অভিশপ্ত তিড্ডিম – ৯

নয়

বাহাদুর ততক্ষণে তার খুলে বসে পড়েছে ডিনামাইট ফিট করতে।

আমি বললাম, প্রথমেই আমাদের নদীর গতিপথ যেখানে পাথরের খাঁজ বেয়ে নীচে পড়ছে, সেই জায়গাটাকে ধসিয়ে দিতে হবে। তা হলে ফাকটা বড় হলেই ভেতরের জল হুড়হুড় করে কমে যাবে। আর ফাঁক বড় হলে পাখিটাও মুক্তি পাবে এই বন্দি দশা থেকে।

রামদুলালবাবু বললেন, জল কমে গেলে আমরাও দিব্যি এখানটা পার হয়ে গুহার সুড়ঙ্গে ঢুকতে পারব।

বাহাদুর ততক্ষণে বেশ খানিকটা তার জুড়ে ফেলেছে।

আমি বললাম, বাহাদুর, তুমি তোমার কাজ করো। আমি খাঁজগুলোর কাছে যাই। কোনখানে কীভাবে কী করবে তা দেখে রাখি।

রামদুলালবাবু বললেন, আমিও যাব সঙ্গে।

আসুন।

আমরা বারান্দার কাছে যেতেই পাখিটা আবার চেঁচাতে লাগল। রামদুলালবাবু মুখ দিয়ে একরকম বিচিত্র শব্দ বার করে চুপ করালেন পাখিটাকে। তবে একবারে যে চুপ করে গেল তা নয়। খুব মৃদু স্বরে কি কি কি কি শব্দ করে একবার এ দেওয়াল, একবার ও দেওয়াল করে বসতে লাগল পাখিটা।

আমি বারান্দার দড়ি ধরে নেমে পড়লাম নীচে। কী বিদঘুটে অন্ধকার। ওপরে যে প্রদীপ জ্বলছে তার ছিটেফোঁটা আলোকপাতও নীচে হচ্ছে না। তাই নেমেই টর্চ জ্বাললাম।

জলস্রোত ধীর ও গম্ভীর মেজাজে বয়ে চলেছে। তোড় না-থাকলেও, টান আছে বেশ।

রামদুলালবাবু ওপর থেকে বললেন, যদি অসুবিধে হয় তা হলে একটা মশাল জ্বেলে দিই?

ভেবে দেখলাম টর্চের চেয়েও মশালের আলো একটু জোরালো হবে। বললাম, তাই দিন। পারেন তো আপনিও নীচে আসুন।

একটু পরেই মশাল হাতে নেমে এলেন রামদুলালবাবু।

দু’-তিনটে বড় বড় পাথরের গা বেয়ে জলটা ঢুকে যাচ্ছে আরও ভেতর দিকে। আমরা দু’জনে প্রায় এক হাঁটু জল ভেঙে ভেতর দিকে ঢুকে গেলাম। ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম গুহামুখ সরু হয়ে গেছে। আর সাত-আটটি বড় বড় পাথরের ফাঁক দিয়ে জলস্রোত বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাথরগুলোর অবস্থান দেখে মনে হল এগুলো এই গুহার ভো আপনা থেকেই জড়ো হয়নি। এগুলো খুব যত্ন সহকারে এখানে নিয়ে এসে, এর সাহায্যে বাইরে যাবার এবং ভেতরে ঢোকার পথ বন্ধ করা হয়েছে। তলাকার ফাঁক দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে এবং ওপরের ফাঁক পাথর দিয়ে বোজানো আছে। ওপরের ফাঁক যদিও শাবলের ঘা মেরে ধসানো যায়, নীচের ফাঁক বড় করতে গেলে ডিনামাইটের একান্ত প্রয়োজন। রামদুলালবাবু বললেন, কী ভাবছেন?

ভাবছি একটা শাবল পেলে হত।

তার জন্য কী? সব আছে এখানে। আনছি।

তাড়াতাড়ি যান।

তাড়াতাড়ির প্রয়োজন নেই। যা হবে সব ধীরেসুস্থে। কেন না সকাল না হলে

আমরা গুহার বাইরে গিয়েও এই দুর্ভেদ্য জঙ্গল পার হতে পারব না। তা অবশ্য পারব না। জংলিদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেলেও বাঘের হাতে মরতে হবে।

আমি বসে রইলাম। রামদুলালবাবু চলে গেলেন। একটার জায়গায় দুটো শাবল নিয়ে ফিরে এলেন রামদুলালবাবু।

মশালটা এক জায়গায় কায়দামাফিক রেখে শুরু করলাম আমাদের কাজ।

শাবলের ঘা পড়তেই ঝর ঝর করে ঝরতে লাগল সব। ছোট বড় পাথর নোনা ধরা দেওয়ালের মতো ধসতে লাগল। তারপর ফাঁক হল একটু। এইভাবে অনেকগুলো ফাঁক হল। সেইসব ফাঁকের মাঝামাঝি জায়গায় ডিনামাইট বসিয়ে দিয়ে পলতেয় আগুন দিলেই একেবারে নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত সব কিছু উড়ে গিয়ে একদিকের দেওয়াল আর ছাদ বেরিয়ে যাবে।

ফাঁকের ভেতর দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া ঢুকছে। এদিকে ওপরের মাটি-পাথর চাপা পড়ে নীচের অনেকগুলো ফাঁকের মুখ বুজে যাওয়ায় জলনিকাশেও দারুণ বাধা পাচ্ছে। সুতরাং জমা জল ফুলতে লাগল একটু একটু করে।

রামদুলালবাবু বললেন, সেরেছে। এ যে দেখি কাছা দিতে গিয়ে কেঁাঁচা খুলে যায়।

আমিও চিন্তায় পড়লাম। কেন না জল বেড়ে গেলে সব চাল ভেস্তে যাবে। আর সপ্ত নদীর গতিপথ যেখানে একই মুখে বের হচ্ছে, সেখানে জল জমে যেতে খুব একটা সময়ও লাগবে না। আর জল জমে গেলে ডিনামাইট ফিট করা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। রামদুলালবাবুকে বললাম, আপনি এক্ষুনি চলে যান। বাহাদুরকে তাড়া দিন। আমি ততক্ষণে নীচের ফাঁকগুলো একটু পরিষ্কার করবার চেষ্টা করি।

রামদুলালবাবু চলে গেলেন।

আমি প্রাণপণে শাবলের খোঁচা দিয়ে সেই মুখগুলো পরিষ্কার করতে লাগলাম। দিনের বেলা হলে কষ্ট হত না। রাত্রি বলেই অসুবিধে। দেখতে দেখতে দু’ দুটো রাত শেষ হতে চলল। আর কত কষ্ট যে তোলা আছে আমাদের তা ভগবানই জানেন।

এমন সময় হঠাৎ মনে হল আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছি। নরম থলথলে শুঁড়ের মতো কী যেন একটা আমাকে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে নিল। দেখলাম জলের ভেতর থেকে অক্টোপাশের মতো কী যেন একটা আমাকে পাকিয়ে ধরেছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম।

পাখিটা দেওয়ালের গায়ে এক জায়গায় বসেছিল। হঠাৎ বাজের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটার ওপর। তারপর চলল টানাটানি। আমি এমন বেকায়দায় পড়লাম যে, তা বলবার নয়। এদিকে আমার চিৎকারে বাহাদুর ও রামদুলালবাবুও ছুটে এসেছে তখন। আমি সভয়ে দেখলাম ওটা অক্টোপাস নয়, অনেকটা মাকড়সার মতো দেখতে একটা জীবকে পাখিটা তখন নখে করে টেনে জল থেকে তুলছে। পাখিটার আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়েই সেটা আর আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিতে পারল না। তার বাকি শুঁড়গুলো দিয়ে আলিঙ্গন করল অযাচিত শত্রু সেই পাখিটাকেই।

রামদুলালবাবু বারান্দায় ঝোলানো দড়ির একপ্রান্ত আমার দিকে ছুড়ে দিলেন। আমি সেটা ধরে শুঁড়বদ্ধ অবস্থায় নিজেকে টেনে বারান্দার কাছে আনতেই বাহাদুর ছুরি দিয়ে শুঁড়টা কেটে আমাকে মুক্ত করল। আমি বাঁচলাম।

এদিকে সেই অতিকায় পাখিটার সঙ্গে জলজ মাকড়সার তখন পুরোমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেটা তার সব ক’টি শুঁড় দিয়ে পাখিটাকে বেষ্টন করে ঝুলছে। তার মাঝের অংশটা একবার স্ফীত, একবার সংকুচিত হচ্ছে। যেন অতিকায় গোলালো কচ্ছপ একটা। গায়ে কালো ভেলভেটের মতো রোঁয়া। পাখিটা ঠোটে করে সেটাকে ছেঁড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। শুঁড়গুলো দিয়ে পাখিটার গলা এমনভাবে সে জড়িয়ে রেখেছে যে, পাখিটা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছে।

আমি আর বিলম্ব করলাম না। পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরলাম। এই প্রথম আমার পিস্তল গর্জে উঠল। জলজ সেই মাকড়সার মাঝের অংশটা চুরমার হয়ে গেল। সেই সঙ্গে পাখিটাও রক্তাক্ত কলেবরে ঝপাস করে পড়ে গেল জলের ওপর। গুলিটা সেটাকে ভেদ করে পাখিকে আঘাত করেছে। রক্তে লাল হয়ে উঠল জল। জলের স্রোতে চাপ চাপ রক্ত ভেসে চলল কুলকুল করে। এদিকে জল তখন অনেক বেড়ে গেছে।

আমি বললাম, আর দেরি নয় বাহাদুর। তুমি তৈরি তো?

হ্যাঁ।

জল তখন হাঁটু পেরিয়ে কোমরে উঠেছে। বাহাদুর মাথায় অসম্ভব বেঁটে। তাই বাহাদুরকে আমি কাঁধে নিয়ে ফাঁকগুলোর কাছে গেলাম। যেখানে যেটা বসাবার বাহাদুর তা বসিয়ে দিল। অত্যন্ত পাকা লোক। কত সহজে যে কাজ করে ফেলল তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।

মশালটা যেমন জ্বলছিল, তেমনি জ্বলতে লাগল।

আমি তবু টর্চের আলো ফেলে বাহাদুরকে সাহায্য করতে লাগলাম। কাজ শেষ হলে বাহাদুর বলল, ঠিক আছে। এবার আপনি আমাকে বারান্দায় পৌঁছে দিয়ে পলতেয় আগুন দিয়ে পালিয়ে আসুন।

আমি আগে বাহাদুরকে পৌঁছে দিলাম বারান্দায়। সে দড়ি ধরে ওপরে উঠে গেল। আর আমি মশালের আগুনে পলতের মুখ ধরিয়ে দিয়েই পালিয়ে এলাম। পলতেটা পুড়তে পাঁচ মিনিট সময় নেবে। তারপর এক এক করে সাত-সাতটা ডিনামাইট ফেটে উঠবে ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটিয়ে। কিন্তু যার জন্য এত কাণ্ড সেই পাখিটাকে তো আর বাঁচানো যাবে না। না যাক। আমরা নিজেদের পালাবার পথটাই পরিষ্কার করি। পলতেটা ধরিয়ে দড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি বারান্দায় উঠে এলাম আমি। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে তিনজনেই রামদুলালবাবুর ঘরের দিকে দৌড়লাম।

বাহাদুর বলল, কানে আঙুল দিন।

আমরা তিনজনেই কানে আঙুল দিলাম। সামান্য কিছু সময়। তারপরই বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের পর ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখলাম একটা দিক একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাইরে নীল আকাশ চাঁদ তারা সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ছায়া ছায়া পাহাড়ের কায়া। সেই জলজ মাকড়সা আর পাখিটা জলের তোড়ে কখন ভেসে গেছে। সেই জলরাশিও তখন হুড়হুড় করে প্রপাতের মতো ঝরে পড়ছে নীচের দিকে। জল কমে একেবারে চেটোয় এসে ঠেকল।

রামদুলালবাবু বললেন, এতদিনে একটা কাজের কাজ হল।

আমি বললাম, হ্যাঁ। এইবার আসল কাজটা বাকি। আর দেরি নয়। পা চালান। তাড়াতাড়ি।

আমরা দ্রুত চললাম। কিন্তু বেশিদূর যেতে হল না। যেখানে সেই ‘নীল তারা ঝিকমিক’ অর্থাৎ গুহাটা শেষ হচ্ছে সেখানে যেতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। বিপদের পর বিপদ। আর এক বিপদ।

বাহাদুর আর্তকণ্ঠে বলল, ফায়ার।

কিন্তু গুলি করব,—না রামদুলালবাবুকে সামলাব? সেদিকে তাকিয়েই রামদুলালবাবু অজ্ঞান হয়ে গেলেন।