অমরকণ্টক রহস্য – ১

এক

ভাল নাম চন্দ্রকান্ত হলে কী হয়, ডাক নাম কিন্তু চাঁদু। চাঁদের মতোই ছেলে। যেমন সুন্দর মুখশ্রী, তেমনি ফর্সা গায়ের রং। বাপের একমাত্র ছেলে না হলেও খুবই আদরের। যেমনি ডাকাবুকো, তেমনি সাহসী। লেখাপড়াতে ও এমন কিছু অসাধারণ নয়। তবে রেজাল্ট মোটামুটি ভালই করে।

সেই ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই জেদ ধরল এবারে আর কোনও কথা নয়, বিলাসপুরে সুজয়দের বাড়ি যাবেই যাবে। সুজয় ওর একমাত্র বন্ধু। পাশের বাড়িতে থাকত। এক স্কুলে পড়ত। তারপর হল কী, একদিন সুজয়ের বাবা বদলির অর্ডার পেয়ে চলে গেলেন বিলাসপুরে। সেও তো চার বছর আগেরকার কথা। সেই থেকে চিঠিপত্রে যোগাযোগ।

সুজয় কতবার চিঠি লিখেছে ওকে। প্রত্যেক চিঠিতেই একান্তভাবে বিলাসপুরে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু আমন্ত্রণ পেলেই তো হল না, সময় এবং সুযোগ দুটোই পাওয়া চাই।

তা এখন পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিনের অখণ্ড অবসর। অন্তত মাস দুয়েকের তো বটেই। তার ওপর মাত্র কিছুদিন আগে সুজয়ের আর একটা চিঠি এসেছে। সুজয় লিখেছে, ভাই চাঁদু, পরীক্ষার ফল বের হলে যে করেই হোক একবার তুই চলে আয়। এলেই বুঝবি, কী জায়গায় আমরা আছি। বিলাসপুর শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে আমরা জমি কিনে বাড়ি করেছি। চমৎকার একটা বাড়ি। হাওড়ায় আমরা যে বাড়িতে থাকতাম তার চেয়ে অনেক ভাল। আমাদের এই জায়গাটা হাওড়ার মতো ঘিঞ্জি নয়। চারদিক বেশ ফাঁকা ফাঁকা। আর খুব সুন্দর করে সাজানো। দেখলে মন ভরে যাবে। তুই এলে তোকে নিয়ে টেনগন মডা আর খোংগসরার জঙ্গলে বেড়াতে যাব। না হলে চলে যাব পেনড্রা রোড হয়ে অমরকণ্টক। অথবা অনুপপুর থেকে চিরিমিরিও যেতে পারি। তুই এলে যে কী ভাল লাগবে আমার, তা বলে বোঝাতে পারব না। কতদিন তোকে দেখিনি, একসঙ্গে ঘুরিনি। এখানে আসার কোনও ঝামেলা নেই। হাওড়া থেকে অনেক ট্রেন আছে। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস, আমেদাবাদ এক্সপ্রেস, বম্বে মেল। তবে তুই এলে বম্বে মেলেই আসিস। টিকিট কেটেই তার করিস আমাকে। আমি স্টেশনে থাকব। লক্ষ্মীটি, একবার আসিস ভাই। এলে খুব খুশি হব। সব জায়গা আমিও যে খুব ভাল করে ঘুরেছি তা নয়। চেনা-অচেনা জায়গাগুলো দু’ বন্ধুতে একসঙ্গেই ঘুরব। কেমন?

এই চিঠি পাওয়ার পর আর কী চুপ করে থাকা যায়? কিন্তু যেতে গেলে মা-বাবা দাদাদের অনুমতি নিতে হবে। তা ছাড়া যে গাড়িতে যাবে তার রিজার্ভেশন করাতে হবে। অমনি যাব মনে করলেই হল না। তাই চিঠিটা বাবার হাতে দিয়েই চাঁদু বলল, তুমি যে ভাবেই হোক আমাকে একটা টিকিট কেটে বিলাসপুরে যাবার ব্যবস্থা করে দাও বাবা। দিন দশেকের জন্য ওদের ওখান থেকে আমি ঘুরে আসি।

চাঁদুর বাবা তারাপদবাবু অত্যন্ত বদমেজাজি এবং রাশভারী প্রকৃতির লোক। তাঁর অন্যান্য ছেলেরা, এমনকী স্ত্রী পর্যন্ত ভয় করেন তাঁকে। একমাত্র চাঁদু ছাড়া। তার কারণ চাঁদুই একটু বেশিরকম ভালবাসা পায় বাপের কাছ থেকে।

তারাপদবাবু চিঠিখানা হাতে নিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ে বললেন, বিলাসপুর যাবে, দিনকতক ঘুরে আসবে তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করে তবেই তোমার যাওয়া উচিত।

বাঃ রে। তখন স্কুল-কলেজে ভরতি হওয়ার একটা ব্যাপার আছে না? সেসময় তো যেতেই পারব না।

বুঝলাম, কিন্তু এখন যা রাস্তাঘাটের অবস্থা, দিনকাল যা খারাপ পড়েছে তাতে তোমাকে একাই বা ছাড়ি কী করে?

হলেই বা একা? গাড়িতে কি আর লোক থাকবে না? তা ছাড়া আমিও আর আগের মতো ছোটটি নেই। এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। রাতের বম্বে মেলে তোমরা আমাকে চাপিয়ে দিলেই সকালে বিলাসপুরে ঠিক আমি নেমে পড়তে পারব। বিশেষ করে খবর পেলে সুজয় তো স্টেশনে আসবেই আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য।

ধরো যদি কোনওকারণে সে না-আসতে পারে?

তাই কখনও হয়? আমার টিকিট কাটা হলেই টেলিগ্রাম করব ওকে। ও না-আসতে পারলেও কেউ-না-কেউ তো আসবে।

তবু তোমাকে আমি একা ছাড়তে পারি না। আজকাল ট্রেনে উঠতে আমাদেরই ভয় করে। এ তো হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল বর্ধমান নয়, বিলাসপুর বলে কথা। তুমি বরং মধুপুরে যাও। সেখানে দিদি আছেন, দিন কতক থেকে এসো। মধুপুর তোমার অচেনা জায়গা নয়। আমিও নির্ভাবনায় তোমাকে ছেড়ে দিতে পারব।

চাঁদু বলল, মধুপুরে যাবার একটুও ইচ্ছে নেই আমার। কতবার গেছি বলো তো? একই জায়গায় বারবার যেতে ভাল লাগে? তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, সুজয়ের জন্য আমার ভীষণ মন কেমন করছে।

শুনে মা বললেন, বাপরে! এমনই কী বন্ধুত্ব যে, এইভাবে মন কেমন করা? ওরা তো গেছেও আজ চার বছর। সুজয় নিজেও কি একবার এসেছে তারপর থেকে?

বাবা বললেন, অবশ্যই। তা ছাড়া ওদের রেলের পাস আছে। ট্রেনে চাপলে ভাড়া লাগে না। সে যখন আসে না, তখন তার জন্য তোমার এত দরদ কীসের? চাঁদু বলল, সে কী করতে আসবে বলো? কী আছে এখানে যে আসবে? তা ছাড়া এটা তার পুরনো জায়গা।

ওখানেই বা হাতিঘোড়া কী আছেটা শুনি?

ওখানে যা আছে তা এখানে নেই। ওখানে আছে নয়নাভিরাম দৃশ্য। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নদী-ঝরনা।

তোমার মুণ্ডু। মানচিত্র-জ্ঞান আছে কিছু? বিলাসপুরে আবার ঝরনা কোথায়? বিলাসপুরে না-থাকলেও তার আশপাশে তো আছেই? মা বললেন, না নেই।

তার মানে, সোজা কথায় তোমরা আমাকে যেতে দেবে না।

তারাপদবাবু এবার একটু নরম হয়ে বললেন, শোনো, তুমি সুজয়কে চিঠি লেখো। সুজয় অথবা ওর বাবা যদি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যান, তা হলে অবশ্য আমি তোমাকে ছাড়তে পারি। না হলে নয়।

চাঁদুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এর পরে আর কোনও যুক্তিই খাটে না। তাই আর কোনও কথা না বলে একটু গম্ভীর হয়ে জামাটা গায়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে।

ও জানত বিলাসপুরে যাওয়ার ব্যাপারে ওর মা-বাবা রাজি হবেন না। তবু ওর তো উচিত যাবার আগে একবার বাড়িতে জানানো। এখন পরের পদক্ষেপটা কী হবে, তা-ও নিজেই স্থির করবে। আপাতত রতনদের বাড়িতে একবার যাওয়া যাক। রতন ওর ইদানীংকালের বন্ধু। কৈলাস বসু লেনের একটা গলির ভেতর ওরা থাকে। চাঁদু গিয়ে দরজায় নক করতেই রতনের বোন সাড়া দিল, কে? আমি চাঁদু।

ছিপছিপে লম্বাটে চেহারার এক কিশোরী হাসিমুখে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। তারপর ভ্রমরের মতো চোখদুটো নাচিয়ে বলল, এ কী! চাঁদুদা !

এতে অবাক হবার কী আছে? রতন কই?

দাদা তো বাড়ি নেই। মাকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে গেছে। তুই গেলি না কেন?

ওরে বাবা! বাসে উঠলেই আমার বমি পায়। তা এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলবেন, না ভেতরে আসবেন?

রতন যখন নেই, তখন কী করতে যাব? ওর সঙ্গেই দরকার ছিল। ও, আমি বুঝি কেউ নই?

নিশ্চয়ই। তুই আমার বোন তো বটেই।

তা হলে ভেতরে এসো।

অগত্যা ভেতরে ঢুকল চাঁদু। খুবই গরিব এরা। কিন্তু হলে কী হবে, মনটা এদের অতি সরল। যেমনি রতন, তেমনি ওর আদুরে বোন জুলি। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়ে। অথচ চোখদুটো কী দারুণ সাদা। কই মাছের মতন ছটফট করে সর্বক্ষণ। ওর মা-ও তেমনি। চাঁদুকে ঠিক নিজের ছেলের মতন ভালবাসেন। তাঁর খুবই দুশ্চিন্তা জুলিকে নিয়ে। একে গরিব, তায় কালো মেয়ে। কী যে ওর ভবিষ্যৎ তা কে জানে?

চাঁদু জুলির সঙ্গে ওদের ঘরে এসে বসল। একটিই মাত্র ঘর ওদের। পাঁচ ইঞ্চি, বাই দশ ইঞ্চি গাঁথনি দেওয়া। মাথার ওপর টিনের শেড। চেরা বাঁশে দরমা সেঁটে হালকা একটা সিলিং এমনভাবে আটকানো যাতে তাপ রোধ হয় না। শুধু শীতকালে টিনের ঘাম থেকে বাঁচা যায় একটু।

চাঁদুকে ঘরে বসিয়ে জুলি বলল, তুমি এলে, কিন্তু তোমাকে কী খাওয়াই বলো তো চাঁদুদা? ঘরে আমাদের কিছু নেই।

তোদের পাড়ায় মোড়ের মাথার সেই দোকানটায় আগের মতো হিংয়ের কচুরি করে না?

করে না আবার? ওই কচুরি বেচে ব’লৈ ওরা দোতলা হাঁকিয়ে ফেলল।

তা ঠিক আছে। চট করে খান দশেক কচুরি নিয়ে আয় দেখি। তোতে-আমাতে খাই। এই নে টাকা। বলে পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে ওর হাতে দিল।

জুলি কচুরি খাবার আনন্দে টাকাটা নিয়ে ফ্রক উড়িয়ে, বেণী দুলিয়ে দুষ্টু প্রজাপতির মতো ছুটে চলে গেল গলির মোড়ে।

চাঁদু আপন মনে বসে বসে ভাবতে লাগল মানুষের দুরবস্থার কথা। কী কষ্টের সংসার এদের। রতনের বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন। তিনি মারা যাবার পর ওর মা নিয়মিত পেনশেনটা পাচ্ছেন এই যা রক্ষে। না হলে কী যে হত। অবসর সময়ে মা ঘরে বসে ঠোঙা তৈরি করেন। সেই ঠোঙা দু’-ভাইবোন দোকানে দোকানে দিয়ে আসে। এতেই ওদের খাওয়াপরা স্কুলের মাইনে সব কিছুই হয়ে যায়।

চাঁদুর খুব ভাল লাগে এদের। রতন, জুলি, ওর মা। এত দুঃখেও কী দারুণ সুখের সংসারটি গড়ে তুলেছেন ওরা সব। শত দুঃখেও দুঃখকে জয় করে দুঃখজয়ী হয়েছেন. তাই ওদের জয়যাত্রা রয়েছে অব্যাহত। কিন্তু এত দেরি করছে কেন জুলিটা? এই তো কাছেই দোকান। কচুরি কি তবে ভাজিয়ে আনছে? এক ঘণ্টার ওপর হয়ে গেল। বসে বসে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেল চাঁদুর। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ডুবে গেল হাওড়া শহর। কিন্তু জুলি কই? সে ফিরে এল না কেন? অথচ ঘর ফেলে যেতে পারছে না চাঁদু। আরও এক ঘণ্টা হয়ে গেল। না-ফিরল রতনকে নিয়ে ওর মা, না-ফিরল জুলি। চাঁদুর খুব ভয় করতে লাগল। তাই একসময় ঘরের দরজায় শিকল দিয়ে চোরের মতোই চুপিসারে চলে আসতে হল ওকে।