আট
আমরা ধীর পায়ে গুহামুখের কাছে এলাম।
টর্চের আলোয় পথ দেখে গুহামুখের সামনে সেই পাঁচিলের মতো খাড়াই পাথরটার কাছে গেলাম।
এইখান দিয়ে বারবার এই বাধা অতিক্রম করে জংলিটা যে কী করে যাতায়াত করছে তা ভেবে পেলাম না। নাকি অন্য কোনও পথ আছে?
এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই খাড়াইটার গা দিয়ে সরুমতো একটি প্যাসেজ নজরে পড়ল। প্যাসেজটা এত ছোট যে তা নজরে পড়বার নয়। বড় জোর একজন লোক তার ভেতর দিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি দু’জন নয়। বাহাদুরকে নিয়ে আমি আগুপিছু হয়ে সেটায় প্রবেশ করলাম। এবং খাড়াইটার পাশে পৌঁছে গেলাম।
এইখান দিয়েই আমরা খাড়াই ডিঙিয়ে এখানে এসেছিলাম। যাই হোক, পথটা জেনে আবার আমরা খাড়াইয়ের ওপাশে চলে গেলাম। কেন না যে পথে পালকি চেপে জংলিদের সর্দারকে আমরা যেতে দেখলাম, সে পথটা আমাদের অতি অবশ্যই একবার জেনে রাখা দরকার।
ঝোপড়ির পিছনদিক দিয়ে পথ। আমরা সেই পথে গেলাম।
যেতে যেতে এক জায়গায় দেখলাম পাথরের ছাদের নীচে মস্ত একটি গোশালা। গোরু ভরতি গোশালাটা মোটা মোটা শাল কাঠের খুঁটি দিয়ে ঘেরা। তারই একপাশে পালকিটা পড়ে আছে।
গোশালার বাঁদিকে একটি পাথরের দেওয়ালে মস্ত দরজা। দরজার আংটায় দড়ি বাঁধা।
খুব সাবধানে দড়িটা খুলে আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই সিঁড়ি পেলাম নীচে নামার।
সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নীচে নামতে লাগলাম দু’জনে। কয়েক ধাপ নামতেই দেখলাম দালান মতো একটা অংশ।
বাহাদুর চমকে উঠে বলল, আরে! এ তো সেই জায়গা!
সেই জায়গা মানে?
যেখানে জংলিরা আমাদের বন্দি করে রেখেছিল।
যাক এ পথটা চেনা হয়ে গেল।
আমরা সেই জায়গা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেদিকে সেই সর্বনাশা পাখিটা আছে সেদিকের বারান্দায় গেলাম।
তারপর পাখিটার নজর এড়িয়ে পা টিপে টিপে বারান্দা পার হতেই আবার সিঁড়ি। ওই তো রামদুলালবাবুর ঘর।
রামদুলালবাবু তখন নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছিলেন।
ঘরে গিয়ে বাহাদুর আর আমি ঝুঁকে পড়ে রামদুলালবাবুকে একবার ডাকতে গিয়েও থেমে গেলাম।
থাক। দরকার নেই। মাথাপাগলা লোক। বোঝালে হয়তো বুঝবে না। যদি চেঁচিয়েমেচিয়ে ওঠে?
তার চেয়ে নিজেরাই একবার চেষ্টা করে দেখি।
তাই মানচিত্রের নির্দেশমতো পথে এগিয়ে চললাম।
ওই তো মাথার ওপর নীল আকাশ। এই তো সেই পাঁচিলের খাড়াই। পথ শেষ। কিন্তু গুপ্তধন? গুপ্তধন কোথায়?
অথচ গুপ্তধনের নির্দেশ এইখানেই দেওয়া আছে। ভাবতে গেলেও মাথাটা যেন ঘুলিয়ে যায়।
বাহাদুর বলল, কেন আর আলেয়ার পিছনে ছুটতে গিয়ে মিথ্যে দেরি করছেন বাবু? দরকার নেই গুপ্তধনের। এখন ভালয় ভালয় কেটে পড়ি চলুন।
সত্যি কথা বলতে কী, আমাকে তখন গুপ্তধনের নেশায় পেয়ে বসেছে। বললাম, না বাহাদুর। ম্যাপ যখন রয়েছে, তখন পালাবার পথ খুঁজে বার করা আমাদের পক্ষে এমন কিছু কঠিন হবে না। তবুও ভাগ্যচক্রে একবার যখন এসে পড়েছি এখানে, তখন রাজা শাতকর্ণির সেই রত্ন ভাণ্ডার না দেখে যাব না।
সে কি আমারও ইচ্ছে নয় বাবু? যদি পারি তো সঙ্গে করে কিছু নিয়েও যাব। সে পরের কথা। এখন আমাদের যেমন করেই হোক খুঁজে বার করতে হবে গুপ্তধন কোথায় আছে। সংকেত অনুযায়ী গুপ্তধন এখানেই থাকবার কথা। কিন্তু মানচিত্রের ধাঁধা বড় জটিল।
আমি বারবার ধাঁধাটার সমাধানের চেষ্টা করতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ জট খুলে গেল। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম।
বাহাদুর বলল, হদিস পেলেন কিছু?
নিশ্চয়ই।
বাহাদুরের মুখও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যাক। আমাদের এই প্ৰচষ্টা তা হলে বিফলে যাবে না। রাজা হবার বাসনা আমরা রাখি না। শুধু রহস্যের আবরণটা খুলে দেখতে চাই।
আমি ধাঁধাটার যা মানে করলাম, তা হল এইরকম, ‘নীল তারা ঝিকমিক, বিশ গতি ডানদিক।’ অর্থাৎ আমাদের মাথার ওপর সেখানে নীল তারা ঝিকমিক করছে তার ডানদিকে বিশ পা যেতে হবে। আমরা পা মেপে সেইভাবেই গেলাম।
সামনেই পাথরের দেওয়াল। পথ নেই।
এবার লেখা আছে ‘রাধা মোড় ছ’ চরণ, সাবধানে হে মরণ।’ রাধা মোড়ের মানে বুঝলাম না। তবে অনুমান করলাম রাধা তো কৃষ্ণের বাঁদিকে থাকে। অর্থাৎ এখানকার এই ঘন অন্ধকারকে যদি কৃষ্ণ ধরা হয়, তবে এর বাঁদিকে ছ’ চরণ অর্থাৎ ছয়-পা যেতে হবে।
তাই গেলাম। টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে গেলাম।
তারপর সাবধানে হে মরণ’। এবার সাবধান হতে বলেছ। সত্যিই ছ’-পা যাবার পর আর এক পাও যাবার জায়গা নেই।
গভীর গর্ত। গর্তটা অন্তত দু’ হাত চওড়া।
না জেনে কেউ যদি আচমকা এসে পড়ে এখানে, তা হলেই গুপ্তধন নেওয়া মাথায় উঠে যাবে তার।
বাহাদুরকে দাঁড়াতে বলে আমিই আগে লাফ দিয়ে গর্তটা পার হলাম। তারপর এল বাহাদুর।
ওকে অবশ্য লাফাতে হল না। এক জায়গায় চওড়া মোটা একটা শক্ত কাঠের তক্তা ছিল, সেটা পেতে দিতেই চলে এল সে।
এবার লেখা আছে, ‘শিলাটন খান তিন, অমাবস্যা সারাদিন।’
মিলিয়ে দেখলাম একেবারে অঙ্কের হিসাবের মতো সবই ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে। ঘন অন্ধকার যেন আরও ঘন, আরও জটিল সেখানে। কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই।
সেইখানে তিনটে আংটাওয়ালা পাথর ছিল। সেগুলো টেনে তুলতেই নীচে নামার সিঁড়ি পেলাম।
এবার ‘একুশে চরণ রেখো, সামনে তাকিয়ে দেখো।’ একুশ ধাপের সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমেই সামনে তাকালাম।
দেখলাম একটি প্রকাণ্ড সিংহ দরজায় মস্ত একটি তালা ঝুলছে। পাশেই দেওয়ালে আছে চাবি। সেই চাবি দিয়ে তালা খুলে দরজাটা ফাঁক করতেই সব অন্ধকার যেন দূর হয়ে গেল। দেখলাম প্রকাণ্ড একটি সোনার পিলসুজে মস্ত একটি সোনার প্রদীপ জ্বলছে। আর তার পিছনে রুপোর রেলিং দেওয়া একটি ঘরের মধ্যে মস্ত একটি রত্ন সিংহাসন। সিংহাসনকে বেড় দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে মস্ত একটা সাপ। দেখলে বুক যেন শুকিয়ে যায়।
ঘরের ভেতর শত শত কলসিতে মোহর ভরা।
শুধু তাই নয়। আরও কত যে ধনরত্ন রয়েছে সেখানে, তার আর সীমা নেই। বিশ্বের ঐশ্বর্য যেন একত্রিত হয়েছে এখানে। এরকম ধনভাণ্ডার বোধহয় এর আগে কখনও কোথাও ছিল না। চোখে দেখেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে লাগল সব। মনে হল যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছি। বড় বড় হিরের টুকরোগুলো ঘরময় এমনভাবে ছড়ানো যে, দেখলে লোভ লাগে। হয়তো এইরকমই কুবেরের ঐশ্বর্য। যেমনি ধনসম্পদ, তেমনি সাপের রাজত্ব সেখানে। ছোট বড় নানা ধরনের সাপ কিলবিল করছে। আমার মনে হল এগুলো সাপের ফণা তো নয়, মৃত্যুরূপী প্রলোভন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমরা মুগ্ধ নেত্রে এবং অপলকে সেই লোভনীয় ধনরাশির দিকে চেয়ে রইলাম।
বাহাদুর বলল, বাবু! এর কিছুও কি আমরা নিয়ে যেতে পারব না? না। কী করে নেবে? এইসব সাপেরা হল মূর্তিমান যখ। এমনকী এই জংলিরাও। তাই এই সম্পদে কেউ হাত দেয় না। যে দিতে যায় সে মরে। একমাত্র রাজা শাতকর্ণি নিজে যদি কখনও নরদেহ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন এবং পথ ভুলে তোমার আমার মতো এই গুহায় কখনও যদি ঢুকে পড়েন, তা হলে গুপ্তধন তিনিই শুধু নিতে পারবেন। যখের ধনের এই নিয়ম। তুমি আমি তো সে লোক নই। অতএব এর ওপর আমাদের কোনও অধিকারও নেই।
কে বললে আমরা সে লোক নই। এই তো, আপনিই মহারাজ শাতকর্ণি আর আমি আপনার মহামন্ত্রী। ওই দেখুন আপনার কপালে রাজ চক্রবর্তী তিলক। আসুন এ সবই আমরা লুটে পুটে নিই।
তোমাকেও দেখছি এখন রামদুলালি রোগে ধরেছে। এসো চলে এসো। বলে ওর হাত ধরে টান দিলাম।
বাহাদুর একটুও নড়ল না। দু’হাতে শক্ত করে সেই রেলিংগুলো ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমিও।
আবার অনেকক্ষণ ধরে সেই গুপ্তধনের জৌলুস দেখে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। আসবার সময় যেমন তালা দেওয়া ছিল, ঠিক সেইভাবে তালা দিয়ে যেভাবে এসেছিলাম সেইভাবেই ফিরে এলাম।
বাহাদুর বলল, এবার কি আমরা ফিরছি?
হ্যাঁ। একবার জল পার হতে পারলে আর কোনও ভয় পাখিটা যদি আবার চেঁচামেচি শুরু করে?
নেই।
করলেই বা। ওর চিৎকার জংলিদের কানে যাবে না। তারা এখন গুহার বাইরে
ঝোপড়িতে আছে। তবে রামদুলালবাবু ছুটে আসতে পারেন। ওকে কবজা করতে এক মিনিটও লাগবে না আমার।
আমরা ফিরে আসতে আসতে রামদুলালবাবুর ঘরের কাছে থমকে দাঁড়ালাম একবার। তারপর আবার সেই বারান্দায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। একপাশে একটি প্রদীপ জ্বলছে।
প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় গুহার সেই ঘন অন্ধকার একটুও দূর হয়নি। আমরা যেতে আমাদের দেখে কর্কশ কণ্ঠে বিকট চিৎকার শুরু করে দিল পাখিটা।
বাহাদুর বলল, ফায়ার। বাবু, এখুনি গুলি করুন ওটাকে। না হলে ওর চিৎকার আমাদের বিপদ ডেকে আনবে।
না। অযথা একটা প্রাণকে নষ্ট করতে চাই না আমি।
বারান্দার একপাশে সেই মোটা শক্ত দড়িটা তখনও ঝুলছে দেখলাম। সেই দড়ি ধরেই নামতে যাচ্ছি এমন সময় রামদুলালবাবু এসে হাজির, এ কী! তোমরা এখানে?
ভয়ে বাহাদুরের মুখ শুকিয়ে গেল। আমি বললাম, বিদায় রামদুলালবাবু। রামদুলালবাবু বিস্মিতভাবে বললেন, তোমরা এখনও বেঁচে আছ? শুধু শুধু মরব কেন? তোমরা তা হলে পালাতে গিয়ে মরনি? না। এই তো দেখছেন দিব্যি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু…। কোনও কিন্তু নয়। এখন বলুন আপনিও আমাদের সঙ্গে যাবেন কি না? রামদুলালবাবু চমকে উঠলেন, না না। আমি যাব না। আমি কোথাও যাব তোমরাও যেয়ো না। গেলেই মরবে।
না।
আমরা মরব না রামদুলালবাবু। দেখছেন তো এখনও পর্যন্ত এদের কবলে থেকেও কেমন অক্ষত শরীরে বঁচে আছি। এরা আমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। আমাদের বুদ্ধিই আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।
রামদুলালবাবু কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, তোমরা তা হলে সত্যিই পালাতে চাও?
চাই কেন, পালাচ্ছি তো?
গুপ্তধন নিতে তোমরা তা হলে আসনি? না।
তোমরা যে পালাবে, পালাবার পথ জান?
আপনি জানেন?
না। তা হলে তো কবেই পালাতাম।
তার মানে পালাবার ইচ্ছে আপনারও আছে। শুধু উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে পালাতে সাহস করেননি। এই তো?
হ্যাঁ।
আমাদের কাছে ম্যাপ আছে। সেই ম্যাপ দেখে পালাব। কোনওরকমে একবার গুহার বাইরে যেতে পারলেই ব্যস।
কিন্তু ম্যাপের নকশা যদি ভুল হয়? তা হলে কিন্তু অবধারিত মৃত্যু। তা জেনে রেখো। এই গুহার জঠরে জঠরে অতিকায় পাইথনের বাস।
আপনার কোনও ভয় নেই রামদুলালবাবু। আসুন আমাদের সঙ্গে। রামদুলালবাবু এবার সাহস পেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, বেশ, আমিও যাব। তবে তার আগে…
তার আগে? বলুন তার আগে কী?
কিছু গুপ্তধন আমাদের নিয়ে যেতে হবে।
বাহাদুর বলল, ঠিক বলেছেন। আমারও তাই ইচ্ছে।
আমি বললাম, না ওতে আমাদের কোনও লোভ নেই।
রামদুলালবাবু বললেন, আমার আছে। আমি যে গুপ্তধনের লোভেই এখানে এসেছিলাম।
আমি রামদুলালবাবুকে বুঝিয়ে বললাম, দেখুন গুপ্তধন যে কোথায় কীভাবে আছে তা আমরা দেখে এসেছি। সেই অতুল ধনরাশি আমরা গাড়ি বোঝাই করেও নিয়ে যেতে পারব না। কাজেই কোনও লাভ নেই।
রামদুলালবাবু এবার খেপে উঠলেন, তবে দূর হও তোমরা। যেমন যাচ্ছ তেমনি চলে যাও। আমাকে ডেক না। তোমাদের জমিদারি আছে, দেশে গিয়ে তোমরা তাই ভাগ করবে। কিন্তু আমার কী আছে? আমি কী খাব? আমি কি ভিক্ষে করব? না ডাকাতি করব?
আমি বললাম, কিচ্ছু করতে হবে না আপনাকে। আমি একটা যাত্রাদলে অভিনয় করি। আমাদের অধিকারীকে বলেকয়ে সেই দলেই আমি আপনার একটা কাজ করে দিতে পারব। সে ক্ষমতা আমার আছে। যতদিন না কাজ হয়, ততদিন আপনি আমার কাছেই থাকবেন।
আমার কথায় রামদুলালবাবু আশ্বস্ত হলেন। বললেন, বেশ, তা হলে চলো। তবে যাবার আগে দুটো কাজ আমাদের করতে হবে। কী কাজ?
প্রথম হচ্ছে পাখিটাকে মুক্তি দেওয়া। আর দ্বিতীয় কাজ হল এই গুপ্তধন যাতে কেউ কখনও আবিষ্কার করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করে যাওয়া। অর্থাৎ এখানকার সবকিছুই আমি ধ্বংস করে দিতে চাই। যে জিনিস আমরা পেলাম না, তা কাউকে নিতে দেব না।
বাহাদুর আমি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম।
রামদুলালবাবুর চোখমুখ কেমন যেন নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে।
আমি বললাম, কী করে ধ্বংস করবেন?
বিস্ফোরণ ঘটাব। সব চুরমার করে দেব। ধ্বংস করে দিয়ে যাব এখানকার সবকিছু। অভিশপ্ত তিড্ডিমের সমস্ত অভিশাপের শেষ হয়ে যাবে। আমার মতো জীবনের এই দীর্ঘ বাইশটা বছর কাউকে আর গুহার অন্ধকারে বন্দি হয়ে থাকতে হবে না। কোনও মানুষের অমূল্য জীবন আর কখনও জংলিদের সংস্কারের বলি হয়ে বৃথা নষ্ট হবে না।
সেরকম কিছু কি আছে আপনার কাছে?
আছে।
কী আছে?
ধ্বংসের বারুদ। এসো, দেখবে এসো।
আমরা রামদুলালবাবুকে অনুসরণ করলাম। এ অবশ্য মন্দ নয়। এখানকার সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাক, সেটা যে একান্তভাবে আমরাও চাই।
আমরা রামদুলালবাবুর সঙ্গে অন্যত্র ফিরে গেলাম। রামদুলালবাবুকে যে, দলে টানতে পেরেছি এতে আমাদের মনোবল বেড়ে গেছে খুব। মনকে তবু তো বোঝাতে পারব অভিশপ্ত তিড্ডিমে গিয়ে আর কিছু হোক, বা না হোক তার অভিশাপের কবল থেকে একটা মানুষকেও আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
রামদুলালবাবু গুহার অন্ধকার কোণ থেকে কী যেন একটা বাঁধা অবস্থায় নিয়ে এলেন। কাছে আনতে বাহাদুর আমি অবাক হয়ে বললাম, কী এটা? –
ধ্বংসের বারুদ। খুলে দেখো।
আমরা সব দেখে চমকে উঠলাম, আরে! এ কোথায় পেলেন?
সংগ্রহ করেছি।
সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কী করে?
কিছুদিন আগে জনা চারেক লোক এখানে এসেছিল। জংলিরা তাদের প্রত্যেককে হত্যা করেছে। এসব তাদেরই। আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। শুধু ফিটিং করতে জানি না বলে কাজে লাগাতে পারিনি। আর বেরোবার পথ জানি না বলে, পালাতেও সাহস করিনি। পারবে তোমরা এগুলো দিয়ে এখানকার সবকিছুকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে?
আমি বললাম, পারতেই হবে।
বাহাদুরও এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল। বলল, এ তো খুব হেভি ওয়েটের ডিনামাইট দেখছি।
হ্যা। তারে তারে জুড়ে দিয়ে পলতের মুখে শুধু একটু আগুন ছুঁইয়ে দেবার অপেক্ষা। পারবে? সাহস আছে?
বাহাদুর বলল, কী যে বলেন। সাত বছর মিলিটারিতে চাকরি করেছি। তবে এগুলোকে ফিটিং করতে সময় লাগবে একটু।
লাগুক। এখন আমি তো তোমাদের সহায়। আর ভয় কী?
আমিও পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরে বললাম, আপনি তো সহায় রইলেনই। তবুও বাধা যদি কিছু আসে তখন এটা তো সঙ্গে আছেই।