অভিশপ্ত তিড্ডিম – ৫

পাঁচ

রাত এখন কত তা জানি না। বাহাদুর বা আমার কারও চোখেই ঘুম নেই। দু’জনেই অসহায়। দু’জনেই বন্দি। কী কঠিন সেই বন্ধন। কিন্তু সে বন্ধনও আমরা শেষ পর্যন্ত খুলে ফেললাম। ওরা আমাদের বেঁধে রেখেছে বটে, তবে শুধু পা বেঁধেই ফেলে রেখেছে। অন্য কিছুর সঙ্গে বেঁধে রাখেনি। তার ওপর ঘরের ভেতর একটা প্রদীপও জ্বেলে রেখে গেছে।

চারদিক যখন একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল আমরা দু’জনে তখন গড়িয়ে গড়িয়ে সেই প্রদীপের কাছে গেলাম। প্রদীপের শিখার মুখে হাতের বন্ধনটা তুলে দিতেই সেটা জ্বলে উঠে ছিঁড়ে গেল। পায়ের বাঁধন অনায়াসে খুলে ফেললাম এবার। তারপর নিজে মুক্ত হয়ে বাহাদুরকেও বাঁধনমুক্ত করলাম।

বাহাদুর বলল, সব তো হল, কিন্তু ঘর থেকে বেরোব কী করে?

আমি আস্তে আস্তে দরজার কাছে গেলাম। গিয়ে দরজাটা টানতেই দেখলাম সেটা একটু ফাঁক হল। ফাঁক হতে দেখলাম দরজার কড়াতে দড়ি বাঁধা। তাড়াতাড়ি প্রদীপটা এনে শিখাটা সেই দড়ির মুখে ধরতেই জ্বলে উঠল সেটা। এবং পরে দরজায় টান দিতেই দরজাও খুলে গেল।

আমরা দু’জনেই সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু এ কী! বাইরে বেরোতেই দেখি চোখের সামনে এক মূর্তিমান যম দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে তার কালো রং এমনভাবে মিশেছিল যে তা লক্ষই করিনি। জংলিটা বল্লম হাতে পাহারা দিচ্ছিল। আমাদের দেখেই বল্লমটা উঁচিয়ে ধরল সে। অন্ধকারে তার কালো মুখে সাদা দাঁতের সারিগুলো ঝিকমিক করে উঠল। অর্থাৎ হাসল।

আমি বাহাদুরের দিকে তাকালাম। বাহাদুর আমার দিকে তাকাল। ইশারা হয়ে গেল চোখে চোখে। বাহাদুর চোখের পলকে একবার উবু হয়ে বসেই লাফিয়ে উঠে বল্লমের মুখটা চেপে ধরে সেটা ওপর দিকে করে দিল। আর আমি সেই ফাঁকে জোড়া পায়ে মারলাম এক লাথি জংলিটার পেটের ওপর।

একবার শুধু কোঁক করে একটু শব্দ। তারপর পেটটাকে চেপে ধরে দু’হাত দূরে ছিটকে পড়ল বেচারা।

আমরা ছুটে গেলাম তার কাছে। বাহাদুর একেবারে তার বুকে চেপে বসল! বসেই টিপে ধরল মুখটা। তারপর মাথাটা কয়েকবার মেঝেতে ঠুকে দিতেই অচৈতন্য হয়ে পড়ল সে। যখন দেখা গেল আর সে নড়াচড়া করতে পারছে না, তখন দু’জনে মিলে তাকে ধরাধরি করে যে ঘরে আমরা বন্দি ছিলাম সেইঘরেই এনে ঢোকালাম। তারপর হাত-পা বেঁধে রেখে প্রদীপ নিভিয়ে দরজার কড়ায় দড়ি বেঁধে পালাবার জন্য তৈরি হলাম।

বাহাদুর বলল, এখন আমরা কোনদিকে যাব?

যেদিক দিয়ে এসেছি সেই পথে।

কিন্তু সে পথ চিনে কি যেতে পারবেন?

পারব। আমার মনে আছে। চোখ বাঁধা থাকলেও আমি সতর্ক ছিলাম।

আমরা ফিরে চললাম। ঠিক যেভাবে এসেছিলাম সেইভাবে। প্রতিটি পদক্ষেপ গুনে গুনে। বিশ পা যাবার পরই সিঁড়ি পেলাম ওপরে ওঠার। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে উঠলাম। গুনে গুনে একশো ধাপ। একশো ধাপ ওঠার পরই দেখলাম পথ রুদ্ধ। তবে হতাশ হলাম না। হাত দিয়ে বুঝলাম কাঠের দরজা একটা। গুহার কালো পাথরের সঙ্গে এবং সেই ঘন ঘোর অন্ধকারে দরজাটা এমনভাবে মিশেছিল যে, তা নজরেও পড়ল না। হাতড়ে হাতড়ে বুঝলাম দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল। দরজা পেরিয়ে আমরা সেই বারান্দায় গিয়ে পৌঁছলাম।

দরজা আবার আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেল। আমরা অন্ধকারে মিশে পা টিপে টিপে চললাম। কারণ একবার যদি সেই পাখিটা আমাদের দেখতে পায়, তা হলে তার চিৎকারে সব পণ্ড হয়ে যাবে। আমরা আবার ধরা পড়ে যাব।

এবার বাঁদিক ধরে বিশ পা এগোতেই সেই জায়গায় এসে পৌঁছলাম। সেখান দিয়ে রামদুলালবাবু আমাকে তাঁর ঘরের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। যে পথ ধরে জংলিরা আরতি করতে গিয়েছিল, সেই পথে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা। আমাদের খোয়া যাওয়া জিনিসগুলো উদ্ধার করতেই হবে। না হলে প্রাণেও বাঁচব না এবং এখান থেকে পালাতেও পারব না।

যেতে যেতে রামদুলালবাবুর ঘরের কাছে এসে পড়লাম আমরা। বাইরে থেকে দেখলাম একটা হরিণের চামড়া পেতে তার ওপরে শুয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছেন রামদুলালবাবু। একবার ভাবলাম ডাকি। আবার ভাবলাম, না থাক। অযথা বিপদ বাড়িয়ে লাভ নেই। মুক্তির পথ না পেয়ে এই বদ্ধ গুহায় থেকে থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধহয় লোকটার। অবশ্য মাথার আর দোষ কী! একজন মানুষের জীবনে দীর্ঘ বাইশটা বছর কি বড় কম কথা?

আমরা রামদুলালবাবুর ঘরের পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম। খানিক যাবার পরই সিঁড়ি পেলাম। মাত্র কয়েকটি ধাপ। তারপর নীচে নেমেই অবাক হয়ে গেলাম। ডাইনে বাঁয়ে নিকষ অন্ধকার। এখানে কোথায় গুপ্তধনের ঘর, কোথায় কী।

বাহাদুর হঠাৎ চাপা গলায় বলে উঠল, বাবু! ওই দেখুন।

আমি দেখলাম। দেখে বিস্মিত হলাম। এ কী সত্যি! ঘুমের ঘোরে কোনও স্বপ্ন দেখছি না তো?

দেখলাম সিঁড়ির শেষধাপে যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেখানে মাথার ওপর কোনও ছাদ নেই। ওপর দিকে চেয়ে দেখলাম ধূ ধূ করছে নীল আকাশ। সেই আকাশ অসংখ্য তারায় ঝিকমিক করছে। এই তো মুক্তি। এত সহজে যে গুহা থেকে বেরোতে পারব তা ভাবতেও পারিনি। আকাশ যে কত সুন্দর, তা এই প্রথম অনুভব করলাম।

সামনেই পাঁচিলের মতো একটা পাথরের খাড়াই, উচ্চতায় আট ফুটের মতে৷ হবে। একটু চেষ্টা করলেই সেটা টপকানো যায়।

আমি কোনও কিছু না পেয়ে বাহাদুরের কাঁধে পা দিয়েই পাথরের খাড়াতে উঠলাম। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম বাহাদুরের দিকে। সেই হাত ধরে বাহাদুরও উঠে পড়ল খাড়াইয়ের ওপর।

এখন শেষ রাত। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। আর একটু পরেই ভোর হবে। এই ভোর আমাদের জীবনে এক আশ্চর্য সুন্দর স্মরণীয় ভোর। তারপর আমাদের মুক্তির সূর্য উঠবে। দিনের আলো ফোটার আগেই আমরা এই অভিশপ্ত গুহা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারব।

খাড়াইটার ওপর বসে দেখলাম আমাদের সম্মুখেই ধু ধু করছে লতাগুল্মে ভরা এক প্রান্তর। ছোট ছোট ঝোপঝাড়ও আছে অনেক। মাঝেমধ্যে বড় গাছও আছে। আর আছে ছায়া ছায়া পাহাড়ের সারি।

আমরা খাড়াইয়ের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লাম নীচে। পাদুটো একবার একটু কনকনিয়ে উঠল। তারপর সুমুখপানে ছুট— ছুট— ছুট।

খুব বেশি ছোটা গেল না। একে পথ পরিষ্কার নয়, তার ওপর খানিকটা ছুটে হাঁপিয়ে পড়লাম। তবু চলতে লাগলাম। পথ আর শেষ হয় না। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটে উঠছে। চারদিকের বিশাল পর্বতচূড়াগুলো প্রেতের মতো দেখাচ্ছে। এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম। এ কী! পথ কই? যেদিকে তাকাই সেদিকেই অতলস্পর্শী খাদ। খাদের হাজার হাজার ফুট নীচেটা যেন ধোঁয়ার মতো দেখাচ্ছে। গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল দেখে। মুক্তির যে আনন্দ এতক্ষণ ভরিয়ে তুলেছিল আমাদের তা এক মুহূর্তে উবে গেল।

বাহাদুর বলল, এ তো মহা মুশকিল দেখছি।

আমি কথাটি বলতে পারলাম না। আমার দু’চোখ ফেটে যেন জল আসতে লাগল। ওঃ! এমন বিপদেও মানুষ পড়ে? তবুও আমরা হতাশ না হয়ে খাদের গা ঘেঁষে পথ চলতে লাগলাম। দেখিই না কোনওদিক দিয়ে একটুও যদি নামার পথ পাই।

এদিকে সকাল হয়ে গেছে। সূর্যও উঠেছে।

দিনের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক।

জংলিরা যখন দেখবে আমরা নেই, যখন দেখবে ওদের দলের লোকের ওইরকম অবস্থা করে এসেছি আমরা, তখন নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না। চারদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজবে আমাদের। খুঁজতে খুঁজতে যদি এইদিকে আসে? এইসব ছোট ছোট ঝোপগুলো কি লুকিয়ে রাখতে পারবে আমাদের? যা সাংঘাতিক ওরা তাতে ঠিক খুঁজে বার করে ফেলবে।

খাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ ঘটে গেল দুর্ঘটনা। একপাশের কিছু মাটি ও আলগা পাথর ধসে যেতেই হুমড়ি খেয়ে মুখথুবড়ে পড়লাম আমি। তারপর হড়হড় করে নেমে যেতে লাগলাম খাদের দিকে। আমি হাতের সামনে যা পেলাম, তাই আঁকড়ে ধরে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। প্রথমেই ধরলাম একমুঠো ঘাস। কিন্তু তা নিমেষের মধ্যে মাটি থেকে গোড়াসুদ্ধ উপড়ে এল। আমার বুকের স্পন্দন মনে হল থেমে যাবে বুঝি। গড়িয়ে পড়ার গতিও বেড়ে গেল। কত— কত নীচে যে পড়ব, তা কে জানে? ঘর্ষণে হাত-পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলাম না। হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম। তবে একেবারে নীচে নয়। ভগবান রক্ষা করলেন। খাদের গায়ে পাথরের ফাটলে একটা মাঝারি ধরনের বটগাছ গজিয়ে উঠেছিল, সেটারই একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়লাম। প্রথম কয়েকটা মিনিট স্থিরভাবে ঝুলে রইলাম। তারপর একটু একটু করে চোখ মেলে তাকালাম নীচের দিকে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ওপরদিকে তাকালাম। ওপরে শুধু পাথরের দেওয়াল আর আকাশ। হাতদুটো অসম্ভব ভারী হয়ে আসছে। এইভাবে কি ঝুলে থাকা যায়? একবার অতি কষ্টে ডাকলাম, বা— হা – দু― র! আমার ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে ঘুরতে লাগল। একটু পরেই বাহাদুরের গলা শুনতে পেলাম, আমি এইখানে-এ।

আমি সাড়া দিলাম, আমাকে বাঁচাও বাহাদুর। যেমন করেই হোক বাঁচাও।

আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।

আমাকে দেখবার চেষ্টা কোরো না। তা হলে তুমিও পড়ে যাবে।

ওপর থেকে বাহাদুরের গলা শোনা গেল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন।

বাহাদুরের কথায় আশ্বস্ত হলেও আর যে ঝুলতে পারছি না। দেহের ভারে হাতদুটো যেন ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। মনে হচ্ছে হাতের কবজিদুটো আপনা থেকেই আলগা হয়ে যাবে। এমন সময় কী যেন একটা আমার গায়ের ওপর এসে পড়ল। দেখলাম একটা কঠিন ডাঁটার শক্ত লতা। বুঝলাম বাহাদুরই এটি নিক্ষেপ করেছে। এমন সময় ওপর থেকে বাহাদুরের গলা শোনা গেল, বাবু পেয়েছেন? পেয়েছি।

ওটা শক্ত করে ধরুন।

আমি দেখলাম সেটা এমনভাবে ঝুলছে যে সেটাকে ধরতে গেলে হাত বাড়িয়ে একটু রিস্ক নিয়ে ধরতে হবে। আর রিস্ক নিতে গিয়ে যদি কোনওরকমে একবার হাত ফসকাই তো ব্যস। একেবারেই ফর্সা।

ওপর থেকে বাহাদুরের গলা আবার শোনা গেল, পেয়েছেন তো…?

আমি বললাম, তুমি ওটা আর একটু নামিয়ে দাও।

বাহাদুর আমার কথা শুনতে পেয়ে আর একটু নামিয়ে দিল সেটা।

আমার তখন ঘাম ছুটে যাচ্ছে। আমি প্রথমেই সেটাকে দু’পায়ের আঙুলের টিপনিতে ধরলাম। তারপর দাঁতে করে কামড়ে এক হাত দিয়ে টেনে দু’ হাতে ধরলাম।

এবার যেন একটু হাঁফ ছাড়লাম।

তারপর ভুলেও আর নীচের দিকে না তাকিয়ে সেই লতা ধরে উঠে এলাম ওপরে। ওপরে উঠে দেখলাম শক্ত লতাটাকে একটা গাছের সঙ্গে ভাল করে বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছে বাহাদুর। দিয়ে পাছে বাঁধন খুলে না যায়, তাই বাহাদুর নিজেও সেটাকে ধরে আছে।

আমি ওপরে উঠে আমার জীবনদাতা বাহাদুরকে বেশ কিছুক্ষণ দু’চোখ ভরে দেখলাম। তারপর মাটিতে বসে শুয়ে পড়লাম সটান হয়ে। বুকটা তখনও টিপ ঢিপ করছে। বাহাদুরকে কিছু বলার আগেই সে এসে ম্যাসেজ করে দিল আমাকে। বেশ কিছুক্ষণ ম্যাসেজের পর একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসলাম। আমার পুনর্জন্ম হল।

এখান থেকে দূরে অভিশপ্ত তিড্ডিমের সেই গুহাটাকে দেখা যাচ্ছে। কাল থেকে আজ পর্যন্ত যা ঘটে গেল, তার সবকিছুই আমার কাছে ছায়াছবির দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছে।

বাহাদুর বলল, আমি তো ভাবলাম আর বুঝি ফিরেই পেলাম না আপনাকে।

আমিও ভাবতে পারিনি ওইরকমভাবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাব বলে।

কী ভাগ্যি গাছের ডালটাকে ধরে ফেলেছিলেন।

সবই ভগবানের দয়ায় বাহাদুর। না হলে ওইরকম জায়গায় কখনও গাছ গজায়? তাঁরই কৃপায় আমরা বারবার বেঁচে যাচ্ছি।

আমরা বসে বসে এইসব কথা বলছি। এমন সময় হঠাৎ বাহাদুর একটু শঙ্কিত দৃষ্টিতে কী যেন দেখে বলল, ওই দেখুন বাবু!

দেখেই চমকে উঠলাম আমি। দেখি না আমরা যেখানে বসে আছি ঠিক সেইখানেই একটা ঝোপের ভিতর কী যেন একটা জুল জ্বল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাল করে নজর দিতেই দেখলাম একটা বাঘের বাচ্চা। তবে নেহাত শিশু নয়। ইচ্ছে করলেই আক্রমণ করতে পারে।

বাহাদুর বলল, আপনি ওর চোখে চোখ রেখে চুপ করে বসে থাকুন। তুমি কী করবে?

মারব ব্যাটাকে।

খুব সাবধানে। কাছেপিঠে যদি ওর মা থাকে তা হলে কিন্তু একেবারে শেষ করে ফেলবে আমাদের।

বাহাদুর বলল, সে জানি। বলে পা টিপেটিপে উঠে গেল সে।

আমি বাঘের চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে বসে রইলাম।

একটু পরেই বাহাদুরের ছায়াটা আমার পায়ের কাছে পড়ল। দেখলাম ওর হাতে বড় একটা পাথর। পাথরটা সঙ্গোরে বাঘের মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল বাহাদুর।

এক ঘায়েই কাত। একটু চিৎকার করবারও সময় পেল না বেচারি। মাথাটা একেবারে গুঁড়িয়ে থেঁতো হয়ে গেল। অল্পক্ষণ একটু ধড়ফড় ছটফট করেই স্থির হয়ে গেল বাঘটা আমার ঠিক এভাবে মারার ইচ্ছা ছিল না বাঘটাকে। তবু বাহাদুরকে বাধাও দিলাম না। হাজার হলেও বাঘের বিক্রম। একবার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়লে, আমরা নিরস্ত্র অবস্থায় কিছুই করতে পারতাম না ওর। বেঘোরে প্রাণটা দিতে হত।

এমন সময় দূর থেকে দামামার শব্দ ভেসে এল। দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট একটু কোলাহল।

আমাদের দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। ভয়ে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল বুকের ভেতরটা। আবার মৃত্যুর পদধ্বনি। আবার শত্রুর মুখোমুখি হওয়া। মরণের ডঙ্কা ওইতো বাজছে। দ্রিম… দ্রিম… দ্রিম… দ্রিম।

আমি বাহাদুরের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম।

বাহাদুর এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে এক্ষুনি কী করা উচিত তা ভেবে নিল। আমি বললাম, জংলিরা মনে হয় আমাদের খোঁজেই বেরিয়েছে।

আমারও তাই মনে হচ্ছে। এখন কী করবেন ঠিক করেছেন?

আর পালাবার বৃথা চেষ্টা না করে, এখানেই কোনও একটা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়ব।

আমারও তাই মত। তবে লুকোবার আগে এই পাপটাকে কিন্তু এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

মৃত বাঘটা তখন রক্তাক্ত কলেবরে পড়ে আছে। আমরা আর একটুও দেরি না করে সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিলাম খাদের মধ্যে। না হলে ওটাকে দেখতে পেলেই ওরা হইচই পাকিয়ে আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে। বাঘটাকে লোপাট করে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোপের ভেতর ঢুকলাম। আত্মগোপন করবার এ এক চমৎকার জায়গা। নেহাতই কপালটা মন্দ না হলে বাইরে থেকে কেউ দেখতেই পাবে না আমাদের।

দামামার শব্দটা ক্রমশ কাছের দিকে এগিয়ে আসছে। আর সেই শব্দের প্রতিধ্বনির ঢেউ নাচছে পাহাড়ে পাহাড়ে। চারদিক যেন গমগমিয়ে উঠছে। শুধু কোলাহল আর শব্দের তরঙ্গ।

দ্রিম…দ্রিম…দ্রিম…দ্রিম।

আমরা একদম নড়াচড়া না করে স্থিরভাবে বসে রইলাম। মনে মনে ডাকতে লাগলাম ভগবানকে। প্রতিবারের মতো এবারেও কি ভগবান আমাদের রক্ষা করবেন না?