অমরকণ্টক রহস্য – ১২

বারো

চাঁদু আর গোলাপ আবার যখন সার্কিট হাউসে ফিরে এল দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে দু’জনেরই। লছমি চলে গেছে সিদ্ধিবাবার আশ্রমে। দু’-একটা দিন সেখানে থেকে আবার ও ফিরে যাবে ওর নিজের কাজে, অনুপপুরের হাসপাতালে।

টাকা-পয়সা চাঁদুর কাছে যেমনটি যা ছিল তা ঠিকই আছে। শুধু জিনিসপত্তরগুলোই যা খোয়া গেছে।

চাঁদু বলল, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না তুমি কী করে রকির পাল্লায় পড়লে? গোলাপ বলল, এখনই শুনবে? বড্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু। তা হলে চলো। খেতে খেতেই গল্প করা যাবে।

অমরকণ্টকের সব হোটেলেই খাওয়াদাওয়া ভাল। এক এক সময় মনে হয় জায়গাটা কী ভারতের বাইরে? না হলে এই ‘নেই নেই’-এর দেশে এরা এত সব ভাল ভাল খাবার পায় কোত্থেকে?

বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে গোলাপ ওর কথা বলতে লাগল, তুমি তো চলে গেলে অনুপপুরে। আমার মনটা কেমন যেন বিষাদে ভরে উঠল। বেশ তো বন্ধুর মতো ছিলুম দু’জনে। তার ওপর সবাই আমাকে জোর করতে লাগল বিলাসপুরে ফিরে যাবার জন্য। আমি আর কী করি, আমার জিনিসপত্তর আনতে যাবার নাম করে সার্কিট হাউসের টাকা মিটিয়ে মালপত্তর নিয়ে সোজা পালাতে গেলুম কপিলধারার দিকে। ভেবেছিলাম বাবাজির আশ্রমে গিয়ে সব কথা বলে ওইখানে থেকে যাব দু’-একটা দিন। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত। তারপর সোজা তোমাকে নিয়ে চলে যাব আমাদের বাড়িতে। আসলে কী জানো, বুদ্ধিভ্রম আমারও হয়েছিল। যেমন ধরো, হাওড়া স্টেশনে, হাওড়া শহরে বা তোমার বাড়ির কাছে তোমার বিপদ হলেও ধানবাদে তো নয়। আর ধানবাদে যেতে হলে যে হাওড়ায় আমাদের যেতেই হত তারই বা কী মানে আছে? টাটানগর থেকেও তো আসানসোল হয়ে সব মুকিলের আসান করা যেত।

চাঁদু বলল, তা যেত। তবে ভাগ্যে এখানে এসে পড়েছিলাম, তাই তো শত্রুমুক্ত হলাম। জুলিটারও খবর পেলাম! ওর মায়ের কী অবস্থা বলো তো?

গোলাপ বলল, সত্যি, এই তীর্থভূমির কিন্তু মহাত্ম্য আছে। জাগ্রত অমরেশ্বর, মা নর্মদা, আমাদের কীভাবে রক্ষা করলেন তা ভাবা যায়? মা নর্মদা চিরকুমারী। তাই বুঝি আমার অবমাননা মা সহ্য করলেন না। আর আমার মতো অসহায় যারা, তাদের যারা উৎপীড়ন করে তাদেরও ধরিয়ে দিলেন তোমার আমার হাত দিয়ে।

চাঁদু বলল, আমিও কী আশ্চর্য উপায়ে বেঁচে গেলাম বলো তো? ওই মুশাটা

যদি আমাকে জল খাওয়াতে না গিয়ে সত্যিই ফেলে দিত তা হলে কী করতাম? গোলাপ বলল, আমি কপিলধারার পথে গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় আড়ালে লুকিয়ে যখন খানিকটা এসেছি, তখনই হঠাৎ কয়েকজন লোক আমাকে পিছনদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা জিপে তুলে নিল। তারপর নাকে একটা ক্লোরোফর্ম দেওয়া রুমাল এমনভাবে চেপে ধরল যার ফলে আর কিছুই আমার মনে নেই। জ্ঞান যখন ফিরল, তখন আমি ওই অভিশপ্ত গুহায়। যে গুহায় পাষাণে মাথা খুঁড়ে অনেক মেয়েই একটু আলোর প্রত্যাশা করেছে। অথবা ফুরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে কোথাও কোনও দূর জনপদে।

খাওয়াদাওয়ার পর ওরা পায়ে পায়ে নর্মদা মায়ের মন্দিরের কাছে এল। আজ আর আরতি না দেখে সার্কিট হাউসে ফেরা নয়। রাতের খাওয়ার তো প্রয়োজন নেই। খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেক বাদে হয়তো এক কাপ চা খেতে পারে।

মন্দিরের গায়ে নর্মদাকুণ্ডের সিঁড়িতে বসে গোলাপ বলল, এবার তোমার কথা বলো। এরই মধ্যে এমন কী হল তোমার যে তুমি আর বাড়িতেই ফিরতে চাও না?

চাঁদু বলল, হ্যাঁ বলব। সব কথা খুলে বলব তোমাকে। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার আগে আমার পরিচয়টা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার। হয়তো সব শুনলে তুমি এখুনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তা যাও। তবু আত্মপরিচয় আমি কিছুতেই গোপন করব না।

কী সব আজেবাজে বকছ তুমি?

শোনো গোলাপ, তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার আগে আমি নিজেও কিন্তু জানতাম না আমি কে।

কে তুমি?

একজন কুখ্যাত সমাজবিরোধী, ওয়াগন ব্রেকার এবং এক খুনি বেড়ালতপস্বীর ছেলে আমি।

গোলাপ হেসে বলল, এইসব কে মাথায় ঢোকাল তোমার?

চাঁদু তখন লছমির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর থেকে সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া বলল গোলাপকে।

সব শুনে গোলাপ বলল, হ্যাঁ, এইসব শুনে সত্যিই নিজের ওপর ধারণাটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু চাঁদুদা, তুমি তো শিক্ষিত ছেলে। বাল্মীকির উপাখ্যান পড়নি? সেই যে ‘চ্যবন ঋষির পুত্র নাম রত্নাকর।’ মনে আছে, দস্যু রত্নাকর যখন তার পাপের ভাগ নেবার জন্য তার বাবা-মা-স্ত্রী প্রত্যেকের কাছে গেল তখনকার কথা? কী বলেছিলেন তাঁরা? বলেছিলেন, তুমি পুত্র, তুমি স্বামী। আমাদের প্রতিপালন করবার দায়িত্ব তোমার। তুমি সৎপথে উপার্জন করে আমাদের পালন করবে কি দস্যুবৃত্তি করবে তা আমরা কি জানি? আমরা তোমার কর্তব্যের সুযোগ নেব। কিন্তু পাপের ভাগ তো নেব না। আমাদের কি দোষ? তেমনি বাবা-মা তোমাকে জন্ম দিয়েছেন, পালন করেছেন। এই যথেষ্ট। তাঁরা কীভাবে কী করছেন সে দেখবার অধিকার তো তোমার নেই। এখন তুমি বড় হয়েছ, বুঝতে শিখেছ। এখন যদি তুমি সৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হও তবে ওদের মন্দ যা কিছু তার কিছুই তুমি গ্রহণ করো না। দৈত্যকুলেও প্রহ্লাদ জন্মায়। তুমি যদি সৎভাবে জীবন কাটাতে চাও নিশ্চয়ই আমার সহযোগিতা পাবে। তুমি আমাদের কাছেই থাকবে। তোমার বাবা যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে থাকেন, তিনি যদি তাঁর মত এবং পথ পরিবর্তন করে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই তোমার সাধুবাদ জানানো উচিত তাঁকে। তাই রাগের মাথায় এমন কিছু করো না যাতে তিনি দুঃখ পান বা অপমান বোধ করেন।

কথা বলতে বলতে কখন যে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে তা কারও খেয়ালই নেই। শীত পাচ্ছে খুব। আরতি শুরু হচ্ছে। মন্দিরে কাঁসর ঘণ্টা বেজেও উঠল। ওরা ভেতরে ঢুকল।

আরতির প্রসাদ নিয়ে যখন ওরা বাইরে এল তখন হঠাৎ বিরজুর সঙ্গে দেখা। বিরজু বলল, কাঁহা গয়ে থা দোস্ত? তোমাদের ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাম তো হয়রান হো গিয়া। চলো থানায় চলো।

চাঁদু বলল, আবার থানা! কী ব্যাপার?

আরে চলো না ইয়ার।

ওরা তিনজনেই থানায় এল।

পুলিশ ইনস্পেক্টর ওদের সস্নেহে বসতে বলে বললেন, দেখো তো ও সামান তুমহারা কি নেহি?

গোলাপ ও চাঁদু দু’জনেই বলল, হ্যাঁ। এই তো আমাদের সবকিছু। কোথায় পেলেন?

বিরজু বলল, ওগুলো সাইকেলে চেপে খুঁজে আমিই উদ্ধার করেছি। ইনাম মিলেগা তো?

গোলাপ বলল, জরুর।

পুলিশ এবার ধীরে সুস্থে ওদের দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সবকিছু জেনে নিল। এমনকী জুলি যে হত্যাকারী নয় সে খবরও পেয়ে গেল চাঁদুর মুখে। মেয়েটি অপহৃতা। এবং সে চম্পায় আছে জেনে অমরকণ্টক-পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ফোনে জানিয়ে দিল বিলাসপুরকে। বিলাসপুর খবর দিল চম্পাকে। মাত্র কয়েকটা মিনিটের ব্যাপার।

চাঁদু আর গোলাপ পরদিন সকালেই চম্পায় যাবার মন করে ফিরে এল সার্কিট হাউসে। এবার বিশ্রাম।

বিছানায় শোয়া মাত্রই ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ল দেহটা। সারাটা দিন যে কীভাবে কেটেছে তা ওরাই জানে। একেই অসুস্থ শরীর চাঁদুর। মাথার মধ্যে তাই টিস টিস করতে লাগল। খুব খারাপ লাগল ওর। এ সময় একটু সেবার প্রয়োজন ছিল। অমরকণ্টকে না এসে অনুপপুরেই ফিরে গেলে ভাল করত বোধহয়। হাসপাতালে ওষুধ, নার্সিং দুই-ই পেত।

পরদিন সকালে ঘুম যখন ভাঙল তখন অনেকবেলা হয়ে গেছে। রোদ্দুরে ঝলমল করছে চারদিক। কিন্তু চাঁদুর আর ওঠার ক্ষমতা নেই। সারাটা গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

গোলাপ ছুটে গিয়ে বিরজুকে খবর দিতেই, বিরজু ডাক্তার ডেকে আনল। ওর বাবা-মা এল।

ডাক্তারবাবু সব দেখে শুনে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। টিটেনাস দেওয়া আছে। তা ছাড়া অতিরিক্ত পরিশ্রম, ঠান্ডালাগা এবং উৎকণ্ঠার জ্বর এটা। এখন ফুল রেস্ট আর ব্যথা মরার কয়েকটা ক্যাপসুল খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। গোলাপ টাকা দিতে গেলে ডাক্তারবাবু নিলেন না।

বিরজু প্রেসক্রিপসনটা হাতে নিয়ে গোলাপের টাকায় কয়েকটা ক্যাপসুল কিনে এনে দিল।

সিদ্ধিবাবা আর লছমিও এসে হাজির হল একটু পরে।

সার্কিট হাউসের এই ঘরটা ভরে উঠল সকলের আনাগোনায়। এই দূর দেশে চাঁদুর একবারের জন্যও মনে হল না যে সে নিজের বাড়িতে নেই। বিরজুর বাবা কেটলি ভরতি গরম চা এনে খাওয়ালেন সকলকে। লছমি ওদের ঘরটা ঝেড়েমুছে বিছানাটা গুছিয়ে দিল। যেন এখানেও ও ডিউটি করছে।

গোলাপ সিদ্ধিবাবাকে বলল, বাবা! আমাদের যদি আরও দু’-একটা দিন এখানে থাকতে হয় লছমিকে রাখুন না আমাদের কাছে?

সিদ্ধিবাবা বললেন, তা হয় না মা। ও যে লছমি। আর্তের সেবাই ওর ধর্ম। অনুপপুরের হাসপাতালে অনেক রোগী ওর জন্য প্রতীক্ষা করে আছে। ওকে যেতেই হবে মা। আমি ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।

চাঁদু ওর পকেট থেকে একশোটা টাকা বার করে লছমিকে দিয়ে বলল, তুই আমার বহিন কা মাফিক। এটা রাখ তুই। কিছু কিনে খাস।

সে টাকা কিছুতেই নেবে না লছমি। অবশেষে চাঁদু ও গোলাপের অনুরোধে, সিদ্ধিবাবা অনেক করে বলতে তবেই নিতে রাজি হল।

গোলাপ বলল, ও আর একটা দুটো দিন এখানে থাকলে আমাদের খুব সুবিধে হত। চাঁদুদার এইরকম শরীর খারাপ। তায় আমি একা।

এমন সময় দরজার বাইরে থেকে কে যেন বলল, কে বলল তুমি একা। আমি

আছি না? আমাদের দু’ বোনের সেবায় চাঁদুদা শিগগির ভাল হয়ে উঠবে। কণ্ঠস্বর শুনেই চমকে উঠল চাঁদু। এ কী জুলি! তুই এখানে কী করে এলি?

জুলি তখন নবসাজে সজ্জিতা হয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই মাজা কালো গায়ের রং, ভ্রমরের মতো চোখ, হাসিখুশি মুখ। দেখলেই ভাল লাগে। জুলি ছুটে এসে চাঁদুকে প্রণাম করে ওর পাশে বসে বলল, কেমন আছ চাঁদুদা? মাথা ফাটালে কী করে?

আমি ভালই আছি। দুর্বল শরীরে বেশি উত্তেজনা, তার ওপর কাল আরতি দেখতে গিয়ে ঠান্ডাও লেগেছে। তাই জ্বর হয়েছে একটু। ওষুধ খেয়েছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুই কার সঙ্গে এলি?

জুলি বলল, যে দেবতা আমাকে দানবদের কবল থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি আমাকে চম্পার মাতৃমন্দিরে রেখেছিলেন। সেখানে মেয়ের মতোই ছিলাম। দেখছ না আমার সাজপোশাক। কী চমৎকার একখানি শাড়ি পরেছি। আমি ওঁদের কাছে দীক্ষা নিয়েছি। তা কাল রাত্তিরবেলা পুলিশ আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে বিলাসপুরে। তারপর এখানে। তোমার বাবা, গোলাপদির বাবা সবাই এসেছেন। একই সঙ্গে এসেছি আমরা। উঃ কী বিপদ গেল বলো তো? গোলাপ বলল, ওঁরা কোথায়।

থানায় আছেন। আসবেন এখুনি। আমি বিরজুদার সঙ্গে এলাম।

চাঁদু বলল, ওরে বাবা। এর মধ্যেই বিরজুর সঙ্গে দাদা পাতিয়ে ফেলেছিস? বাঃ রে। আমার কত দাদা। তাই তো বোনের কোনও বিপদ হল না। আমার বাড়ির খবর কিছু জান চাঁদুদা?

চাঁদু বলল, কিছুই জানি না রে। আমিও তো ঘর ছাড়া। তবে তোকে হারিয়ে ওদের আর দিন কাটছে না। আমার বাবা, কেষ্ট মিত্তির, সমাজের এই সমস্ত মাথাওয়ালা লোকেরা যতদিন মাথা উঁচু করে থাকবেন ততদিন তোর-আমার মতো অভাগাদের ভাগ্যের আকাশে নিত্যনতুন ধূমকেতু উঠবে।

চাঁদুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই তারাপদবাবু ও সোমনাথবাবু ঘরে এলেন। ছোট্টঘরে এত লোক আর ধরে না। সঙ্গে পুলিশের লোক।

তারাপদবাবু বললেন, কেমন আছ তুমি?

চাঁদু কোনও উত্তর না দিয়ে মুখ নামিয়ে নিল। গোলাপ ছুটে গিয়ে ওর বাবার বুকে মাথা রাখল। তারাপদবাবু বললে, আমার কথা তুমি শুনতে পেলে না? তারাপদবাবুর মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেল, কী শুনেছ শুনি?

আপনার সব কথাই আমি সন্দীপদার মুখে শুনেছি।

শালিমারের সেই অন্ধকার দিনগুলোর সব কথাই শুনেছি। যদি অনুমতি দেন তো সবার সামনেই চেঁচিয়ে বলি।

তারাপদবাবু উত্তেজনা দমন করে বললেন, কোথায় সেই পাজি হতচ্ছাড়া শয়তানটা ?

সে একজন সমাজবিরোধীর ছেলের জীবনরক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে।

গোলাপের বাবা সোমনাথবাবু বললেন, এখন এসব আলোচনা থাক। তোমরা যে বেঁচে ফিরেছ এই ঢের।

গোলাপ বলল, জান তো বাপি, চাঁদুদা আমার জন্য কত করেছে। ওর জন্যই আবার আমি তোমাকে ফিরে পেলাম। আবার আমি বাড়ি যেতে পারব। এই জুলি নামের মেয়েটাও উদ্ধার হল। সবই চাঁদুদার জন্য। চাঁদুদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ও আর হাওড়ার ওই বিষাক্ত পরিবেশে থাকবে না। চাঁদুদা ধানবাদে আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করবে।

সোমনাথবাবু বললেন, বেশ তো, ক্ষতি কী? তারাপদবাবু যদি তাঁর ছেলেকে আমাদের কাছে রাখেন তা হলে আমার কোনও আপত্তি নেই।

তারাপদবাবু বললেন, আমি এক কথায় রাজি। আমার প্রথম জীবনের ভুলের মাণ্ডল যে আমাকে এইভাবে দিতে হবে তা আমি কখনও ভাবিনি। আমি তো ওকে দূরে কোথাও বোর্ডিংয়ে রেখে আসব ভেবেছিলাম।

সোমনাথবাবু বললেন, কোনও দরকার নেই। ও ধানবাদে আমার ওখানে থেকে আসানসোল কিম্বা চিত্তরঞ্জনে কলেজে পড়বে।

সিদ্ধিবাবা এতক্ষণ বসে বসে সব শুনছিলেন। এবার লছমিকে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে। আমরা যাচ্ছি। এখন আপনারা আয়াস করুন। নর্মদে হয়।

চাঁদু দরজা পর্যন্ত উঠে এসে বিদায় জানাল সিদ্ধিবাবাকে।

ওই সার্কিট হাউসে আরও একটি ঘর পাওয়া গেল। সেই ঘরটা সোমনাথবাবু নিলেন। একটা দিনের ব্যাপার। কালই চলে যাবেন সবাই। জুলি, গোলাপ ও চাঁদু একঘরে রইল শুধু গল্প করার জন্য। সবাই চলে গেলেও বিরজু ছিল ওদের কাছে। চাঁদু ওর হাতে টাকা দিয়ে গরম গরম শিঙাড়া, কচুরি, লাড্ডু, জিলিপি ইত্যাদি আনতে দিল। বেশি করেই আনতে বলল। যাতে তারাপদবাবু ও সোমনাথবাবুও ভাগ পান।

বিরজু চলে গেলে চাঁদু জুলিকে বলল, তোর কী ব্যাপার বল তো? কীভাবে কী হল সেদিন। সন্দীপদার সঙ্গে তোর পরিচয় কীভাবে হল?

জুলি বলল, আবার কেন সেই অভিশপ্ত দিনটার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছ চাঁদুদা ?

না হলে সবকিছুই যে অস্পষ্ট হয়ে যাবে।

তোর মুখে তোর বিপদের কথা শুনতে হবে

না?

জুলি বলল, তুমি তো আমাকে কচুরি কিনতে পাঠালে। আমিও গেলাম। তখন সন্ধের মুখ। হঠাৎ মোড়ের মাথায় গিয়েই দেখি একজনদের রকে বসে গল্প করছে ওই রাজু শয়তানটা। আমি জানতাম ও নলহাটিতে বোর্ডিং-এ আছে। কিন্তু এইভাবে যে ওকে এখানে দেখব তা ভাবিনি। তাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম।

রাজু আমার ভয় দেখে আড্ডা ছেড়ে উঠে এসে বলল, কীরে কালটি! এত ভয় পেলি কেন? আমি আর আগের মতো নেই। অনেক ভাল হয়ে গেছি। এখন থেকে আমি ভাল ছেলেই হয়ে থাকব। তোর দাদা আর ওই চেঁদোটা একবার আমাকে পিটিয়েছিল মনে আছে?

সেটা তুমি আমাকে বিরক্ত করেছিলে তাই।

ওদের বলিস, আমি আবার ফিরে এসেছি। ওদের সঙ্গে আমি দোস্তি চাই।

আগেকার সব কথা যেন ভুলে যায় ওরা।

বেশ বলব। এখন আমার পথ ছাড়ো।

না ছাড়লে?

চেঁচাব।

রাজু একটা শিশি বার করে বলল, এটাতে কী আছে জানিস? জানি না।

অ্যাসিড আছে। তোর মুখ তো এমনিতেই কালো। ওখানে আর ঢেলে কী হবে? তবে তোর ওই লালটুস চাঁদুদা, ওর বদন আমি বেগড়াবই। অনেকক্ষণ তোদের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দে। না হলে তুইও কিন্তু ছাড় পাবি না।

আমি বললাম, পারব না।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মুখে অ্যাসিডটা ঢালবার জন্য শিশি থেকে ছিপিটা খুলল রাজু। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন আমাকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে গেল। পরক্ষণেই রাজুর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। যে আমাকে টেনে নিয়ে গেল সে আমার পেটের কাছে ছোরা ঠেকিয়ে মন্টুদার গ্যারেজে নিয়ে ঢোকাল। অন্ধকার ভাঙা গ্যারেজ ঘর। বলল, খবরদার চেঁচাবি না। আর তুই পালাতে পারবি না। পালালেও বাঁচবি না। এখন থেকে তুই আমাদের। আমরা তোকে যেখানে নিয়ে যাব যাবি। যদি আমাদের কথা না শুনিস, তা হলে কিন্তু তোর মা আর দাদাকে হারাতে হবে। মনে থাকবে?

আমি কেঁদে বললাম, তোমরা যে যা বলবে আমি তাই করব। আমার দাদার কোনও ক্ষতি কোরো না তোমরা।

ঠিক তো? আমাদের কথা শুনলে আমরা কারও ক্ষতি করব না। তোরও না। তা ছাড়া এখন আমরা তোকে ছেড়ে দিলেও তোর বিপদ কিন্তু কমবে না। দেখলি তো রাজুটা কীভাবে খুন হল?

খুন হতে আমি দেখিনি তো?

আঃ। চেঁচানি তো শুনেছিস। এতক্ষণে ওর লাশ চলে গেছে হাওয়াপুকুরের ধারে। ওর বন্ধুরা কিন্তু তোর সঙ্গেই ওকে দেখেছে। তারপরই এই খুন। সবাই কী ভাববে বল তো? তুই-ই খুনটা করেছিস। তার ওপরে ওর বাবা আবার কেষ্ট মিত্তির। তাই বলছি আমরা ছেড়ে দিলেও তোকে কিন্তু সারাজীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। নয়তো লটকাতে হবে ফাঁসির দড়িতে। আর আমাদের সঙ্গে এলে তোর হবে সুখের জীবন। তা ছাড়া ও তো অ্যাসিড দিয়েই পুড়িয়ে দিচ্ছিল তোর মুখটাকে। সারাজীবন এই মুখ নিয়ে কী করতিস? আমরা সেদিক থেকেও তোকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।

আমি বললাম, আমি কোনওরকম গোলমাল করব না। তোমরা যে যা বলবে তাই শুনব।

এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। তা ছাড়া আর দু’দিন বাদে একটু বড় হলে শ্বশুরবাড়ি তো তোকে যেতেই হত। মনে কর না সেইরকম কোথাও যাচ্ছিস। আমি দু’ ফোঁটা চোখের জল ফেলে অনুসরণ করলাম ওদের।

ওরা সেই রাতে আমাকে খড়্গপুরে নিয়ে গিয়ে রাখল। পরদিন আবার ট্রেনে করে কোথায় যেন নিয়ে চলল ওরা। এইসময় ট্রেনের মধ্যেই দেখা হল সেই দেবতার সঙ্গে। ওদের সঙ্গে আমাকে দেখে অনেকক্ষণ থেকেই নজরদারি করছিলেন তিনি। পরে আমি যখন বাথরুমে গেছি তখন আমার কাছে এসে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেন সব কথা। আমি ভয়ে ভয়ে সব বললাম।

উনি বললেন, তোর কোনও ভয় নেই। তুই আমার সঙ্গে আয়। তারপর দেখছি ওদের দৌড় কত।

কিন্তু আপনার সঙ্গে গেলে যদি ওরা আমার মা বা দাদার কিছু করে?

কিছু করবে না। তুই চলে গেলেই ওরা ভুবন অন্ধকার দেখবে। তুই যদি পুলিশকেও বলে দিস ওদের কথা, সেই ভয়ে ওরা আর কোনওরকম গোলমাল করবে না। তুই নির্ভয়ে চলে আয় আমার সঙ্গে। ,

আমার কেন জানি না মনে হল উনি ঠিকই বলছেন। তাই আমি ভাগ্যের হাতে

নিজের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়ে তখনকার মতো ওদের নজর এড়াবার জন্যে গাড়ির ভেতরে ভেতরে খানিকটা এগিয়ে নিজেকে আড়াল করলাম। তারপর সেই দেবতার সঙ্গে নেমে পড়লাম পরের স্টেশনে। স্টেশনটার নাম চম্পা। উনি বললেন, দেখ, আমি যে তোকে নামিয়ে নিলাম এটা কিন্তু ওরা বুঝতে পারবে। তাই ওদের যত রাগ পড়বে আমার ওপর। আমি অবশ্য তাতে ভয় পাই না। কিন্তু আমি তোকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি তুই সেখানে সাবধানে থাকবি। একদম ঘর থেকে বেরোবি না। সময়মতো হাওয়া বুঝে তোর বাড়িতেও আমি খবর দেব। তারপর ওই শয়তানদুটোকে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে আমি নিজে তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব তোর বাড়িতে। ইতিমধ্যে পারি তো ওই কেষ্ট মিত্তিরকেও দেখে নেব।

চাঁদু বলল, সন্দীপদা কত মহৎ। যাক, ভগবান রক্ষে যে ওর নজরে পড়ে গিয়েছিলি তুই। আর কালচক্রে ওরা নিজেরাই ফেঁসে গেল বলে তোকে-আমাকেও বেশিদিন বাইরে থাকতে হল না।

বিরজু খাবার নিয়ে এলে, সেই খাবার ভাগ করে খেল সবাই। তারাপদবাবু ও সোমনাথবাবুও বাদ গেলেন না। খেতে খেতেই ঠিক হল দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটা টাঙ্গায় করে অমরকণ্টকের সবকিছুই ঘুরে দেখে নেবেন ওরা। চাঁদুর ইচ্ছে হলে ওদের সঙ্গে যাবে। না হলে শুয়েবসেই কাটিয়ে দেবে সময়টা। কাল সকাল হলেই চলে যাবার তাড়া। এই তীর্থভূমি যতই রমণীয় হোক, আর এখানে পড়ে থাকা ঠিক নয়। কেন না মুখে কিছু না বললেও জুলির মনটা ওর বাড়ির জন্য ছটফট করছে তো?