চার
ততক্ষণে সবাই এসে ঘিরে ফেলেছে আমাকে। সেই কালো কালো বিচ্ছিরি চেহারার জংলিগুলোর চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। পালকি থেকে নেমে এল ওদের সর্দার।
রামদুলালবাবুও এগিয়ে এলেন। যেন আমাকে চেনেনই না, এমন ভান করে মশালটা আমার দিকে তুলে ধরে আমার মুখে আলোকপাত করতে লাগলেন।
জংলিসর্দার এগিয়ে এল আমার কাছে। আমার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিল। তারপর শুরু হল তল্লাসি। আমার কোমরে গোঁজা ছুরি-টর্চ যা ছিল সব কেড়ে নিল। যে আমার বুকে বল্লম ঠেকিয়ে রেখেছিল সর্দার কী যেন বলতেই বল্লমটা সরিয়ে নিল সে।
সর্দার এবার আমার দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে আমার জামার কলার ধরে একটু টান দিয়েই ঠাস করে মারল আমার গালে এক চড়। কী সাংঘাতিক সেই চড়। গাল যেন জ্বলে উঠল।
এবার রামদুলালবাবুকে কী যেন বলল সর্দার।
রামদুলালবাবু কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, কে তুই?
আমি তো বুঝতেই পারছি রামদুলালবাবু আমার সঙ্গে অভিনয় করলেন। উঃ। কী ভুলই না করেছি ওনার কথা না শুনে। বললাম, আমি পথ ভুলে এসে পড়েছি। আপনাদের গুপ্তধনের সন্ধানে আসিনি।
রামদুলালবাবু সেই কথাটা বুঝিয়ে বললেন সর্দারকে।
সর্দার সব শুনে কিছুক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আবার কী যেন বললেন রামদুলালবাবুকে।
রামদুলালবাবু বললেন, সর্দার বলছেন অভিশপ্ত তিড্ডিমে কেউ শখ করে বেড়াতে আসে না। কাজেই পথ হারিয়ে এখানে প্রবেশ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে তোমাকে পরিচয় জানতে চাওয়া হলে তুমি গুপ্তধনের সন্ধানে আসনি এই কথা বলেছ। তার মানে এখানে যে গুপ্তধন আছে তা তুমি জান। আমি আর উত্তর দিতে পারলাম না।
সর্দার নিজে আমাকে সার্চ করতে লাগল এবার। অত যত্নে গুঁজে রাখা সেই ম্যাপটা টেনে বার করল। ম্যাপটা হাতে পেয়েই রাগে ফেটে পড়ল সর্দার। তারপর রামদুলালবাবুকে চিৎকার করে কী যেন বলতেই রামদুলালবাবু বললেন, তুমি থ্যে কথা বলেছ সর্দারকে। এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। কেন না যারা মিথ্যে কথা বলে তারা বিশ্বাসঘাতক হয়।
সর্দার এবার দলের লোকদের কী যেন বলল।
বলতেই সবাই এসে একটা বড় পাথরের থামের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল আমায়। তারপর আবার ওদের যাত্রার জন্য তৈরি হল। দামামা বেজে উঠল দ্রিম দ্রিম করে। আর দামামার তালে তালে শুরু হল সেই অসভ্য নাচ। নাচ আর গান। সর্দার আবার গিয়ে বসল পালকিতে। বাহকরা পালকি বয়ে নিয়ে চলল।
সবাই চলে গেলে একা আমি বন্দি অবস্থায় রয়ে গেলাম সেখানে। আমার ভুলের জন্যই সব কিছু ভেস্তে গেল। পিস্তল, ছুরি, ম্যাপ, টর্চ সব কিছু খোয়ালাম। নিজেও পড়লাম জংলিদের খপ্পরে। এখন আর আমার নিস্তার নেই।
রামদুলালবাবুর কথা শুনলে তাঁর সাহায্যেই গুপ্তধনের সন্ধানও পেয়ে যেতাম। এখন একমাত্র মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমার। এখন আমি নিরস্ত্র। আমি অসহায়।
ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? কী করবে? কীভাবে রাখবে? তার কিছুই আমি জানি না। এদের অসাধ্য যে কিছু নেই শুধু এইটুকুই জানি আমি।
এমন সময় হঠাৎ দূর থেকে একটা ক্যা ক্যা শব্দ ভেসে এল। সেই পাখিটার কণ্ঠস্বর। পাখিটা চিৎকার করছে। একটানা একঘেয়ে। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম দু’জন জংলি বল্লম উঁচিয়ে তিরবেগে ছুটে গেল আমার পাশ দিয়ে। তাদের সঙ্গে মশাল হাতে রামদুলালবাবুও গেলেন। যাবার সময় একবার শুধু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, কেমন হয়েছে? এবার মরো। বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুই হচ্ছে উপযুক্ত পুরস্কার।
আমি মাথা হেঁট করলাম।
খানিকবাদেই দেখলাম একটা লোককে টেনেহিঁচড়ে মারতে মারতে নিয়ে আসছে ওরা। কে ও? আরে, এ যে বাহাদুর! বাহাদুরকে দেখে আমার বুকে যেন হাজার গুণ বল ফিরে এল। আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, বাহাদুর!
বাহাদুরও আমাকে দেখে চমকে উঠল, বাবু ! আপনি এখানে? আমি বন্দি।
জংলিদুটো ততক্ষণে বাহাদুরকে নিয়ে এসে আর একটা থামের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলল।
রামদুলালবাবু আমাদের সামনে এসে মশালের আলোটা মুখের কাছে তুলে ধরে হো হো করে হেসে উঠে বললেন, কী ভায়ারা, গুপ্তধন নেবে নাকি?
আমি বিনীত ভাবে বললাম, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন রামদুলালবাবু। আপনার কথা না-শুনেই এই কাল ঘটিয়েছি আমি।
রামদুলালবাবু বললেন, আমি তোমাকে একবার সুযোগ দিয়েছি। আর নয়।
অভিশপ্ত তিড্ডিমে শাতকর্ণি গুহায় গুপ্তধন নিতে এসে আজ পর্যন্ত কেউ ফিরে যায়নি। তোমরাও ফিরবে না। তোমরা মৃত্যুর জন্য তৈরি হও।
বাহাদুর ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে তখন। বলল, আপনার দুটি পায়ে পড়ি। আমাদের ছেড়ে দিন। আপনি বিশ্বাস করুন আমরা গুপ্তধনের ব্যাপার কিছুই জানি না। গুপ্তধন নিতেও আসিনি আমরা।
রামদুলালবাবু আবার গুহা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন, তোমরা গুপ্তধন নিতেই এসেছ। তোমরা না বললে কী হবে। তবে জেনে রাখো, এই গুপ্তধন তোমরা পাচ্ছ না। পাবে না। আমি এর মালিক। আমি একে বাইশটা বছর ধরে আগলে রেখেছি। আমি মরে গেলেও যক্ষ হয়ে এর ভেতরে বসে এই গুপ্তধন আগলাব। তোমাদের মতো আরও যারা এই গুপ্তধন নিতে আসবে, আমি তাদের প্রত্যেককে গলা টিপে মারব।
আমরা সব শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রামদুলালবাবু জংলিদুটোকে নিয়ে চলে গেলেন।
রামদুলালবাবু চলে গেলে বাহাদুরকে বললাম, কী কুক্ষণেই না তিড্ডিমে এসেছিলাম।
এ দোষ আপনার নয় বাবু। আমার। আমিই তো আপনাকে এখানে এনেছিলাম। তবে আমি কিন্তু এই গুহার বিপজ্জনক পরিণতির কথা জানতাম না। এটাকে একটা সাধারণ গুহা বলেই জানতাম। কখনও ঢুকিওনি এর ভেতর।
না এর ভেতরে ঢুকতে যাব, না এই কাণ্ডটা হবে। আমার জন্যে তুমিও বিপদে পড়লে।
আমি আপনাকে খুঁজতে এসেই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাই।
এইটাই তো এ গুহার রহস্য।
তারপর এক জায়গায় আসতেই দেখি শুধু জল আর জল। এমন সময় কোথা থেকে একটা হতচ্ছাড়া সর্বনাশা পাখি, উঃ কী ভীষণ তার চেহারা। অমন পাখি আমি জীবনে দেখিনি। পাখিটা আমার ছোঁ মেরে তুলে নিল। তারপর এক জায়গায় নামিয়েই শুরু করল তার চিৎকার। অমনি জংলিদুটো এসে ধরে ফেলল আমাকে।
আমিও ঠিক ওইভাবেই এসেছি বাহাদুর। তবে আমার অবশ্য বাঁচবার উপায় ছিল। কিন্তু আমি নিজেই তা নষ্ট করেছি। আমি বাঁচলে তোমাকেও বাঁচাতে পারতাম। এখন আমরা দু’জনেই মরব।
বাঁচতে আমাদের হবেই বাবু। যেমন করেই হোক। এভাবে বেঘোরে প্রাণ দেওয়াটা মোটেই উচিত হবে না।
কী করে বাঁচবে?
বুদ্ধির জোরে। বাঁচবার কৌশল একটা বার করতেই হবে। অসম্ভব।
আমার কোমরে একটা ছুরি আছে। সেটা যে করেই হোক বার করে ওরা আসবার আগেই আমাদের বাঁধন খুলে ফেলতে হবে। তারপর আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। যেমন করেই হোক পালাতে হবে।
কোথায় পালাবে বাহাদুর? এ গোলক ধাঁধার রাস্তা তো আমাদের জানা নেই। তা ছাড়া আমরা নিরস্ত্র। ওদের সঙ্গে পেরে উঠব কেন?
বাহাদুর হতাশ হয়ে বলল, সবই জানি। তবুও একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? ধরা যখন পড়েছি মরতে তখন হবেই। তবুও বিপদের মুখোমুখি হয়ে বাঁচার চেষ্টা করব না কেন?
সবই বুঝলাম। কিন্তু তোমার কোমরের ছুরি কী করে বার করব? দু’জনেই তো বাঁধা।
আপনি এক কাজ করুন।
কী করব বলো?
হাত দুটোই বাঁধা আছে আমাদের। পা তো বাঁধা নেই। কোনওরকমে পায়ে করে আমার কোমর থেকে ছুরিটা বার করার চেষ্টা করুন।
বাহাদুরের যুক্তিটা আমার নেহাত মন্দ বলে মনে হল না। আমি অতিকষ্টে পাদুটো তুলে বাহাদুরের কোমর থেকে ছুরিটা বার করবার চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। পায়ের আঙুল কোনওরকমে ওর কোমরের কাছ অবধি গেল বটে, কিন্তু আসল জিনিসের নাগাল পেলাম না। আবার চেষ্টা করলাম। বার বার করলাম। বাহাদুরকে বললাম, তুমি একটু কাত হয়ে বেঁকে দাঁড়াও তো।
বাহাদুর একটু সরবার চেষ্টা করল। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে প্রাণপণে দেহটা টান টান করে আমার দিকে যতটা সম্ভব নিজেকে এগিয়ে দিল।
আমি আমার পায়ের আঙুলে করে ওর ছোরার বাঁটটা একটু টেনে ধরলাম। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর ওর হাতে দিতে পারলাম সেটা।
ততক্ষণে দূর থেকে আবার সেই দামামার শব্দ ভেসে আসছে। বাহাদুর ! কুইক। আর দেরি কোরো না।
বাহাদুর সত্যিই দেরি করল না। পিছন থেকে অদ্ভুত কায়দায় নিজের বাঁধন কেটে নিল।
ডিম দ্রিম শব্দ তখন কাছের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে ভেসে আসছে জংলিদের বর্বর ভাষায় বিচিত্র সুরের গান।
নিজের বাঁধন কেটেই বাহাদুর আমাকে বাঁধন মুক্ত করল। বাঁধন মুক্ত হয়ে যে পথে আমরা এসেছিলাম সেই পথেই দৌড় দিলাম দু’জনে। ছুটতে ছুটতে আবার সেই বারান্দার কাছে এসে পড়লাম। কিন্তু পথ কোথায়! কোন দিকে পথ? এদিকে আমাদের দেখতে পেয়েই সেই ভয়ংকর পাখিটা আবার চিৎকার শুরু করে দিয়েছে।
বাহাদুর বলল, বাবু সাঁতার জানেন তো?
জানি।
তা হলে আর কোনও কথা নয়। এখুনি এই জলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন। তারপর স্রোতে ভেসে যতদূর পারি চলে যাব।
আমি অত বিপদেও হাসলাম। বললাম, কোনও লাভ হবে না বাহাদুর। কেন!
যাবার পথ নেই।
সে কী! এত জল তা হলে যাচ্ছে কোথায়! এই জল নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও জায়গা দিয়ে পাশ করছে।
করছে। খুব সামান্য ফাঁক আছে এক জায়গায়। সেইখান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে জল। আমি আসবার সময় দেখেছি। কিন্তু সে ফাঁক এতই সামান্য যে, সেখান দিয়ে জলই শুধু বেরোতে পারে কোনও মানুষ নয়।
পাখিটা সমানে চিৎকার করছে তখন।
আর পাখির চিৎকারকে ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে দ্রিম দ্রিম দামামার শব্দ। সেই সঙ্গে দ্রুত ছুটে আসা কতকগুলো পায়ের আওয়াজ।
মশালের আলোয় অন্ধকারও ফিকে হয়ে আসছে।
বাহাদুর হঠাৎ একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, বাবু! ওই দেখুন—
চেয়ে দেখি বারান্দার এক কোণে বহুদিনের পুরনো বড় বড় ঢাকের মতো কতকগুলো দামামা সারি দেওয়া আছে।
বাহাদুর বলল, আপাতত এর ভেতরেই আত্মগোপন করা যাক।
তাই চলো।
আমরা আর কাল বিলম্ব না করে একটা দামামার ভেতর ঢুকে পড়লাম দু’জনে। ভেতর থেকে বাইরের অবস্থা কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু অনুমানে বুঝতে পারলাম ওরা এসে চারদিকে ছুটোছুটি করছে সকলে। মশালের আলোয় লাল হয়ে উঠেছে চারদিক। এমন সময় হঠাৎ আমার চুলের মুঠিটাকে ধরে কে যেন টান দিল।
সোজা উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম আগুনচোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে জংলিসর্দার। যাঃ। এত কাণ্ড করেও ধরা পড়ে গেলাম। বাহাদুরও ধরা পড়ল। আমরা সেই ভাঙা দামামার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম দু’জনে।
জংলিসর্দার কী যেন বলল বিড় বিড় করে।
রামদুলালবাবু এগিয়ে এসে বললেন, তোমাদের মুক্তি নেই। সর্দারের আদেশ।
সর্দার আবার কী যেন বলল।
রামদুলালবাবু বললেন, আজ থেকে তিন দিন পরে দেবী নাগেশ্বরীর কাছে বলি দেওয়া হবে তোমাদের।
বাহাদুর, আমি দু’জনেই কাঁপছি তখন। আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। সর্দারের ইঙ্গিতে দু’জন জংলি এগিয়ে এল এবার। তারপর আমাদের চোখ বেঁধে পিছন মুড়ে হাত বাঁধল। বাহাদুরের কাছে যে ছুরিটা ছিল সেটাও কেড়ে নিল ওরা।
আমি এবার ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত সচেতন হলাম। কেন না আবার যদি কোনওরকমে এদের খপ্পর থেকে পালাতে পারি, তা হলে পালাবার পথ খুঁজে বার করতে মানে আবার ঠিক এইখানেই যাতে ফিরে আসতে পারি, সে সম্বন্ধে সজাগ রইলাম। এরা যে ভাবে আমাদের নিয়ে যাবে প্রতিটি পদক্ষেপ, ঠিক সেই ভাবে স্মরণে রাখতে হবে! অর্থাৎ কীভাবে কতটা পথ যাচ্ছি মনে রাখতে হবে সেটা।
ওরা আমাদের যেতে বলল।
প্রথমেই ডানদিকে ঘুরলাম। তারপর চললাম পা মেপে বিশ পা। বুঝলাম বারান্দা ধরেই চলেছি। এবার ঘরঘর শব্দ করে কী যেন সরে গেল একটা। একটু শীতল হাওয়া বয়ে গেল শরীরের ওপর দিয়ে। এক-পা এক-পা করে নীচে নামতে লাগলাম। নামছি তো নামছিই। একেবারে একশো ধাপ নামলাম। বাঁদিকে ঘুরলাম। বিশ পা গেলাম। একটা ঘরের ভেতরে ঢোকাল ওরা। সর্দার কী যেন বলল। কথাটা বুঝতে পারলাম না। একজন এসে আমাদের বাঁধন খুলে দিল।
দেখলাম একটা ছোট্ট ঘরে ওরা নিয়ে এসেছে আমাদের। ঘরের বাইরে গিস গিস করছে একদল কালো ভূতের মতো চেহারার জংলি। গায়ের গন্ধে ভূত পালাবে এমন বোটকা গন্ধ তাদের। বিটকেল বিচ্ছিরি বিদঘুটে।
সর্দার আমাদের দিকে উল্লসিত চোখে তাকাল। তাতে আর সেই আগুনের হলকা নেই। যা আছে তা হ’ল অনাবিল আনন্দ। হাতের শোল ফসকে গিয়ে আবার ধরা পড়লে যে আনন্দ হয়, ঠিক সেইরকম আনন্দ।
আমরা ভয়ে ভয়ে তাকালাম।
চিড়িয়াখানায় আমরা যেমন জন্তু-জানোয়ার দেখি—ওরাও ঠিক সেইভাবে দেখছে আমাদের। সর্দার হাতে তালি দিতেই একজন এসে দাঁড়াল। তাকে কী যেন বলল সর্দার। জংলিটা একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে চলে গেল।
একটু পরেই দুটো পাত্রে দুধ আর একছড়া কলা নিয়ে এসে আমাদের সামনে ধরে দিল জংলিটা। সেই বড় বড় রামকলা। দেখলে লোভ হয়। কিন্তু একটা কি দুটোর বেশি খাওয়া যায় না।
আমি তো রামদুলালবাবুর কাছে আগেই খেয়েছিলাম। তাই আর খেলাম না। বাহাদুরকে বললাম, তুমি খেয়ে নাও বাহাদুর। আমি আগেই খেয়েছি। বাহাদুর কোনও কথা না বলে খেতে শুরু করে দিল।
আমাদের ঘরটা এতক্ষণ মশালের আলোতে উদ্ভাসিত ছিল। এবার একটা বড় প্রদীপ জ্বালানো হল ঘরের ভেতর। প্রদীপের ভেতর একজন পাতলা চ্যাটচেটে কী একটা জিনিস ঢেলে দিল। তেল কি ঘি, কি অন্য কিছু তা এরাই জানে। আমরা শুধু বলির মানুষ দু’জন সবকিছু দেখতেই লাগলাম।
গুহার এমন গভীর প্রান্তেও কী করে যে অক্সিজেন আসছে তা ভেবে পেলাম না। সকাল না হলে রাতের অন্ধকারে বোঝা যাবে না কিছুই। তবে ভেতরটা বেশ ঠান্ডা। যেন শান্তির শীতলতা বিরাজ করছে সর্বক্ষণ।
বাহাদুরের খাওয়া হলে দু’জন জংলি এসে আমাদের বেঁধে ফেলল।
সর্দার এবার হাত তুলে আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আখোবা’। অর্থাৎ ওদের ভাষায় শুভরাত্রি। তারপর দরজা বন্ধ করে চলে গেল সকলে।
বাহাদুর আর আমি অসহায় বন্দি দু’জন সকালের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। তিনদিন পরেই তো আমাদের ছিন্ন শির লুটিয়ে পড়বে দেবী নাগেশ্বরীর পায়ে। তাই কানখাড়া করে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনবার আশায় রইলাম। মনে মনে ভগবানকেও ডাকতে লাগলাম। এই তিনদিনের ভেতর অভিশপ্ত তিড্ডিমের এই গুহা থেকে মুক্তি কি আমরা সত্যিই পাব না?