অমরকণ্টক রহস্য – ১০

দশ

অনুপপুর জায়গাটা মন্দ নয়। অমরকণ্টকের যাত্রীরা অনেকে এখান দিয়েও আসেন। যেমন জব্বলপুরের দিক থেকে যারা আসছেন তাঁরা খামোকা পেনড্রা রোডে নামতে যাবেন কেন? তাই এখান থেকেও নিয়মিত বাস চলাচল করছে। শুধু অমরকণ্টক নয়। মনেন্দ্রগড়, চিরিমিরি আরও অনেক জায়গার বাস পাওয়া যায় এখান থেকে।

সকালের সোনার রোদ্দুরে চারদিক যখন ভরে উঠেছে, তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কত কী ভাবছিল চাঁদু। গোলাপকে কাল ওরা আসতে দেয়নি। আজ নিশ্চয়ই দেবে। সার্কিট হাউসের ওই নিরালা পরিবেশে একা একা কী করছে সে কে জানে? কাল ওর মাথায় স্টিচ করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আজ আর কাল দু’দিন থাকলেই ওর ছুটি। অবশ্য ছুটি পেলে আজকেই ও চলে যেতে পারে। কিন্তু তা দেবে না ওরা।

লছমি নামের একজন ছত্তিশগড়িয়া মেয়ে ওর দেখাশোনা করছে। মেয়েটি বড় ভাল। ও বলেছে ওর এই বিপদের খবর পেয়ে ওর বাবা যখন ওকে নিতে আসবেন, তখন বেশ মোটা রকমের বকশিশ দেবে ওকে। বকশিশের লোভেই হোক বা যে কোনও কারণেই হোক লছমি কিন্তু খুব খুশি ওর ওপর।

চাঁদু অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে নানারকম ভাবনা চিন্তা করল। প্রাণহানির আশঙ্কাটা ওর মন থেকে একেবারেই দূর হয়ে গেছে। তাই নির্ভয়ে এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারি করে অন্যান্য রোগীদের দেখে দরজার কাছে এল। এমন সময় দূর থেকে যাকে আসতে দেখল, তাকে দেখেই, আনন্দে ভরে উঠল ওর মন। ও দেখল স্বয়ং সিদ্ধিবাবা জোর কদমে হেঁটে আসছেন ওর দিকে।

উনি কাছাকাছি আসতেই চাঁদু এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল সিদ্ধিবাবাকে। সিদ্ধিবাবা বললেন, কেমন আছিস বেটা?

আমি ভাল আছি বাবা। এখনও আমি চলে যেতে পারি। কিন্তু এরা বলছে আরও দু’দিন আমাকে এখানে থাকতে।

বেশ তো। ঠারো। আয়েশ করো।

আপনি কী করে খবর পেলেন আমি এখানে আছি?

কাল বিকেলে নর্মদা মায়ের মন্দিরে গিয়ে আমি সব শুনলাম। থানায় গেলাম। আমি কাল তোমার বাড়িতে ফোন করে সবকিছু জানিয়েছি। কিন্তু তোমার সঙ্গে ওই যে লেড়কি ছিল, ও তো নো পাত্তা হয়ে গেছে। সে কী!

পুলিশ অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনওরকম সন্ধান করতে পারছে না। আর তোমরা যে দু’জনকে কপিলধারার কাছে ঘায়েল করেছ, ওদেরও পুলিশ ধরে এনে খুব পেটাচ্ছে। একজনকে বিলাসপুরে পাঠানো হয়েছে। ওর তো দোনো আঁখো বরবাদ হয়ে গেছে।

কিন্তু ওই মেয়েটা গেল কোথায় বাবা?

ভগবান জানে। বাসে, ট্রেনে, হোটেলে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটাকে। কেউ ওকে কিডন্যাপ করেনি তো?

হো ভি সকতা।

চাঁদুর মনে হল ওর পায়ের নীচে মার্টিটাও যেন দুলছে। মেঘের পরে মেঘ যেন সরতে আর চায় না। কী বিভ্রাট!

চাঁদু বলল, বাবাজি, আমি কিন্তু এখন বেশ সুস্থ। আপনি একটু বলে কয়ে আমার ছুটির ব্যবস্থা করে দিন। এখানে আমি আর এক মুহূর্ত থাকতে পারব না। গোলাপকে যেভাবেই হোক খুঁজে বার করতেই হবে। এই অমরকণ্টকে এমন কোনও রহস্য আছে যা আমাদের কাঁটার মতো বিধছে। যেমন দুধধারার ওই পাগলা রামু। ওই ভয়ংকর লোকদুটো। গোলাপের অন্তর্ধান। সবই তো দেখছি একই সুতোয় বাঁধা। অমরকণ্টক আমাদের নিয়তি। না হলে এত জায়গা থাকতে মরতে আমরা এখানেই বা আসব কেন।

রহস্য আরও আছে। তোমার আততায়ীরাও খুব রহস্যময়ভাবে লকআপ থেকে উধাও হয়েছে।

কী করে?

যে করে রহস্যের পর রহস্য তার জালকে বিস্তার করে চলেছে, সেইভাবে। বিলাসপুরের ওই অচেনা লোকটিও তো আর এক রহস্য।

সিদ্ধিবাবা ঘাড় নাড়লেন। তারপর বললেন, তুমি বেশি বাইরে ঘোরাফেরা কোরো না। হাসপাতালের বেড়েই শুয়ে বসে থাক। আমি পুলিশকে বলছি তোমার দিকে একটু নজর রাখতে। ওই পলাতক লোক দু’জন এখানেও তো আসতে পারে। ওরা এসে গেলে তোমার জিন্দগি বরবাদ করে দেবে।

চাঁদু কঠিন গলায় বলল, ওরা আসুক। আর আমি কাউকে ভয় খাই না। আর আমি পালিয়ে বেড়াব না। এবার লড়ে মরব আমি। বাবাজি, আপনি একটু এইখানকার বনে পাহাড়ে গোলাপকে খুঁজে দেখুন। আমার মনে হয় ও এখানেই কোথাও আছে। কেন না পুলিশ যদি সত্যিই ওর খোঁজে লোক লাগিয়ে থাকে তা হলে এতক্ষণে ধরা ও পড়তই। ওকে কেউ গুম করে এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। তাই ওর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওর কাছে টাকা-পয়সা আছে, মালপত্তর আছে। সেইসব নিয়েও ও তো হেঁটে যাবে না। বাস অথবা ট্রেনে ওকে উঠতেই হবে। উঠলেই ধরা পড়ত।

আমারও তাই মনে হয়। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আমি কয়েকজনকে কাজে লাগিয়েছি। সমস্ত পাহাড়িদের খবর দিয়েছি। ও যদি সকলের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েও গিয়ে থাকে, তা হলেও কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিতে গেলেই ধরা পড়বে। ওর চিন্তা তুমি একদম কোরো না।

সিদ্ধিবাবা চলে গেলেন।

সিদ্ধিবাবা চলে যেতেই লছমি কাছে এসে বলল, তোমার কী হয়েছে ভাইয়া? কী বলছিলে তুমি সাধুজিকে?

চাঁদু বলল, ও তুই বুঝবি নারে।

সমঝানে সে ভি নেহি সমঝেগা?

কিন্তু বুঝেই বা তুই করবি কী?

তবু বোলো না ভাইয়া।

চাঁদু তখন ওর দুঃখের কথা এক এক করে সব বলল।

সব শুনে শিউরে উঠল লছমি। বলল, ইয়ে বাত? তো মালুম হোতা হ্যায় তুমহারা গুলাবকো ও শয়তান রকি নে উঠাকে লে গয়া।

রকি! রকি আবার কে?

রামরূপ সিং কি লেড়কা। বহৎই বদমাশ। ও জরুর বুলানারা মে হোগা। চাঁদু বলল, বুলানারা! সেটা কোথায়?

বহৎ দূর। অমরকণ্টক সে কমসে কম দশ মিল হোগা। হিয়াসে ভি জায়দা দূর। হুঁয়া চারো তরফ পাহাড়ো পাহাড়।

চাঁদু লছমির হাতদুটো ধরে বলল, তুই আমাকে সেখানে নিয়ে যাবি লছমি? তুই এইখানকার মেয়ে। রাস্তাঘাট চিনিস। তুই ছাড়া আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। গোলাপকে উদ্ধার করতে পারলে তুইও লাভবান হবি। ওর বাবার অনেক টাকা। তা ছাড়া একমাত্র মেয়ে। ওর বাবা খুশি হয়ে অনেক টাকা দেবেন তোকে।

লছমি বলল, ভাইয়া, তুম হামকো রুপিয়া কি লালস মাত দিখাও। আমি গরিব ঘর কি লেড়কি। পেটকে লিয়ে এখানে আয়ার কাম করতে এসেছি। তুমহারে লিয়ে ইয়ে কাম হম জরুর করেঙ্গী।

তা হলে তুই আমাকে এখুনি নিয়ে চলো সেখানে।

হুঁয়া যানে সে ফায়দা ক্যা হোগা?

ওই শয়তান রকির খপ্পর থেকে গোলাপকে মুক্ত করব।

ও রকি বহতই খতরনক। ও সব লেড়কি কো লে যাতা। মার ডালতা। কলকাত্তা বোম্বাই ভেজ দেতা।

সে কী !

হ্যাঁ। অ্যায়শা হি করতা ও লোগ। উধার কোঈ আদমি যানে সে বহৎ মারতা। তা হলে?

চলো, আমরা বরং পুলিশে খবর দিই। ও লোগ জরুর পাকড়েঙ্গে।

চাঁদু বলল, খবরদার নয়। পুলিশে খবর দিলে পুলিশ হইচই পাকিয়ে সব ভেস্তে দেবে। আর পুলিশের মধ্যে যদি ওদের কোনও স্পাই থাকে তা হলে ওরাও ওদের সাবধান করে দেবে। আমরা লুকিয়ে ওখানে যাব। এমনভাবে যাব যাতে সবাই ভাববে বুঝি জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যাচ্ছি। মাথায় কাঠের বোঝা থাকবে। ময়লা জামাপ্যান্ট পরে থাকব।

লেকিন তোমার এমন সুন্দর চেহারা লুকোবে কী করে?

ও ঠিক পালটি হয়ে যাবে। ওর জন্যে ভাবিস না।

তোমার তবিয়ত ঠিক আছে তো ভাইয়া?

খুব ভাল আছে। বল খেলতে গিয়ে এইরকম মাথা অনেকের অনেকবার ফেটেছে। কিন্তু তুই আর দেরি করিস না। এখুনি চল। থোড়া দের হোগা।

চাঁদু রেগে মেগে বলল, তা হলে আমি একাই যাব।

লছমি হাসল, তুম! বুলানারা যাওগে? অউর অকেলে? ও বহতই নটখটিয়া রাস্তা ভাইয়া। বলে যা বলল তার অর্থ হল, আর এক ঘণ্টা বাদেই ওর ডিউটি খতম হয়ে যাবে। তখন গেলে ওর নোকরি যাবার ভয় থাকবে না। চাঁদু তো একেবারেই যাবে। কিন্তু ওকে যে আবার ফিরে আসতে হবে, তাই।

অগত্যা এক ঘণ্টা বাদেই যেতে রাজি হল চাঁদু। লছমিকে বলল, যাবার সময় তুই আমার মাথা ঢাকবার জন্যে একটা টুপি, আর বিপদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য একটা ছুরি আনিস। তুই-ও ছুরি রাখিস সঙ্গে। বলা যায় না কখন কী হয়।

লছমি ওকে বেড়ে যেতে বলে নিজের কাজে মন দিল।

একটু পরেই ডাক্তার এসে রোগীদের পরীক্ষা করলেন। চাঁদুকেও একবার দেখে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে চলে গেলেন।

দেখতে দেখতেই ঘণ্টা কাবার হয়ে গেল।

লছমির পর বুধবারি নামে একজন এল। সে এলে ডিউটি খতম হল লছমির। ও তখন চাঁদুকে ইশারা করে নিজের মনে গুণগুণিয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে চলল।

চাঁদুও সকলের নজর এড়িয়ে লছমিকে অনুসরণ করে চলতে লাগল এক-পা এক-পা করে।

বেশ খানিকটা যাবার পর লছমি কথা বলল ওর সঙ্গে। বলল, তুম হিয়া ঠারো। আভি হম আ রহে।

যে জায়গায় ওকে থামতে বলল লছমি, সে জায়গাটা খুবই নির্জন। অনুপপুরও পাহাড়ি এলাকা। যদিও পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হওয়ায় এবং জঙ্গল কাটার ফলে বছরে বছরে জায়গাটার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, তবুও ফাঁকা। পিছনেই জঙ্গলের শুরু। গভীর নয়, পাতলা। বড় গাছ একটিও নেই। ছোট ছোট গাছ। বনবাদাড়ে ভরা। চাঁদু ওইখানেই একটি বড় পাথরের খাঁজের আড়ালে বসে রইল চুপটি করে। এইসময় ওর কাছে এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি যুগ বলে মনে হতে লাগল। লছমি যতক্ষণ না ফিরে আসে ততক্ষণ ওর পক্ষে একা বসে থাকাও যেন একটা দায় হয়ে উঠল।

কতক্ষণ বসেছিল ওর ঠিক মনে নেই। ও যখন বসে বসে লছমির জন্য অপেক্ষা করছে ঠিক সেই সময় দু’জন মানুষের ছায়া লম্বালম্বিভাবে ওর সামনে পড়তে দেখল। সভয়ে পিছনে তাকিয়েই দেখল বলিষ্ঠ চেহারায় দু’জন যুবক শিকারি বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

ও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েই বলল, কী চাই তোমাদের?

ওরা হেসে বলল, আমরা তোমাকে চাই। তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছি আমরা। কী কাণ্ড করে যে পুলিশের চোখ ধুলো দিয়ে এসেছি তা আমরাই জানি। কিন্তু তুমি তো হাসপাতালে ভরতি ছিলে, এখানে কী করে এলে?

যেভাবেই আসি না কেন, সেকথা জানবার কোনও অধিকার তোমাদের আছে বলে মনে করি না।

তা না করতে পারো। কিন্তু তোমাকে আমাদের প্রয়োজন আছে। কোনওরকম চিৎকার চেঁচামেচি না করে আমাদের সঙ্গে চলে এসো। যদি না যাই?

তা হলে আমরা অন্য উপায়ে নিয়ে যাব।

চাঁদু আড়চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই। অনেক দূরে অবশ্য দু’-একজনকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে হেঁকে তাদের ডাকতে গেলে দুষ্কৃতীরা ওকে শেষ করে পালাতে পারবে। কেউ নাগালও পাবে না ওদের। তাই বুদ্ধিমানের মতো বলল, কোথায় যেতে হবে?

যেখানে আমরা নিয়ে যাব।

আমাকে নিয়ে যাবার দরকারটাই বা কী? তোমরা যদি আমাকে মারবার জন্যই এসে থাক তা হলে মেরে ফেলো। অযথা অপহরণের ঝুঁকি নিচ্ছ কেন?

ওরা হাসল। হেসে বলল, তোমাকে মারব কি মারব না সেটা ঠিক করব পরে। আগে তোমার বাবার সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া হোক। তোমার বাবাকে মোচড় দিয়ে কোনও মালকড়ি আদায় করতে পারি কি না দেখি। তবে তো।

এই যদি তোমাদের মতলব তা হলে এতদূর আসতে গেলে কেন তোমরা? এটা তো পাড়াতেই হতে পারত।

পারত। তবে তখন আমাদের ওইরকম কোনও পরিকল্পনা ছিল না। ঘটনাচক্রে এইরকম করতে বাধ্য হচ্ছি। তা যাকগে, এখন এসব কথা নয়। আগে তোমাকে কোনও একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখি। তারপর সব ঠিক করব। পুলিশ খুব খোঁজাখুঁজি করছে আমাদের। সন্দীপটা বিশ্বাসঘাতকতা করল তাই। না হলে পুলিশেও আমাদের ধরত না। তোমাকেও সাবাড় করে দিতুম বিলাসপুরে।

কথা বলতে বলতে ওরা জঙ্গলের পথধরে খানিকটা এগোবার পর একটা পাকা রাস্তা দেখতে পেল। পথটি নির্জন, কিন্তু এই পথে মোটর বাস যাতায়াত করে। একজন এইখানে একটি পাহাড়ের বড় পাথরের আড়ালে চাঁদুকে নিয়ে লুকিয়ে রইল। আর একজন অনেক চেষ্টার পর একটা ভ্যানগাড়িকে হাত দেখিয়ে থামাল। এতে কিছু প্রসাধন সামগ্রী যাচ্ছিল। সেই ভ্যানে ওকে উঠিয়ে একজন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে বলল, বুলানারা।

ড্রাইভার কঠিন গলায় বলল, উধার হম নেহি যায়েঙ্গে।

লোকটি এবার একটা রিভলভার বার করে ড্রাইভারের ঘাড়ের কাছে ধরতেই গাড়িতে স্টার্ট দিল ড্রাইভার।

বুলানারা নাম শুনেই চমকে উঠেছিল চাঁদু। ও তো সেখানেই যাচ্ছিল। কিন্তু এইভাবে এত সহজে যে সে সেখানে পৌঁছতে পারবে তা ভাবতেও পারেনি। শয়তান রকি গোলাপকে সেখানেই তো নিয়ে গিয়ে রেখেছে। গোলাপের সঙ্গে আর একবার দেখা হবে এই আশাতেই ওর বুকটা ভরে উঠল। কিন্তু রকির সঙ্গে এই লোকদুটোর সম্পর্ক কী? এরা তো বাঙালি। থাকে হাওড়া অথবা কলকাতায় কিম্বা তারই আশেপাশে কোনও শহরতলিতে। অথচ এই মেকল পর্বতের ঘন অরণ্যের সঙ্গে এদের যোগসূত্র কীসের?

বেশ কিছুটা পথ যাবার পর এক জায়গায় ভ্যানটাকে থামাল ওরা। তারপর যা করল তা যেমনই বর্বরোচিত, তেমনই অমানুষিক। ওরা ভ্যান থেকে নেমেই গায়ের জোরে ভ্যানটাকে পাহাড়ের খাদের দিকে ঠেলে দিল। প্রাণভয়ে চিৎকার করে উঠল ড্রাইভার। কিন্তু কে শোনে তার আর্তনাদ। ভ্যানটা গড়িয়ে পড়ল খাদে। সব শেষ।

চাঁদু ভয়ে কাঠ হয়ে গেল।

ওরা চাঁদুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় কী! এরকম আমরা অনেক করেছি। ওটাকে না-মারলে ও গিয়ে পুলিশে খবর দিত। তখন বিপদের আর শেষ থাকত না। তাই শত্রুর শেষ আগেই করে দিলাম।

ওরা ওকে বনপথ ধরে এক জায়গায় একটি পুরনো বাড়ির কাছে নিয়ে এল।

বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে একতলা। কিন্তু ভেতরে ঢোকার মুখেই কার্পেটের নীচে যে কবজা আঁটা কাঠের ডালাটা আছে, সেটাকে তুলতেই দেখা গেল নীচে নামার একটা সিঁড়ি আছে। ওরা ওকে সেইখানে নিয়ে এসে বলল, যা। নীচে যা।

চাঁদু কী করবে কিছুই ভেবে না পেয়ে নীচে নামল। বেশ কয়েক ধাপ নামার পরে দেখল নীচের তলায় মুখোমুখি দু’-তিনটি ঘর। একজন পাহাড়ি সেখানে একটি ঘরের কাছে টুল পেতে বসে আছে। ওকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল, আও দোস্ত। বলে একটা ঘরের শিকল খুলে দরজাটা ফাঁক করেই এক ধাক্কায় ওকে ঘরের ভেতর ঠেলে দিল।

সেই ধাক্কার টাল সামলাতে পারল না চাঁদু। একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল গিয়ে ঘরের মেঝেয়। একে মাথার ওই অবস্থা, তার ওপরে ওইভাবে পড়ে যাওয়া। চোখে যেন সর্ষে ফুল দেখল। কী ভাগ্যে মাথাটায় লাগেনি। সেই ঘরে আর একজন যে ছিল তাকে দেখেই চিনতে পারল চাঁদু। সেই লোক। সেই তৃতীয় ব্যক্তি। বলল, এ কী! আপনি এখানে?

তোর জন্যই তো এখানে আসতে হল আমাকে। কেন?

বাঃ রে। তোকে বাঁচাতে গিয়েই তো এদের হাতে

বন্দি হলুম। আপনি বন্দি?

দেখছিস না হাতদুটো পিছনদিকে মুড়ে বাঁধা।

তা হলে কেন আপনি আমাকে বাঁচাতে গেলেন?

ভুল করলাম। আমার কথা না শুনে তুইও ভুল করলি। এখন তুই, আমি, জুলি তিনজনেই মরব।

জুলি! জুলি কোথায়?

সে আছে, পরে সব বলব। তোকে আমি কত করে বললাম, তুই দূরে কোথাও পালিয়ে যা। কিন্তু কেন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে এখানে আসতে গেলি? তারপর থানা-পুলিশ করে এমন কাণ্ড করলি যে আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। তোর ওই আততায়ীরা আমারও শত্রু। ওদের মারব বলে এমন ফাঁদ পেতেছিলাম যে পুলিশের চালে নষ্ট হয়ে গেল সব। ওরা এমনই শয়তান যে ওদের না মেরে ধরে রাখা যায় না। হলও তাই। ধরা পড়া মাত্রই ওরা রকির কারসাব্জিতে ফসকে পালাল। ইতিমধ্যে পুলিশের হইচইতে আমরা সবাই জেনে গেছি অমরকণ্টকের সার্কিট হাউসে উঠেছিস তোরা। রকির তিন সঙ্গী তোদের কপিলধারায় আটকাতে গেলে তোরা তাদের রীতিমতো ঘায়েল করেছিস। কিন্তু তারপরও মেয়েটা ওদের খপ্পর থেকে রেহাই পেল না। তুইও ধরা পড়লি।

অনুপপুর হাসপাতাল থেকে ওরা তোকে নিয়ে এল কী করে?

চাঁদু তখন আগাগোড়া সব বলল তারপর বলল, ওরা একজন সন্দীপের নাম করছিল। আপনিই কি সন্দীপবাবু?

বাবুটাবু কিছু নই। সন্দীপদা বলবি।

আচ্ছা, গোলাপকে ওরা কোথায় রেখেছে? জুলি কোথায়?

গোলাপ কে?

আমার সঙ্গের মেয়েটি।

ওর কথা বলতে পারব না। তবে জুলিকে আমি চম্পায় লুকিয়ে রেখেছি। চম্পা! সেটা কোথায়?

বিলাসপুরের কাছে। চম্পার ওপর দিয়েই তো এলি।

ও, হ্যাঁ। মনে পড়েছে।

মনে না পড়াটাই স্বাভাবিক। ভোরে ট্রেনটা থেমেছিল। তখন হয়তো ঘুমোচ্ছিলি।

চাঁদু বলল, সন্দীপদা, আমার সব কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। কী থেকে যে কী হল। কোন রহস্যের জালে কীভাবে জড়িয়ে পড়লাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় ছিলাম আমরা। কোথায় এলাম। কোথায় আমাদের হাওড়া শহর, আর কোথায় এই অমরকণ্টকের মেকল পাহাড়।

এর পিছনে অনেক জটিল রহস্য আছে ভাই।

রাজুর খুন হওয়া, জুলির হারিয়ে যাওয়া, সবই তো রহস্যময়। তা ছাড়া আমি তো কারও কিছুই করিনি। তবু কেন ওরা আমাকে বাঁচতে দিতে চায় না? আপনি তো আমাকে চোনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না। আপনি যেসব জায়গায় আমাকে পালাতে বললেন, সেখানে পালালে আমার কোনও বিপদ হত না। শুধু আমার কেন, গোলাপেরও হত না কিছু। কী সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটা।

ওরা দুষ্কৃতী। ওদের কাছে ফুলের পাপড়ি ঝরানোও যা, একটা মেয়েকে অপহরণ করে লোপাট করে দেওয়াও তাই। ভাগ্যে জুলিটাকে আমার কাছে রাখিনি। ওকে ওরা হন্যে হয়ে খুঁজছে। এখন যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাতে না পারলে আমাদের বাঁচোয়া নেই। জুলিকে বিলাসপুরেই আমি তোর হাতে তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু তখন তোরই জীবন বিপন্ন ছিল।

এখন কি এখান থেকে পালানো যায় না?

না। বুলানারার এই বন্দি গুহায় একবার কেউ এসে হাজির হলে মৃত্যুই তার একমাত্র মুক্তি। তবু মরবার আগে মানুষ একবার অন্তত বাঁচবার চেষ্টা করে। আমরাও করব। আর এও বলে রাখি, এখান থেকে পালাবার একমাত্র পথ কিন্তু, যে-পথে এলি সেই দিকেই। বাঁদিকের পথ বিপজ্জনক। ও পথে অবধারিত মৃত্যু।

ওইটাই প্রকৃত গুহামুখ। কিন্তু এই গুহামুখের নীচেই প্রায় সাতশো থেকে হাজার ফুট গভীর খাদ। গুহা থেকে বেরোবার কোনও পথ নেই। অর্থাৎ একটা দেওয়ালের মতো খাড়াই চাঁছা পাহাড়ের গায়ে এই গুহা। গুহার ভেতর থেকে বাইরের প্রকৃতি দেখা যায়। কিন্তু বেরোতে গেলেই শেষ। আর গুহামুখ এমনই পিচ্ছিল যে সেখানে যাবার আগেই শ্যাওলায় হড়কে একবারে মোক্ষধাম। তা হলে?

তা হলে আর কী? এখন চেষ্টা করে দেখ দেখি আমার হাতকড়াটা কোনওরকমে খুলতে পারিস কি না।

চাঁদু অনেক চেষ্টা করল সে দুটো খোলবার। কিন্তু পারল না। বলল, আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু এই হাতকড়া তো পুলিশের লোকেরা আসামিদের বন্দি করবার জন্যে ব্যবহার করে। ওরা পেল কোথায়?

তা হলেই বুঝতে পারছিস তো লকআপ থেকে শংকর আর অর্জুনের বেরিয়ে আসাটা অত সহজ কী করে হয়েছিল?

শংকর আর অর্জুন!

তোকে যারা এখানে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু তুমি ওদের সবাইকে কী করে

চিনলে সন্দীপদা?

সে সব অনেক কথা। আর হয়তো বলবার সময় পাব না! এইবেলা বলে রাখি। বলেও লাভ হবে না। তবু কোনওরকমে যদি এদের খপ্পর থেকে পালাতে পারিস তা হলে হয়তো কাজে লাগবে। তবে আমাকে ওরা মারবেই। রকি এলেই মরতে হবে আমাকে। ও যে রকম নির্দেশ দেবে সেইভাবেই মারবে। কী ভয়ংকর পৈশাচিক মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তা কে জানে?

চাঁদু সবকিছু শোনবার আশায় অধীর আগ্রহে সন্দীপের মুখের দিকে চেয়ে রইল। এই ঘনঘোর রহস্যের অন্ধকারে সন্দীপদা নতুন কোনও আলোকপাত হয়তো করতে পারবে না, কিন্তু অতীতের তমসা তো দূর করতে পারবে।