তিন
ভগবান আমাকে আর কিছু দিন বা না-দিন বিপদে সাহস হারাতে দেননি কখনও। তাই এত বড় বিপদেও ঘাবড়ে গেলাম না।
এক হাতে টর্চ যেমন ধরা ছিল, তেমনি ধরাই রইল। অপর হাতে পিস্তল বার করে গুলি করবার জন্য তৈরি হলাম।
এই পাখিটা যে পথে আমাকে নিয়ে চলেছে, সেই পথই হয়তো আমার মুক্তির পথ। এই পথে গেলেই হয়তো গুহার বাইরে আমি যেতে পারব। কিন্তু এই বিশাল গহ্বরের শেষ কোথায়?
পাখিটাকে তাগ করে পিস্তল উঁচিয়ে সবে গুলি করতে যাচ্ছি, এমন সময় পাখিটা আমাকে বড় একটা পাথরের ওপর নামিয়ে দিয়ে ক্যা ক্যা করে একবার এ দেওয়াল, একবার ও দেওয়ালে বসতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য! আমাকে সে আক্রমণই করল না।
আমি টর্চের আলো ফেলে চারদিক দেখতে লাগলাম।
দেখলাম সেই জলরাশি কতকগুলো বড় বড় পাথরের ফাঁক দিয়ে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সে ফাঁক এত সংকীর্ণ যে, সেখান দিয়ে জল গলতে পারে, কোনও মানুষ নয়।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এই রহস্যময় গুহার ভেতরে বন্দি হয়ে যত না ভয় পেলাম তত বিস্মিত হলাম। কেন না এই বিশাল গহ্বরে যেখানে পালাবার সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে আছে, সেখানে এই অতিকায় পাখি এলই বা কী করে, আর ওই অজস্র প্রদীপ জ্বেলে এই স্রোতে ভাসাচ্ছেই বা কারা? সবচেয়ে আশ্চর্য এই, পাখিটা আমার ক্ষতি না করে চিৎকারই বা শুরু করল কেন? ভূতপ্রেত মানি না। কাজেই ব্যাপারগুলো ভুতুড়ে ভাবতেও ইচ্ছে হল না। অথচ এ যা ঘটল তাকে ঠিক ভৌতিক অঘটন ছাড়া কী-ই বা বলতে পারি?
আমি পাখিটার গায়ে আলো ফেলে দেখলাম পাখিটা একটা পাথরের খাঁজ নখে করে আঁকড়ে বসে বসে হাঁফাচ্ছে। যখন বুঝলাম তার দিক থেকে আমাকে আক্রমণের কোনও আশঙ্কাই নেই, তখন একটু নিরাপদ স্থান দেখে যেখানে জল নেই, এমন একটা শুকনো জায়গায় বসে পকেট থেকে সেই ম্যাপখানা বার করলাম। যে ম্যাপ কিছুক্ষণ আগে সেই কঙ্কালদুটোর ব্যাগ থেকে বার করেছি। ম্যাপটা মেলে ধরে দেখলাম তার পিছন দিকে খুব ছোট ছোট অক্ষরে
কতকগুলো কথা লেখা আছে। অনেক চেষ্টার পর সেই লেখাটা আমি পড়তে পারলাম।
পরিষ্কার বাংলায় লেখা, ‘অভিশপ্ত ভিড্ডিমে’র গুহার জঠরে অন্ধ্রের শাতবাহন সাম্রাজ্যের রাজা শাতকর্ণি আশ্রয় নিয়েছিলেন। মণি-মাণিক আর হিরা জহরতে গুহার গোপন কক্ষ ঠাসা। অতিকায় পাইথন আর বিষধর সাপেরা সেই গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে। এই গুহা সাধারণ মানুষের কাছে একটা গোলকধাঁধা। এই গুহার ভিতর একটি ঝরনা ও সপ্তনদীর অসংখ্য গতিপথ আছে। গুহার পশ্চিমদিকে জংলিদের বাস। দেবী নাগেশ্বরীর উপাসনা করে তারা। সন্ধ্যায় মায়া নদীর জলে প্রদীপ ভাসায়। এই প্রদীপ ভাসানোকে ওরা দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের প্রতীক বলে মনে করে। এই প্রদীপ নদীর গতিপথ ধরে ভেসে ভেসে শাতকর্নি গুহায় প্রবেশ করে এবং জলস্রোতে প্রপাতে পড়ে। এই জলপ্রপাত ইতিহাস বিখ্যাত নয়। তবে এই প্রপাতের জল নদীর আকারে প্রবলপ্রবাহ ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে। রাজা শাতকর্ণির এই গুপ্তধনের সন্ধানে এসে বহু প্রাণ বিষধর সাপের দংশনে অথবা পাইথনের গর্ভে লীন হয়ে গেছে। জংলিদের হাতে ধরা পড়েও মরেছে অনেকে। পরিপূর্ণভাবে মানচিত্রজ্ঞান না-রেখে এই গুহায় প্রবেশ করা কারও উচিত নয়। যদি কোনও ভাগ্যবান এই ম্যাপ ধরে ঠিক পথে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে গিয়ে গুপ্তধনের সন্ধান পায়, তবে সেই ভাগ্যবান নিজেই যে শুধু ধন্য হবে তা নয়, ইতিহাসের এক অজ্ঞাত অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সে আবিষ্কার করতে পারবে। মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পা নগরীর ধ্বংসাবশেষের আবিষ্কারকের মতো তার নামও অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। জনৈক হতভাগ্য অভিযাত্রী। পাশে তারিখ দেওয়া আছে ২।৯।১৯৪০।
আমি একাগ্রচিত্তে সেই লেখাটা একাধিকবার পড়লাম।
তারপর ম্যাপটার ওপর টর্চের আলো ফেলে খুঁজতে লাগলাম আমার পালাবার পথ। দরকার নেই গুপ্তধনের। প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু পালাব কী করে? এই জলরাশি কী করে পার হব?
এমন সময় হঠাৎ আমার গায়ের ওপর কী যেন একটা এসে পড়ল। আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর বিস্ময়ের ঘোর কাটলে দেখলাম খুব মোটা একটা শক্ত দড়ি। দড়িটা টেনে দেখলাম। বুঝলাম ছেঁড়বার ভয় নেই। এই দড়ি ধরে আমি ওপরে উঠতে পারব। কিন্তু উঠব কোথায়। ওপরে তো ছাদ। অথচ দড়িটা যে কীভাবে এল, তাও বুঝতে পারছি না।
যাক। মরেছি না মরতে বাকি আছি। উঠে তো পড়ি। এই ভেবে দড়ি ধরে আমি ক্রমশ ওপরে উঠতে লাগলাম।
কিছুটা ওঠার পরই দেখলাম এক জায়গায় বারান্দার মতো চওড়া একটু অংশ রয়েছে। সেইখানে দেখলাম একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি ও ঝাঁকড়া চুলের বাঘছাল পরা একজন বলিষ্ঠ লোক দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে ছোট্ট একটা প্রদীপ জ্বলছে। যেন বিভীষিকার মতো থম থম করছে চারদিক।
আমি তাকে কিছু বলার আগে সে-ই ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলল।
তারপর আমার হাত ধরে মৃদু একটু টান দিয়ে আমাকে নিয়ে চলল তার সঙ্গে। আমি তাকে দেখে খুবই অবাক হয়ে গেলাম যদিও, তবুও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকেই অনুসরণ করলাম। কেন জানি না তার হাবভাব দেখে মনে হল, এ আমার কোনও ক্ষতি করবে না।
তার পিছু পিছু খানিক যাবার পর দেখলাম এক জায়গায় ধাপে ধাপে কয়েকটা সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে আগুপিছু আমরা নামতে লাগলাম।
কয়েক ধাপ নামার পরই দেখলাম দূর থেকে আলোর রেখা ভেসে আসছে। নামতে নামতে আলোটা স্পষ্ট হল। একটা প্রশস্ত ঘরের ভেতর ঢুকলাম। তারপর আর একটা। তারপর আরও একটা।
একেবারে শেষঘরে গিয়ে লোকটি বলল, এই ঘরে আপনি থাকবেন। আপনি নিশ্চয়ই একা এসেছেন?
না দু’জন। অবশ্য এখন আমি একা।
লোকটি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, যাক। ভালই হয়েছে। বাইশ বছর এই গুহার ভেতর আছি। একটিও কথা বলবার লোক পাইনি। বাকি জীবনটা দু’বন্ধুতে কোনওরকমে গল্প করতে করতে কাটিয়ে দেব। আমি অবাক হয়ে বললাম, তার মানে?
আপনাকে মরতে আমি দিচ্ছি না। শুধু আমার কথামতো যদি চলেন, আর পালাবার চেষ্টা যদি না করেন, তা হলে বেঘোরে প্রাণ হারাবার কোনও ভয় নেই।
আমার হাত-পা যেন অবশ হয়ে এল। বললাম, কী বলতে চান, আপনি? বলতে চাই যে এর ভেতর একবার যখন এসে ঢুকেছেন, তখন আর আপনার মুক্তি নেই। তিড্ডিমের অভিশাপ হচ্ছে এই গুহা। এখানে ঢুকলে হয় মৃত্যুকে বেছে নিতে হবে, নয় সারাজীবন বন্দি হয়ে থাকতে হবে আমার মতো। আমি মৃত্যুকেই বেছে নেব। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল।
লোকটি যেন চমকে উঠল, সে কী!
হ্যা। ঠিকই বলছি।
আপনি গুপ্তধন নেবেন না? আপনার মতো আমিও গুপ্তধনের সন্ধানে এসেছিলাম। এখন আমি গুপ্তধনের মালিক। রাজা শাতকর্ণির সমস্ত ধন এখন আমার হাতের মুঠোয়। আমি এখন রাজা, বুঝেছেন?
আমি বুঝতে পারলাম না লোকটার মাথা খারাপ কি না।
লোকটি হঠাৎ বলল, ওঃ হো। আপনার তো কিছুই খাওয়া হয়নি। নিন, রাত অনেক হয়েছে। আপনি যা হোক দুটো খেয়ে নিন। কিন্তু সাবধান। আমি না বললে এখান থেকে নড়বেন না। আমি কথা না বললে কথা বলবেন না। ওরা জানতে পারলে একেবারে শেষ করে ফেলবে।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কারা?
ওরা হল এই পাহাড়পুরীর যক্ষ। আপনার আমার মতো গুপ্তধনের লোভে যারা আসে, ওরা তাদের বন্দি করে। যারা পালাতে যায় তারা মরে। যারা কথা শুনে টিকে থাকে, তারা বাঁচে। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন? আজ পর্যন্ত কেউই এখানে টিকে থাকেনি। কেউ বাঁচেনি, বহুকষ্টে আমিই টিকিয়ে রেখেছি নিজেকে। এই পাহাড়পুরীর যক্ষ হয়ে আছি আমি। তবেই আমি জানতে পেরেছি সেই ধনরাশি কোথায় কীভাবে আছে।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, কোথায় আছে?
দেখাব দেখাব সব দেখাব। বলতে বলতে লোকটা চলে গেল ঘর থেকে।
আমি অসহায় ভাবে একা বসে রইলাম ঘরের ভেতর। ভাবতে লাগলাম আকাশপাতাল। এখান থেকে তবে কি সত্যিই আমার মুক্তি নেই? তা যদি হয় এর মতো এই আজীবন বন্দিদশা আমি মেনে নেব না। যেমন করেই হোক আবার বাইরের জগতে পালাবার চেষ্টা করব। একান্ত না পারি…।
হাতের পিস্তলটা একবার কপালে ঠেকালাম। প্রত্যেকটি গুলিই এখনও অবশিষ্ট আছে। কয়েকটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য খরচ করে শেষেরটি নিজের মৃত্যুর জন্য খরচ করব। তাড়াতাড়ি কিছু করতে যাব না। দেখিই না ঘটনার গতি কোনদিকে যায়। বাহাদুর আমাকে বাঁচাতে পারে কিনা। হাফলঙে ফিরে গিয়েও সে কী আমাকে উদ্ধার করবার জন্য লোকজন নিয়ে আসবে না?
লোকটি আবার ঘরে ঢুকল। এই লোকটাকেই এখন মূর্তিমান বিভীষিকা বলে মনে হচ্ছে। ঝাঁকড়া চুল, গোঁফ-দাড়ি। উঃ কী ভয়ংকর। তার ওপর একটা বাঘের ছাল পরে আছে। লোকটির হাতে কয়েকটা রামকলা আর একটা পাত্রে দুধ। সেগুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলল, নাও। খেয়ে নাও। তোমাকে আর আপনি আজ্ঞে নয়। এবার থেকে তুমিই বলব।
আমি হেসে বললাম, বেশ, তাই বলবেন। আপনি তো আমার চেয়ে অনেক বড়।
অনেক মানে, তোমার ছাব্বিশ-সাতাশ, আমার বাহান্ন।
আজ্ঞে আমার আঠাশ বছর বয়স।
ওই একই হল। ভাগ্য ভাল যে ওদের হাতে পড়নি। আমার যেতে আর একটু দেরি হলেই এসে পড়ত ওরা। পাখিটার চিৎকার শুনেই বুঝেছি শিকার জুটেছে। তাই তো এগিয়ে গেলাম। ভগবান রক্ষে যে ওরা ছিল না এই সময়।
আমি বললাম, খুব বাঁচিয়েছেন আপনি। কিন্তু কী পাখি বলুন তো ওটা?
তা কি আমিও জানি? তবে ও পাখি এখন আর দেখা যায় না। ওই পাখিটাও আমার মতো মুক্তি চাইছে। কিন্তু কে দেবে ওকে মুক্তি? কত বছর যে এখানে আছে ও, তাও জানি না। আমাকে ঠিক তোমাকে যেভাবে এখানে নিয়ে এসেছে সেই ভাবেই এনেছিল। শুধু দুধ আর ফল খায়। কবে কোন শিশুকালে এর ভেতরে ঢুকে পড়েছিল কে জানে? দেহটা এখন অসম্ভব বড় হয়ে গেছে। মানুষ দেখলেই চিৎকার করে। হয়তো বা ওর ভাষাতে বলে তোমরা আমাকে মুক্তি দাও।
আমি কলা খেয়ে, দুধে চুমুক দিলাম। কী দুর্গন্ধ দুধে। খেতেই গা গুলিয়ে উঠল।
তিনি বললেন, খাও। দু’-একদিন অমন লাগবে। তারপর সয়ে যাবে। পাহাড়ি গাইয়ের দুধ তো। তাই একটু গন্ধ।
দুধ আর কলায় পেট বেশ ভরে উঠল।
আমার তৃপ্তি দেখে উনি হাসলেন। মৃদু, প্রসন্ন হাসি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তা হলে বাইশ বছর আছেন এখানে? হ্যাঁ। দু’মাস সতেরো দিন বেশি। ক্যালেন্ডার না থাকলেও পাথরের গায়ে দাগ দিয়ে আমি হিসেব রেখেছি।
আপনি দেখছি অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট। কী নাম আপনার?
আমার নাম রামদুলাল সেন। বাড়ি ছিল রানিগঞ্জে।
কে কে আছে বাড়িতে?
কী করে জানব? মা ছিল, বাবা ছিল, দাদা ছিল। বিয়ে তো করিনি। কাজেই এখন আর কেউ-ই নেই।
আপনি এখানে কী করে এলেন?
সে অনেক কথা। শুনতে চাও?
বলুন না?
আমার বয়স তখন তিরিশ বছর। আমার এক বন্ধু ছিল। তার নাম দীপঙ্কর। দীপঙ্করের বাবা কোলিয়ারির মালিক ছিলেন। ভদ্রলোক হঠাৎ কীভাবে যেন জানতে পারেন তিড্ডিমের এই গুহার কথা। তিনি তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে এখানে গুপ্তধনের সন্ধানে আসেন। কিন্তু সেই আসাই শেষ আসা। তাঁকে আর ফিরে যেতে হয়নি। দীপঙ্কর ও আমি তাঁর পুরনো ডায়েরি পড়ে সেকথা জানতে পারি। এবং আমরাও তাঁদের খোঁজে গুপ্তধনের সন্ধানে এখানে আসি। কিন্তু এখানে এসে আজপর্যন্ত ফিরে যেতে তো পারেনি কেউ। তাই আমরাও পারলাম না। বেরোবার পথ না-জেনে এখানে এসেছিলাম। তাই গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে বন্দি হয়েছি। ওই পাখিটাই ওদের হাতে তুলে দিয়েছে আমাদের। জংলিদের কথা শুনে আমি বাধ্য হলাম, তাই বাঁচলাম। দীপঙ্কর পালাতে গেল, তাই মরল। কথাগুলো শেষ করে রামদুলালবাবু আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন, খবরদার পালাতে যাবে না।
এমন সময় হঠাৎ দ্রিম দ্রিম দামামার শব্দে ভেতরটা গমগমিয়ে উঠল। উঃ! সে কী দারুণ শব্দ! সেই সঙ্গে এক বিদঘুটে জংলি গান। আলোয় ভরে উঠল চারদিক।
রামদুলালবাবু ঠোঁটে তর্জনী রেখে ‘হিসস্’ করে আমাকে চুপ করতে বললেন। তারপর বললেন, আমি না-আসা পর্যন্ত তুমি এখানে দেওয়াল ঘেঁসে লুকিয়ে থাকো। একদম বেরিয়ো না। বেরোলেই মরবে।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কারা?
ওরা এই গুহার যক্ষ। রাজা শাতকর্ণির গুপ্তধন ওরা পাহারা দেয়। এমনি, কারও ক্ষতি করে না। কিন্তু কেউ গুপ্তধন নিতে এলে তাকে ফিরে যেতে দেয় না। ওদের দেবী নাগেশ্বরীর কাছে তাকে বলি দেয়। প্রতি রাত্রে ওদের সর্দার আসে গুহায় আরতি করতে।
দামামার শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এল।
আমি বললাম, তাই যদি হয় তবে ওরা আপনাকে বলি দেয়নি কেন? আমি ওদের বিশ্বাস উৎপাদন করেছি। এবং এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করিনি তাই।
কেন করেননি?
ওদের নজর এড়িয়ে পালাতে পারতাম না বলে। যাক, ওসব কথা পরে হবে। এখন নয়। এখন পালাবার সুযোগ পেলেও আর আমি পালাচ্ছি না। গুপ্তধনের সন্ধানে এসেছিলাম। গুপ্তধন পেয়ে গেছি। এই অতুল ধনরাশি, এই কুবেরের ঐশ্বর্যের আমি এখন মালিক। এসব ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারি?
দামামার শব্দে ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই সঙ্গে ভেসে আসছে বিচিত্র সুরের বিদঘুটে জংলি গান।
ওরা যত এগিয়ে আসছে আমার বুকের স্পন্দন ততই দ্রুত হচ্ছে। উঃ, কী দারুণ সর্বনাশের পথেই না পা দিয়েছি। কেন যে ঢুকতে গেলাম এই পাপ-গুহার ভেতরে। এদের হাত থেকে কতদিন আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখব?
রামদুলালবাবু ইশারায় আমাকে লুকিয়ে থাকতে বলে চলে গেলেন জংলিদের কাছে। তারপর একটা মশাল হাতে ওদের সঙ্গেই এগিয়ে চললেন।
আমি পিস্তলটা বার করে হাতের মুঠোয় বাগিয়ে ধরলাম। তারপর খুব সন্তর্পণে চুপি চুপি আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখলাম ওদের।
চেহারা দেখেই বুক শুকিয়ে গেল। যেন মূর্তিমান যমদূত সব। কালো কালো বেঁটে বেঁটে চেহারা। কিম্ভুতকিমাকার। মাথায় পালকের টুপি। পরণে বাঘ অথবা হরিণের ছাল। ভালুকের চামড়াও পরেছে কেউ। গলায় বিভিন্ন ধরনের তবলকির মালা। মালার মাঝখানে একটি করে নরমুণ্ডের করোটি।
জনা-বিশেক জংলি রয়েছে। কারও হাতে মশাল! কারও হাতে বর্শা। কেউ দামামা বাজাচ্ছে। কেউ নেচে নেচে গাইছে। চারজনে একটা পালকিও কাঁধে নিয়েছে। ওর ভেতরেই বসে আছে ওদের সর্দার। একবার একটু দেখতে পেলাম। তাতেই দেখলাম কী বিচ্ছিরি চেহারা ব্যাটার।
রামদুলালবাবুর নিষেধ সত্ত্বেও আমি আড়াল থেকে সরে এসে ওদের পিছু নিলাম। দেখিই না কোথায় যায়! কোনখানে গুপ্তধন আছে? হাতে যখন পিস্তল আছে তখন ভয়টা আমার কী?
যেমন করেই হোক এদের খপ্পর থেকে পালাতে হবে। সঙ্গে যখন ম্যাপ আছে তখন পালাবার রাস্তা পাবই পাব। আমি নিঃশব্দে ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম। এমনভাবে দেওয়ালের গা ঘেঁষে চললাম যাতে কেউ না টের পায়।
হঠাৎ এক জায়গায় এসে জংলিরা থেমে পড়ল। গান বন্ধ হয়ে গেল। দামামার শব্দও থেমে গেল। চোখের পলকে একটা জংলি ভয়ংকর মূর্তিতে ছুটে এল আমার দিকে। তারপর বর্শার তীক্ষ্ণ ফলাটা আমার বুকে ঠেকিয়ে পৈশাচিক হাসি হেসে উঠল হোঃ হোঃ করে। আমার হাত-পা থর থর করে কাঁপতে লাগল। কী করে যে কী হয়ে গেল তা ভেবেই পেলাম না। বর্শার খোঁচাটা বড্ড লাগছে। বুকের ভেতর গিঁথে যাবে নাকি?