অমরকণ্টক রহস্য – ৪

চার

থমথমে মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরল দু’জনে। দু’জনেরই চোখেমুখে আতঙ্ক। মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা। কে এই রহস্যময় লোক? সে কি সত্যিই কোনও হিতৈষী? নাকি ওকে পথে বার করে সহজে গুম করবার কোনও অভিনব ফন্দি এঁটেছে?

মা বললেন, কী রে! এত দেরি করলি কেন?

সুজয় বলল, দেরি কোথায় মা?

সেই কখন গেছিস বল তো?

চাঁদুকে রেল কলোনিটা ঘুরিয়ে দেখালাম। নদী দেখাতে নিয়ে গেলাম। তাই বল। এবার চানটান করে নে দেখি? খেয়েদেয়ে ছেলেটা একটু ঘুমোক। ওদের ভাবান্তর গোলাপের নজর এড়াল না। সে তেলের বাটি আর তোয়ালে এগিয়ে দিতে এসে চাঁদুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার! হঠাৎ কী হল আপনাদের? কারও মুখে হাসি নেই, কিছু নেই। গম্ভীর গম্ভীর ভাব।

সুজয় চোখ টিপে দিল চাঁদুকে।

চাঁদু তবুও মরা চাঁদের মতো ম্লান হেসে বলল, সে তুমি বুঝবে না গোলাপ, আমার যে কী জ্বালা। কতদিনের আশা ছিল বিলাসপুরে বেড়াতে আসার। কিন্তু সেই আশা এমনভাবে পূর্ণ হল যে আর মনে হচ্ছে না এক মিনিটও এখানে থাকি।

কোনও খারাপ খবরটবর পেলেন নাকি কিছু ?

মাসিমাকে কিছু যেন বোলো না। খুবই খারাপ খবর। কীরকম তবু শুনি?

হয়তো খাওয়াদাওয়া করেই আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাবেন?

জানি না।

পাণ্ডুর হয়ে গেল গোলাপের মুখ। সে একবার করুণভাবে সুজয়ের দিকে তাকাতেই মুখ নামিয়ে নিল সুজয়।

চাঁদু খুব তাড়াতাড়ি ব্যস্ততার সঙ্গে স্নানপর্বটা মিটিয়ে নিল। চাঁদুর হলে সুজয় ঢুকল বাথরুমে। গোলাপ অনেক আগে থেকেই শুচিস্নিগ্ধ হয়ে ছিল। ঘড়ির কাঁটায় দেড়টা।

মাসিমা ডাইনিং টেবিলে খেতে দিলেন তিনজনকেই। তবে চাঁদু ও সুজয় পাশাপাশি বসলেও গোলাপ কিন্তু বসল না। ও নিজেও মাসিমার সঙ্গে পরিবেশনের কাজে হাত লাগাল। কত কী রান্না করেছেন মাসিমা। গোলাপও সহযোগিতা করেছে। সরু চালের ভাত, মাংস, মাছ দু’-তিন রকমের তরকারি, চাটনি।

চাঁদু ও সুজয় ঘাড় হেঁট করে খেয়ে যেতে লাগল। কারও মুখে কথা নেই। গোলাপও নীরব।

মাসিমা বললেন, কী রে তোরা সব এমন বোবা হয়ে গেলি কেন?

কেউ কোনও উত্তর দিল না।

একটা-দুটো কথাটতা বল? তবে তো ভাল লাগবে। মাংসটা গোলাপ রেঁধেছে। বেশি ঝাল হয়নি তো?

চাঁদু জোর করে মুখে হাসি এনে বলল, খুবই উপাদেয় হয়েছে। মনে হচ্ছে আরও খাই। অনেক খাই।

তা খাও না বাবা। দেব আর একটু?

না মাসিমা। একদম নয়। এত রান্না না হলে আরও খেতাম। অনেক খেতাম। খাওয়া হলে ঘরের দরজা বন্ধ করে আলোচনা করতে বসল ওরা, চাঁদু আর সুজয়।

সুজয় বলল, তুই তা হলে কী ঠিক করলি বল?

চাঁদু বলল, পালাব। এমনিতেই আমার মন চাইছিল না থাকতে। তার ওপর লোকটা যখন অযাচিতভাবে এসে চলে যাবার কথা বলেই গেল তখন আর অযথা মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?

তা হলে কোথায় যাবি তুই?

ভাবছি অচেনা জায়গায় দূরে কোথাও না গিয়ে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাব।

ও লোকটা কিন্তু বাড়ি যেতে নিষেধ করেছে তোকে।

কিন্তু অচেনা জায়গায় গিয়ে আমি করবটা কী? কোথায় থাকব-না-থাকব এসবের কিছুই তো জানি না আমি। তা ছাড়া অত টাকা-পয়সাও আমার কাছে নেই।

আমি তোকে গোটা পঞ্চাশেক টাকা দিতে পারি।

আমার কাছে দু’ হাজার টাকা আছে। তাতেই আমি যেতে সাহস করছি না, তোর ওই পঞ্চাশ টাকায় আমার কী হবে?

সুজয় চুপ করে গেল।

ঘড়িতে দুটো বাজল।

সুজয় বলল, কখন যাবি তা হলে?

সন্ধে হলেই যাব। আমি চলে গেলে তারপরে তোর মাকে যা বলার বলবি। আগে কিছু বলিস না যেন। গোলাপকেও কিছু বলার দরকার নেই। আমি এদিক-ওদিক করতে করতে সুট করে কেটে পড়ব একসময়।

ওরা দরজা বন্ধ করে কথা বললেও উৎসাহী গোলাপের কান যে জানালার পাশে সজাগ হয়ে আছে তা ওরা ভাবেওনি। গোলাপ খুবই সতর্কতার সঙ্গে ওদের কথাবার্তা শুনছিল, এমন সময় মাসিমা ডাক দিলেন, ওখানে জানলার কাছে কী করছিস গোলাপ? আর দেরি না করে খেতে আয়।

গোলাপ ত্ৰস্তে সরে গেল সেখান থেকে।

পরক্ষণেই মাসিমা এসে ঘরে ঢুকলেন, এ কী শুনছি বাবা? তুমি নাকি চলে যাচ্ছ?

মাসিমা ঘরে ঢুকলেও গোলাপ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

চাঁদু বলল, গোলাপ বলেছে বুঝি?

তোমরা তো বলনি বাবা। কিন্তু চলেই যাবে যদি তা হলে এলে কেন? একটা রাত অন্তত থেকে গেলে হয় না?

গোলাপ বলল, আসলে আমরা তো ওনার সেবাযত্ন করতে পারছি না ঠিক মতো তাই বোধহয় উনি চলে যাচ্ছেন।

চাঁদু বলল, না না। তা নয়।

সুজয়ই এবার সেই ভয়ংকর কথাটা শুনিয়ে দিল মাকে। বলল, ওর চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই মা। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস রাত বারোটা নাগাদ এখানে আসবে। তারপরে আর একটা মুহূর্ত ও যদি এখানে থাকে, তা হলে খুন হয়ে যাবে ও।

মা দু’হাতে কানঢেকে শিউরে উঠলেন, চুপ চুপ! আর বলিস না। কী সাংঘাতিক কথা! শিগগির তোর বাবাকে ফোন কর।

কাউকে কিছু করবার দরকার নেই। কাকপক্ষীতে টের পাবার আগে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে পালাতে হবে ওকে। কোথায় যাবে ও?

সেটা ওকেই ঠিক করে নিতে হবে। এমনকী বাড়িও যেতে পারবে না বেচারি। ওর মৃত্যুদূতেরা সেখানেও অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

গোলাপও এবার ছুটে ঢুকে এল ঘরের ভেতর। বলল, একথা তোমরা এতক্ষণ বলনি কেন?

সুজয় বলল, এ কী পাঁচকান করবার কথা রে? ভেবেছিলাম কাউকে না জানিয়েই চুপি চুপি পাঠিয়ে দেব ওকে।

গোলাপের চোখে জল এসে গেল এবার। বলল, চাঁদুদা ছেলেমানুষ। একা উনি কোথায় যাবেন? এইভাবে ওনাকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়? বিশেষ করে এই বিদেশবিভুঁয়ে?

ছেড়ে যে দিতেই হবে বোন। ও যেখানে হোক চলে যাক। তারপর সুবিধেমতো সেখান থেকে ফোন করে ওর বাড়িতে যোগাযোগ করুক। এবার ওর বাবা-মা যা ভাল বুঝবেন করবেন।

আমি বলি কী, তুমিও ওর সঙ্গে যাও।

মাসিমা বললেন, না না। তা হয় না। সুজয়কে আমি কাছ ছাড়া করতে পারব না। কার কোপ কার ঘাড়ে পড়ে কেউ কি তা বলতে পারে? এই জালে আমার ছেলেকে আমি কিছুতেই জড়াতে দেব না।

চাঁদু বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন মাসিমা। আমার সময় এখন খারাপ। কখন কী হয় তা বলা যায় না। আমি চলে গেলেও আমার খোঁজে ওরা হয়তো এখানে আসবে। তখন কী যে হবে তা ভগবানই জানেন । সুজয়কে আপনি একটু সাবধানে রাখবেন। পারলে আশপাশের কারও বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।

কী বললে? এখানে আসবে? তোমার খোঁজে? সর্বনাশ। তোমাকে না-পেয়ে যদি ওরা সুজয়কে পায়?

সেই জন্যেই তো বলছি ওকে একটু সাবধানে রাখবেন।

তুমি আর সন্ধের জন্য অপেক্ষা কোরো না। এখুনি চলে যাও। তোমার বাবা তোমাকে পাঠাবার আর জায়গা পেলেন না, এইখানে পাঠালেন। আর কোথাও কি কেউ ছিল না তোমাদের?

সুজয় বলল, মা।

গোলাপ বলল, এসব কী যা তা বলছেন আপনি? তা ছাড়া সন্ধে হতে আর দেরিই বা কত? দিনের আলোয় পাঁচজনকে দেখিয়ে কোথায় যাবেন উনি? যে চুলোয় হোক যাক। এখুনি বিদেয় হতে বল ওকে।

অপমানে, দুঃখে পায়ের তলার শেষ মার্টিটুকুও যেন সরে যেতে লাগল চাঁদুর। এই সুজয়ের মা। এদের এখানে আসবার জন্যই এতদিন ধরে মনে মনে এত রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল ও? সত্যি, বিপদে না-পড়লে মানুষকে চেনা যায় না। এই জন্যেই বাবা বলেন, কখনও কারও আশ্রয়ে উঠতে নেই । তা সে যত আপনজনই হোক।

সুজয়ের মাকে প্রণাম করে চাঁদু বলল, আমি এখুনি চলে যাচ্ছি মাসিমা। আমি চাই না আমাকে ঘিরে আপনাদের পরিবারে কোনও বিপদের মেঘ ঘনিয়ে আসুক। বলে চকিতে নিজের ব্যাগটাকে গুছিয়ে নিয়ে সুজয়কে বলল, আসিরে সুজয়।

সুজয় বলল, সাবধানে যাস।

এরপর গোলাপের কাছে এসে বলল, সুজয়ের মুখে তোমার কথা আমি অনেক শুনেছিলাম। দেখবার ইচ্ছেও ছিল তোমাকে। দেখা হল। এখন আসি কেমন?

মৌন গোলাপের ডালিমের মতো গালদুটি বেয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজল মুক্তোর মতো ঝরে পড়ল। সে একভাবে চেয়ে রইল ওর চলে যাওয়া পথের দিকে।

সুজয়ের মা বললেন, ওর জন্যে তোর চোখে জল কেন? ও কে তোর? নিজের দাদা নয়, কিছু নয়, কোনও আত্মীয়স্বজনও নয়। ন্যাকামো।

গোলাপ চোখের জল মুছে বলল, পিসিমা। আপনি শুধু সুজয়দার কথাটাই চিন্তা করলেন। ওই খুনিরা এলে আমারও যে কী বিপদ হতে পারে কই একথা তো একবারও ভাবলেন না? আর চাঁদুদা আপনার নিজের ছেলে না হলেও আর এক মায়ের ছেলে তো সে। নিজের স্বার্থের কথা ভেবে তাকে আপনি এইভাবে ঠেলে দিলেন ঘাতকের মুখে?

সুজয় বলল, তুই এবার খেয়ে নে গোলাপ।

আমার খিদে নেই। তা ছাড়া আজ রাতে যদি কোনও গোলমাল হয় তাই আমিও আর এখানে থাকতে সাহস পাচ্ছি না। আমি আজই রাতের ট্রেনে যে কোনও গাড়িতে কলকাতায় যাব। বাবা-মা’র জন্যে ভীষণ মন খারাপ করছে আমার। এখন ভাবছি সেদিন ওদের সঙ্গে চলে গেলেই হত। তুই চলে যাবি! বিনা রিজার্ভেশনে একা একা?

সব গাড়িতেই লেডিজ কম্পার্টমেন্ট থাকে। মেয়েদের অসুবিধে কোথায়? তা ছাড়া টাকা ফেললে একটা বার্থ কোনও-না-কোনও গাড়িতে মিলেও যেতে পারে।

কলকাতা যাবার কোনও গাড়ি আছে এখন?

জানি না। যে গাড়ি পাব তাতেই উঠব।

গোলাপও আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে জিনিসপত্তর গোছাতে লাগল ওর। ওকে দেখে মনে হল বয়সে ছেলেমানুষ হলেও মনের দিক থেকে ও যেন অনেক বড় হয়ে গেছে।

মৃত্যুভয় যে কী সাংঘাতিক তা যে না পেয়েছে তাকে বোঝানো যাবে না। রাস্তায় নেমেই চাঁদু টের পেল ওর মতো অসহায় বুঝি আর কেউ নেই। এই দূরদেশে একা ও কোথায় যাবে? যে লোকটি এত বড় একটা খবর দিয়ে সাবধান করল ওকে, সেই বা কে? অজ্ঞাত আততায়ীরা এসে চাঁদুকে খুন করলে তার কী এসে যেত? শুধু তাই নয়, সে বলল, ওকে, ওর বাবাকে সবাইকেই নাকি চেনে। এমনকী জুলিকেও। লোকটি তা হলে কে? আর লোকটিকে চিনতে না পারলেও চেনাচেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না কিছুতেই।

চাঁদু প্রথমেই নির্জন পথ এড়িয়ে জনারণ্যে মিশে গেল। ওরা নাকি মধ্যরাতে