পাঁচ
গীতাঞ্জলিতে আসবে। কিন্তু তার আগেই যদি এসে পড়ে? এখনও যদি এসে থাকে? ওরা এই ভিড়েও ওকে লক্ষ করছে না তো? না কি এ সবই লোকটার চাল? তবে লোকটি যে মিথ্যে বলছে এমন বলেও মনে হল না। কিন্তু ও কিছুতেই ভেবে পেল না কোথায় যাবে এখন। বাড়ি যেতে পারলে সব থেকে ভাল হত। অথচ বাড়ির দিকে যাওয়া মানেই মরণকে বরণ করা। তাই জুলির থেকেও নিজেকে রক্ষা করার চিন্তাটাই ওকে পেয়ে বসল বেশি।
ও পায়ে পায়ে স্টেশনে এল।
সন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে তখন। টিকিটঘরের সামনে এসে একবার চুপ করে দাঁড়াল। কাউস্টারে দীর্ঘ লাইন। কোন ট্রেন কোনদিকে যাচ্ছে, কোথায় কীভাবে যেতে হয় কিছুই তো জানে না ও। তাই উদ্দেশ্যহীনভাবে ও যখন নানারকম ভাবতে ভাবতে পায়চারি করছে তেমন সময় হঠাৎই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ওর কানে এল, চাঁদুদা !
কে?
চাঁদু ঘুরে তাকিয়েই অবাক। দেখল একটা কাঁধে ঝোলাব্যাগ নিয়ে কোথায় যেন যাবার জন্য তৈরি হয়েই এসে হাজির হয়েছে গোলাপ। বলল, কী ব্যাপার। তুমি এখানে?
ছল ছল চোখে গোলাপ বলল, আমিও চলে এলাম। যে ভাবে ওরা আপনাকে তাড়িয়ে দিল তাতে খুবই খারাপ লাগল আমার।
তা তো এলে । কিন্তু এই রাতদুপুরে তুমি যাবে কোথায়?
আমি বাড়ি ফিরে যাব।
ওরা তোমাকে একা আসতে দিল?
আমাকে ওরা চেনে। আমি যদি যাব মনে করি, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। তা ছাড়া আমি তো ঘরকুনো মেয়ে নই। একা একা যাতায়াত আমি করেই থাকি।
সে তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। অত্যন্ত স্মার্ট মেয়ে তুমি।
গয়া, দেওঘর, রাজগির, পুরী, বেনারস এসব আমি একাই যেতে পারি। তুমি বুঝি অনেকবার গেছ ওইসব জায়গায় ?
বাবা-মায়ের সঙ্গে বছর বছর গেছি।
তা হলে আমাকে তুমি রাজগির বা বেনারসের কোনও একটা ঠিকানা বলে দাও না গোলাপ। আমি সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকি কিছুদিন। পুরী হলেও মন্দ হয় না।
গোলাপ বলল, আমি একটা কথা বলব চাঁদুদা?
বলো।
আপনি বরং আমাদের বাড়ি চলুন। আমার মা-বাবা খুব খুশি হবেন আপনাকে দেখে। আমাকেও একা যেতে হবে না। তা ছাড়া আপনি গেলে আমার খুব ভাল লাগবে।
চাঁদু যেন অকূলে কূল পেল এবার। সে গোলাপের হাতদুটি ধরে বলল, গোলাপ। মায়ের মুখে শুনেছিলাম যার কেউ নেই তার ভগবান আছেন। এখন দেখছি সত্যিই তাই। তুমিই আমার ভগবান। একা একা কী খারাপ যে লাগছিল তা কী বলব। এখন তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলে বাঁচব। তোমাদের বাড়িতে কয়েকটা দিন থাকতে পেলে আমিও শান্তিতে থাকব। তার পর বাবা এসে যখন নিয়ে যাবেন তখন হাসিমুখে বিদায় নেব তোমাদের কাছ থেকে। এখন দেখো ধানবাদ যাবার গাড়ি কখন আছে।
গোলাপ বলল, ধানবাদ যাবার গাড়ি এখানে কোথায় পাবেন? এখন আমাদের যে কোনও ট্রেন ধরে যেভাবেই হোক যেতে হবে হাওড়ায়। তারপর ওইখান থেকে অন্য ট্রেনে ধানবাদ।
হাওড়ার নাম শুনেই মুখ শুকিয়ে গেল চাঁদুর। বলল, এবার তা হলে আর যাওয়া হল না তোমার সঙ্গে।
কেন? কেন?
তুমি তো সবই শুনেছ? হাওড়াতেই যদি যাব তা হলে আর বাড়ি যেতে দোষ কী? মিছিমিছি তোমাদের কষ্ট দিতে যাব কেন? হাওড়ায় গেলেই তো আমি খুন হয়ে যাব।
গোলাপ শিউরে উঠে বলল, না না তা হলে গিয়ে কাজ নেই। এ কথাটা মনেই ছিল না আমার।
তাই বলি তুমি রাজগির, পুরী কিংবা বেনারসে যাবার রাস্তাটা বলে দাও। আমি ঠিক চলে যাব। ওখানে গিয়ে কোথায় থাকব, কী করব যদি জানা থাকে তাও বলো।
গোলাপ বলল, আপনি যেসব জায়গার নাম বললেন, এখান থেকে সেগুলো অনেক-অনেক দূরে। রাজগির বেনারস গেলে প্রথমেই আমাদের হাওড়ায় যেতে হবে। তারপর আবার অন্য ট্রেনে রাজগির, বেনারস। সেও এক রাতের রাস্তা। অর্থাৎ মোট দু’ রাতের জার্নি। পুরীও তাই। পুরী গেলে অবশ্য খড়্গপুরে নামলেই চলবে। সেখান থেকে…।
থাক। আর দরকার নেই। তোমাকে হাওড়ার গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি ভাবছি টিকিট না-কেটে যেখানে হোক চলে যেতে পারব।
সে কী। চেকার এসে ধরলে অনেক টাকা ফাইন দিতে হবে তা জানেন? তার ওপর গাড়ি যেখান থেকে আসছে সেইখান থেকে ভাড়া দিতে হবে।
না দিতে পারলে?
জেল।
জেল থেকে পালানো যায় না?
কী করে পালাবেন? চারদিকে পুলিশের কড়া পাহারা।
চাঁদু যেন অকূলে কূল পেল না এবার। বলল, তা হলে গোলাপ, আমার মনে হয় বিনা টিকিটেই ট্রেনে চাপা ভাল। চেকার ধরলে ভাড়া দেব না। যদিও দু’ হাজারের মতো টাকা আছে আমার কাছে। আর ভাড়া না দিলেই জেল। জেলে থাকলে সেখানে তো কেউ আমাকে খুন করতে পারবে না।
গোলাপ বলল, ভারী দুষ্টু বুদ্ধি তো আপনার। তাই যদি মনে করেন তা হলে সোজা এখানকার থানায় গিয়ে সব কথা খুলে বললেই তো হয়।
এমন সময় অচেনা একটি ছেলে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এইভাবে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন তোমরা? সবাই দেখছে যে? চাঁদু বলল, কে তুমি?
তোমার বন্ধু। শিগগির পালাও! গা ঢাকা দাও। ভূপাল এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে, এক্ষুনি ছাড়বে। ওইতে চেপে ভূপালের দিকেই পালাও।
চাঁদু ভয়ে ভয়ে বলল, ভূপাল কী করে যাব?
ওই গাড়িতে চেপেই যাবে। পেনড্রা রোড, অনুপপুর, কাটনি হয়ে যাচ্ছে ট্রেন। সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস ওটা। লেট গাড়ি, এক্ষুনি ছাড়বে। চলে যাও।
টিকিট কাউন্টরে তখন অনেক ভিড়। তাই না দেখে গোলাপ ওর ঝোলা ব্যাগটা চাঁদুর কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে ছুট্টে চলে গেল টিকিট কাটতে। লেডিজ কাউন্টার একেবারে ফাঁকা। ও গিয়ে দুটো টিকিট কেটেই চাঁদুর হাতে টান দিয়ে বলল, চলে আসুন।
ওরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই দেখল ট্রেন ছাড়ার সিগন্যাল হয়ে গেছে। দু’জনে প্রায় হন্তদন্ত হয়ে একটা কামরার হাতল ধরে কোনওরকমে ভেতরে ঢুকতেই একজন কোচ অ্যাটেনডেন্ট হা হা করে ছুটে এলেন, ইয়ে থ্রি-টিয়র হ্যায়। ইসমে মাত চড়িয়ে।
গোলাপ বলল, আমরা মাত্র দুটো স্টেশন যাব।
লেকিন ইয়ে গাড়ি তুমহারে লিয়ে নেহি। ইয়ে সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস। একশো চার রুপিয়া নিকাল। তুমকো জুরমানা দেনে পড়েগা।
ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে।
চাঁদু বলল, আমাদের কাছে কোনও রুপিয়াই আর নেই।
অ্যাটেনডেন্ট গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন।
অত্যন্ত দ্রুতগামী ট্রেন। ছাড়ার পরই ভয়ংকর গর্জনে অজগরের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটতে লাগল ঝড়ের বেগে!
চাঁদু বলল, এটা কী হল?
গোলাপ বলল, কীসের কী হল?
আমরা এই গাড়িতে যাচ্ছিটা কোথায়? তা ছাড়া তুমি তো বাড়ি যাচ্ছিলে? যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যেতে পারলাম কই? আপনার এই অসহায় অবস্থার কথা আর কেউ না বুঝুক আমি তো বুঝি। তা ছাড়া এখনই আমার কলকাতা যাওয়ার ট্রেন না-ও থাকতে পারে। তাই আমার বিশেষ পরিচিত একটি জায়গাতেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আপনাকে রেখে তবেই বাড়ি ফিরব আমি। অবশ্য এখন আমার বাড়ি ফেরবার তাড়াও নেই। শুধু বাবাকে একটা ফোন করে দেব, তা হলেই হবে।
কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এলে, তোমার বাবা যদি রাগ করেন? আমি তো তোমাদের কেউ নই।
এক সময় কেউ ছিলেন না ঠিকই। এখন নিশ্চয়ই কেউ। না হলে আমিই বা এলাম কেন আপনার সঙ্গে? দু’-এক বছরের তো ছোটবড় আমরা। ভাইবোনও হতে পারি। বন্ধুও হতে পারি।
তুমি কোনটা হতে চাও বলো?
আমি শেষেরটাই চাই।
আমিও। বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলে মেলামেশায় কোনও জড়তা থাকবে না। ভাইবোনের মতো পবিত্র বন্ধন থাকবে। অথচ ব্যবহার হবে বন্ধুর মতো।
না হলে দাদাগিরির মধ্যে একটা কেমন যেন গাম্ভীর্য এসে যায়।
তা যদি হয় তা হলে কিন্তু এখন থেকে আর আপনি নয়। তুমি আমাকে তুমিই বলবে।
গোলাপ মিষ্টি হেসে বলল, তাই বলব।
এখন বলো তো এই রাতদুপুরে তুমি আমাকে
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
আমরা যাচ্ছি অমরকণ্টক। কালিদাসের মেঘদূতের সেই মেকল পর্বতে। ওখানে বরফানিবাবার আশ্রমে আমরা উঠব। আমার বিশেষ পরিচিত জায়গা। গিরিধারীদাদা নামে একজন আছেন ওখানে। তিনি আমার খুবই পরিচিত। দরকার হলে উনি নিজে সঙ্গে করে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন আপনার বাড়িতে।
তুমি কিন্তু শর্ত ভুলে যাচ্ছ গোলাপ। আমাকে আবার আপনি বলছ। আয়্যাম ভেরি স্যরি ব্রাদার।
ব্রাদার।
নিশ্চয়ই। যতই আমরা বন্ধু হই না কেন। সুজয়দার বন্ধু তো আপনি। না না, আপনি নয়, তুমি।
চাঁদু বলল, তুমি সঙ্গে আছ বলে এখন কিন্তু আমার আর কোথাও যেতে ভয় করছে না।
আপাতত বরফানিবাবার আশ্রমটাই তোমার নিরাপদ আশ্রয়। কাল ওখানে পৌঁছে প্রথমেই বাড়িতে একটা ফোন করবে। আমিও করব।
আজ রাতে কোথায় থাকব আমরা?
পেনড্রা রোডেই। ওখানে নর্মদা লজে উঠব আমরা। ঠিক আছে।
গোলাপ এবার অন্য একটা প্রশ্ন করল, জুলির জন্য তোমার এখনও মন খারাপ করছে চাঁদুদা?
এই মুহূর্তে না করলেও মনে পড়লেই করছে। কোথায় যে তলিয়ে গেল মেয়েটা?
আচ্ছা ধরো, এই মুহূর্তে আমাকেও যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়। তুমি তা হলে কার কথা বেশি ভাববে? আমার কথা, না জুলির?
দু’জনকার কথাই ভাব। তবে ভগবান করুক আর কোনও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে।
ট্রেন এসে পেনড্রা রোডে থামল।
রাত্রি তখন আটটা।
স্টেশনের কাছেই নর্মদা লজ। ম্যানেজার খুবই পরিচিত গোলাপের। ওকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, এ কী দিদিভাই? আউর সব কাহা? আসছেন।
গোলাপ মিথ্যে করে বলল, মা-বাবা কালপরশু
এখন কোথা থেকে এলে? বিলাসপুর থেকে?
হ্যাঁ। সেখানে আমাদের এক রিলেটিভের বাড়িতে ছিলাম। ইনি কে আছেন?
আমার দাদা।
ম্যানেজার তিনতলার একটা ডাবল বেডের রুম খুলে দিয়ে বলল, খানা পিনার কুছু ব্যবস্থা হোবে?
ওমলেট ভাজি আর পুরী।
সবজি কুছ?
নেহি।
মাটন কারি মিলেগা।
লে আইয়ে।
সে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর শরীরে অনেক ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে পড়ল দু’জনে। শুয়ে শুয়ে কত কী চিন্তা করতে লাগল চাঁদু।
গোলাপ বলল, এখন তো নিশ্চিন্দি। এত কী ভাবছ চাঁদুদা? ভাবছি কী থেকে কী হয়ে গেল। কেষ্ট মিত্তির আমার পিছনে কেন গুন্ডা লাগাল বলো তো? আমার বাবার সঙ্গে ওর দীর্ঘদিনের শত্রুতা তা জানি। তাই বলে আমাকে মেরে বদলা নিতে হবে? সবচেয়ে বড় কথা ওই লোকটিই বা এত সব জানল কী করে? শুধু আমার বা আমাদের কথা নয়। জুলির কথাও। তা ছাড়া ও বিলাসপুরেই বা এল কেন? ওর কি এখানে বাড়ি? কেষ্ট মিত্তিরের ছেলের খুন হওয়ার পিছনে ওর কি কোনও হাত আছে? আমাকে বাঁচানোর জন্যই বা ওর অত প্রয়াস কেন?
গোলাপ বলল, সবই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে না? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না গোলাপ।
আর ভাবতে হবে না। চুপ করে শুয়ে ঘুমোও তো দেখি?
ঘুম আসছে না। দুশ্চিন্তা যে কী ভয়ংকর তা আজ বুঝতে পারছি। গোলাপ বলল, তবু ভাল, ওই অচেনা আগন্তুকরা তোমাকে সাবধান করে দিল। আমার মনে হয় ওরা আর যাই হোক, তোমার হিতৈষী। হলেই ভাল।
চাঁদু চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। ঘুমিয়ে পড়ল গোলাপও। আঃ কী সুন্দর, নিবিড় গভীর ঘুম। আর তেমনই মধুময় এই পেনড্রার নর্মদা লজ।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল দু’জনার। ঘুম ভাঙতেই উঠে পড়ল। বেশি তৎপরতা গোলাপের। বলল, আর এখানে থাকা নয়। এখুনি সকালের বাসেই চলে যেতে হবে আমাদের।
অতএব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে পথে নামা।
পেনড্রা রোড শহরটি খুবই ছোট্ট। স্টেশনের কাছেই বাসস্ট্যান্ড। আবার নর্মদা লজ থেকেও স্টেশন বেশি দূরে নয়। ওরা স্টেশনে আসতেই অমরকণ্টকের বাস পেল। সকালের বাস বলে ভিড় বেশি নেই। বাসে উঠে বসবার জায়গাও পেল। ওরা জানলার ধারে সাইড সিটে বসল দু’জনে। বাস ছাড়লে বাসে বসেই পেনড্রা রোডের যা কিছু দেখবার তা দেখে নিল। কাল রাতের অন্ধকারে কিছুই তো দেখা হয়নি। গোলাপের যদিও এ শহর দেখা, কিন্তু চাঁদুর প্রথম। শহরের দোকানপাটে নানা দ্রব্যের পসারি। পথে অটো, বাস, টাঙ্গা, সাইকেল-রিকশা কী নেই? এমনকী সিনেমা হলও আছে।