অভিশপ্ত তিড্ডিম – ৬

ছয়

আমরা ঘন ঝোপের ভেতর ঠিক খরগোশের মতো আত্মগোপন করে বসে রইলাম।

জংলিগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।

তাদের দাদামার শব্দে বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।

ওদের কথাবার্তা আর হইচই খুব কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে এবার। একটা আতঙ্কের ভাব যেন মনের মধ্যে ক্রমশ জমাট বেঁধে উঠছে। আমাদের ঠিক পাশ দিয়েই দু’জন চলে গেল।

হঠাৎ একজন কী বলে যেন চেঁচিয়ে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে হই হই করে ছুটে এল সকলে। মোট বারো জন। যেন বারোটা পিশাচ। তাদের দুর্বোধ্য ভাষার কথা শোনা যাচ্ছে। প্রত্যেকেই উত্তেজিত। অনুমানে বুঝলাম গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা সেই লতাটাকে দেখতে পেয়েছে ওরা। আমরা ঝোপের ভেতর থেকে উঁকি মেরে দেখলাম লতাটাকে ধরে কী যেন বলাবলি করছে সবাই।

একজন একটু টেনে দেখল লতাটাকে। কী দেখল কে জানে, হয়তো দেখল যে ওই লতাটা ধরে আমরা ওদের ভয়ে খাদের দিকে ঝুলছি কি না। কিন্তু টান দেওয়ার পর যখন বুঝতে পারল ওধারে ভারী কিছু নেই তখন দু’-একবার সেটাকে ধরে টানাহেঁচড়া করে ঝাঁকানি দিল। তারপর সরসর করে খানিকটা টেনেও তুলল। পরে বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিল সেটাকে।

এবারে হাতমুখ নেড়ে চলল নানারকম যুক্তি। যুক্তির পর জনা সাতেক জংলি পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল সেদিকে। তারপর খাদের মাটি-পাথর ধরে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল নীচের অবস্থাটা।

যেই না দেখতে যাওয়া অমনি ঘটে গেল বিপর্যয়। ওরা দলবদ্ধ হয়ে ঢালের এমন একটা অংশে গিয়ে পড়েছিল, যেখানকার আলগা মাটি অতগুলো লোকের ভার সইতে না পেরে হুড়মুড় করে ধসে পড়ল খাদের ভেতর।

চোখের পলকে সাতজনই সাফ হয়ে গেল।

ওদের অন্তিম আর্তনাদ ও ধসের শব্দে গুরুগম্ভীর ধ্বনি ও প্রতিধ্বনিতে ভরে উঠল চারদিক।

বাদবাকি জংলিগুলো যারা অদূরে দাঁড়িয়েছিল তারা তখন প্রচণ্ড চিৎকার করে লাফাতে গল সেখানে। কয়েকজন শূন্যে হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে লাগল। তারপর বিলাপ করতে করতে যে পথে এসেছিল ওরা, দলবদ্ধ হয়ে সেই পথেই ছুটল। বুঝলাম এই নিদারুণ দুঃসংবাদটা দলের লোকেদের দিতে গেল ওরা।

যাক। বিপদ কাটল এখনকার মতো।

এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে বসেছিলাম আমরা। এবার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাহাদুরকে বললাম, এইবার আমাদের একটু সতর্ক হয়ে চলতে হবে বাহাদুর। কেন না বুঝতে পারছ তো ওরা গিয়ে ওদের দলের লোককে খবর দিলেই, যে যেখানে আছে ওদের, সবাই হই হই করে ছুটে আসবে।

তা হলে?

তা হলে আর কী? এই সময়টুকুর মধ্যে যেভাবেই হোক আমাদের কোনও একটা নিরাপদ জায়গা দেখে লুকিয়ে পড়তে হবে।

সেরকম নিরাপদ জায়গা এখানে কোথায়?

খুঁজে বার করতে হবে। আপাতত এই ঝোপ থেকে বেরিয়ে আরও একটু এগিয়ে চলো। তারপর ওরা যখন ফিরে এসে এখানে ওদের শোকপ্রকাশ করবে, আমরা তখন গুহার দিকেই দৌড়ব।

বাহাদুর যেন শিউরে উঠল, না না না। আপনার কি মাথাখারাপ হয়েছে? এ আপনি কী বলছেন?

কেন?

এত কষ্ট করে বেরিয়ে এসে আবার ওই অভিশপ্ত গুহায় ঢোকে কেউ?

এছাড়া যে আর কোনও উপায় নেই বাহাদুর। এখন জংলিদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে আবার ওই গুহাতেই যেতে হবে। পরে অবশ্য ঘটনার সঙ্গে তাল রেখে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। না হলে ওইখানে ফিরে যেতে আর কি কারও মন চায়?

জংলিগুলো চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম।

যখন দেখলাম ওরা অনেক দূরে চলে গেছে, তখন ওদের পথ অনুসরণ করলাম আমরা।

খানিক যাবার পর ঘন পত্রবিশিষ্ট একটি প্রকাণ্ড গাছ দেখতে পেয়ে বাহাদুরকে বললাম, বাহাদুর, এখনই আর বেশি এগনো ঠিক হবে না। যদি ওরা ফিরে আসতে শুরু করে তো একেবারে মুখোমুখি পড়ে যাব। আপাতত এই গাছে উঠেই আমরা লুকিয়ে বসে থাকি এসো। এর চেয়ে লুকানোর পক্ষে নিরাপদ জায়গা এখানে আর নেই। ওরা যখন দলবল নিয়ে আবার এইদিকে আসবে, আমরা তখন বিপরীত দিকে ছুটে গুহায় গিয়ে ঢুকব।

বাহাদুর একটু বিমর্ষ হয়েই বলল, যা আপনি বলবেন।

বুঝতে পারছি ওই গুহায় আবার ফিরে যেতে বাহাদুরের আর একটুও মন নেই। মন কী আমারও আছে। খাঁচার পাখি খাঁচা ছেড়ে একবার বেরিয়ে গেলে আর কি খাঁচায় ফিরে যায়। কিন্তু এমনই ঘটনাপ্রবাহ যে, ওই ছেড়ে আসা গুহাই এখন আমাদের একমাত্র নিরাপদ স্থান।

যাই হোক। আমরা আর দেরি না করে গাছে ওঠা শুরু করলাম। মোটা মোটা ঘেঁস ঘেঁস ডালে পা দিয়ে তর তর করে ওপরে উঠতে একটুও বেগ পেতে হল না।

ওপরে উঠতে উঠতে বাহাদুর বলল, একটা জিনিস লক্ষ করেছেন বাবু? কী?

ওরা মানে জংলিরা কিন্তু গুহার দিকে যাচ্ছে না।

আমি অবাক হয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কালো কালো পিঁপড়ের মতো জংলিরা গুহার ডানদিকের পথ ধরে হারিয়ে গেল পাহাড়ের বাঁকে। আমি মধ্যপথে একটি শক্ত ডাল ধরে বসে রইলাম।

বাহাদুর গাছের আরও ওপরে উঠল। আমি বললাম, কিছু নজরে পড়ছে? হ্যাঁ পড়ছে। একটা নদী দেখতে পাচ্ছি। নদী?

হ্যাঁ বাবু।

সত্যি সত্যি নদী দেখতে পাচ্ছ, না অন্য কিছু? ভাল করে লক্ষ করো কিন্তু। হ্যা ভাল করেই দেখছি। ওটা নদীই।

ওখানে কোনও খাদ নজরে পড়ছে?

না প্রায় সমতলের মতো। কোনও খাদ নেই।

তা হলে তো ওই নদীটা ডিঙোতে পারলেই আমাদের মুক্তি। সমস্ত বিপদের শেষ।

আমারও তাই মনে হচ্ছে বাবু। এবারে আমরা অনায়াসে পালাতে পারব।

আনন্দের আবেগে আমিও তখন একটু একটু করে গাছের একেবারে মগডালে বাহাদুরের কাছাকাছি উঠে গেলাম। বেশ নিরাপদ এখানটা। ঘন পাতার আড়ালে খুব নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থাকা যায়। শুধু যা একটু কাঠপিঁপড়ের উপদ্রব। তা হোক। সহ্য করা যাবে। আত্মরক্ষার জন্য এটুকু কষ্ট না করলে চলবে কেন?

ওপরে উঠে আমিও তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু লক্ষ করতে লাগলাম। না, বাহাদুর ভুল দেখেনি। ওই তো রুপোলি ফিতের মতো একটা নদী বহু দূরে সূর্যালোকে চকচক করছে।

বেশ কিছুটা সময় গাছের ডালে বসেই কেটে গেল।

তারপর যা ভেবেছিলাম হয়ে গেল তাই। অর্থাৎ সেই জংলিগুলো দলবদ্ধভাবে হই হই করে ছুটে আসতে লাগল এদিকে। ওরা সঙ্গে করে একটা পালকিও বয়ে এনেছে দেখলাম। সেই পালকিতে নিশ্চয়ই ওদের সর্দার আছে। মনে মনে ভাবলাম এসো বাছাধনরা। এই তো আমরা চাইছিলাম। আসতে অবশ্য অনেকটা সময় লাগল ওদের। একে তো ঝোপভরতি পথ, তার ওপর দূরত্বও কম নয়।

ওরা এল। এবং সেই বিশাল গাছতলা দিয়ে চলেও গেল। আমরাও সময় নষ্ট না করে নেমে পড়লাম গাছ থেকে

নামবার আগে অবশ্য ভাল করে বেশ চারদিক একবার দেখেও নিলাম। যখন দেখলাম আর কেউ নেই, তখনই নামলাম।

তারপর সোজা এগিয়ে চললাম যে পথ দিয়ে জংলিরা এসেছিল, সেইদিকে। লক্ষ্য আমাদের নদী।

যেতে যেতে বাহাদুর বলল, আচ্ছা বাবু ওদের সঙ্গে সেই লোকটিকে দেখলাম না তো?

কোন লোকটি?

ওই যে সেই বুড়ো, ঝাঁকড়া চুল।

ও রামদুলালবাবু।

আপনি নামও জেনে গেছেন?

হ্যাঁ। তিনি আর এখানে এসে কী করবেন? এ হল জংলিদের ব্যাপার। তিনি হলেন ভিন্ন জাত। এদের তো নন।

যাই হোক, আমরা কখনও জোরে পা চালিয়ে, কখনও ছুটে গুহার দিকেই চললাম। তবে আর তো গুহায় ঢোকার প্রয়োজন নেই। তাই ডানদিকের পথটা ধরে নদীর দিকে এগোলাম আমরা।

কিছু পথ যাবার পর দেখলাম, এক জায়গায় সাতটি ঝরনা বা সপ্ত নদীর ধারা একত্রিত হয়ে প্রবল প্রবাহে নেমে আসছে একটি পাহাড়ের গা বেয়ে। দূর থেকে এটি অবশ্য আমাদের নজরে পড়েনি। কেন না এটি একটি খাড়াই পাহাড়ের বাঁকে ছিল।

নদীর ওপারে পাহাড়ের বাঁকে এক মনোরম ঢাল। কত বিচিত্র বর্ণের নুড়িপাথর যে পড়ে আছে সেখানে, তার আর শেষ নেই। দেখে মনে হয় কিছু পাথর খুবই মূল্যবান। যাই হোক, সেই মূল্যবান নুড়িপাথরের ঢালের গায়ে ঘন সবুজ নিবিড় বন। গাছপালার চেহারা দেখলে কাশ্মীর উপত্যকার কথা মনে হয়। কুলু কাংড়ার সৌন্দর্যও যেন প্রকটিত হয়ে উঠেছে এখানে।

আত্মগোপনের চমৎকার একটি জায়গা। কোনওরকমে নদীটা একবার পার হতে পারলে মুক্তিও মিলতে পারে। তবে তা দুরূহ প্রচেষ্টা। কেন না যা খরস্রোতা নদী।

নদীটা প্রবল প্রবাহে ধোঁয়ার আকারে একপাশে প্রায় দু’ হাজার ফুট নিচু খাদে পড়ছে।

কিন্তু নদীর ওপারে কী করে যাব?

যা বেগ তাতে তো কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বড় বড় বোল্ডারের মতো পাথরের চাঁই যা দু’-একটা রয়েছে, তাতে তো শ্যাওলা ধরে আছে। সবচেয়ে মারাত্মক যা, তা হল নদীর বালি ও পাথরের খাঁজে হাঁ করে আছে বড় বড় কুমির। যারা আলুভাতের মতো দু’জনকে মুখে পুরে নিতে একটুও কষ্ট বোধ করবে না।

আমি হতাশ হয়ে বললাম, আমরা ভারতবর্ষেই আছি তো? নাকি ভুল করে আফ্রিকার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি?

বাহাদুর বলল, আমরা ঠিক জায়গাতেই আছি বাবু। এটা হচ্ছে লুসাই পাহাড়ের রেঞ্জ। এও হিমালয়।

এইরকম বিচ্ছিন্ন পরিবেশের প্রভাবেই এই মানুষগুলো আজও জংলি হয়ে আছে। এবং দুর্লঙ্ঘ প্রাকৃতিক অবস্থানের জন্য কেউ এদের অস্তিত্ব টেরও পায় না। ফলে এরা যেমনি অসভ্য, তেমনি বর্বর।

যাই হোক। নদী পার হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই দেখে, আমরা মাথায় হাত দিয়ে বসলাম।

এমন সময় বাহাদুরই হঠাৎ বলল, ওই দেখুন বাবু কী বিচিত্র একটা জিনিস।

দেখলাম একটা প্রকাণ্ড পাথরকে কুঁদে এক ভয়ংকর মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। মূর্তিটা সম্পূর্ণ নয়। গলা থেকে মুখ ও মাথা পর্যন্ত। মুখটা প্রকাণ্ড এবং হাঁ করা। যেন সর্বস্ব গিলে খেতে চাইছে সেই হাঁ মুখে।

তার সেই ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্যই বুঝি একটি গ্যাজলা ওঠা তেলভরতি মাটির প্রদীপ দীপ্ত শিখায় জ্বলছে সেই মুখগহ্বরে। এই কি তবে নাগেশ্বরী? জংলিদের আরাধ্যা দেবী নাগমাতা?

মূর্তিটার সামনে যেতেই দেখলাম, এক ঝাঁক বুনো হাঁস কোথা থেকে যেন বেরিয়ে এসে প্যাক প্যাক করে ডানা ঝাপটে উড়তে লাগল।

তাদের দেখাদেখি এক ঝাঁক পাখিও।

সে এক দেখবার মতো দৃশ্য।

এখানে সারিবদ্ধ কতকগুলো ছোট ছোট ঘরও আছে দেখলাম। এই তা হলে জংলিদের বস্তি।

ঘরগুলো এমন যে ওগুলোকে দেখলে ঘর বলে মনেই হবে না। মনে হে পাথরের খাঁজে খাঁজে গজিয়ে ওঠা কতকগুলো ঝোপ। প্রতিটি ঘরই বাইরের দিক থেকে বুনো লতাপাতায় ঢাকা। সেইসব লতা গাছে রকমারি সুগন্ধি ফুলও আছে।

ঘরগুলোয় ঢোকবার জন্য কোনও দরজার বালাই নেই। সামান্য একটু আটকান দেওয়া। ঘাড় হেঁট করে গর্তের মতো জায়গা দিয়ে শুধু ঢুকে পড়া।

যাই হোক, আমি চট করে সেগুলোর ভেতরে ঢুকে পড়ে একটু তল্লাশি চালালাম। খুঁজেপেতে দেখলাম, যদি পাওয়া যায় আমাদের খোয়া যাওয়া সেইসব জিনিসগুলো।

বাহাদুরও চুপচাপ রইল না। সেও শুরু করল খোঁজাখুঁজি। দু’জনের সমবেত চেষ্টায় যদি পাওয়া যায়।

এরই মধ্যে একটি ঝোপড়ি ঘর দেখলাম, বেশ উন্নত ধরনের। বুঝলাম এইটাই সর্দারের ঘর।

বাহাদুরকে বললাম, বাহাদুর, তুমি একটু বাইরের দিকে নজর রাখো। আমি ভেতরটা খুঁজে দেখি।

কেন বেকার সময় নষ্ট করছেন?

আমার মনে হচ্ছে জিনিসগুলো এখানেই আছে।

তাড়াতাড়ি করুন তা হলে। আমি বরং একটা গাছের ওপর উঠে ওদের দিকে নজর রাখি। বিপদ বুঝলেই শিস দেব। আপনি বেরিয়ে আসবেন।

বাহাদুরের যুক্তিটা মন্দ নয়।

এখানে সবসময় সতর্ক থাকা দরকার।

তবে বিপদ বা ধরা পড়ার ভয়ও যেমন আছে, তেমনি আরও কিছু না থাক, লুকিয়ে পড়ার জন্য এইসব বৃহদাকৃতি গাছও আছে। বিশেষ করে ওই রাক্ষুসি দেবী নাগেশ্বরী যেখানে আছেন তার ঠিক পিছনেই আছে একটি প্রকাণ্ড গাছ। তার ডালপালাগুলোও যেন হাত বাড়িয়ে আকাশটাকে ধরতে যাচ্ছে। কী গাছ তা জানি না। ঘন ডালপালা। বড় বড় পাতা। আর যেন অন্ধকারময়। পাহাড়-জঙ্গলে এরকম কত গাছ যে আছে, কে আর অত নাম জেনে বসে আছে সব।

বাহাদুর গাছে উঠল।

আমি ঝোপড়ির ভেতরে ঢুকলাম।

ঢুকেই অবাক। দেখি না আমাদের অতি যত্নে কেটে রাখা সেই হাতির দাঁতদুটো ঝোপড়ি ঘরের এক কোণে পড়ে আছে।

এমনকী সেই বাঘের ছালটাও ছাড়িয়ে এনেছে দেখছি।

অবশ্য এসবের জন্য এখন আর আমার মনে কোনও ক্ষোভ নেই। এখন শুধু আমাদের আসল জিনিসগুলো এবং প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি। তবুও খুব তৎপরতার সঙ্গে এটা ওটা সেটা দেখতেই পেয়ে গেলাম ম্যাপখানা।

মনটা উল্লাসে নেচে উঠল।

সর্দারের বিছানার নীচে গোঁজা ছিল ম্যাপটা। এতটুকু মলিন হয়নি। নকশা লেখা যেমন ছিল তেমনিই আছে। ম্যাপটা নিয়ে হাতড়াতে লাগলাম আরও কিছু পাওয়া যায় কি না তা দেখবার জন্য।

ঘরের ভেতরে একটা মাচা মতন ছিল। টর্চ, পিস্তল আর ছুরিটা সেখানেই পেয়ে গেলাম।

ঠিক তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুখেই দেখলাম যে ঘরে সর্দার থাকে, পাশের ঘরেই সারি সারি সাজানো আছে তরমুজ, পেঁপে আর রামকলার কাঁদি। আমি তাড়াতাড়ি করে কয়েক ছড়া কলা আর পেঁপে নিয়ে পালিয়ে এলাম। কেন না প্রাণ বাঁচানোর জন্য এবং পালিয়ে যাবার জন্য যতই চেষ্টা করি, ক্ষুধায় খাদ্য না পেলে পেট কোনও কথা শুনবে না।

এমন সময় শিসের সংকেত শুনতে পেলাম। এ তো বাহাদুরের শিস।

নিশ্চয়ই ওরা ফিরে আসছে এবার।

বাহাদুর তাই সতর্ক করে দিচ্ছে।

আমি আর একটুও বিলম্ব করলাম না। আর বিলম্বের দরকারই বা কী? আমার কাজ তো হাসিল হয়ে গেছে।

আমি যা নেবার তা নিয়ে এক লাফে বাইরে বেরিয়েই তাড়াতাড়ি করে গাছে উঠতে লাগলাম। গাছে ওঠার ব্যাপারে আমি বরাবরই পটু। তাই খুব একটা অসুবিধা হল না। বিশেষ করে এখানকার গাছপালার ডালগুলো ঘন এবং মোটা বলে চটপট করে ওপরে ওঠা যায়।

আমি ডালপালা ধরে ওপরে উঠে আসতেই বাহাদুর জিজ্ঞেস করল, লাভ হল কিছু? পেয়েছেন?

আমি হেসে বললাম, ভগবান সহায়। পেয়েছি।

ওরাও আসছে। ওই দেখুন।

ওরা আসবে, সে তো জানিই। গেছে যখন ফিরতেই হবে। তবু তাকিয়ে দেখলাম দূরে— অনেক দূরে ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে জংলিরা দলে দলে আসছে। বাহাদুর এইসময় একবার আড়চোখে আমার হাতের দিকে তাকাল অর্থাৎ সংগ্রহ করে আনা সেই ফলমূলগুলোর দিকে।

আমি বললাম, ওরা আসার আগেই খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। পরে হয়তো সময় পাব না।

বাহাদুর বলল, খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল। এতসব কোথায় পেলেন বাবু? সর্দারের ঘরে।

ওঃ বাঁচালেন আপনি।

আমরা দু’জনেই তখন সর্বাগ্রে গোগ্রাসে খেতে শুরু করে দিলাম সেগুলো।

খেয়ে ফলের খোসাগুলো গাছেরই একটা ফোকরে গুঁজে রাখলাম। না হলে নীচে পড়লেই চোখে পড়বে ওদের। আর চোখে পড়লেই সর্বনাশ। যদি গাছের দিকে তাকায়, তা হলে আবার ধরা পড়ে যাব।

বাহাদুর খাওয়া শেষ করে বলল, তা বাবু আমাদের এইভাবে এখানে সময় নষ্ট করে গাছের ডালে বসে না থেকে, পালাবার চেষ্টা করলে হত না? এইভাবে পিঁপড়ের কামড় খেয়ে কতক্ষণ বসে থাকব?

সারাদিন। এখন পালাতে গেলেই ধরা পড়ব। সে খেয়াল আছে? সব ব্যাপারে বেশি আঁকুপাঁকু করলে হয় না। অসীম ধৈর্যে বুক বেঁধে বসে থাকতে হবে আমাদের।

কিন্তু এখানে বসে থেকেও যদি ধরা পড়ি?

সেটা নেহাতই দুর্ভাগ্য বলতে হবে। তবে একটা ব্যাপারে এখন আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি এই যে, ওরা কিন্তু ধরেই নিয়েছে আমরা পাহাড় টপকে পালাতে গিয়ে খাদে পড়ে মারা গেছি। কাজেই এখন আর ওরা আমাদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবে না। ওরা এখন ওদের দলের লোকদের মৃত্যু নিয়েই চিন্তিত। তাই আমাদের প্রতি আর ওদের নজর নেই।

তা অবশ্য ঠিক।

তবুও এখানকার প্রকৃতিগত অবস্থানের জন্যে যে বাধা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে আমার মনে হচ্ছে সময় ও সুযোগ বুঝে আমাদের পালাতে গেলেও ওই গুহার ভেতর দিয়েই পালাতে হবে।

বাহাদুর আক্ষেপের সুরে বলল, আবার ওই গুহা। গুহা দেখছি আমাদের ছাড়বে না।

না গুহাপথ ছাড়া সত্যি সত্যিই আর আমাদের কোনও পথ নেই। কেন না এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থা অনেকটা মধ্যপ্রদেশের অমরকণ্টক পাহাড়ের শোণ প্রপাতের জায়গাটার মতো।

তা হলে কখন যাবেন ঠিক করছেন?

দিনমানে তো সম্ভব নয়। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাতের অন্ধকারেই যেতে হবে আমাদের।

বাহাদুর বলল, ওই ম্যাপটার মধ্যে কি গুহাপথের কোনও নির্দেশ দেওয়া আছে?

আছে বইকী। সেইজন্যেই তো এত কষ্ট করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করলাম এটাকে। এইখানে নিরাপদে বসে সেই ম্যাপ দেখে গুহাপথের নির্দেশ বুঝে নিয়ে তবেই আবার ভেতরে ঢুকব।

আর তা হলে কোনও ভয় নেই বাবু, কী বলুন?

ভরসাও নেই। সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়? শুধু সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।

এমন সময় বাহাদুর হিস্ করে উঠল।

ওর সংকেত বুঝতে পেরেই আমার রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে উঠল তখন। এই অবস্থায় ঠিক কী করা উচিত, তা আমার জানা আছে। একদম নড়াচড়া নয়। একেবারে স্থিরভাবে বসে থাকতে হবে। না হলেই মৃত্যু।

উঃ। কী দারুণ হিমশীতল ঠান্ডা সেই পিচ্ছিল পরশ। পাহাড়ি সাপটা যে কখন গাছের ডাল বেয়ে এসে আমার কাঁধে নেমেছে তা টেরই পাইনি।

কাঁধের ওপর থেকে আস্তে আস্তে সেটা আমার বুকে নামল। তারপর কুতকুতে চোখে মাথাটা একটু দুলিয়ে সড় সড় করে চলে গেল সামনের একটি ডাল বেয়ে।

এতক্ষণ আমি নিশ্বাস পর্যন্ত ফেলিনি। এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হঠাৎ একটা পিলে চমকানো শব্দে বুকটা কেঁপে উঠল। জংলিরা কখন যে এসে গাছতলায় দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করিনি।

পাগলের মতো উন্মত্ত হয়ে দামামা বাজাতে লাগল তারা। দ্রিম দ্রিম দ্রিম সেই সঙ্গে বিকট চিৎকার।

কেউ কেউ বুক চাপড়ে কান্নাও শুরু করে দিয়েছে।

সেই ভয়ংকরী দেবীমূর্তির সামনে এসে লুটিয়ে পড়ছে সবাই।

সর্দার নতজানু হয়ে দেবীকে প্রণাম করল। তারপর কী ভেবে যেন ওপর দিকে তাকাতে গিয়েই থেমে গেল সর্দার। কান্না মাথায় উঠে গেল তার। সোজা খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে ‘আকুকুক্’ করে একটা অদ্ভুত শব্দ বার করে সমস্ত জংলিদের হাতছানি দিয়ে ডাকল।

জংলিগুলো কান্না থামিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে এল সর্দারের কাছে।

সর্দার আঙুল তুলে গাছের ওপর দেখতে বলল সকলকে। ইসরে। ধরা পড়ে গেলাম।

গাছের দিকে তাকানো মাত্রই হনুমানের মতো লম্ফঝম্ফ শুরু হয়ে গেল জংলিদের। তারপর বল্লম উঁচিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল গাছের দিকে। আমাদের চোখে যেন জল এল।

হাত-পা কাঁপতে লাগল ভয়ে। নাঃ। বিধি বাম। তাই এত চেষ্টা করেও মুক্তির স্বাদ পেলাম না। অভিশপ্ত তিড্ডিমের এই অভিশপ্ত প্রান্তরেই বল্লমের খোঁচা খেয়ে অসহায়ভাবে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে আমাদের।

আমরা আবার ওদের নজরে পড়ে গেলাম।

বাহাদুর ভয়ে চোখ বুজল।

আসলে কিন্তু আমরা যে ভয় করছিলাম, তা ঠিক নয়। ওরা আমাদের দেখতেই পায়নি। ওরা যা দেখে ছুটে এসেছিল তা হল একটা সাপ। বোধহয় খুব ভয়ংকর জাতের সাপ। না হলে এই সাপের রাজত্বে বাস করে সাপ দেখে ছুটে আসবে কেন?