অভিশপ্ত তিড্ডিম – ৭

সাত

সাপটা গাছের ডালে নিজের দেহটা পাকিয়ে এমনভাবে মুখটা লুকিয়ে রেখেছিল যে, সেটা অতর্কিতে সর্দারের চোখে পড়ে যায়।

একটু আগেই তো ওটার পাশ দিয়ে আমরা ওপরে উঠেছি।

গাছের ডালের সঙ্গে জড়িয়ে রঙে রং মিলিয়ে এমনভাবে ছিল ওটা যে তখন আমরা ভুলেও ওটাকে সাপ বলে মনে করতে পারিনি। কী ভাগ্য যে ছোবল মারেনি আমাদের। তা হলে বাঁচার আর কোনও উপায়ই থাকত না।

সাপটাকে দেখে জংলিরা খুব তৎপরতার সঙ্গে অদ্ভুত কায়দায় তার চোখ লক্ষ্য করে এমনভাবে বর্শা বিদ্ধ করল যে, প্রথমে সেটা কুঁকড়ে গেল। তারপর গোটা দেহটা দুমড়েমুচড়ে পাকিয়ে নিজের থেকেই পাক খুলে ধীরে ধীরে নেমে এল সেটা।

অনেক উঁচু ডালে বসে পাতার আড়ালে আত্মগোপন করে এইসব দেখলাম আমরা।

কী প্রকাণ্ড সাপ।

যেন আস্ত একটা গাছের গুঁড়ি।

খুব কম করেও পঁচিশ-ত্রিশ হাত লম্বা হবে।

সাপটা নেমে এলে জংলিরা একত্রিত হয়ে মেরে ফেলল সেটাকে। তারপর দলবদ্ধ হয়ে তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলল নদীর দিকে।

নদী তো কাছেই।

নদীর জলে তিনবার ওরা সাপটাকে চুবিয়ে ছুড়ে দিল খাদের দিকে। আবার বেজে উঠল দামামা।

দ্রিম। দ্রিম। দ্রিম। দ্রিম।

একটু পরেই দেখলাম গুহার ভেতর থেকে রামদুলালবাবু বেরিয়ে এলেন।

সর্দার তাঁকে কী যেন বলতেই রামদুলালবাবু বললেন, মায়ের কী মহিমা। মা কখনওই বিশ্বাসঘাতক ও লোভীকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়েন না। শাতকর্ণি গুহার এই গুপ্তধন একমাত্র আমরা ছাড়া আর কারও ভোগ করবার অধিকার নেই। এই বলে ধীরে ধীরে দেবী নাগেশ্বরীর মূর্তির কাছে এগিয়ে গেলেন রামদুলালবাবু। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে দু’ হাত জোড় করে অর্ধ নিমীলিত চোখে কী সব বিড় বিড় করে বলে প্রার্থনা করতে লাগলেন।

হঠাৎ সর্দার চেঁচিয়ে উঠে কী যেন আদেশ দিল।

সঙ্গে সঙ্গে জংলিরা যে যেখানে ছিল এসে হাজির হল সেখানে। তারপর সবাই মিলে দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল।

প্রার্থনা শেষ হলে কয়েকজন নিজ নিজ ঝোপড়ির ভেতরে ঢুকে বিচিত্র সব সাজ পরে এল।

মাথায় পরল হালকা কাঠের ফণাওয়ালা পঞ্চমুখী সাপ।

দেবী নাগেশ্বরীর সামনে শুকনো কাঠ জড়ো করে তাইতে আগুন ধরানো হল। আর সেই আগুনের লেলিহান শিখাকে ঘিরে শুরু হল আধ ন্যাংটো জংলিদের হাত-পা তুলে বর্বর নাচ।

দামামার ছন্দ এবার অন্যরকম হয়ে গেল।

এবারে আর দ্রিম দ্রিম নয়। কেটে কেটে থেমে থেমে ত্রিমাত্রিক ছন্দে বাজতে লাগল দামামা – দুম দুম বা। দুম দুম বা। দুম দুম বা। –

বাঁশের চোঙায় করে রস এল। সেই রস আকণ্ঠ পান করল সকলে। দারুণ নেশা জমে উঠল এবার। নাচের উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। নাচের সঙ্গে গানও শুরু হল এবার।

কেঁপে উঠল তিড্ডিমের পার্বত্যঅঞ্চল, বনভূমি ও উপত্যকা। পাহাড়ে-পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হতে লাগল। পাখিরা চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে লাগল আকাশে।

বিচিত্র সুরে, বিচিত্র ভাষায়, বিচিত্র কণ্ঠের গান জমে উঠল তখন—

“আম্বুম্‌বো আম্বুবে আম্বুম্‌বিপে-এঃ”

বাহাদুর বলল, এসব গানের ভাষা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কী যে ছাই বলে। আসলে এটা বোধহয় ওদের শোক উৎসব।

হ্যাঁ। অতগুলো লোক মরে যাওয়ায় ওরা দুঃখ পেয়েছে খুব।

প্রচণ্ড মাতালও হয়েছে।

তাই তো দেখছি। যে নাচন নাচছে, তাতে মনে হচ্ছে, আজই বোধহয় ওদের সকলের শেষদিন। এ নাচ কি দেখা যায়? আমার তো সর্বাঙ্গে কাঁটা দিচ্ছে। মানুষের মতো চোহারা। কিন্তু কী দারুণ অমানুষিক নাচ যখন দারুণ জমে উঠেছে, তখন হঠাৎ হই হই রবে চিৎকার করে উঠল জংলিগুলো। মুহূর্তের মধ্যে নাচগান থেমে গেল সব।

বল্লম নিয়ে রুখে দাঁড়াল লে।

শুরু হল প্রচণ্ড কোলাহল।

রামদুলালবাবু ছুটে গিয়ে নাগেশ্বরীর মূর্তির পিছনে একটি বড় পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করলেন। কাঁকড়াগুলো যেমন বিপদ বুঝলে মাটির গর্তে, ফাটলে নিজেদের ঢুকিয়ে নেয়, ঠিক সেইভাবে পাহাড়ের পাথরের খাঁজে নিজের দেহটা ঢুকিয়ে নিলেন রামদুলালবাবু।

এমন সময় সেই প্রচণ্ড কোলাহলকে ছাপিয়েও পাহাড়-পর্বত কাঁপিয়ে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন ভেসে এল গোঁ গোঁ করে।

বাহাদুরের মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে এল ‘ওরে ব্বাবা’!

দেখলাম মস্ত লম্বা একটি ডোরাকাটা বৃহদায়তন বাঘ সেই কোলাহলের মধ্য থেকেও ঝাঁপিয়ে পড়ে জংলিদের একজনকে মুখে নিয়ে চোখের পলকে হারিয়ে গেল সেখান থেকে।

ইতিমধ্যেই জংলিদের অব্যর্থ টিপে বাঘের পিছনদিকের রানে একটি বল্লম গেঁথে গেছে যদিও, তবুও বাঘ তাকে গ্রাহ্য করল না। শিকার মুখে নিয়ে দৌড়। বাঘটা উধাও হবার সঙ্গে সঙ্গেই জংলির দল বল্লম উঁচিয়ে পিছু নিল তার। হই হই চিৎকার করতে করতে ছুটল তার চলে যাওয়া পথের দিকে।

রামদুলালবাবু নিরাপদ বুঝে পাথরের খাঁজ থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন এবার। তারপর আর একবার দেবীকে প্রণাম করে চলে গেলেন। সর্দার দেবীর বেদিতে অনেকক্ষণ ধরে মাথা খুঁড়ে কান্নাকাটি করল। তারপর কান্না শেষ হলে চোখের জল মুছে একজনকে কী যেন বলল।

সে আস্তে আস্তে সর্দারের ঘর থেকে বড় একটা কলার কাঁদি নিয়ে এল ঘাড়ে করে।

তারপর আবার গেল।

দুটো বড় বড় পেঁপে নিয়ে এল।

সর্দার একটি পেঁপে ও দু’ছড়া কলা লোকটিকে দিতেই, লোকটি ঢুকে গেল গুহার ভেতর। অর্থাৎ রামদুলালবাবুকে বা পাখিটাকে দিতে গেল। সর্দার নিজেও কিছু ফল খেল।

তারপর কী মনে করে যেন উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।

সমস্ত আবহাওয়াটাই কীরকম হয়ে গেল যেন।

বাহাদুর বলল, সকালে আমরা যে বাঘের বাচ্চাটাকে মেরেছিলাম এটা বোধহয় তার মা। মরিয়া হয়ে এসে তার সন্তানহত্যার প্রতিশোধ নিয়ে গেল।

ঠিক বলেছ তুমি। ওর ধারণা এই জংলিরাই ওর বাচ্চাকে মেরেছে। সত্যি, এত লোকের সামনে থেকে যে কী করে তুলে নিল জংলিটাকে তা ভাবাই গেল না। অথচ দোষটা আমাদেরই। এখানে এসে এই একটিই খারাপ কাজ করে ফেলেছি আমরা।

খুব অন্যায় করেছি। ওটাকে না মারলেই হত।

যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আর এর জন্য আপশোশ করে কোনও লাভ নেই।

বুকের ভেতরটা এখনও যেন ঢিপ ঢিপ করছে।

নীচে আগুনের তেজ একটু একটু করে কমে আসছে তখন। সর্দার গেছে ঝোপড়িতে।

জংলিরা গেছে বাঘ মারতে।

দু’–একজন শুধু নাগেশ্বরীর মূর্তির কাছে শুয়েবসে ঝিমুচ্ছে।

আমি গাছের ডালে বসে গুহার ম্যাপখানা মেলে ধরলাম। ম্যাপের প্রথমেই একটি ক্রুশ চিহ্ন আঁকা আছে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের দিক নির্ণয় করছে চিহ্নটা।

বাহাদুর বলল, এই সংকেত থেকেই আমরা রাস্তার হদিস পেয়ে যাব। কী বলুন?

হ্যা। আজ রাত্রে জংলিরা আরতি করে ফিরে এসে খেয়েদেয়ে ঘুমোলেই আমরা পালাব। ততক্ষণে পথের হদিসটা জেনে নিই।

কিন্তু গুপ্তধন? গুপ্তধনের কী হবে?

গুপ্তধনের সন্ধান দেবে রামদুলালবাবু। ভাল কথায় রাজি না হলে পিস্তল দেখিয়ে জেনে নেব।

কী বিচিত্র ধাঁধার মতো ম্যাপ। মোটা সবুজ কাগজে লাল কালিতে আঁকা। সূর্যটা মাথার ওপর যেখানে আছে, সেখান থেকে আমরা দিকনির্ণয় শুরু করলাম। অর্থাৎ আমরা এখন উত্তরে আছি।

গুহার প্রধান মুখ মানে যে পথে আমরা প্রবেশ করেছি সেটা দক্ষিণে। পূর্বে নদী। পশ্চিমে গিরিখাত।

এক জায়গায় লেখা গুপ্তধন। লেখাটা সাংকেতিক। একটা বিচিত্র ধাঁধানীল তারা ঝিকমিক, বিশ গতি ডানদিক, রাধা মোড় ছ’চরণ, সাবধানে হে মরণ। শিলাটন খান তিন অমাবস্যা সারাদিন, একুশে চরণ রেখো, সামনে তাকিয়ে দেখো। বাহাদুর বলল, এর মানে কী বাবু?

এর মানে কি আমিও জানি? তা হলে তো সব সমস্যার সমাধান এখুনি হয়েই যেত। শুধু ভেবে চ্ছি না অনেক অনুসন্ধানের পর এই গুহার মানচিত্র যিনি তৈরি করলেন তিনি এর সন্ধান পেলেন কী করে? এবং সন্ধান পেয়েও গুপ্তধন নিতে পারলেন না কেন?

হয়তো মর্মান্তিক মৃত্যুই তার কারণ।

বাহাদুর আমি দু’জনেই ঝুঁকে পড়লাম ম্যাপের ওপর। কী জটিল সেই নকশা। রেখার পর রেখা এমনভাবে মিলেছে যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

আমরা প্রধান মুখে যেদিকে ঢুকেছি সেই দিকটাই এখন প্রস্থানপথ ভেবে বিপরীত দিক অর্থাৎ যেদিকে সেই অতিকায় পাখি এবং জলস্রোত রয়েছে, সেইদিক থেকে এখানকার যাত্রাপথ নির্ণয় করতে লাগলাম।

এই তো এক দুই তিন অর্থাৎ অর্ধবৃত্তাকারে এদিককার গুহামুখ থেকে ডানদিকে তিন পাক বেরোলে গুহার মধ্যস্থলে গিয়ে পড়ব। বাঁদিকে নিষেধ। লাল ডট দেওয়া আছে। তারপর সোজা দুটি গহ্বর ডাইনে রেখে সূর্য আঁকা তৃতীয় গহ্বর বাঁদিকে। তারপর আর দেখা হল না।

নীচে তখন প্রচণ্ড চেঁচামেচি।

সর্দার ঝোপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করছে। আর তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে।

যে দু’-একজন সেখানে উপস্থিত ছিল তারাও ছুটে গেল সর্দারের কাছে। সর্দার কী যেন বলতেই একজন ছুটল গুহার দিকে। তারপর রামদুলালবাবুকে

ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল।

রামদুলালবাবু এসেই বললেন, তা

সর্দার আবার কী যেন বলল।

কী করে হয়? তারা তো মরে গেছে।

রামদুলালবাবু বললেন, তুমি বিশ্বাস করো সর্দার, আমি তাদের পালিয়ে যেতে কোনওরকম সাহায্য করিনি। তা ছাড়া ওই ম্যাপও চুরি করিনি আমি। ওরাই নিয়ে পালিয়েছে। পালাতে গিয়ে মরেছে।

সর্দার এবার গম্ভীরভাবে কী যেন বলল রামদুলালবাবুকে।

রামদুলালবাবু বললেন, বেশ তো, যদি তোমার সন্দেহ হয়, তা হলে আমার ঘরের ভেতরটা খুঁজে পেতে দেখো যদি কিছু পাও। আমি এই মায়ের দিব্যি দিলাম। মা নাগেশ্বরীর সঙ্গে যারা বেইমানি করেছে তারা যেন মরে। আমারও মৃত্যু হোক।

সর্দার একবার দু’হাতে নিজের চুলের মুঠি ধরে মাথাটাকে ঝাঁকানি দিয়ে নিল। তারপর রামদুলালবাবুর কাছে এগিয়ে এসে হাতে হাত মিলিয়ে বলল, চেল্লিটাল্লিচো। অর্থাৎ বিশ্বাস করলাম।

রামদুলালবাবু বললেন, তারা মরেছে সর্দার। এদিকে জলের মধ্যে শত শত কুমিরের পাহারা, ওদিকে গভীর গিরিখাদ। ওরা যাবে কোনদিকে?

রামদুলালবাবু আবার বললেন, ওরা পালাতে গিয়েই মরেছে। মা ধ্বংস করেছেন ওদের। মা কখনও ওদের ক্ষমা করেননি। মায়ের ওপর বিশ্বাস হারিয়ো না সর্দার।

বেলা তখন পড়ে আসছে।

দূর থেকে বিচিত্র বুনো গানের সুরও ভেসে আসছে। অর্থাৎ জংলিরা ফিরছে। হই হই রব শোনা যাচ্ছে।

দামামা বাজছে দ্রিম দ্রিম দ্রিম।

জোরে জোরে বাজছে।

কাঁপছে তিড্ডিম। কেঁপে কেঁপে উঠছে লুসাই পাহাড়ের সুদীর্ঘ রেঞ্জ। ভেসে আসছে প্রচণ্ড কোলাহল।

হই হই করে ছুটে আসছে সব। বিজয়উল্লাসে চিৎকার করতে করতে আসছে। বাহাদুর দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আরে! কী সাংঘাতিক। ওই দেখুন বাবু। সেই বাঘটাকে মেরে ওরা ঘাড়ে করে আনছে।

একটু পরেই বাঘটাকে নিয়ে এসে পড়ল ওরা। বর্শাবিদ্ধ করে বাঘটার শরীরের কোনও অংশ ওরা অক্ষত রাখেনি।

যে জংলিটাকে বাঘে ধরেছিল, তাকেও বয়ে নিয়ে এল কয়েকজন। কী মর্মান্তিক অবস্থা তার।

জংলিটা মরে গেছে।

বাঘে বীভৎসভাবে তার পেটটা খেয়ে ফেলছে। কী সাংঘাতিক দৃশ্য। চোখে দেখা যায় না।

মৃত জংলিকে ওরা নাগেশ্বরীর সামনে রাখল।

বাঘটাকেও রাখল একপাশে।

দু’জন খুব যত্ন সহকারে বাঘের ছাল ছাড়াতে বসল। বেশি সময় লাগল না। ছাল ছাড়িয়ে বাঘটাকে ওরা নদীতে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল সেই হা করে থাকা বুভুক্ষু কুমিরগুলোর আনন্দভোজ।

কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটল।

তারপর দেবীর কাছে অনেক প্রার্থনার পর দলের লোকেরা সেই মৃত জংলিটাকেও ছুড়ে দিল ক্ষুধার্ত কুমিরের গ্রাসে।

আবার দামামা বাজল।

দেবীর সামনে জ্বলে উঠল অগ্নিকুণ্ড।

আবার শুরু হল নাচ।

লকলকে আগুনের লেলিহান শিখায় দেবীর রাক্ষসী মূর্তি ঝকমক করে উঠল। নাচগান শেষ হলে একজন ঝোড়া বোঝাই করে হাতে গড়া মাটির প্রদীপ এনে ঢালতে লাগল সেখানে। কয়েকজন সেই প্রদীপ সাজাতে বসল। আর বাদবাকিরা কলার মান্দাসে গাছের ছালে সেই প্রদীপ সাজিয়ে পলতের মুখ জ্বেলে ভাসিয়ে দিতে লাগল নদীর জলে। যেখানে স্রোতের বেগ একটু কম, সেখানে স্রোতের টানে প্রদীপগুলো খাদের দিকে না-পড়ে কয়েকটি গুহামুখের ভেতর দিয়ে ভেসে যেতে লাগল।

তিড্ডিমের এই আলোকিত সন্ধ্যা মনোরম হয়ে উঠল। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। সে দৃশ্য ভোলা যায় না।

প্রদীপ ভাসানো শেষ হলে শিঙা ফুঁকে সর্দারকে বসানো হল একটা পালকিতে।

কয়েকজন পালকি নিয়ে ঝোপড়িগুলোর পিছনদিক দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বোধহয় শাতকর্ণি গুহায় সাতবাহন রাজার গুপ্তধনের আরতি করতে গেল।

বাহাদুর আর আমি অবাক হয়ে সব দেখলাম।

বাহাদুর বলল, এবার নামবেন তো বাবু?

এখন কী? ওরা ফিরে আসুক। রাত বাড়ুক। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবে তো। আমরা আজই পালাতে পারব। কী বলুন? আর ভাল লাগছে না এখানে। ভাল কি আমারও লাগছে? তবু দেখিই না কী আছে কপালে।

আমি কিন্তু এখন পালাবার কথা নয়, অন্য কথা ভাবছি। সেই সাংকেতিক ধাঁধাটার কথা। ভেবে ভেবে কোনও কূলই পেলাম না। ভাবনার জটগুলো পাকিয়ে মাথাটাই শুধু ঝিম ঝিম করতে লাগল।

এখন কত রাত তা জানি না।

জংলিরা একটু আগেই ফিরে এসে শুয়ে পড়েছে যে যার ঘরে। বাহাদুর আর আমি আস্তে আস্তে নেমে এলাম গাছ থেকে। চারদিক নিঝুম।