। তা কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। বাঘটা হঠাৎ একটা লাফ মেরে জঙ্গলের গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওরা তখনও স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
খানিক বাদে দু’জনে একটু প্রকৃতিস্থ হবার চেষ্টা
করল।
চাঁদু বলল, যেন পুনর্জন্ম হল। বাঘের মুখ থেকে বাঁচা এ কখনও সম্ভব! কাউকে বললেও বিশ্বাস করবে না।
গোলাপ বলল, না করুক। কিছু যায় আসে না তাতে। এখন আর এখানে থাকা নয়। এমনও তো হতে পারে বাঘটা এখান থেকে সরে গিয়ে অন্য কোনও জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে?
কিন্তু সাইকেল? সাইকেলদুটো কোথায় গেল?
গোল্লায় যাক। দু’-দু’জন মানুষের জীবনের চেয়ে সাইকেলদুটোর দাম নিশ্চয়ই খুব একটা বেশি নয়। হেঁটেই যাব আমরা।
অগত্যা ওরা বাধ্য হয়েই হাঁটা পথ ধরল। এছাড়া উপায়ই বা কী? ফিরে তো আসতে হবে। গভীর ঘন বনানীর মাঝখান দিয়ে সাপের পিঠের মতো অমরকণ্টকের পথ। পিচ ঢালা পরিষ্কার। নেহাত এ সময় ট্যুরিস্ট নেই তাই, না হলে টাঙ্গা আর অটোতে জমজম করত চারদিক। মোটরের মিছিল এসে যেত।
ওরা সবে কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময় জঙ্গলের ভেতর থেকে তিনজন যুবক এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। তিনজনেই অপ্রকৃতিস্থ। আর কী ভয়ংকর চোখের চাউনি তাদের। দেখেই বুক শুকিয়ে গেল। ওরা তিনজনে এমনভাবে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়াল যে আর এক পা-ও এগোতে পারল না ওরা।
গোলাপের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে তখন।
চাঁদু ভয় পেয়েও বীরত্ব দেখাতে ছাড়ল না। বলল, রাস্তা ছোড়ো।
নেহি ছোডুঙ্গা তো?
চাঁদু বলল, তো তুমহারা হাল হাম বেহাল কর দেগা। বলেই আচমকা একজনের একটা হাত ধরে এমন একটা হেঁচকা টান দিল যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে।
কিন্তু বাকি দু’জন ভয়ংকর ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। তারপর একজন করল কী গোলাপকে তুলে নিয়েই ছুটে চলল বনের দিকে।
গোলাপ চিৎকার করে উঠল। ওর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চারদিকে। পাহাড় ও বনভূমি মুখর হয়ে উঠল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অঘটন। প্রথমে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ল ওপর থেকে। পরক্ষণেই সেই বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ল আর একজনের ওপর। তারপর আলুভাতের মতো লোকটাকে মুখে নিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে লাফিয়ে হারিয়ে গেল কোথায় যেন। যে লোকটা চাঁদুর হাতে ঝাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল সে তখন কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়েই প্রাণপণে ছোটা শুরু করেছে।
গোলাপের চিৎকার তখনও দূর থেকে শোনা যাচ্ছে, ছাড়। ছাড় বলছি। ছেড়ে দে আমাকে। আর মাঝে মধ্যে, বাঁচাও বাঁচাও বাঁচাও।
চাঁদু তখন পলায়মান লোকটাকে ধাওয়া করছে। হঠাৎ হাতের কাছে একটা ভারী পাথর পেয়েই ছুড়ে মারল লোকটাকে। পাথরটা গিয়ে লোকটার মাথায় লাগল। এক ঘা-ই যথেষ্ট। ‘মর গয়ি’ বলে বসে পড়ল লোকটি। তারপর শুধুই চিৎকার।
ততক্ষণে গোলাপও ছুটে এসেছে ওর দিকে। সে তখন থরথর করে কাঁপছে।
চাঁদু বলল, তুমি ফিরে এসেছ গোলাপ? কীভাবে রক্ষা পেলে ওর কবল থেকে?
কাঁপা কাঁপা গলায় গোলাপ বলল, ওই পাজির চোখদুটোকে আমি উবড়ে নিয়েছি এই নখ দিয়ে, দেখো।
চাঁদু দেখল গোলাপের হাতের আঙুলগুলো রক্তে মাখামাখি। ওর পোশাকআশাক কাঁটায় বা শুকনো ডালপালার খোঁচায় ছিন্নভিন্ন। ভয়ংকর একটা বিপদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে ও যেন কেমন হয়ে গেছে।
চাঁদু বলল, ভগবান আমাদের দু’-দু’বার বাঁচালেন।
গোলাপ বলল, বাঘ মানুষের শত্রু হয় আবার বন্ধুও। ওই লোকটাকে বাঘে না ধরলে তুমি কিছুতেই রক্ষা পেতে না।
চাঁদু তোমার তুলনা নেই। তাই বলি আর কারও ভয়ে পালিয়ে না গিয়ে চলো এবার যে যার বাড়ির দিকে ফিরে যাই। বাঘ যেখানে বশ মানল আর নিয়তি যেখানে উদার সেখানে কার সাধ্য কেউ আমাদের কিছু করে?
বলল, সে যা হত তা হত। আক্রমণটা তো প্রথমে আমিই করেছি।
চাঁদু বলল, ঠিক বলেছ তুমি। বরং এখন থেকে আমরা সবসময় তৈরি থাকব আর প্রতিটি আক্রমণের মোকাবিলা করব।
ওরা আবার পথ চলা শুরু করল।
খানিক এসেই গোলাপের কী মনে হতে থমকে দাঁড়াল সে। বলল, আমরা এভাবে হেঁটে যাচ্ছি কেন?
তবে কীভাবে যাব? বাঘের পিঠে চেপে?
তা কেন? আমাদের সাইকেলে।
সাইকেল! সাইকেল কোথায়?
ওই লোকগুলোর কাছে। ওরাই চুরি করেছে আমাদের সাইকেল! ওদের মোচড় দিলেই সব বেরোবে।
ঠিক বলেছ তুমি। এই কথাটা তো একবারও মনে হয়নি আমার। সাইকেল চুরি ওরা ছাড়া আর কেউ করতেই পারে না।
অতএব আবার পিছু হটতে হল ওদের।
যে লোকটার মাথায় পাথর ছুড়ে মেরেছিল সে তখনও মাথা ধরে পথের ওপর বসে আছে।
চাঁদু ও গোলাপকে দেখেই গাঁক করে উঠল সে।
গোলাপ বলল, এই তোমরা আমাদের সাইকেল কোথায় রেখেছ?
লোকটি অতি কষ্টে বলল, হম নেহি জানতা।
চাঁদু বলল, শোনো, তোমাদের এক বন্ধু বাঘের পেটে গেছে। এই মেয়েটি একজনের চোখ উবড়ে দিয়েছে। বাকি আছ তুমি। তোমার অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। তা এবার বলবে কি সাইকেলদুটো কোথায়? না বললে কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ করে দেব।
ম্যায় কুছ ভি নেহি জানতা। তুমহারা সাইকিল হমলোক নেহি চুরায়া।
তা হলে কি বলতে চাও যে সাইকেলদুটোকে ভূতে পেল আর ওরা অমনি গড়াতে গড়াতে চলে গেল?
লোকটি চুপ করে রইল।
আর চাঁদু করল কী, বড় সড় একটা পাথর এনে বলল, দেব এটা দিয়ে মাথার ওপর এক ঘা?
লোকটি তখন বলল, নেহি। মাত মারো মুঝে
তা হলে বলো আমাদের সাইকেল কোথায়?
লোকটি কাঁপা কাঁপা হাতে দূরের দিকে দেখিয়ে বলল, উধার যাও। রামুকো পুছো।
রামু! কে রামু?
উ দেখো।
ওরা তাকিয়ে দেখল কপিলধারার কাছে যে নিরীহ ছেলেটি বসেছিল বা যাকে ওরা জিজ্ঞেস করেছিল সিদ্ধিবাবার আশ্রম কোথায়, সেই ছেলেটি উঁচু একটা পাথরের ওপর বসে ওদের গতিবিধি লক্ষ করছে। ওরা সেদিকে লক্ষ করে কয়েক পা এগোতেই ছেলেটি ওদের লক্ষ করে পাথর ছুড়তে লাগল। বড় বড় পাথর। বৃষ্টির ফোঁটার মতো এসে পড়তে লাগল ওদের সামনে। ছেলেটি ছিল ওপরে, ওরা নীচে। ফলে পালটা আক্রমণ করা ওদের পক্ষে সম্ভব হল না। এমন সময় হঠাৎ একটা পাথর এসে চাঁদুর কপালে লাগল। লাগামাত্রই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল সেখান থেকে। সে কী রক্ত! লালে লাল হয়ে গেল। কপালে হাত চেপে পথের একপাশে বসে পড়ল চাঁদু। পাথর আসার তবুও বিরাম নেই। গোলাপ চকিতে চাঁদুকে টেনে আনল একটা বড় পাথরের আড়ালে। চাঁদু তখন থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ ওর বমি পেল। গা-মাথা ঘুলিয়ে চারদিক দুলে উঠল যেন। তারপর ক্রমশই একটু একটু করে নেতিয়ে পড়তে লাগল। একসময় দু’চোখ বুজে অবশ হয়ে গেল ও।
এই মুহূর্তে গোলাপ যে কী করবে কিছু ভেবে পেল না। এখানে চারদিকেই ওদের শত্রু। ওই শান্ত সুবোধ ছেলেটি ওদের শত্রু। যে লোকটি আহত হয়ে বসে আছে সে শত্রু। এছাড়াও আছে সেই নরখাদক বাঘটা। শুধু তাই নয়, ধারেকাছে কোথাও এমন একটু জলও নেই যে ওর মুখে এনে দেয়। আর এইভাবে তো এখানে বসে থাকা যায় না। অথচ লোকালয় এখান থেকে অনেক দূরে। তাই এই অবস্থায় ওর কী করা উচিত কিছুই ভেবে পেল না ও। তবু আশপাশের পরিস্থিতি দেখে ভাল-মন্দর দিকটা একটু বিবেচনা করে হঠাৎ সাহসে ভর করে চাঁদুর হাতদুটো ওর দু’ কাঁধের পাশ দিয়ে টেনে ধরে ওকে পিঠে নিয়েই পথ চলা শুরু করল। দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। খানিক আসার পরই ঘেমে উঠল সে। পথ অসম্ভব খাড়াই। তাই বুকে টান ধরতে লাগল, তবুও হাল ছাড়ল না সে। কষ্ট করেও এগিয়ে চলল।
এইভাবে বেশ খানিকটা পথ যাবার পর একটা পাহাড়িয়া নদী দেখতে পেল সে। ঝরনার আকারে উপলখণ্ডের ওপর দিয়ে যেন নেচে নেচে বয়ে চলেছে। সেইখানে এনে মাটিতে ঘাসের ওপর চাঁদুকে শুইয়ে ওর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। তারপর রুমালটা ভিজিয়ে ক্ষতস্থান মুছিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।
এইবার একটু একটু করে চোখ মেলল চাঁদু। বলল, আমি কোথায়?
গোলাপ বলল, তুমি ঠিক জায়গাতেই আছ। তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে চাঁদুদা ?
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।
করবেই তো। অতবড় একটা পাথরের টুকরো এসে লেগেছে। ডিপ হয়ে কেটে গেছে কপালের পাশটা। অমরকণ্টকে ফিরেই তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। সেলাই করতে হবে মনে হচ্ছে।
খুব ব্লিডিং হয়েছে না?
হয়েছেই তো।
সেইজন্যেই বোধহয় এত বমি ভাব আসছে।
তা আসুক। এখন তুমি কি আমার হাত ধরে একটু একটু করে চলতে পারবে? চেষ্টা করব। কিন্তু এখানে আমি কী করে এলাম? এখানে তো ছিলাম না। আমি অনেক কষ্ট করে তোমাকে পিঠে করে বয়ে এনেছি এখানে। আর পারছি না। বড় ক্লান্ত আমি।
তোমার ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। এত কষ্ট করলে তুমি আমার জন্য?
বন্ধুর জন্য নিজের জীবনও দিতে পারি আমি। কিন্তু এখন আমি হেরে গেছি। সত্যিই আর পারছি না। আসলে ঢালু পথে কোনও কষ্ট নেই। কিন্তু এত খাড়াই যে দম বেরিয়ে গেছে।
গোলাপকে ভর করে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল চাঁদু। তারপর ধীর পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলল। পা যেন চলছে না। গা-মাথা সব টলছে। মনে হচ্ছে যেন কোনও একটা ভারী অসুখ থেকে উঠেছে। তবু যেতে তো হবে।
খানিকটা পথ এসেছে এমন সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল একদল কাঠুরের সঙ্গে। এরা এখানকার পাহাড়ি। গভীর জঙ্গল থেকে অরণ্যের নিধন করে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরছিল। ওদের দু’জনের ওইরকম অবস্থ। দেখেই ছুটে এল তারা, কা হুয়ারে মুন্নু?
গোলাপ আধা হিন্দি আধা বাংলায় সব কথা খুলে বলল ওদের।
সব শোনার পর দলের একজন বলল, থোড়া বইঠিয়ে। ও সাইকিল মিল যায়েগা তুমকো। লেকিন ইধার শের ক্যায়সে আ গিয়া?
চাঁদু বলল, ক্যায়সে আ গিয়া তা জানি না ভাই। তবে এসেছে, একজনকে নিয়েও গেছে। আর সাইকেলের জন্য আমরা চিন্তা করি না। আমরা এখুনি গিয়ে থানায় খবর দিচ্ছি। সাইকেল আমরা পাবই।
নেহি নেহি। পোলিশবালেকা পাস যানেকা জরুরত নেহি। সে কী! পুলিশে খবর দেব না?
আর একজন বলল, তুম সব জেরা বইঠো না বাবা। ইতনা দূর পয়দাল কিউ যাবে? ও রামু ছোকরাকা দিমাগ ঠিক নেহি। কুছ গড়বড়ি হ্যায়। ওহি নে চুরায়া তুমহারা সাইকিল। হম আতে হেঁ। বলেই একজনকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল লোকটি। “
ওরা বসে রইল। দেখাই যাক না, যদি পাওয়া যায় সাইকেলদুটো। হাজার হলেও পরের তো।
ওরা বসে বসে পাহাড়িদের সঙ্গে নানারকম গল্প করতে লাগল। এই অমরকণ্টকের পথে চোর ডাকাতের গল্প। হিংস্র জন্তুজানোয়ারের গল্প, পাহাড়ের ধস নামার গল্প। ওরা বলল, অমরকণ্টকের পথ এখন সুগম হলেও ভৃগুকমণ্ডলের পথ নাকি এখনও দুর্গম। এখনও সেখানে দিনমানেও বাঘ-ভালুক বের হয়।
এইভাবে কথা বলতে বলতেই মিনিট কুড়ি হয়ে গেলে সাইকেলদুটো নিয়ে পাহাড়ি দু’জন ফিরে এল। সেই সঙ্গে কান ধরে টেনে আনল সেই ছেলেটিকে, যে পাথর ছুড়ে চাঁদুর কপাল ফাটিয়েছিল। ওরা ছেলেটিকে টেনে এনেই চাঁদুকে দেখিয়ে বেশ কয়েক ঘা চড়চাপড় দিল। দিয়ে বলল, দেখাতনি, ক্যায়সা হাল বনা দিয়া তু নে?
রামু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ওদের দিকে। সে চাহনি এমনই যে ও স্বচক্ষে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, এই কাজ ও করেছে। কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটোকে নামিয়ে নিল সে।
গোলাপ ওর পা থেকে চটি খুলে মারতে যাচ্ছিল ওকে। চাঁদুই বারণ করল। ছেলেটার যখন সত্যি সত্যিই মাথার ঠিক নেই, তখন অযথা ওকে মারধোর করেই বা লাভ কী? স্বভাবের তো পরিবর্তন হবে না।
কাঠুরেরা বলল, রামু ছেলেটা যে বদ্ধ উন্মাদ তা নয়। মগজ যখন ঠিক থাকে তখন খুব ভাল। কিন্তু যখন বেগড়ায় তখন কী যে না করে, তার ঠিক নেই। তখন ওকে ধরে রাখাই দায়।
যাই হোক, ওরা সাইকেল পেয়ে কাঠুরেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চলল সার্কিট হাউসের দিকে।
চাঁদু যে কীভাবে সাইকেলে চেপে যাচ্ছিল তা সে-ই জানে। কেবলই মনে হচ্ছিল সাইকেলসুদ্ধ গড়িয়ে অন্যদিকে চলে যাবে বুঝি।
ওর অবস্থা দেখে গোলাপ বলল, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে চাঁদুদা?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে পড়ে যাব। ঠিকমতো ব্যালান্স রাখতে পারছি না। গোলাপ সাইকেল থামিয়ে বলল, তা হলে নেমে পড়ো। তুমি বরং আমার সাইকেলে এসে বসো। আমি তোমাকে ডবল ক্যারি করি।
সাইকেল থেকে নেমে চাঁদু বলল, তা হলে এই সাইকেলটার কী হবে? ওটাকে এখানেই কোথাও লুকিয়ে রাখো। পরে আমি কারও সঙ্গে এসে বরং নিয়ে যাব।
তার চেয়ে আমি বলি কী, তোমাকে ডবল ক্যারিও করতে হবে না, কিছুই না। তুমি একটু জোরে সাইকেল চালিয়ে সোজা থানায় চলে যাও। তারপর সেখানে গিয়ে আমার অবস্থার কথা বিরজুর বাবাকে বলে কাউকে নিয়ে চলে এসো। বিরজু যদি থাকে তো ওকেও নিয়ে আসতে পার।
সেটা কি ঠিক হবে।
কেন ঠিক হবে না কেন?
একে তোমার ওপর একটা অশুভ গ্রহর কোপ পড়েছে। তার ওপর এই নির্জনে একা একা থাকবে? একটু আগেই একজনকে বাঘে ধরেছে। মনে আছে তো?
ভয় নেই। আমি সাবধানেই থাকব।
থেকো তা হলে। আমি এখুনি আসছি।
চাঁদু পথের ধারে এক জায়গায় সাইকেলটা রেখে একটি পাথরের ওপর বসে রইল। আর গোলাপ সাইকেল নিয়ে ঝড়ের বেগে হারিয়ে গেল সেই নির্জন পাহাড়ে পথের বাঁকে।
সেই যে গেল গোলাপ আর তার ফিরে আসার নামটি নেই। চাঁদু বসে থেকে থেকে অধৈর্য হয়ে উঠল। এত সময় তো লাগার কথা নয়। তা হলে কি কাউকে পায়নি ও? না পেলে ও নিজেও তো ফিরে আসতে পারত।
চাঁদু আর অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়াল এবার। দুশ্চিন্তা এবং উত্তেজনা ওকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে এখন আর নিজেকে আগের মতো দুর্বল মনে হচ্ছে না। ও সাইকেল নিয়ে পথে নামল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সার্কিট হাউসের দিকে।
ও যখন শহরের কাছাকাছি এসে গেছে, তেমন সময় দেখল অন্য একটা সাইকেলে বিরজু দ্রুত আসছে ওর দিকে।