অমরকণ্টক রহস্য – ৬

ছয়

অল্প সময়ের মধ্যেই শহর ছেড়ে পার্বত্যপথে এসে পৌঁছল বাস। তারপর পাক খেয়ে খেয়ে পাহাড়ে ওঠা। ঘন সবুজ গাছপালায় আবৃত পাহাড়ের শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল চাঁদু। কী সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্য। মাঝে মাঝে বাস থামছে। আর দলে দলে লোক উঠছে। এরা সবাই স্থানীয় অধিবাসী। যাবে নর্মদা তীর্থে। স্নানপুণ্য সঞ্চয়ে। মাঝে মাঝে মনের আনন্দ প্রকাশ করে ধ্বনি দিচ্ছে, নর্মদা মায়ি কী জয়।

বাসে চেপে যেতে যেতে কত হনুমান আর ময়ূর দেখতে পেল ওরা।

গোলাপ বলল, আগে এই পাহাড়ে বুনো বাঘ আর ভালুকের দাপট ছিল খুব। যেসময় এখানে বাস ছিল না সেই সময় পদব্রজে লোক এখানে আসত। কত মানুষ যে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে তখন তার লেখাজোখা নেই। তবে সে ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা। পাহাড়কে জয় করার, দুর্গম পন্থাকে লঙ্ঘন করার আনন্দই ছিল আলাদা। অরণ্যের ঘ্রাণ নিয়ে বন্য জন্তুদের সঙ্গে যুদ্ধ অথবা মিতালি করতে করতে সেই পথচলার আনন্দ বাসযাত্রায় কই?

সে পথে তুমি গেছ কখনও ?

বাবার মুখে শুনেছি। আমার ঠাকুরদাদা নাকি একবার ওইভাবে এখানে এসেছিলেন। নর্মদা পরিক্রমা করেছিলেন তো উনি। তখনই এসেছিলেন। আমরা যতবার এসেছি, ততবার বাসে। আসলে বাস চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই পায়ে হাঁটা পথের মহাপ্রস্থানও হয়ে গেছে।

ওদের পাশে এক সাধুবাবা বসেছিলেন। বললেন, তুম দোনো নর্মদা মায়ি কী দর্শন করনে যা রহে হো?

ওরা বলল, হ্যাঁ।

বহৎ কমতি উমর তুমহারা। তারপর মিষ্টি হেসে বললেন, নর্মদা পরিক্রমা করো গে?

গোলাপ বলল, না। শুধুই দর্শন করব। দু’-একটা দিন থাকব।

সাধু কী যেন দেখলেন, কী যেন বুঝলেন। তারপর বললেন, জিন্দগি ভর তুম দোনো এক সাথ দোস্তিমে রহো। ভগবান করে বিছোড় না হো।

চাঁদু ও গোলাপ আবেগভরা চোখে তাকাল সাধুর দিকে। সাধুজি বললেন, ক্যা নাম তুমহারা?

চাঁদু বলল, আমার নাম চন্দ্ৰকান্ত।

গোলাপ বলল, আমার নাম গোলাপ।

সাধু বললেন, ফুল য্যায়সি। তো তুমকো গুলাব নেহি গুলেবকায়লি হোনা চাহিয়ে। ও ফুল নন্দনকানন কা পারিজাত কী মফিক। ও কঁহি নেহি মিলতা। স্রেফ ইধরিসে মিলতা। দেখোগে? হাম তুমকো দিখলায়গা।

সাধুজি বড়ই রসিক। আর অত্যন্ত ভাল মানুষ। ওঁর মুখেই ওরা শুনল নর্মদা কী কহানি।

এক গভীর অরণ্যবেষ্টিত উচ্চ গিরিচূড়ায় শিব ছিলেন কঠোর তপস্যারত। কতদিন, কত বছর, কত যুগ ধরে যে তিনি তন্ময় ধ্যানময় হয়েছিলেন তার হিসেব শিবও রাখেননি। ঠিক এমনিই সময়ে এক শুভক্ষণে শিবের নীলকণ্ঠ থেকে নির্গত হলেন নর্মদা। আবির্ভূতা হয়েই তিনি শিবের দক্ষিণ চরণে দাঁড়িয়ে শুরু করলেন শিবের তপস্যা। সেই তপস্যার প্রভাবে শিবের তপস্যাও টলে গেল। একটু একটু করে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। দেখলেন এক অপূর্ব সুন্দরী কুমারী কন্যা তাঁর দক্ষিণ চরণে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই কুমারী তাপসীর ধ্যানভঙ্গ করিয়ে সস্নেহে ডাকলেন তিনি, কে মা তুমি? কন্যা বললেন, আমি যে আপনার নীলকণ্ঠ নিঃসৃতা কন্যা। শিব বললেন, তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। কী বর চাও তুমি বলো? কন্যা বললেন, আমি আপনার নীলকণ্ঠ নিঃসৃতা হলেও যেন বর প্রভাবে অমৃতময়ী হতে পারি। শুধু তাই নয়, গঙ্গার মতো মাহাত্ম্য যেন আমারও হয়। আমার সলিলে স্নান করে যেন সর্বপাপমুক্ত হয় মানুষ। শিব বললেন, তাই হবে। শুধু স্নানে নয়, তোমাকে দর্শন করলেও মোক্ষ হবে মানুষের। কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর পরে গঙ্গার মাহাত্ম নষ্ট হলে গঙ্গামাহাত্ম্যও লাভ করবে তুমি। কন্যা বললেন, আমি আরও বর চাই পিতা। শিব বললেন, আরও কী বর চাও তুমি? কন্যা বললেন, আপনার দেহ হতে নির্গত হয়েছি আমি। তাই এমন বর দিন যেন সবসময় আপনার সঙ্গে আমি একাত্ম থাকতে পারি। শিব প্রসন্ন হয়ে বললেন, বেশ। আজ থেকেই তুমি শিব মহিমায় মহিমান্বিত হবে। আমার নিত্যতৃপ্তিবিধায়িনী হয়ে চিরকুমারী থাকবে। তোমার নাম হবে নর্মদা। যেখানে তুমি, সেখানে আমি। তাই তো নর্মদা কী কঙ্কর বিলকুল শংকর।

কাহিনি শুনে অবাক হয়ে গেল দু’জনে।

সাধুজি আবার বললেন, এই নর্মদা হল আটশো মাইল দীর্ঘ। এই দীর্ঘপথে কোথাও পর্বত, কোথাও অরণ্য, কোথাও মরুভূমি, আবার কোথাও বা সমৃদ্ধ জনপদ। আর সেই গতিপথের উভয় তীরেই অসংখ্য শিবের মন্দির। বাস এসে অমরকণ্টকে থামল।

সবাই নেমে গেলে সব শেষে নামল চাঁদু ও গোলাপ। আর জটাজুটধারী সাধুবাবা।

সাধু ব্ললেন, তোমরা দু’জনেই এসেছে তা হলে? আর কেউ আসেনি? না।

তোমাদের দেখে বড় কৌতূহল হচ্ছে আমার। তোমাদের পরিচয়?

গোলাপ বলল, তার আগে বলুন আপনি কি এখানেই থাকেন না তীর্থ করতে

এসেছেন?

আমি এখানেই থাকি মা। দুগ্ধধারার কাছে নির্জনে আমার আশ্রম।

আপনি বাঙালি?

একজন যোগী এবং ভারতীয়।

গোলাপ বলল, আমরা নিরাশ্রয়।

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস বুঝি?

না বাবা, ঠিক তা নয়। এই যে ছেলেটিকে দেখছেন এর জীবন বিপন্ন। ভেবেছিলাম বরফানিবাবার আশ্রমে ওকে লুকিয়ে রাখব কয়েকটা দিন। এখন আপনি যদি একটু কৃপা করেন…।

সাধুবাবা সস্নেহে চাঁদুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এই কথা। কোনও ভয় নেই তোদের। আয়, আমার সঙ্গে আয়। তবে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে কিন্তু। পারবি তো?

ওরা দু’জনেই বলল, হ্যাঁ পারব।

যেতে যেতেই ওরা ওদের পরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলল সাধুবাবাকে। আগাগোড়া সমস্ত কথা।

সাধুবাবা সব শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, এখানে যখন এসে পড়েছিস তখন আর ভয় নেই। কেউ তোদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। শান্তিতে থাক তোরা। তোদের বাড়িতে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা আমিই করব। এমন সময় ওদেরই বয়সি একটি ছেলেকে সাইকেলে চেপে নির্জন পাহাড়িপথ ধরে আসতে দেখে চেঁচিয়ে ডাকলেন সাধুজি, বিরজু ! এ বিরজু ! জেরা ইধার তো আও।

স্বাস্থ্যবান সুন্দর একটি ছেলে সাইকেল নিয়ে ওদের কাছে এল।

সাধুজি বললেন, এই, তোদের ধর্মশালায় একটা ঘর পাওয়া যাবে রে? বিরজু ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যা পাওয়া যাবে। এখন তো যাত্রী একদম নেই। তা হলে এই ছেলেমেয়ে দুটোকে ঢুকিয়ে দে তো একটা ঘরে।

বিরজু ওদের দু’জনকে দেখে বলল, আমার মাতাজি রাজি হবেন না। কানুন নেহি।

কাহে কো?

না। এইরকম বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গার্জেন না থাকলে ঘর দেওয়া যায় না।

তোমার মাজিকো আমার প্রণাম তো দেও। আমি গিয়ে দেখা করছি মাজির সঙ্গে। আর তোমার পিতাজির সঙ্গেও একটু বাতচিত আছে আমার।

বিরজু বলল, ঠিক আছে, তবে ওরা আসুক।

চাঁদু বলল, ধর্মশালা কেন। আপনার আশ্রমে আমাদের নিয়ে যাবেন না বাবাজি?

সাধুজি বললেন, তোদের যাতে কোনওরকম অসুবিধে না হয় আমি সেইজন্যেই এইরকম ব্যবস্থা করলাম রে বেটা। আমার আশ্রম এখান থেকে অনেক দূর। তা ছাড়া ওখানে সন্ধের পর বাঘ-ভালুকের উপদ্রব আছে। আর ওখানে থাকলে তোরা খাবার পাবি না। ঘুরে বেড়াতে পারবি না। এই যে ছেলেটি তোদের নিয়ে যাচ্ছে এ তো বড় সাংঘাতিক ছেলে। এই হবে তোদের বডিগার্ড। আমি ওকে সব বলে দেব। রামবাঈ ধর্মশালার কেয়ারটেকার ওরা। কাজেই কোনও অসুবিধে হবে না তোদের।

চাঁদু ও গোলাপ বাবাজিকে প্রণাম করে বিরজুর সঙ্গে চলল।

সাধুবাবা বললেন, আজকের দিনটা বিশ্রাম নে। কোথাও যাস নে যেন। কাল সকালে একবার দেখা করিস।

ওরা বিরজুর সঙ্গে রামবাঈ ধর্মশালায় এসে হাজির হল। খুব একটা উন্নতমানের ধর্মশালা নয়। তবে থাকা যায়। ধর্মশালাটি অমরকণ্টকের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। এর আশেপাশে জমজমাট দোকান পসার হোটেল প্রভৃতি। একপাশে একটু উচ্চস্থানে টিলার ওপর সার্কিট হাউস।

ওরা যেতে ওদের বসিয়ে রেখে বিরজু একটা খাতা নিয়ে এসে ওদের নামধাম লিখে নিল। তারপর একটি ঘর খুলে দিয়ে বলল, সামকো বিস্তারা মিলেগা। আভি তুম সামান রাখো। এহি মে রহো।

বিরজুর মা এসে একবার দেখে গেলেন ওদের।

বিরজু বলল, চায় পিয়োগে? এক এক রুপাইয়া।

গোলাপ বলল, এখন আর চা খাব না। এবার স্নানটান করে ভাত খেয়ে নেব একেবারে।

চাঁদু বলল, খাই না এক কাপ। এমন সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানকার। স্নান খাওয়া আরও একটু বেলা করেই করব।

চাঁদু বিরজুকে চা আনতে বলল।

কিছু সময়ের মধ্যেই দু’জনের জন্য দু’ কাপ চা নিয়ে চলে এল বিরজু। ওরা আয়েশ করে তৃপ্তির সঙ্গে চা খেতে লাগল ঘরের ভেতরে বসে।

যে ঘরটিতে ওরা জায়গা পেয়েছিল তার মাটির মেঝে। দেওয়ালও মাটির। মাথায় টিনের চাল। স্যাঁত স্যাঁত করছে চারদিক। ঘরের মেঝেয় একটা পুরু শতরঞ্চি পাতা আছে। সেটা এত বিশাল যে যাত্রার আসরে পাতার মতো। কিন্তু সেও এমন স্যাঁতসেতে যে তাতেও শোয়া যাবে না। অথচ শীত এখানে প্রচণ্ড।

এত বেশি শীত যে পৌষ মাসের কনকনে ঠান্ডাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। পেনড্রা থেকে দূরত্ব মাত্র তেতাল্লিশ কিমির। উচ্চতাও তিন হাজার চারশো তিরানব্বই ফুট। তবু কী প্রচণ্ড শীত।

গোলাপ বলল, এখানে সারা বছরই শীত। মধ্যপ্রদেশ সরকারের গ্রীষ্মাবাস হচ্ছে এ অমরকণ্টক। তুমি মেঘদূত পড়েছ চাঁদুদা? না।

আমি পড়েছি। যদি পড়তে তা হলে দেখতে এই অমরকণ্টক তোমার চোখে নতুন রূপে ধরা দিত। কালিদাসের বর্ণনার সেই আম্রকূটই আজকের অমরকণ্টক। মেকল পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া। নর্মদার উৎপত্তি এইখানেই। আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে এই নদী। এর একদিকে বিন্ধ্য পর্বতমালা, অপরদিকে সাতপুরা। শাডোল, মান্ডালা, নরসিংপুর, হোসাঙ্গাবাদ, খান্ডোয়া ও খরগোন জেলার ওপর দিয়ে গুজরাটে সৌরাষ্ট্রের কাছে ব্রোচে সমুদ্রে মিলেছে নর্মদা।

নর্মদা সঙ্গম দেখেছ তুমি?

না যাইনি। তবে যাবার খুব ইচ্ছে আছে।

চা খাওয়া শেষ করে ওরা ঘরের দরজায় শিকল দিয়ে বাইরে এল। একটা তালা তো চাই। গোলাপ গিয়ে বিরজুর মাকে বলতেই উনি তালার ব্যবস্থা করে দিলেন।

অমৃতভূমি অমরকণ্টক গোলাপের একাধিকবারের পরিচিত স্থান। বছর বছর আসে ওরা। কখনও সার্কিট হাউসে, কখনও বরফানিবাবার আশ্রমে থাকে। তা ছাড়া একমাত্র শিবরাত্রির মেলার সময় ছাড়া এখানে থাকার তো কোনও অসুবিধে নেই। তাই ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে বেড়ায় ওরা। এখন শীতের দাপট বেশি বলে যাত্রীর ভিড় একদমই নেই। আসলে এপ্রিল থেকে জুনই হচ্ছে এর উপযুক্ত সময়। তবুও এর মধ্যে হঠাৎ করে যদি কখনও বৃষ্টি হয় তা হলে বৈশাখেও মাঘের শীত।

গোলাপের সঙ্গে বিরহী যক্ষের বেদনাবিধুর এই মেকল পর্বতে পরিভ্রমণ করতে সত্যিই ভাল লাগল চাঁদুর। প্রকৃতি যে কত সুন্দর হতে পারে তা এখানে না এলে বুঝি অনুভব করা যায় না। যেতে যেতেই হঠাৎ একসময় বলল চাঁদু, এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি গোলাপ?

আপাতত নর্মদা মায়ের মন্দিরে। সেখানেই দেখতে পাবে এই পবিত্র নদীর উৎস।

এখন আমার কী মনে হচ্ছে জান?

কী মনে হচ্ছে?

মৃত্যুরূপী মহাকাল আমাদের তাড়া করতে করতে একেবারে স্বর্গের উদ্যানে নিয়ে এসে ফেলেছে। তোমাকে মনে হচ্ছে তুমি গোলাপও নও, সাধুবাবার গোলেবকায়লিও নও, তুমি এক গন্ধর্বকন্যা। আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে এসেছ এই স্বর্গলোকে। নিজেকেও আর অসহায় বলে মনে হচ্ছে না আমার। মনে হচ্ছে আমি নিজেও এক দেবদূত। এই অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির রাজ্যে আমিও এক দিগ্বিজয়ী বীরের মতো রাজত্ব স্থাপন করতে পারি। এই অরণ্য-পর্বতে আমার প্রাসাদ গড়ে উঠবে। আমি পৌরাণিক রাজাদের মতো ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতে যাব। মৃগয়া করব। তুমি…।

সর্বনাশ! তোমার বাবা-মা কাঁদবে না? জুলির কী হবে? বাড়ি ফিরতে হবে না?

চাঁদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সত্যিই আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। খাঁচার পাখি একবার ছাড়া পেলে আর কী সে খাঁচার ভেতর ফিরতে চায়? আমারও তাই একবারও মনে হচ্ছে-না ঘরে ফিরি। মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে এখানে থেকে যাই।

মনে হচ্ছে। মনে হওয়া ভাল। তেমন সুযোগ যদি পাও সত্যিই কি তুমি পারবে এখানে থাকতে?

পারব। অবশ্য তুমিও যদি আমার সঙ্গে থাকো।

গোলাপ বলল, ওই দেখো মায়ের মন্দির।

চাঁদু দেখল এই তীর্থভূমিতে শ্বেতশুভ্র একটি মন্দির সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। মন্দিরের চূড়ায় ধ্বজা উড়ছে পতপত করে। মন্দিরের সামনেই একটু কুণ্ড। কত লোক স্নান করছে সেখানে।

গোলাপ বলল, এই হল নর্মদাকুণ্ড।

চাঁদু বলল, এইখানে স্নান করেই মানুষের মোক্ষ লাভ হয়?

হ্যাঁ। আর ওই যে দেখছ ক্ষীণ জলধারা, ওই হচ্ছে নর্মদার উৎস। চাঁদু লক্ষ করল একটা পাথরের গোমুখে নর্মদার জল গড়িয়ে এসে কুণ্ডে পড়ছে। তারপর সেইখান থেকেই ক্ষীণ স্রোতে বয়ে চলেছে সুদূর সুরাতে সাগরসঙ্গমের দিকে।

স্নানের সরঞ্জাম সঙ্গে আনেনি ওরা। তাই স্নান হল না। নর্মদার জল স্পর্শ করে মাথায় ছিটাল। এরপর পিছনদিকের নির্জন পাহাড়িপথ ধরে খানিক এগোতেই দেখতে পেল বহু পুরাতন কালের একটি সুদৃশ্য ভগ্ন মন্দির।

এ মন্দিরটা কীসের?

স্থানীয় একজন বলল, করণ মন্দির।

কর্ণ মন্দির?

মহাভারতীয় করণ ইয়ে শিবজি কা আদি মন্দির বনায়া।

ওরা যখন অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে মন্দিরের কারুকার্যগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তখন সরকারি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কিছু লোক সেখানে কী সব যেন মাপজোক করতে এল। তাঁদেরই মধ্যে একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ এটা মহাভারতের কর্ণ মন্দিরের নামে খ্যাত হলেও এর নির্মাতা কিন্তু কর্ণ নন। যদিও লোকের ধারণা এটা কর্ণেরই মন্দির। এবং যেহেতু কৌরব কর্তৃক দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার ব্যাপারে কর্ণের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল, সেই পাপে এখানে তাঁর মন্দির বিশেষ মর্যাদা পায়নি। কেন না নর্মদা চিরপবিত্রা। তাই নর্মদা শংকর কর্ণের ওই পূজা গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে কর্ণের মন্দির আজও অবহেলিতই রয়ে গেছে। তবুও এই কর্ণমন্দির কিন্তু অমরকণ্টকের প্রাচীনতম মন্দির। তবে ইতিহাস বলে এই মন্দিরের আসল প্রতিষ্ঠাতা হলেন কলচুরি বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কর্ণদেব। তিনি চেদীরাজ মহাচন্দ্র নামে খ্যাত ছিলেন। এই মন্দিরের নির্মাণকাল দশম বা একাদশ শতাব্দী।

কর্ণমন্দির দেখে ওরা পায়ে পায়ে বাজারের কাছে এল। ফুলের মতো ফুটফুটে গোলাপকে দেখে কয়েকটি বখাটে ছেলে খারাপ মন্তব্য করল। ওরা ওসব গায়েও মাখল না। প্রচণ্ড খিদে নিয়ে একটা হোটেলে খেতে বসল ওরা।

কী সুন্দর বাসমতী চালের ভাত এখানকার। তার সঙ্গে ঘন ডাল ও সুস্বাদু তরকারি। পেট ভরে তৃপ্তি করে খেল ওরা। তারপর আবার ফিরে এল ধর্মশালায়। এখন একটু বিশ্রাম নিতে হবে। কিন্তু বিশ্রাম তো নেবে। শোবে কোথায়? এর থেকে বরফানিবাবার আশ্রমটা ভাল ছিল। সবকিছুই মিলত সেখানে। অথচ সাধুবাবা নিজে আগ্রহ করে যখন বিরজুকে ডেকে ব্যবস্থা একটা করে দিলেন তখন হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা উচিত না। তা ছাড়া এটা তো ঠিক, সমবয়সি একটি ছেলেমেয়ের মধ্যে যতই বন্ধুত্ব থাক, তাদের একসঙ্গে এক ঘরে থাকাটা খুবই সন্দেহের। সেই সন্দেহের বশে ওখানেও যদি আশ্রয় না মিলত?

বিরজুর মাতাজিকে জানাতেই ওদের বিছানার ব্যবস্থা হয়ে গেল। নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ছারপোকায় ভরা শোবার অযোগ্য বিছানা। দেখেই তো গা ঘুলিয়ে উঠল ওদের।

গোলাপ বলল, এইভাবে একটা মুহূর্তও এখানে থাকা সম্ভব নয়।

চাঁদু বলল, আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হবে। তাই বলছিলাম তুমি বাড়ি ফিরে গেলেই পারতে। কেন আমার সঙ্গে এত কষ্ট করছ?

আমি বাড়ি চলে গেলে তোমার বরাতে এটুকু আশ্রয়ও জুটত না। তুমি কত কষ্ট পেতে বলো তো? তুমি কি পারতে এত সহজে এইভাবে এখানে বা অন্য কোথাও থাকতে? ভয় করত তোমার। কখনও তো ঘর থেকে বেরোওনি।

যাক, একটু তুমি বসো, আমি এখুনি আসছি।

কোথায় যাবে তুমি?

আসছি। যাব কি আসব।

আমার খুব ভয় করবে কিন্তু। যদি কেউ কিছু করে তোমার? গোলাপ বলল, এত সস্তা নয়। গোলাপে কাঁটা আছে জানো তো? বলেই গোলাপ চলে গেল।

আধঘণ্টার মধ্যেই হাসি মুখে ফিরে এল সে। বলল, আর কষ্ট ভোগ করতে হবে না। সার্কিট হাউসে একটা ঘর পেয়ে গেছি। চমৎকার ঘর, অ্যাটাচড় বাথ। গদি, বিছানা, মশারি সবকিছু আছে। ওখানে গিয়ে আর এমনভাবে হি হি করে কাঁপতে হবে না শীতে।

আনন্দে লাফিয়ে উঠল চাঁদু

মাতাজির হাতে দশটা টাকা দিয়ে ঘর খালি করে চলে এল ওরা। মাথাগোঁজার জায়গাটা একটু ভদ্রস্থ না হলে চলে?

কথায় বলে সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। গোলাপ নিজেও বুঝি সেটা জানে। তা ছাড়া চাঁদুও তো কম সুন্দর নয়। টকটকে ফর্সা গায়ের রং। সুঠাম দেহ নধরকান্তি। তাই তো আদর করে ওর চাঁদ মুখ দেখে ঠাকুরমা ওর নাম রেখেছিলেন চন্দ্ৰকান্ত। তা এই মুখ দেখিয়ে বা রূপ দেখিয়েই বুঝি বাজিমাত করল গোলাপ। সার্কিট হাউসে গিয়ে একটু ইনিয়ে বিনিয়ে বলতেই ঘর একটা পেয়ে গেল। এবং ঘর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই দশটি টাকা কেয়ারটেকারকে দিতে খুব খুশি সে।

ওর সঙ্গে চাঁদুর চেহারার এমন এক আভিজাত্যের মিল আছে যে, ওদের দু’জনকে কোলেপিঠের ভাইবোনের অতিরিক্ত কিছু বলে মনেও হল না কারও। ওরা যখন সার্কিট হাউসে এল তখন সন্ধ্যা সমাগত। এখানে তালাচাবির ব্যবস্থা আছে। অবশ্য না থাকলেও ক্ষতি কিছু নেই। কীই বা আছে ওদের, যে চোরে নেবে? টাকা-পয়সা যা কিছু তা তো সঙ্গেই আছে।

মন্দিরে মন্দিরে তখন স্তোত্রপাঠ ও ঘণ্টা ধ্বনি হচ্ছে।

ওরা পায়ে পায়ে বাসস্ট্যান্ড যেদিকে সেইদিকে গেল। এদিকে একপাশে ঘন অরণ্যের হাতছানি। একপাশে মঠ ও মন্দিরের সমারোহ। তারই মাঝখানে চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা। যতক্ষণ না অন্ধকার হয়, ততক্ষণ ঘুরে বেড়াল ওরা। তারপর রাতের খাবারের জন্য একটা দোকান থেকে হাতে গড়া গরম রুটি, তরকারি আর প্যাড়া নিয়ে ফিরে এল। সঙ্গে উপযুক্ত শীতবস্ত্র নেই। অতএব এইভাবে ঠান্ডায় ঘোরাটা ঠিক নয়।

কেয়ারটেকার ওদের কাছ থেকে একরাতের জন্য পঁচাত্তর টাকা ভাড়া নিল। তা নিক। আপাতত দু’-চারটে দিন তো আরামে থাকা যাবে ওখানে। তারপর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে যা হয় করা যাবে। ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে এসে মুখহাত ধুয়ে বিছানায় দেহ এলিয়ে দিল। এখন সবে সন্ধে সাতটা। এখনই দু’চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। তবে এখনই ওরা ঘুমোবে না। অন্তত রাত্রি ন’টা না হলে শয্যা গ্রহণ করা উচিত নয়।

গোলাপ বলল, আজ আর শরীর বইছে না। ভাবছি কাল সকালেই বাড়িতে যোগাযোগ করব। এদের ফোন আছে। কাজেই যোগাযোগের অসুবিধে হবে না। কিন্তু সাধুবাবা যে বললেন, উনিই বাড়িতে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন? উনি একটা কথার কথা বলেছেন।

তবু আমার মনে হয় কাল সকালেই একবার ওনার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করা উচিত।

সে তো করবই। বিরজুই আমাদের নিয়ে যাবে সাধুবাবার কাছে। সাধুবাবা যে তখন বললেন বিরজুই আমাদের বডিগার্ড, তা বিরজুইর তো পাত্তা নেই।

হয়তো গেছে কোথাও।

এমন সময় দরজায় টকটক শব্দ।

গোলাপ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলেই দেখল একজন জাঁদরেল চেহারার কনস্টেবল এবং তাঁর পাশে পুলিশের একজন ইনস্পেক্টর দাঁড়িয়ে আছেন। ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওদের।

কনস্টেবল বলল, ঘবড়াও মাত। আমি বিরজুর বাবা আছি। সকালে যে সাধুজির সঙ্গে তোমাদের মুলাকাত হয়েছিল ওই সিদ্ধিবাবা আমাকে সব কুছু বলেছেন। আমি ওই রামবাঈ ধরমশালার কেয়ারটেকার। কখন কোন ফাঁকে তোমরা চলে এলে আমি জানি না।

চাঁদু বলল, আমরা তো মাতাজির সঙ্গে দেখা করে ভাড়া মিটিয়ে এসেছি।

আরে জয়রামজি কী। ও বাত নেহি। তোমরা ভাল ঘরের ছেলেমেয়ে। ওই জায়গায় তোমরা কখনও থাকতে পার? কোনও তখলিফ হলে আমিই তোমাদের ভেজিয়ে দিতাম এইখানে। আমার লেড়কা বিরজু আজ হঠাৎ একটা কাজে শাডোল চলে গেছে। ও তোমাদের এখানকার সবকিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে। কাল দশ বাজে বিরজু মিলে গা তুমকো।

গোলাপ বলল, আমি এখানকার সবকিছুই জানি সেপাইজি। বছরে একবার আমি এখানে আসি আমার বাবা-মা’র সঙ্গে।

তব তো কোঈ বাত নেহি। লেকিন আভি তুমহারা জিন্দেগি খতরেমে হো। ইসি লিয়ে বিরজুকো সাথ রাখনা তুমহারে লিয়ে সেফটি হোগা। বেশ তো, বিরজু থাকবে আমাদের সঙ্গে।

আভি তুমহারা প্রবলেম সাবকো বতাও।

ইনস্পেক্টর ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসলেন। তারপর মন দিয়ে সব কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে। দু’-একটা দিন তোমরা একটু সাবধানে থাক। বিলাসপুরিয়া পার্টি যখন, এখানে আসতে ওদের খুব একটা দেরি হবে না। চাঁদু বলল, আমরা এখানে আছি ওরা জানবে কী করে?

তোমরা বিলাসপুরে আছ ওরা খবর পেল কী করে? কিন্তু ওরা তো আমার কোনও ক্ষতি করতে চায় না।

তোমার গতিবিধির ওপর নজর তো রাখে। তোমরা যখন কাউন্টারে টিকিট কেটেছ তখনই ওরা জেনে গেছে তোমরা কোথায় যাচ্ছ। চাঁদু ও গোলাপ যুক্তি খুঁজে পেল ইনস্পেক্টরের কথায়।

ইনস্পেক্টর বললেন, তবে ওদের কথা যদি ঠিক হয় আর লোকগুলো যদি গীতাঞ্জলিতে আসে, তা হলে ট্রেন থেকে নামলেই অ্যারেস্ট হয়ে যাবে ওরা। আমি এখুনি বিলাসপুরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।

গোলাপ এবার ইনস্পেক্টরের হাতদুটি ধরে করুণভাবে বলল, আমাদের দু’জনের বাড়িতে খবর দেবার কী হবে? আপনি কি অনুগ্রহ করে একটু সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?

অবকোর্স। নিশ্চয়ই পারি। ফোন নাম্বার আছে কিছু?

গোলাপ ও চাঁদু দু’জনেই ওদের নাম, বাবার নাম সহ ফোন নম্বরটা ইনস্পেক্টরকে দিয়ে দিল।

উনি যাবার সময় বলে গেলেন কাল সকালের দিকে ওদের দু’জনকে অবশ্যই একবার থানায় যোগাযোগ করতে।

ওরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

এরপর আর কি দেরি করা উচিত? তাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রাতের খাওয়া খেয়ে আলো জ্বেলেই শুয়ে পড়ল দু’জনে। আলোটা জ্বললে ঘরটা একটু গরম থাকবে হয়তো।