অমরকণ্টক রহস্য – ২

দুই

পরদিন সকালেই রতন ছুটতে ছুটতে এল ওদের বাড়িতে। কিন্তু এলে কী হবে? সিঁড়ির মুখেই ওকে আটকালেন তারাপদবাবু। বললেন, কাকে চাই? চাঁদুকে একবার ভেকে দিন না কাকাবাবু, বিশেষ দরকার। তুমি কৈলাস বসু লেনের বস্তিতে থাক না?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমারই নাম রতন?

হ্যাঁ। চাঁদু আমি একসঙ্গে একই স্কুলে পড়ি।

জানি। কিন্তু চাঁদুর সঙ্গে তো দেখা হবে না।

আমি আপনার দুটি পায়ে পড়ি কাকাবাবু। একবার অন্তত আপনি ওর সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দিন।

বললাম তো দেখা হবে না।

তারাপদবাবুর এইরকম ব্যবহারে বিস্মিত হয়ে গেল রতন। এর আগেও তো কয়েকবার এ-বাড়িতে এসেছে ও। কই তখন তো তিনি এরকম করেননি। সে ছলছল চোখে বলল, শুনুন, আমার বোন জুলি…। জানি।

এই ব্যাপারেই আমি চাঁদুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

এই ব্যাপারে ওর সঙ্গে কোনও কথাই তুমি বলবে না। প্লিজ, ইউ গো ব্যাক। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না কাকাবাবু। কাল বিকেলে আমাদের বাড়ি গিয়েছিল।

বিশ্বাস করি না।

রতন বিনীতভাবে বলল, বেশ তো। আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করুন। তা ছাড়া প্রতিবেশীরা দেখেছে। তাই ওকে দু’-একটা কথা জিজ্ঞেস না করলেই নয়। সে এখানে নেই। কাল রাতের গাড়িতেই সে বিলাসপুর চলে গেছে। তুমি এখন যেতে পারো।

এবার কেমন একটু হতাশ হয়ে পড়ল রতন, কাল সে বিলাসপুর চলে গেছে? কোন গাড়িতে?

অত কৈফিয়ত তো আমি তোমাকে দিতে পারব না বাবা।

কাকাবাবু!

তুমি কি ভাল ব্যবস্থায় যাবে? না আমি অন্য রাস্তা দেখব।

রতন এবার বিমর্ষ গলায় বলল, শুনুন কাকাবাবু! চাঁদু আমার ভাইয়ের মতো। ওকে কোনওভাবে জড়াবার বা সন্দেহ করবার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি আমাকে তাড়ালেও পুলিশকে কিন্তু ঠেকাতে পারবেন না। একটু পরেই পুলিশ আসবে ওর খোঁজে। আমি যাচ্ছি। ও ঘরে থাকলে ওকে বলবেন আমি এসেছিলাম।

রতন যখন ফিরে আসছে তখনই সিঁড়ির ওপর থেকে চাঁদুর গলা শোনা গেল, তুই যাস না রতন। শোন, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

ধমকে উঠলেন তারাপদবাবু, চাঁদু !

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চাঁদু বলল, আমাকে ওর সঙ্গে দু’-একটা কথা

বলতে দাও বাবা। আমি সত্যি সত্যিই কাল বিকেলে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তারাপদবাবু বললেন, তা তো গিয়েছিলে। কিন্তু তুমি কি জান কাল কী হয়েছিল?

না। কিছু জানি না আমি। কাল যখন আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম তখন রতন বা ওর মা কেউই ঘরে ছিল না। আমি ফিরে আসছিলাম। ওর বোন জুলি আমাকে ডেকে নিয়ে ঘরে বসায়। ওদের বাড়িতে তখন এমন কিছু ছিল না যে খেতে দেয় আমাকে।

তুমি কি বাড়িতে খেতে পাও না যে লোকের বাড়ি খেতে গেছ?

আমি ওদের বাড়ি খেতে যাইনি বাবা। গিয়েছিলাম রতনের খোঁজে অন্য একটা দরকারে। তবে মানুষের বাড়িতে মানুষ গেলে স্বাভাবিক ভাবেই একটু খেতে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে। কিছু-না-হোক এক কাপ চা-ও দেওয়া হয়। আমরাও তো দিই। তার মানে কি এই যে, আমাদের বাড়িতে যাঁরা আসেন তারা খেতে পান না?

তুমি দেখছি এর মধ্যে অনেক কথা শিখে গেছ? তারপর কী হল বলো।

তারপর আমি ওকে পাঁচটা টাকা দিয়ে মোড়ের মাথা থেকে কচুরি আনতে বলি। ও হিংয়ের কচুরি খেতে খুব ভালবাসত, আমিও। কিন্তু সেই যে গেল ও আর ফিরল না। দেরি দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ঘরের দরজায় শিকল দিয়ে চুপি চুপি পালিয়ে এলাম। আমি কিন্তু এখনও জানি না ওর কী হয়েছে। তবে আমার মন বলছে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে ওর।

চাঁদুর কথা শেষ হতেই রতন ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল, কেষ্ট মিত্তিরের সেই বখাটে ছেলে রাজুর কথা মনে আছে তোর?

হ্যাঁ। বছরখানেক আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে জুলিকে বিরক্ত করেছিল বলে তুই আমি খুব করে পিটিয়েছিলাম ওকে এবং শাসিয়েছিলাম ফের কখনও এইরকম হলে জান্ত কবর দেব বলে। কিন্তু এখানে রাজুর প্রসঙ্গ আসছে কেন? সে তো এখন খুব ভাল ছেলে হয়ে গেছে। নলহাটিতে পড়াশুনা করছে।

দিনকতক হল সে বাড়ি এসেছে। কাল বিকেলে মানে সন্ধের মুখে জুলি যখন মোড়ের মাথায় কচুরি কিনতে যায়, রাজু তখন ওর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিল। জুলিকে দেখেই এগিয়ে যায় সে। ওকে তোর আর আমার কথা জিজ্ঞেস করে। জুলি প্রথমটা এড়িয়ে যায় ওকে। তারপর কচুরির অর্ডার দিয়ে বেশ ভালভাবেই কথা বলতে থাকে ওর সঙ্গে। মনে হয় কোনও অশোভন আচরণ করেনি ও। তারপর কথা বলতে বলতে একটু দূরের দিকে এগিয়ে যায় ওরা।

চাঁদুর চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে।

তারাপদবাবু বললেন, ওঃ মাই গড। আমি ভেবে পাচ্ছি না এই সেদিনের ছেলে তোমরা ভেতরে ভেতরে এতখানি অ্যাডাল্ট কী করে হলে? এসব কী শুনছি? চাঁদু বলল, তারপর কী হল বল?

তারপর থেকেই জুলি নিখোঁজ। তবে রাজুর লাশটা বৈষ্ণবপাড়ায় হাওয়াপুকুরের কাছে পাওয়া গেছে। কিন্তু জুলির কোনও খবর নেই। এসব খবর তোকে কে দিল?

রাজুর বন্ধুরা। তা ছাড়া পুলিশও বলেছে। পুলিশ তো কাল রাত থেকে জেরায় জেরায় প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছে আমাদের। শুধু পাড়ার লোকেদের জন্যে এখনও আমাকে অ্যারেস্ট করেনি। তবে ওর বাবা কেষ্ট মিত্তির পুলিশকে বলেছে জুলির নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা নাকি একটা সাজানো নাটক। আসলে আমরা নাকি ষড়যন্ত্র করে কোনও কিছুর বদলা নেবার জন্যই রাজুকে খুন করেছি বা করিয়েছি। কেষ্ট মিত্তির তাই উঠি-পড়ি করে লেগেছেন তাঁর একমাত্র ছেলের হত্যাকারী হিসেবে তোকে-আমাকে আইনের জালে জড়াতে। ঘটনার দিন তুই যে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলি সে-কথাও লোকমুখে শুনে খোঁজখবর নিয়ে কেষ্ট মিত্তির পুলিশকে বলেছে।

চাঁদুর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

রতন বলল, পুলিশ তোর কাছেও আসবে। তবে জুলিকে খুঁজে না-পাওয়া পর্যন্ত সম্ভবত ওরা আমাদের দিকে নজর দেবে না। অথচ আসল সর্বনাশটা হল কিন্তু আমাদেরই। এক তো বোনটাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর কাগজে কী লিখেছে জানিস?

কী লিখেছে?

তারাপদবাবুর হাতে সেদিনের খবরের কাগজটা ছিল। সেটা চাঁদুর দিকে মেলে ধরলেন।

চাঁদু কাগজ পড়েই চমকে উঠল।

বড় বড় হরফে কাগজের প্রথম পাতায় লেখা আছে ‘বিখ্যাত ব্যবসায়ী কেষ্ট মিত্তিরের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে খুনি কিশোরী নিখোঁজ।’

চাঁদু বলল, না না। এ হতে পারে না। এ মিথ্যা! ওই খুন যদিও কেউ করে থাকে— জুলি নয়। করলেও বাধ্য হয়েই করেছে। তা ছাড়া রাজুর সঙ্গে গায়ের জোরে ও পেরে উঠবে কেন? আর খুন করতে গেলে যে কোনও একটা অস্ত্র হাতের কাছে থাকা চাই। কাগজে লিখছে ক্ষুরজাতীয় কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলার নলিটাকে দু’ ফাঁক করা হয়েছে, কিন্তু জুলির পক্ষে তা কী করে সম্ভব! ওইসময়ে হাতের কাছে সে ক্ষুরই বা পাবে কোথায়?

রতন অশ্রুসজল চোখে বলল, সেইজন্যেই তোর কাছে ছুটে এসেছি ভাই। পুলিশ এলে শুধু এই কথাটাই পুলিশকে তুই বুঝিয়ে বলবি। বলবই তো।

তারাপদবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, পুলিশ এ বাড়িতে আসবে না। সে-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

চাঁদু বলল, কেন আসবে না?

পুলিশের মুখ আমি বন্ধ করে দিয়েছি।

রতন ও চাঁদু মুখ চাওয়াচায়ি করল।

তারাপদবাবু বললেন, পুলিশ কাল রাত্তিরেই এসেছিল। পুলিশকে যা বলবার আমি বলেছি।

রতন বলল, পুলিশকে আপনি কী বলেছেন?

বলেছি আমার ছেলে এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন আগে কলকাতার বাইরে ওর বন্ধুর বাড়িতে চলে গেছে। এবং আগামী দু’-এক মাসের মধ্যে সে এখানে আসবে না।

কিন্তু পুলিশ তো জানে ও কাল আমাদের বাড়িতে ছিল।

জানে বলেই তো এখানে এসেছিল। কিন্তু আমার টাকা জানিয়ে দিয়েছে ও এখানে ছিল না।

রতন খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, কাকাবাবু! আপনার অনেক টাকা। তাই আপনি এই কাজ করতে পেরেছেন। কিন্তু…।

নিজের ছেলেকে বাঁচাবার জন্য সব বাবাই এই কাজ করে থাকেন। তা ছাড়া আমার চাঁদু নির্দোষ। আমি ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।

কিন্তু আমার অসহায় বোনটি? সেও তো নির্দোষ।

ঘটনা কিন্তু তা বলে না। যাই হোক, ওর ব্যাপারটা আদালতেই প্রমাণ হবে। তুমি এখন যেতে পার।

রতন নীরবে দু’ ফোঁটা চোখের জল ফেলে বিদায় নিল সেখান থেকে।

রতন চলে গেলে তারাপদবাবু সস্নেহে ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আজ সারাদিনে তুমি একদম ঘর থেকে বেরোবে না। শুধু তাই নয়, আজ রাতের গাড়িতেই তোমাকে বিলাসপুরে যেতে হবে। ওখানে সুজয়দের বাড়িতে তুমি যতদিন ইচ্ছে থাকবে। আমি আর তোমাকে আটকাব না। আমি নিজে গিয়ে তোমাকে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে আসব। আমি এখুনি ওর বাবার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করছি।

সে তুমি করতে পারো বাবা। তবে এখন আমি আমার মতের পরিবর্তন করেছি।

তার মানে?

তার মানে আমি যাচ্ছি না।

কী বলত চাও তুমি?

এই অবস্থায় আমার পক্ষে এইভাবে চোরের মতো পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

তারাপদবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবার, যেতে তোমাকে হবেই। এখন ভাবছি তুমি নিজের থেকে যখন যেতে চেয়েছিলে তখনই আমার রাজি হওয়া উচিত ছিল। তা হলে হয়তো এই জালে তোমাকে জড়িয়ে পড়তে হত না। মনে রেখো, কেষ্ট মিত্তিরের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের শত্রুতা। এবং সেও একটা ক্রিমিন্যাল। তার একমাত্র ছেলের হত্যাকারীকে সে সহজে ছাড়বে না।

কিন্তু বাবা! জুলি এ কাজ করতে পারে না।

কে কী পারে, না পারে সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। এটা তো ঠিক, দিস ইজ এ কেস অব মার্ডার?

তা হলে এটাও তো ঠিক শুধুমাত্র আমারই জন্যে একটি পরিবারের বুকে আজ এত বড় একটা বিপর্যয় ঘনিয়ে এল? না আমি ওকে কচুরি কিনতে পাঠাব, না এই কাণ্ডটা হবে।

এর নাম নিয়তি। ললাটের লিখন কেউ রোধ করতে পারে না। তুমি উপলক্ষ মাত্র।

চাঁদু কী যে করবে কিছু ঠিক করতে পারল না। ওর মনের মধ্যে সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। ও আবার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করল। বাবার হুকুম অমান্য করবার মতো সাহস এবং স্পর্ধা ওর নেই। অথচ এই অবস্থায় ও চলে গেলে রতনটা কী ভাববে? সহায়-সম্বলহীন ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটা এইভাবে শুকনো পাতার মতো ঝরে যাবে, এ কী ভাবা যায়? জুলির ভ্রমরের মতো চোখদুটো ওর চোখের সামনে যেন ভাসতে লাগল।