অমরকণ্টক রহস্য – ৭

সাত

সকাল সকাল শোয়ার জন্য খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল ওদের। কিন্তু এত ভোরে কে আর ওঠে, একমাত্র পাখিরা ছাড়া? চারদিকে যেমনই সবুজ বনানী, তেমনি পাখিদের কিচির মিচির। ওরা লেপমুড়ি দিয়ে চুপচাপ পড়ে রইল। ডবল বেডেড রুম। কিন্তু বিছানা সেপারেট। খুব ভাল ব্যবস্থা। মশা নেই। ছারপোকাও নেই।

গোলাপ বলল, এই সময় একটু চা পেলে বেশ হত।

চাঁদু বলল, যা বলেছ। একবার একটু রোদ উঠুক। তবেই ঘর থেকে বেরোব। এখন তো চোখেমুখে জল দিতেও ভয় লাগছে।

গোলাপ বলল, কাল রাত্তিরে পুলিশ দেখে আমি কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

আমিও।

এমন সময় দরজায় টক টক শব্দ।

চাঁদু উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল একটি আট-দশ বছরের ছেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

ছেলেটি বলল, চায় কফি কুছ পিয়োগে?

গোলাপ বলল, হ্যাঁ জরুর। তবে গরম থাকে যেন।

ছেলেটি চলে যাচ্ছিল। গোলাপ বলল, এই শোনো, একটু গরম পানির ব্যবস্থা করে দিতে পার? মুখ ধোব।

ছেলেটি আমতা আমতা করতে লাগল।

রুপিয়া মিলেগা। এক রুপিয়া দেগা তুমকো।

রুপিয়ার নাম শুনেই লাফিয়ে উঠল ছেলেটি। কোনওদিকে না তাকিয়ে ছুটে চলে গেল দোকানের দিকে। পরক্ষণেই এক মগ ফুটন্ত জল এনে বলল, লিজিয়ে।

বাথরুমে কলের জল তখন বরফের মতো ঠান্ডা। সেই জলের সঙ্গে গরম জল মিশিয়ে চোখমুখ ধুয়ে পরিষ্কার করল। তারপর ছেলেটি চা নিয়ে এলে চা খেল। চায়ের দাম জলের দাম নিয়ে ছেলেটি চলে যেতেই, ওরা নিজেদের একটু চাঙ্গা মনে করল এবার। অল্প অল্প রোদের আভাও তখন ফুটে বেরোচ্ছে পূবের আকাশ থেকে। তাই আর ঘরে থাকতে ভাল লাগল না কারও। দু’জনেই হি হি করতে করতে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর ঢাল বেয়ে একটু নামতেই দেখতে পেল বিরজুকে।

বিরজু ওদের দেখেই ছুটে এল। বলল, এই আমি ভাবছিলাম তোমাদের ওখানে যাব। মন্দির দর্শন করিয়ে আনব।

গোলাপ বলল, মন্দির দর্শন কাল আমরা নিজেরাই করে নিয়েছি। আসলে এটা তো আমার চেনা জায়গা।

তা হলে শোনমুড়া চলো।

শোনমুড়া হচ্ছে শোন নদের উৎস।

গোলাপ বলল, শোনো বিরজু, তোমাকে শোনমুড়া, কপিলধারা, দুধধারা কোথাও নিয়ে যেতে হবে না। তুমি যদি পার তো, আমাদের দু’জনকে একবার ভৃগুকমণ্ডল নিয়ে চলো। ওই একটা জায়গাই আমরা সাহস করে যেতে পারব না। ভৃগুকমণ্ডলের নাম শুনে বিরজু কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ও হাম নেহি যা সকতা। কাহে?

ও রাস্তা মুঝে মালুম নেহি। তা ছাড়া আমার মাজি হামকো উধার নেহি জানে দেঙ্গে।

ওদের কথা শুনে একজন দোকানদার বলল, ও জায়গায় দল বেঁধে না-গেলে যাওয়া যায় না। গভীর বনের ভেতর দিয়ে পথ। বাঘ-ভালুক সবকিছুই মিলতে পারে ও পথে।

চাঁদু উৎসাহিত হয়ে বলল, তাই নাকি?

গোলাপ বলল, আমি একবারই গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে। আমাদের দলে অন্তত পঞ্চাশজন যাত্রী ছিল।

দোকানদার বলল, কী হবে ওখানে গিয়ে? অনেকেই যায় না। এখানেই যা আছে দেখলে মন ভরে যাবে। যাও না, কপিলধারায় গিয়ে বসে থাকো। গোলাপ বলল, কপিলধারায় তো যাবই। ওই তো এখানকার স্বর্গ।

বিরজু বলল, তোমরা এক কাজ করো, কপিলধারা অনেক দূর। হেঁটে তো যেতে পারবে না। তাই তোমাদের টাঙ্গা একটা করতেই হবে। তাতে হবে কী টাকা লেগে যাবে অনেক। এখন আমার কথা যদি শোনো তা হলে এক কাজ করো, এইখানে ঘণ্টা হিসেবে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। তোমরা সাইকেল চাপতে জান?

চাঁদু বলল, জানি।

গোলাপ বলল, আমিও জানি।

তোমরা তা হলে দু’জনে দুটো সাইকেল নিয়ে নাও। আট আনা করে ঘণ্টা। দু’জনে এক টাকায় হয়ে যাবে। এখন ওই সাইকেলে চেপে তোমরা কপিলধারা শোনমুড়া যেখানে যাবে চলে যাও। কাজ মিটে গেলে সাইকেল জমা দাও। পরে আবার ভাড়া নাও।

চাঁদু বলল, দি আইডিয়া।

গোলাপ বলল, তুমি বেশ ভাল যুক্তি দিয়েছ তো। এখন চলো সাইকেলের দোকানটা একবার আমাদের দেখিয়ে দাও।

বিরজু ওদের সাইকেলের দোকান দেখিয়ে দিল।

ওরা বিরজুর সঙ্গে আলাপ করতে করতে একটা চায়ের দোকানে ঢুকল। ঘন দুধ দিয়ে কী সুন্দর চা তৈরি করেছে ওরা। শুধু তাই নয় এত বড় বড় শিঙাড়া আর অমৃতি তৈরি করেছে যে দেখেই লোভ হল ওদের।

ওরা প্রত্যেকে দুটো করে শিঙাড়া-অমৃতি খেয়ে চা খেল এক কাপ করে। তারপর দু’জনে দুটো সাইকেল নিয়ে হাওয়ায় উড়ে চলল শোনমুড়ার দিকে। সাতপুরা আর বিন্ধ পর্বতের মিলনস্থল হচ্ছে মেকল। অর্থাৎ এই অমরকণ্টক। এরই একান্তে অতি নির্জনে শোন নদের উৎস। উৎসের কাছ থেকে এই নদ ঝরনার রূপ ধরে ঝরে পড়ছে অনেক নীচে। তারপর যে কী হচ্ছে তা দেখা যায় না।

ওরা সাইকেল রেখে উঁকিঝুঁকি মেরে নীচে তাকিয়ে দেখল, কিছু দেখা যায় কি না। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। এরপরে চলে গেল নর্মদা মায়ের বাগিচা বা উদ্যানে। ঘন বনের মধ্যস্থলে উঁচুনিচু পাহাড়ের পটভূমিতে এ এক মনোরম উদ্যান। নাম মাঈ কি বাগিয়া। এইখানেই ওদের চোখে পড়ল সেই বিখ্যাত গোলেবকায়লি ফুল। যার কথা বাসে আসা সেই সিদ্ধিবাবা বলেছিলেন। যে ফুলের সঙ্গে গোলাপের তুলনা করেছিলেন। যে ফুলের প্রশংসায় উর্দু কবিরা পঞ্চমুখ। একমাত্র এইখানকার মাটিতে ছাড়া যে ফুল কোথাও গজায় না। এই ফুল চোখের পক্ষেও খুব উপকারী। এই ফুলের সুরমাও তাই বিক্রি হচ্ছে এখানে। অনেকের দেখাদেখি গোলাপও ওর চোখের কোলে সুরমার রেখা আঁকল।

মাঈ কি বাগিয়া থেকে ওরা আবার এল নর্মদা মন্দিরের কাছে। সেখানে তখন অগণিত তীর্থযাত্রীর ভিড়। ওরা এবার অন্য কোথাও না গিয়ে অমরেশ্বর শিবের মন্দিরে একটা প্রণাম করে চলল কপিলধারায়। এই অঞ্চলের প্রধান দর্শনীয় স্থানে।

কপিলধারার পথ দুর্গম নয়। তবে অতুলনীয় প্রকৃতির শোভা সৌন্দর্যমণ্ডিত। অমরকণ্টক থেকে প্রায় দশ কিলোমিটারের পথ। কিন্তু প্রকৃতি যেখানে অনবদ্য সেখানে এই পথ এমন আর কী? পথ কখনও উঁচুনিচু, কখনও এবড়ো খেবড়ো। উৎস থেকে নির্গত হয়ে নর্মদা গায়ত্রী সাবিত্রী সঙ্গমের পর গভীর অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে কপিলধারায় পুনরাবির্ভূতা। এইখানে আরও দুটি ছোট পাহাড়িয়া নদী এসে মিশেছে নর্মদার সঙ্গে। তার একটির নাম এরশ্তী, অপরটির নাম কপিলা। এরণ্ড ও কপিল এই দুই মহামুনির নামেই নদী দুটির নাম। এবং এইখানেই প্রায় সত্তর ফুট নীচে নর্মদার প্রথম প্রপাত।

ওরা ক্লান্ত অবসন্ন দেহে একপাশে সাইকেল দুটিকে শুইয়ে রেখে পিচ্ছিল পথে সেই ধারার কাছে এসে প্রপাত দেখতে লাগল। একটি দশ বারো বছরের ছেলে বসেছিল সেখানে। চাঁদু তাকে জিজ্ঞেস করল, সিদ্ধিবাবাকা আশ্রম কিধার? ছেলেটি বলল, আউর নীচে উতারো। দুধধারা কি পাস।

চাঁদু গোলাপের মুখের দিকে তাকাল।

গোলাপ বলল, আমি দুধধারায় গেছি এর আগে অনেকবার। কিন্তু ওই সাধুকে কখনও দেখিনি।

রাস্তা চেনো তুমি?

চেনাচিনির কিছু নেই। একটাই রাস্তা এর।

ওরা সেই নির্জনে বৃক্ষছায়ায় অন্ধকারে কপিলধারার গতিপথ ধরে আরও নীচে নামতে লাগল। অনেকটা নামার পর এক জায়গায় একটু উচ্চস্থানে সত্যি সত্যিই একটা আশ্রম দেখতে পেল ওরা।

সিদ্ধিবাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন আশ্রমের সামনেই। ওদের দেখে বললেন, এত দেরি হল যে?

আমরা মাঈ কি বাগিয়া দেখতে গিয়েছিলাম বাবা।

তা হলে নিশ্চয়ই তোমরা গুলেবকায়লি ফুল দেখেছ? একটা দুটো।

সিদ্ধিবাবা ওদের আশ্রমের দাওয়ায় বসিয়ে বললেন, দেখেছ তো কীরকম জায়গায় আমি থাকি? তোমরা এখানে এক দণ্ডও থাকতে পারতে না। তা ওদিককার খবর কী? বিরজু এল না কেন? ওর তো আসার কথা ছিল তোমাদের সঙ্গে।

গোলাপ বলল, এ পর্যন্ত রাস্তা আমার চেনা। তাই ওকে সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। আর ওদিককার খবর বলতে আমরা সার্কিট হাউসে জায়গা পেয়ে গেছি। তাই রামবাঈ ধর্মশালায় থাকিনি। কাল রাতে বিরজুর বাবার সঙ্গে একজন ইনস্পেক্টর এসেছিলেন। আমরা তাঁকে সব বলেছি। উনি হয়তো টেলিফোনে আমাদের বাড়িতেও খবর পাঠিয়েছেন।

তা হলে তো সমস্ত প্রবলেমই সলভড্ হয়ে গেছে। তবু তোমরা দু’-একটা দিন সাবধানে থেকো। কেমন? বিপদ একটা ঘটে যেতে বেশিক্ষণ নয়। অবশ্য অমরকণ্টক খুব ছোট্ট জায়গা। এখানে বদমায়েশি করে কেউ পার পাবে না। তোমরা বিকেলে মন্দির এলাকায় থেকো। আমি গিয়ে ধরে নেব তোমাদের। সকলকে একটু বলেকয়েও দেব, যাতে কোথাও কোনও অসুবিধে না হয়।

ওরা সিদ্ধিবাবাকে প্রণাম করে ফিরে এল।