তিন
সারাটা দিন যে কীভাবে কাটল চাঁদুর তা সেই জানে। সন্ধের পর বাবা ওকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে এসে বম্বে মেলের বিলাসপুর কোচে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। প্রথম শ্রেণীর একটি কুপে কোচ অ্যাটেনডেন্টকে বলে ওর একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে তবেই গেলেন তিনি।
এই নিরানন্দ যাত্রায় চাঁদুর বুকের গভীরে যে কী দারুণ যন্ত্রণা তা বুঝবে কে? বাবা শুধু তাঁর নিজের স্বার্থটাই দেখলেন। কিন্তু এক কন্যাহারা জননীর মর্মবেদনা একবারও উপলব্ধি করলেন না। তাই দ্রুতগামী ট্রেনের কামরায় শুয়ে চাঁদু জুলির কথাই ভাবতে লাগল শুধু। জুলির এই বিপদের জন্য বার বার নিজেকেই অপরাধী মনে হতে লাগল ওর। কেন যে মরতে ওদের বাড়ি গিয়েছিল। যদি না যেত, দুর্ঘটনাটা যদি ওকে বাদ দিয়েই ঘটত, তা হলে কিন্তু এতটুকুও অনুশোচনা হত না। ভাবত জুলির এটা দুদৈব ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু যেখানে ও নিজে জড়িত সেখানে কি অন্য কিছু ভাবা যায়?
এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়ল চাঁদু। ট্রেনের দোলানিতে সেই ঘুম আরও গভীর হল। ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল হয়ে গেছে। ট্রেন এসে থামল চম্পা স্টেশনে। কী সুন্দর নাম স্টেশনটার। এখানে বেশিক্ষণ থামল না গাড়ি। বোধ হয় দু’-পাঁচ মিনিট থেমেই আবার শোঁ শোঁ করে ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগল।
চম্পার পরই বিলাসপুর। স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ও গেটের কাছে চেকারের পাশে সুজয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। জানালা দিয়েই হেঁকে ডাকল, সু-জ-য় !
সুজয়ও হাত নাড়ল দুর থেকে, চাঁদু! তার মানে সেও ওকে দেখেছে এবং ওর ডাক শুনেছে। তা ছাড়া গাড়ির গতির সঙ্গে ছুটতে ছুটতে সুজয় এসে ওর কম্পার্টমেন্টের সামনে দাঁড়াল। চাঁদুও সুটকেশটা নিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়ল স্টেশনে। বেশ জমকালো স্টেশন। হইহই করছে চারদিকে লোকজন। তার ওপর বম্বে মেল বলে কথা। যেমনি নামার ভিড়, তেমনি ওঠার। সেই ভিড়ের মধ্যেই মহামিলন।
চাঁদু ট্রেন থেকে নামতেই সুজয় জড়িয়ে ধরল ওকে! বলল, শেষ পর্যন্ত এলি তা হলে?
এলাম। তবে খুব একটা আনন্দ নিয়ে আসিনি। ওখানকার খবর শুনেছিস নিশ্চয়ই?
শুনেছি। তোর বাবা ফোনে সব কথা আমার বাবাকে জানিয়েছেন। তা ওই কেলটিটা শেষপর্যন্ত খুন করতে গেল কেন?
ছিঃ সুজয়। অন্যের বোন সম্বন্ধে এইরকম মন্তব্য কেউ করে? জুলির গায়ের রংটাই শুধু দেখলি, ওর চোখদুটো দেখিসনি? ওরকম পদ্মচক্ষু ক’টা মেয়ের হয়? তা ছাড়া ও তো আমাদেরও বোন। চোখের সামনে লাউ ডগাটির মতো কেমন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল।
তোকে কাব্যরোগে পেল নাকি? একটা শুঁটকি কালটি মেয়ে…। আবার!
আচ্ছা বাবা আচ্ছা। আর বলব না।
জুলিকে তুই ভুল বুঝিস না রে। ওর মতো মেয়ে হয় না। ও কখনওই খুন করতে পারে না।
সুজয় চাঁদুর সুটকেশটা হাতে নিয়ে গেট পার হয়ে বাইরে এল। তারপর একটা রিকশায় চেপে পাশাপাশি বসল দু’জনে। বলল, বেশ, তা না হয় না করল। কিন্তু গেল কোথায় মেয়েটা?
সেইটাই তো রহস্য।
আমার মনে হয় কী জানিস, রাজুটা তো ভেঁপো ছেলে। প্রথমে ভাল ব্যবহার করে পরে নিশ্চয়ই আড়ালে নিয়ে গিয়ে ওকে ভয়টয় দেখিয়েছে। আর জুলি তখন ওর অস্ত্রেই ঘায়েল করেছে ওকে। তারপর পালিয়েছে।
আমি কিন্তু ও কথা একদম ভাবছি না। তুই জানিস না সুজয়, রাজুর গায়ে কী অসম্ভব জোর। রতন- আমি দু’জনে মিলে একবার ওকে পেটাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেছি। তা ছাড়া হাওয়াপুকুর তো ওখান থেকে অনেক দূরে। সেখান পর্যন্ত জুলিকে ও নিয়ে যাবে কী করে?
তা হলে কী বলতে চাস তুই?
আমার মনে হয় রাজুর এই ব্যাপারটা প্রি-প্ল্যানড মার্ডার। জুলি ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েছে। আসলে রাজুকে যারা মার্ডার করেছে, তারাই কিডন্যাপ করেছে জ্বলিকে।
কী বলছিস তুই?
ঠিকই বলছি। আর এই সংকটমুহূর্তে মেয়েটাকে যেখানে উদ্ধার করবার জন্য খোঁজখবর নেওয়ার দরকার সেখানে আমার বাবা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে সরিয়ে দিলেন।
তুই থেকেই বা কী করতিস? গোয়েন্দাগিরি? বই পড়ে সবাই কি পাণ্ডব গোয়েন্দা হয়? না হওয়া যায়?
তা কেন? তবে চেষ্টা করবার মানসিকতা তো আসে? আর সেইজন্যই তো বই পড়া। না হলে বই পড়বার প্রয়োজনীয়তাই বা কী? পরের ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামানোই ভাল।
ঘামাতাম না রে। যদি না মেয়েটাকে আমি নিজে পকেট থেকে টাকা বার করে কচুরি কিনতে পাঠাতাম। ওর মা-ও তো এখন ভাবতে পারে যে, এইরকম একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটবে জেনেই আমি অসময়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম বা ওকে কচুরি আনতে পাঠিয়েছিলাম। অর্থাৎ ওই দুষ্টুচক্রের চক্রীদের মধ্যে আমিও একজন।
সুজয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হুঁ। এরকম অবশ্য উনি ভাবতে পারেন। ভাবাটা অন্যায় নয়।
রিকশা স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে বেঁকে রেল কোয়ার্টারের দিকে এগোতে লাগল। কী সুন্দর এলাকাটা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সাজানো গোছানো। এখানকার রাস্তাঘাট এবং পরিবেশ দেখে প্রথমদর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেল চাঁদু সুজয়রা এখানে কী সুখেই না আছে।
রিকশা ওদের কোয়ার্টারের সামনে আসতেই ওর মা-বাবা হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন, এসো বাবা, এসো। আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
সুজয়ের বাবা-মাকে প্রণাম করে ঘরে ঢুকল চাঁদু। ওইটুকু সময়ের মধ্যে কত কথাই না হল।
সুজয়ের মা বললেন, কী সব আজকালকার ছেলেমেয়ে বাবা। কতই বা বয়স — এর মধ্যেই খুনখারাপি!
বাবা বললেন, কিন্তু মেয়েটা গেলই বা কোথায়? ও না-পালালে তো তোমাকে কেউ সন্দেহ করত না।
চাঁদু বলল, সন্দেহ তো করেনি কেউ। তবে কালচক্রে ঘটনাটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি আমি।
সুজয় বলল, আসতে-না-আসতেই এসব কথা কেন? ওসব এখন ভুলে যাও। ওই প্রসঙ্গে কোনও আলোচনাই কেউ কোরো না তোমরা।
চাঁদু প্রথমেই বাথরুমে গিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর গাড়িতে পরে আসা জামাপ্যান্ট ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরল।
এক বিদ্যুৎবর্ণা কিশোরী এসে লাজুক লাজুক মুখে দু’ কাপ চা আর টোস্ট এনে ওদের সামনে রাখল। তারপর চাঁদুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই বাধা দিল চাঁদু, এ কী! আমাকে প্রণাম করছ কেন?
মেয়েটি বলল, তাতে কী হয়েছে?
সুজয় বলল, এ কে জানিস? আমরা মামাতো বোন গোলাপ। খুব ভাল মেয়ে। দারুণ স্মার্ট। এ বছর ফার্স্ট হয়ে ক্লাস নাইনে উঠেছে। এইট থেকে নাইন।
চাঁদু বলল, এইবার মনে পড়েছে। যদিও ওকে দেখিনি এর আগে। তবে তোর মুখে ওর কথা অনেকবার শুনেছি। ওরা ধানবাদে থাকত না?
এখনও থাকে । মামা-মামি এসেছিলেন। ওঁরা চলে গেছেন, ও আছে। থাকবে এখানে মাসখানেক। খুব সময়ে এসে পড়েছিস তুই। তিনজনে দাপিয়ে বেড়াব চারদিক। আজকের দিনটা যাক। কাল থেকে প্রথমেই শুরু করব সিনেমা দেখা।
সে কী! তোর মা-বাবা কিছু বলবে না?
এখানে কেউ কিছু বলে না। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি সবাই সিনেমা দেখে এখানে । ঘরে ঘরে টিভি। সবাই বুঝে গেছে এসবে ছেলেমেয়ে খারাপ হয় না! গোলাপ কি সিনেমা কম দেখে? তবুও ক্লাসে ফার্স্ট হয় । আসলে পড়াশুনাটা হল মেধার ব্যাপার! ও যার আছে তার কোনও কিছুতেই আটকাবে না। আমার তো মনে হয় যারা যত বেশি শাসনে থাকে তারা তত বেশি খারাপ হয়।
চাঁদু বলল, ওখানে একদম সিনেমা দেখতে পাই না রে। টিভিই দেখতে পাই না বাড়িতে। অথচ কত দামি কালার টিভি বসানো আছে বড়ঘরে। টিভি শুরু হলে আর ঘরে ঢোকবার উপায় নেই আমার।
এখানে ওসব নেই । দেখবি কী সুন্দর সব সাজানোগোছানো সিনেমা হল । ওরকম হল হাওড়া, কলকাতায় একটাও নেই। হল দেখলেই মাথা ঘুরে যাবে। সিনেমা দেখা তো দূরের কথা।
গোলাপ ওদের জলখাবার দিয়ে চলে গেল।
এরপর মাসিমা এলেন আরও কত খাবার নিয়ে । শিঙাড়া, জিলিপি, লাড্ডু, প্যাড়া— কত কী।
চাঁদু তৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগল।
খাওয়া হলে সুজয় বলল, চল তোকে আমাদের রেলওয়ে কলোনিটা ঘুরিয়ে আনি। এই কলোনির জন্যেই বিলাসপুর বিখ্যাত। কত রকমারি বাংলো আর কোয়ার্টার যে আছে এখানে তা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। আর দেখবি নানান জাতের মানুষের মেলা। আসলে এই জায়গাটাকে মানুষের চিড়িয়াখানা বলতে পারিস।
সুজয়ের কথা শুনে হাসল চাঁদু। বলল, কী সব আবোল-তাবোল বকছিস! চল কোথায় নিয়ে যাবি।
ওরা যখন বেরোচ্ছে তখন পাকা গিন্নির মতো গোলাপ এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। বলল, খুব বেশি দেরি কোরো না যেন। কত দূর থেকে এল ছেলেটা, আসতে-না-আসতেই তাকে নিয়ে চলল।
ছেলেটা অর্থাৎ চাঁদু।
সুজয় বলল, ছেলেটা তুই কাকে বলছিস? ও তোর চেয়েও দু’ বছরের বড় তা জানিস?
গোলাপ চোখে তারায় ঝিলিক মেরে বলল, জানি। আমার বুড়ো দাদুর বয়সি তো নয়? বলে একবার তাকাল চাঁদুর দিকে। তাকিয়ে বলল, আপনার বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ঘরের কথা ভুলে যাবেন না যেন। কাল সারারাত ট্রেন জার্নি করেছেন। আজ একটু সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়বেন। না হলে শরীর খারাপ করবে। বিলাসপুরের রেল কলোনি একদিনে ঘুরে দেখার নয়।
সুজয়ের সাইকেল ছিল। সেই সাইকেলে চেপেই ওরা চলল পথপরিক্রমায়। চাঁদুকে সামনের রডে বসিয়ে ডবল ক্যারি করতে লাগল সুজয়। যেতে যেতেই বলল, এই যে আমার মামাতো বোনকে দেখলি। কী সুন্দর মেয়ে বল তো? অত ভাল চোখমুখের গড়ন, ফর্সা গায়ের রং সচরাচর দেখা যায় না। গোলাপ তো, গোলাপ। যেন সত্যিকারের একটি গোলাপ ফুল। তেমনি লেখাপড়ায়। অথচ ওর মধ্যে কোনও অহংকার নেই। কত সহজে মানুষকে আপন করে নেয় ও, তা ভাবতেও পারবি না। তুই আসবি শুনে আনন্দে কী যে করবে তার ঠিক নেই। ওইটুকু মেয়ে। রান্নার কাজ থেকে সব কাজই শিখেছে ও । বাপের একমাত্র মেয়ে। আদরিণী কিন্তু গরবিনী নয়।
চাঁদু বলল, সেটা আমাকে যখন প্রণাম করতে এল তখনই বুঝেছি। আজ পর্যন্ত আমার পায়ে কেউ হাত দেয়নিরে। এই প্রথম ও দিল। যেহেতু তুই আমার বন্ধু।
অনেক দুঃখ, বেদনা আর বিবেকের দংশন নিয়ে তোর এখানে এসেছিলাম। মনে হচ্ছে ক’টা দিন এখানে ভালই কাটবে।
তুই না এলে আজই আমরা অমরকণ্টক যেতাম। মা, আমি আর গোলাপ। তোর বাবা দুপুরে ফোন করতেই যাওয়া বাতিল করে দিলাম। ঠিক হল তুই এলেই যাব। তবে মা হয়তো নাও যেতে পারেন। এখন তুই, আমি আর গোলাপ, এই তিনমূর্তিতে তোলপাড় করব চারদিক।
কেন মাসিমা যাবেন না কেন?
আসলে গোলাপ আমাদের কাছে যতই ছোট হোক, তবু বয়সের মেয়ে তো।
চোদ্দো বছর বয়স হল। তাই একা আমার সঙ্গে ওকে পাঠাতে মা ঠিক ভরসা পাচ্ছিলেন না। বলা যায় না কখন কী বিপদ ঘটে। এখন তুই এসে পড়ায় আর কোনও দুশ্চিন্তা রইল না।
তা হোক। তবু মাসিমার আমাদের সঙ্গে যাওয়া উচিত। মাথার ওপর একজন অভিভাবক থাকলে আমরা শান্তিতে ঘুরে বেড়াতে পারব। না হলে যতই ও আমাদের বোন হোক, তবু অনেকে অনেকরকম ভাবতে পারে। বাইরের লোকের মনে আমাদের সম্বন্ধে কোনও বাজে ধারণা আমরা জন্মাতে দেব কেন?
যা তুই বলবি।
কথা বলতে বলতে ওরা অনেক দূরে চলে এল । কাছেই একটা নদী দেখা যাচ্ছে। নদীতে জল একদম নেই বললেই চলে। শুধু বলি আর বালি। ওরা নদীতে নেমে বালির ওপর রুমাল পেতে বসল।
এরপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। একসময় সুজয়ই বলল, আজ কাল দু’দিন তুই রেস্ট নে। পরশু সকালের ট্রেনে আমরা রওনা হব।
চাঁদু অবাক বিস্ময়ে বলল, কোথায় যাব?
এতক্ষণ তা হলে কোথায় যাবার কথা হল? অমরকণ্টক।
ও। সেখানে বুঝি ট্রেনে করে যেতে হয়?
হ্যাঁ। বিলাসপুর থেকে ইন্দোর এক্সপ্রেসে পেনড্রা রোড নামে একটা স্টেশন আছে, সেখানে যেতে হবে। তারপর পেনড্রা রোড থেকে বাসে অমরকণ্টক। কালিদাসের মেঘদূতে যে মেকল পর্বতের নাম আছে, সেই মেকল পর্বতই হল অমরকণ্টক। ওইখানে শোন আর নর্মদার উৎস। ভারী মনোরম জায়গা।
চাঁদ বালিতে আঁচড় কাটতে কাটতে অন্যমনস্ক ভাবেই বলল একসময়, তোদের এখানে বাংলা খবরের কাগজ পাওয়া যায় না?
কেন যাবে না? কালকের কাগজটা আজকে পাবি।
কালকেরটা তো দেখা।
আজকের কাগজ পাবি কাল সকালে।
আমাকে একটা কাগজ জোগাড় করে দিস তো কাল। আনন্দবাজার আনবি। আমাদের বেঙ্গলি ক্লাবে সব কাগজই যায়। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। সেখানেই দেখে নিবি তুই।
চাঁদু আর কোনও কথা না বলে দূরের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল।
সুজয় বলল, তুই আসলে জুলির ব্যাপারটা একদম মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিস না, নারে?
ঠিক তাই। আমার মনের ভেতরটা যে কী হচ্ছে সুজয় তোকে কী বলব?
আমার কী মনে হচ্ছে জানিস, মনে হচ্ছে এখুনি যে কোনও একটা ট্রেন ধরে হাওড়ায় ফিরে যাই। তারপর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকি কোথাও, আর ভেতরে ভেতরে খোঁজখবর লাগাই।
সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু তাতে লাভ?
হয়তো কোনও-না-কোনও সূত্র ধরে রাজুর হত্যাকারীর সন্ধান পাব। আর জুলিরও যদি ওইরকম কোনও মর্মান্তিক পরিণতি না হয়ে থাকে, তা হলে জুলিকেও উদ্ধার করতে পারব।
তোর কি মনে হয় জুলি বেঁচে আছে?
নিশ্চয়ই। না হলে ওর ডেড বডিটা তো পাওয়া
যেত।
আমি বলি কী, তুই এক কাজ কর। যা হবার তা হয়ে গেছে। দু’-চারদিন এখানে বসে খবরের কাগজগুলো লক্ষ কর। তারপর কী করবি-না-করবি সিদ্ধান্ত নে । ইতিমধ্যে পুলিশ যদি এই ব্যাপারে কোনও কিনারা করতে পারে তা হলে তো কথাই নেই। না হলে যা মন চায় করিস। তবে যাবার আগে তোর বাবাকে কিন্তু জানিয়ে যাস।
বাবা জানতে পারলে আমাকে যেতেই মানা করবেন।
উনি কিন্তু আমাদের ওপর ভরসা করেই ছেড়ে দিয়েছেন তোকে। এখন ওইসব গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে তোর যদি কোনও বিপদ হয়, তা হলে আমরা তাঁর কাছে কী কৈফিয়ত দেব বল?
কোনও বিপদই হবে না আমার।
না হোক। তবু আমাদের স্বার্থে একাজ তোকে করতেই হবে ভাই।
চাঁদু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, বেশ। তাই হবে। বাড়িতে ফোন করেই আমি উধাও হয়ে যাব। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কেউ কিছুই জানবে না। কাউকে কিছু জানাবও না।
ওরা যখন নদীর বালিতে বসে এইরকম সব আলোচনা করছে, তেমন সময় একজন লোক স্কুটার নিয়ে ধুলোবালি উড়িয়ে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় কেন যেন এক রহস্যময় চোখে তাকিয়ে গেল ওদের দিকে।
চাঁদু বলল, লোকটা কে রে?
না। তবে চেনা চেনা লাগছে?
চিনিস তুই?
আমারও কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। কেবলই মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি।
আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।
কীসের ভয়?
তোর পিছনে সি আই ডি লাগেনি তো?
চাঁদু ঘাড় নেড়ে বলল, না। তারপর বলল, সি আই ডি-দের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আমার পিছনে লাগতে যাবে। তা ছাড়া বাবা ওদিকটা সামলে নিয়েছেন।
তা হলে?
এমনি কেউ হতে পারে।
সুজয় বলল, যেই হোক। এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চল দেখি?
চাঁদু বলল, আর একবার যদি এসে পড়ে লোকটা, ফের ওইভাবে তাকায়, তা হলে দেব ওর চোখের মধ্যে বালি পুরে।
সুজয় লাফিয়ে উঠল, তোর সাহস তো কম নয়। গায়ের জোরে পেরে উঠবি তুই ওই লোকটার সঙ্গে?
খুব পারব। চোখে ধুলো পড়লে সবাই অন্ধ হয়। গায়ের জোর তখন কোন কাজে লাগবে শুনি?
এমন সময় স্কুটারে চড়া লোকটি আবার ওদের দিকে এগিয়ে এল। বেশ ভারিক্কি এবং বলিষ্ঠ চেহারার লোক। লোকটি ওদের দিকে তাকিয়ে স্কুটার থেকে না-নেমেই বলল, তোমার নাম চাঁদু না?
হ্যাঁ, ভাল নাম চন্দ্রকান্ত। এখানে বসে কী করছ?
দেখতেই তো পাচ্ছেন এমনি বসে আছি।
ও ছেলেটি কে?
এত সব কথা জানবার কোনও অধিকার আপনার আছে কি? লোকটি হেসে বলল, মনে হচ্ছে এখানকার বি এস আই-এর ছেলে। সবই তো জানেন দেখছি। কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলুম না তো? আমাকে চেনার অসুবিধে আছে ভাই। আমাকে না চেনাই ভাল। তা হলে কেটে পড়ুন এখান থেকে।
কেটে তো পড়বই। কিন্তু তোমার বাবা হঠাৎ এত ভয় পেয়ে তোমাকে সরিয়ে দিলেন কেন?
সে কথাটা আমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করবেন।
খবরটা পেয়েই সকাল থেকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে।
চাঁদু বলল, আপনি মাথামোটা লোক তাই অযথা এত পরিশ্রম করলেন। সকালে বম্বে মেলের সময়ে স্টেশনে গেলেই তো দর্শন পেতেন আমার।
হ্যা আমি খবর পেয়ে যখন স্টেশনে গেলাম বম্বে মেল তখন রায়পুরে পৌঁছে গেছে।
এখন আপনি কী করতে চান?
আমি তোমাকে সতর্ক করে দিতে এসেছি। তোমার মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে দু’জন লোক আজই মধ্যরাতে বিলাসপুরে এসে পৌঁছুবে। সম্ভবত ওরা গীতাঞ্জলিতে আসছে। কাজ হাসিল করলেই প্রচুর অর্থ পাবে ওরা। শিউরে উঠল চাঁদু, সত্যি! কিন্তু আমার অপরাধ? আমি তো ওদের কোনও ক্ষতি করিনি। ওদের কেন, কারও ক্ষতিই করিনি আমি। তা হলে? বাঃ রে। কেষ্ট মিত্তির তার পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেবে না?
কেষ্ট মিত্তিরের ছেলের খুন হওয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? রাগটা তোমার বাবার ওপর।
আমার বাবাও তো খুন করেননি।
করাতে তো পারেন।
না। আমার বাবা এ কাজ করতে পারেন না।
জুলিও পারে না।
আপনি চেনেন জুলিকে?
তোমাকেও চিনি, তোমার বাবাকেও চিনি। যাক। আমার কাজ শেষ। তোমাকে যে খুঁজে পেয়েছি এতেই আমি খুশি।
জুলি এখন কোথায়? আপনি যখন সবই জানেন তখন দয়া করে একবার বলুন না সে কোথায়? আমি ওকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। তারপর খুন হই, যা হই কোনও কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।
লোকটি স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে বলল, আমার সময় খুব কম। আজই রাত্রের মধ্যে যেখানে হোক পালিয়ে যেয়ো তুমি। শুধু বাড়ি যেয়ো না। গেলেই বিপদ। বিলাসপুরেও থেক না।
পালিয়ে কোথায় যাব একটু বলে দিন না?
কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। ইন্দোর ভূপাল জব্বলপুর ইটারসি যে দিকে হোক কেটে পড়ো। আচ্ছা চলি । বাই বাই।
লোকটা চলে যেতেই লাফিয়ে উঠল সুজয়। বলল, এ যে রীতিমতো নাটক জমে উঠল রে ভাই।
তাই তো দেখছি।
ওরা পায়ে পায়ে বালি হেঁটে ওপরে বাঁধে উঠে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। দু’জনের কারও মুখে আর একটুও কথা নেই।