দুই
সূর্য তখন কাছেরই একটা পাহাড়ের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। সন্ধ্যা আসন্ন হলেও দিনের আলো একেবারে মুছে যায়নি। সমস্ত পার্বত্য-প্রকৃতি তখন কেমন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি বাহাদুরকে বললাম, এইভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে বাহাদুর ? আর একটু পরেই তো রাতের অতিথিদের আবির্ভাব ঘটবে। এবার একটা আশ্রয়ের চেষ্টা দেখো।
বাহাদুরকে একটু চিন্তিত দেখাল। বলল, হ্যাঁ। তাই তো ভাবছি। কোথায় যাওয়া যেতে পারে! সেরকম নিরাপদ আশ্রয় এই বনের ভেতর কোথায় পাব? আমার তখন সত্যি বলতে কী, ভয় ভাবটা কেটে গেছে। শুনলে হয়তো মিথ্যে বলে মনে হবে, তবুও বলছি, আমার বেশ আনন্দ হচ্ছিল তখন। সে আনন্দ যে কী, তা কথায় প্রকাশ করে বলতে গেলে এই কথাই বলা যায় যে, আমি এক ধরনের রোমাঞ্চকর আনন্দ উপভোগ করছিলাম। এই রকম অবস্থায় সাহস যে আমার কী করে এল তা আমিই জানি না। সাহসে বুকটা ভরে উঠল। ভাবলাম জীবনের এতগুলো বছর দিব্যি তো নিরাপদে কাটালাম। এবার দেখিই না একটু ভয়ের মুখোমুখি হয়ে। এ সুযোগ আর তো আসবে না। তাই বেশ ঠান্ডামাথায় বাহাদুরকে বললাম, আচ্ছা বাহাদুর, আবার আমাদের সেই গুহায় ফিরে গেলে হয় না?
বাহাদুর চমকে উঠল। বলল, আপনার মাথাখারাপ হয়েছে নাকি? কেন?
দেখছেন না অন্ধকার হয়ে আসছে। সেই দুর্গম পথে এখন কী যাওয়া যায়? তা হলে কি বলতে চাও এখানে দাঁড়িয়ে বাঘের মুখেই বেঘোরে প্রাণটা দেব? না না। তা নয়।
তবে আর দেরি করছ কেন? এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী? আশ্রয় তো পাব না কোথাও। শেষমেশ গাছের ডালে বসে রাত কাটাতে হবে। কিন্তু সেটা করার চেয়ে সেই গুহাতেই ফিরে যাওয়াটা ভাল নয় কি?
বাহাদুর একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। যত দুর্গমই হোক। আমাদের সেইখানে ফিরে যাওয়াটাই ভাল। একটু সতর্ক হয়ে রাত্রিটা কাটাতে পারলে কাল সকালে রওনা হওয়া যাবে। না হলে এভাবে এখানে থাকলে বেঘোরে মরব।
আমরা আর বিলম্ব না করে দ্রুত পা চালিয়ে আবার ফিরে চললাম সেই গুহার দিকে।
ছোট গুহা। গুহামুখও বড় নয়। কোনওরকমে পাথর-টাথর দিয়ে মুখটা বুজিয়ে রাখলে একেবারে নিশ্চিন্তে রাত্রিটা কাটানো যাবে। এই ভেবে আমরা আরও একটু বাঁকা পথে বড় বড় পাথরে পা দিয়ে কিছুটা লাফিয়ে লাফিয়েই সেই গুহার কাছে পৌঁছলাম। একটু বাঁকা পথে এসেছিলাম বলে গুহার ঠিক বিপরীত দিকে অর্থাৎ যেদিক থেকে সেই ভয়ংকর কালো বাঘটা আক্রমণ করেছিল হাতিটাকে, সেই দিকে এসে পড়লাম।
মস্ত বাঘটা দেখলাম মৃত পড়ে আছে। আর কিছু দূরেই রক্তাক্ত কলেবরে মরে আছে অতিকায় হাতিটা। আমি প্রথমে বাঘের পিঠের ওপর উঠে দাঁড়ালাম। তারপর উঠলাম হাতির ওপর। বাহাদুরকে বললাম, কাল সকালে যাবার আগে এই বাঘের ছালটা কিন্তু ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। আর সেই সঙ্গে নিয়ে যাব হাতির দাঁতদুটো। কী বড় বড় দাঁত দেখেছ? ও-দুটোর কিন্তু অনেক দাম।
বাহাদুর বলল, কিন্তু এত সব বইবেন কী করে বাবু?
যেমন করেই হোক, বইতে হবে।
এক একটা দাঁতের ওজন জানেন? তা ছাড়া কাল সারাটা পথ আমাদের হেঁটেই যেতে হবে। কী করে নিয়ে যাব?
উপায় একটা বার করতেই হবে বাহাদুর। না হলে এগুলোকে তো ফেলে রেখে যাওয়া যায় না। একান্ত না নিয়ে যেতে পারি, ওই গুহার ভেতরেই যত্ন করে লুকিয়ে রেখে যাব। পরে বরং একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে নিয়ে যাব এসে।
সে পরের কথা পরে আছে।
পরের কথা নয়। আমাদের কাছে কুড়ুল আছে। ছুরি আছে। ছালটা ছাড়াতে, আর দাঁতদুটো কেটে নিতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
অবশেষে রাজি হল বাহাদুর। হেসে বলল, বেশ। আপনি যখন বলছেন তখন নেব। দাতদুটো এখুনি কেটে নিচ্ছি। ছালটা ছাড়াব কাল সকালে। কেন না ছাল ছাড়াতে সময় লাগবে তো। এই বলে ঝপাঝপ করে কয়েকটা কোপ মেরে দাঁতদুটো কেটে ফেলল বাহাদুর।
হাতির দাঁত পেয়ে আমার খুব আনন্দ হল। কিন্তু আমার চেয়েও বেশি আনন্দ দেখলাম বাহাদুরের। তবে সে আনন্দ দাঁত পাওয়ার জন্য নয়। সে আনন্দ অন্য রকমের। সে করল কী হাতির গায়ে কোপ বসিয়ে থাবা থাবা মাংস কেটে নিতে লাগল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ও কী হচ্ছে বাহাদুর! মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কেন?
বাহাদুর হেসে বলল, হাতির মাংস খেয়েছেন বাবু?
না। হাতির মাংস আবার খায় নাকি কেউ?
পায় না তাই খায় না। যখন পেয়েছি তখন ছাড়ি কেন? আমি তো খাবই। আপনিও খাবেন।
আমার দরকার নেই ভাই। তুমিই খাও। কিন্তু রাঁধবে কীসে?
রাঁধব কেন, আগুনে ঝলসে খাব।
বেশ, যা ইচ্ছে করো। এখন তাড়াতাড়ি চলো, আগে গিয়ে গুহায় ঢুকি। বাহাদুর বলল, ঢলুন। বলে হাতির দাঁতদুটো কাঁধে নিয়ে কুড়লটা বাগিয়ে ধরে চলল।
আর আমি সেই তাল তাল মাংস যতটা পারলাম নিয়ে বাহাদুরের পিছু পিছু গুহার কাছে চলে এলাম।
গুহার ভেতরটা তখন ঘন অন্ধকারে ঢাকা। একেই তো গুহা এমনিতে অন্ধকার, তার ওপর সন্ধ্যার অন্ধকারে সে আঁধার আরও ঘনীভূত। আরও জটিল।
বাহাদুর প্রথমেই করল কী, আশপাশ থেকে যত শুকনো ডালপালা এনে জড়ো করল গুহামুখে। তারপর দু’-একটা মোটা কাঠকে চেলা করে কাটল।
গুহামুখে বাহাদুর আর আমি যতটা পারলাম বড় বড় পাথর এনে জড়ো করলাম। পাথরগুলো এমনভাবে সাজালাম যাতে গুহার ভেতরে ঢুকে সেগুলো অনায়াসে ভেতর থেকে টেনে নিয়ে গুহামুখে বন্ধ করে দিতে পারি।
বাহাদুর গুহার ভেতরে ঢোকার আগে আবার সেই বিচিত্র সুরে মুখের দু’পাশে দুটো হাত রেখে চিৎকার করে উঠল, আ—হু—আ—। পরে আমার হাত ধরে এক পাশে সরে দাঁড়াল। এরপর গুহার ভেতর থেকে কোনও প্রত্যুত্তর আসে কি না শোনবার জন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু না। কোনও উত্তর এল না ভেতর থেকে। শুধু বাহাদুরের কণ্ঠস্বরে তিড্ডিমের সেই প্রেতপুরীর মতো অন্ধকার গুহা ও পার্বত্য বনভূমি কেঁপে উঠল একবার। তারপর প্রতিধ্বনির ঢেউ পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে গেল দূর হতে দুরান্তরে।
বাহাদুর গুহামুখে বসে প্রথমেই শুকনো ডালপালা ও কাঠ ধরিয়ে মাংসটাকে ঝলসে নেবার ব্যবস্থা করল। আমি গুহার ভেতরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে গুহাটাকে বেশ ভাল করে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলাম।
সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে রাত্রির অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেছে তখন। সেই অন্ধকারে গুহামুখের লাল অগ্নিশিখায় চারদিক রাঙা হয়ে উঠল। কিছুটা আলো গুহার ভিতরেও গিয়ে পড়ল।
আর সেই আলোয় দেখতে পেলাম গুহাটা ভেতরে প্রশস্ত হয়ে কিছুদূরে গিয়ে আবার সংকীর্ণ হয়ে বেঁকে গেছে। বাইরে থেকে ঢুকে টর্চের আলোয় সেই বাঁক সহসা চোখে পড়বে না। মনে হবে বাঁকটা একটা দেওয়ালের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে বুঝি।
আমি টর্চের আলো ফেলে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। সে কী ভীষণ অন্ধকার।
কালো পাথরের বুকচিরে গুহাটা ক্রমশ ভেতর দিকে চলে গেছে। নেহাত কৌতূহলের বশেই আমি এগোতে লাগলাম সেই পথে।
কিছুদূর যাবার পর বাঁকের মুখে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।
হঠাৎ একটা শব্দ আমার কানে এল।
শব্দটা অন্য কিছুর নয়। মনে হল কোথায় যেন ছর ছর করে জল পড়ছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে সেই জল পড়ার শব্দটা শোনবার চেষ্টা করতে লাগলাম। শব্দটা একটানা। যা শুনে মনে হল এটা কোনও ঝরনা বা জলপ্রপাতের শব্দ। কিন্তু ঠিক কোন দিক দিয়ে যে শব্দটা আসছে তা কিছুতেই অনুমান করতে পারলাম না।
যেদিকে কান পাতি সেদিকেই শব্দ।
হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে দেখি রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। আর যাবার কোনও পথ নেই। শুধু দেওয়াল আর দেওয়াল। শব্দটা কিন্তু সেখানেও শোনা যাচ্ছে।
পথ না পেয়ে ফিরে আসছি, এমন সময় দেখি, আমার ঠিক বাঁদিক দিয়ে ওইরকম সরু কোনওরকমে একজন লোক যেতে পারে এমন একটি গর্ত অন্ধকারের সঙ্গে মিশে রয়েছে। আমি টর্চের আলো ফেললাম তার ভেতর। দেখলাম এ গর্তটা লম্বা হয়ে দুরে বহু দূরে হারিয়ে গেছে।
আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল।
সেই পথ ধরে আরও এগিয়ে যাবার পরই দেখলাম ডাইনে বাঁয়ে ওইরকম সুড়ঙ্গপথ অন্তত আরও দশ পনেরোটি গুহার অন্দরে অন্দরে চলে গেছে। ওরই মধ্যে যেটি একটু বড় আমি সেইটির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কিছুটা আসার পর দেখলাম সেটা এত প্রশস্ত হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে সমস্ত পর্বতটাই বুঝি ফাঁপা। আরও কিছু পথ আসতে দেখলাম শীতল জলে ডুবে যাচ্ছে পায়ের পাতা।
কি ঠাণ্ডা সেই জল।
তবে জলটা স্থির বা জমা জল নয়। বেশ টান আছে।
ছর ছর শব্দটা তখন আরও জোরে শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব কাছ থেকে আসছে শব্দটা। কিন্তু সেই শব্দের উৎস যে কোথায় তা কিছুতেই ঠিক করতে পারলাম না। চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় কি?
জল মাড়িয়ে আমি আরও একটু সামনের দিকে এগোলাম। দেখলাম ক্রমশ জলে ডুবে যাচ্ছে পা। অর্থাৎ বেশি জলের দিকে চলে যাচ্ছি। তখন হঠাৎ আমার খেয়াল হল এ আমি কি করছি? বদ্ধ গুহার অভ্যন্তরে এই জলে আমি দাঁড়িয়ে আছি কোন সাহসে? যদি কোনও সাপ অথবা অন্য কোনও জলজ জন্তু আমাকে আক্রমণ করে? তখন? তখন কি হবে?
এই জলরাশি হয়তো পাতালপুরীতে গিয়ে শেষ হয়েছে। একা তো এ পথে অভিযান চালানো যায় না। তাই ফিরে যাওয়াই উচিত। বিশেষ করে বাহাদুর ওখানে একা আছে। যদি গুহার ভেতরে ঢুকে আমাকে দেখতে না পায় তা হলে ভয়ানক চিন্তায় পড়ে যাবে সে। আমি কোথায় গেলাম কি করলাম ভেবে কিছুই কূল পাবে না। তাই আস্তে আস্তে আবার যে পথে এসেছি সেই পথে ফিরে চললাম।
এমন সময় হঠাৎ দেখি কোনও এক গুহামুখ আলোয় ভরে
তারপর দেখি আর একটা
উঠল। ।
তারপর আরও একটা।
বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।
তাড়াতাড়ি জল পার হয়ে শুকনো জায়গাটায় উঠে দাঁড়ালাম।
তখন গুহার ভেতরটা একেবারে আলোয় আলোয় ভরে গেছে।
দেখি না সেই অগুনতি গুহামুখ থেকে শত শত প্রদীপ জলের স্রোতে ভেসে আসছে। প্রদীপের পর প্রদীপ। আলোর পরে আলো।
সেই জ্বলন্ত প্রদীপ গাছের ছালে কলার পেটোয় ভেসে জলস্রোতে এগিয়ে চলেছে।
যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। সেই সঙ্গে প্রদীপের আলো। সেই অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় যেন হীরা মাণিক জ্বলছে।
আলোর ছটায় চোখের তারা নেচে উঠল আমার। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য। হঠাৎ ও কি!
একটা অতিকায় ভয়ঙ্কর পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সেই জলরাশির বুকের ওপর দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমি ভয়ে দ্রুত ছুটতে লাগলাম।
কিন্তু যাব কোন দিকে? কোথায় আমার পথ? চারদিকে শুধু সংখ্যাতীত গুহামুখ। সেই গুহামুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুল হয়ে গেল আমার। ওদিকে পাখিটাও তখন ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। পাখি তো নয়, যেন মরণ দূত।
আমি তখন কি যে করব কিছু ঠিক করতে পারলাম না। হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি এল। টর্চের আলোটা সরাসরি তার মুখের ওপর ফেললাম! কিন্তু সে কৌশল ব্যর্থ হল আমার। সে আলোতে অন্য প্রাণীর চোখ ধাঁধাতে পারে কিন্তু সেই ভয়ঙ্করের চোখ ধাঁধাবে কেন? আলো লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসতে লাগল সে। পাখিটা এত জোরে আসছে যে তার ডানা ঝাপটানিতে সমস্ত গুহাটা কেঁপে উঠছে।
আমি প্রাণের ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম—–বা-হা-দু-র।
আমার চিৎকারে গুহাটা ঝমঝম করে উঠল।
আমার ডাক সিংহনাদের মতো ছড়িয়ে পড়ল গুহাময়। তারপর দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে গহ্বর বিদীর্ণ করে হারিয়ে গেল দূরে—বহু দূরে—।
আমার চেঁচানিতে ভয়ে থমকে গিয়ে পাখিটা ঘুরপাক খেতে লাগল মাথার ওপর। তবে ঘুরপাক খেলেও তার আসল লক্ষ্য যে আমি তা বুঝতে পারলাম। ততক্ষণে আমি ছোট্ট একটু গুহামুখে ঢুকে পড়েছি।
আর পাখিটা তখন নিষ্ফল আক্রোশে গুহামুখ আগলে বারবার ডানা ঝাপটাতে লাগল এবং চিৎকার করতে লাগল ক্যাক্ ক্যাক্ ক্যাক্ ক-র-র-র।
আমি গুহামুখে ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর এগিয়ে চললাম ভেতর দিকে। হামাগুড়ি দিয়ে শামুকের মতো গুটি গুটি এগিয়ে চললাম। সেই ভাবে খানিক যাবার পর সোজা হয়ে চলতে শুরু করলাম আবার।
চলতে চলতে হঠাৎ আর এক গোলক ধাঁধায় আটকে গেলাম। সেখানেও দেখি সেই একই ব্যাপার। সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ। ভয়ে আমার হাত পা অবশ হয়ে গেছে তখন। আমি চিৎকার করতে লাগলাম—বাহাদুর…বাহাদুর…
সত্যি বলতে কী, তখন আমি পাগলের মতো হয়ে গেছি। কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও যেখানটা একটু প্রশস্ত সেখানে ছুটে গিয়ে দিশেহারার মতো বেরোবার পথ খুঁজতে লাগলাম। আর চিৎকার করতে লাগলামবাহাদুর…বাহাদুর…। যদি কোনও রকমে বাহাদুর আমার ডাক শুনতে পেয়ে ছুটে আসে তাই।
আমার ডাক হঠাৎই থেমে গেল। মুখ দিয়ে বাহাদুরের বা-টুকুই বেরুল শুধু। বাকিটা বেরুল না।
এই পাতালপুরীতে এসে এ কী দেখছি! এ স্বপ্ন না সত্যি?
দেখলাম আমার চোখের সামনে দু’দুটো মানুষের কঙ্কাল উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কবে, কতদিন আগে যে এই দুই হতভাগ্য আমারই মতো এর ভেতরে এসে পড়েছিল তা কে জানে? আমারই মতো তারাও হয়তো বেরোবার পথ খুঁজে পায়নি।
এই গুহাভ্যন্তরে আমার দশাও ওদেরই মতো হবে হয়তো।
ওদের মাথার কাছে মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগ মলিন অবস্থায় পড়েছিল।
ব্যাগটা কুড়িয়ে নিলাম আমি। তারপর সেটার চেন টানতেই দেখলাম নীল রঙের একটা মস্ত কাগজে কীসের যেন একটা ম্যাপ আঁকা। দেখে বুঝলাম ম্যাপটা এই গুহারই। ম্যাপের উলটো পিঠে ছোট ছোট অক্ষরে কি যেন লেখা আছে।
আমি ঝুঁকে পড়ে সেই লেখাগুলো পড়বার চেষ্টা করছি এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা সাঁ সাঁ শব্দ কানে এল। ফিরে তাকিয়েই দেখি এক অতিকায় পাইথন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আমি আর কালবিলম্ব না করে ছুটে চললাম।
ম্যাপটা গুঁজে নিলাম পকেটে।
সোজা সামনে না ছুটে আমি করলাম কি, বাঁদিকের একটা গুহামুখে ঢুকে পড়লাম।
কিন্তু কে জানত তখন সে অনাদি অনন্তকাল ধরে এমন ঘন শ্যাওলার আস্তরণ জমে ছিল এর ভেতর! তাই ঢোকা মাত্রই সজোরে আছাড় খেয়ে পড়লাম পাথরের ওপর। তারপর হড় হড় করে পিছলে যেতে লাগলাম নিচের দিকে। উঃ কি অসম্ভব ঢালু সেই জায়গাটা। পিছলে যেতে যেতে এক সময় ঝপাং করে পড়ে গেলাম আবার সেই জলরাশিতে।
কি অসম্ভব জলের টান সেখানে।
মাথার উপরটা একটু ফাঁকা। এক পাশ দিয়ে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেখা গেলে কি হবে, সেই মুক্তির জগতে আমি কি করে পৌঁছুব?
শব্দের উৎস এইখানেই। কোন পাহাড়িয়া নদী বা ঝর্ণা ওপরে পাথরের প্রান্তর বেয়ে যেতে যেতে এইখানে ঢালু পেয়ে জলপ্রপাতের মতো হুড় হুড় করে পড়ছে। জলপ্রপাতের শব্দের উৎস এখানে হলেও জলের উৎস কিন্তু এখানে নয়। বেশ ধীর মেজাজে অপরাপর গুহামুখ থেকেও স্তনেক জলস্রোত এখানে এসে মিলছে।
যাই হোক। মাথার ওপর আকাশ নক্ষত্র দেখতে পেলেও সেখানে আমি পৌঁছুতে পারলাম না। কেননা প্রপাতের জল আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল সেই জলরাশির দিকে।
আমি জলের তোড়ে তলিয়ে যেতে লাগলাম।
কিছুটা এই ভাবে ভেসে আসার পর জলের স্রোতের বেগ কম অনুভব করলে কোনও রকমে পাথরের দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালাম।
তারপর যেদিকটা একটু শুকনো সেই দিকে আবার এগোতে লাগলাম।
এমন ময় আবার শুনে পেলাম সেই ক্যাক ক্যাক শব্দ। দেখলাম সেই জলরাশির ওপর দিয়ে আবার তেড়ে আসছে সেই সাংঘাতিক পাখিটা। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল আমার। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে! আমার কাছেই তো পিস্তল রয়েছে একটা। তবে আর ভয় করি কেন পাখিটাকে? পাখিটা তখন দ্রুত এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
উঃ কী বিরাট। কী ভয়ংকর।
ঝড়ের মতো এগিয়ে আসছে।
আমি পিস্তলটা বার করবারও সময় পেলাম না। পাখিটা তার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। তারপর চিল যেমন ছোঁ মেরে কোনও কিছু তুলে নেয়, আমাকেও ঠিক সেই ভাবেই তুলে নিয়ে উড়ে চলল জলরাশির ওপর দিয়ে। দূরে অনেক দূরে সেই জ্বলন্ত প্রদীপ ভেসে চলেছে। আমি চিৎকার করতে লাগলাম, বা-হা-দু-র…বা-হা-দু-র…।