এক
আমি তখন শ্রীপতি নাট্য কোম্পানি নামে একটা পেশাদার যাত্রাদলে চাকরি করি। আমাদের দল কোলিয়ারি অঞ্চল এবং আসামে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সেবার আমরা হাফলঙে এলাম আমাদের দল নিয়ে। বড় মনোরম জায়গা। সেখানে গিয়ে আমাদের দল একেবারে জেঁকে বসল প্রায়। ওইটুকু জায়গায় পর পর কয়েকদিন ধরে আমাদের একটানা অভিনয় হল। এবং প্রায় প্রতিদিনই আমরা সেখানকার দর্শকদের মনজয় করে ঘন ঘন করতালি ও অভিনন্দন গ্রহণ করতে লাগলাম।
এইখানে যে বাংলোতে আমরা থাকতাম সেখানে বাহাদুর নামে একজন নেপালি দারোয়ান ছিল। তার সঙ্গে কয়েক দিনের মধ্যেই আমার খুব ভাব জমে উঠল। বাহাদুর এক একদিন আমার অভিনয় দেখে আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। একদিন কথায় কথায় বাহাদুর আমাকে বলল, আচ্ছা বাবু, আপনি তো অনেক দেশ ঘুরেছেন। সত্যি করে বলুন তো, আপনাকে কোন দেশটা সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে?
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। এর কী উত্তর দেব বাহাদুরকে? তবু বললাম, দেখো বাহাদুর; জীবনে আমি অনেক দেশ ঘুরেছি একথা সত্যি। তবে কী জান, যখন যেখানে গেছি তখন আমার সেইখানটাই ভাল লেগেছে। তবুও ভালর চেয়েও ভাললাগা বলে একটা কিছু তো আছে, তা আপার হাফলং-এর এই সৌন্দর্য আমি জীবনে ভুলব না। এত ভাল আমাকে কোনও জায়গা লাগেনি। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সত্যিই আমি মুগ্ধ।
বাহাদুর বলল, সত্যি বলছেন, বাবু?
সত্যি বলছি। এমনিতেই পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল আমাদের শহরের লোকেদের প্রত্যেকেরই ভাল লাগে। তবে আমার কথা আলাদা। আমার ভাল লাগাটা আবার অন্যের চেয়েও একটু বেশি। কেন না ছোটবেলা থেকেই পাহাড়-পর্বতের ওপর আমার একটা সহজাত টান আছে।
সব শুনে অত্যন্ত খুশি হয়ে বাহাদুর ব্লল, তা হলে আমাদের এই হাফলং, আপার হাফলং আপনার খুবই ভাল লেগেছে বলুন?
খু-উ-ব ভাল লেগেছে। দেখছ না, আমি কেমন ফাঁক পেলেই এদিক ওদিক কেটে পড়ি।
হ্যাঁ, আমি সেটা লক্ষ করেছি বাবু। তবে আপনি যদি চান তো, এই আপার হাফলঙের চেয়েও হাজার গুণ ভাল একটা জায়গায় আপনাকে আমি নিয়ে যেতে পারি। যাবেন আপনি সেখানে?
বাহাদুরের আগ্রহ দেখে বুঝতে পারলাম, আমার অজানা নিশ্চয়ই এমন এক মনোরম জায়গা এখানে আছে, যার হদিস আমি কোনও দিনই পাব না। একে আমি ভ্রমণরসিক লোক, প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখবার জন্য আমার মনপ্রাণ সবসময়ে ব্যাকুল হয়ে থাকে, তার ওপরে বাহাদুরের এই আহ্বান, এ সুযোগ আমি ছাড়ি কখনও? বললাম, যাব না মানে? কিন্তু কোথায়?
বাহাদুর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি তিড্ডিমের নাম শুনেছেন?
না। তবে নামটা শোনামাত্রই বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। বেশ ভাবগম্ভীর নাম। তিড্ডিমটা কোথায়? আমাদের মানচিত্রে আছে?
আছে কি না-আছে তা বলতে পারব না। তবে যে কেউ ইচ্ছে করলেই সেখানে যেতে পারে না।
আমার মন আনন্দে নেচে উঠল।
যে জায়গায় ইচ্ছে করলেই কেউ যেতে পারে না, সেই জায়গায় আমি যাব। বাহাদুর যখন আছে তখন সে জায়গায় যাওয়া আমার আটকায় কে?
বাহাদুর বলল, যেমন মনোরম জায়গা, তেমনি বিপদসংকুল। মরণ যেন পায়ে পায়ে ঘনিয়ে আসে। প্রাণ হাতে নিয়ে যেতে হয়। বলো কী !
হ্যাঁ বাবু। যদি আপনার সাহস থাকে, আর যাবার ইচ্ছে থাকে, তবেই আমি সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে গেলে এমন সব দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন, যা দেখলে মাথাখারাপ হয়ে যাবে। তবে একটা কথা—
কী কথা বলো?
শুধু আপনি আর আমি যাব। আর কেউ নয়। কার ভাগ্যে কী ঘটে কে জানে? আমরা কেন নিমিত্তের ভাগী হব?
আমি বললাম, না না। গেলে তোমাতে আমাতে যাব। ওসব সঙ্গীসাথি আমি জড়াই না। ওরা হল পথের কাঁটা। তা যাক। কবে যাবে? কাল তো আমাদের শো বন্ধ। কাল গেলে হয় না?
বাহাদুর হেসে বলল, না বাবু। সে অনেক দূরের পথ। ওখানে তো হেঁটে যাওয়া যায় না। টাঙ্গা করে যেতে হয়। অনেক টাঙ্গাওলা হয়তো রাজিই হবে না যেতে। সেসব ব্যবস্থা করে তারপর যাওয়া। অন্তত দিন পাঁচেক আমাকে সময় দিতে হবে।
আমি হিসেব করে দেখলাম দিন পাঁচেক পরে আবার একদিন আমাদের শো বন্ধ আছে। ভালই হল। সেই দিনটাই আমরা তিড্ডিম যাবার জন্যে স্থির করলাম। কয়েকটা দিন যে আমার কীভাবে কাটল, তা ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। অধীর আগ্রহে আমি সেই দিনটির জন্যে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। কতক্ষণে আসবে সেই দিন। কখন যাবার সেই ক্ষণটুকু এসে উপস্থিত হবে?
যাবার আগের দিন রাত্রে বাহাদুর হতাশ হয়ে এসে বলল, নাঃ। অনেক চেষ্টা করেও কোনও টাঙ্গাওলাকে রাজি করাতে পারলাম না।
শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, তা হলে উপায়?
উপায় একটা বের করছি। যাওয়া আমাদের হবেই। আমার বন্ধুর একটা টমটম আছে। তাতে করেই যাব। বন্ধুও যেতে রাজি নয়। অগত্যা আমাকেই টমটম চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কাল খুব ভোরে উঠে আমরা দু’জনে রওনা হব। আপনি খাবারদাবার বেঁধে ঠিক করে রাখবেন, কেমন?
যাক! আমার মনটা এতক্ষণে হালকা হয়ে গেল। যেই শুনেছি টাঙ্গা পাওয়া যায়নি, অমনি মনটা যে কী ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল তা কী বলব। চোখফেটে যেন জল আসছিল। এখন যাবার আনন্দে কল্পনার পাখি হয়ে উড়ে চলল মন। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি? সেই কতটুকুর এত্তটুকুও তো জানতে পারব কাল?
পরদিন খুব ভোরে উঠে আকাশের তারা থাকতে থাকতে রওনা হলাম দু’জনে। আমি আর বাহাদুর। বাহাদুর নিজেই টমটম চালাতে লাগল। আপার হাফলঙের পথে ছুটে চলল আমাদের টমটম।
ক্রমে আমরা লোকালয় ছেড়ে এক ঘন অরণ্যভূমির মধ্যে এসে পড়লাম। কত ছোট ছোট নদী ও ঝরনার পাশ দিয়ে যে আমাদের টমটম ছুটে চলল তার ঠিক নেই। আমার মনে হল যেন রূপকথার রাজপুত্র আমি। রথে চড়ে দিগ্বিজয়ে চলেছি। আর বাহাদুর আমার সারথি। ওঃ! সে যে কী আনন্দ!
আমাদের সঙ্গে রয়েছে প্রচুর খাবার। আর দু’জনের জন্যে দুটো ধারালো কুড়ুল। আত্মরক্ষার জন্যে এ-দুটো সঙ্গে নিয়েছি আমরা। যদিও জানি সত্যিকারের বিপদ এসে সামনে দাঁড়ালে হাতের কুড়ল হাতেই থাকবে। তবুও নিয়েছি।
যেতে যেতে ভোরের আলো মুছে গেল এক সময়।
তরুণ রবির অরুণ আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। আহা কী অপরূপ। ফুলের গন্ধে অপরিচিত গাছগাছালির গন্ধে মনপ্রাণ ভরে উঠল। কত পাখির কণ্ঠস্বর কানে এল। কত সুন্দর হরিণ যে চোখে পড়ল, তা বলে বোঝাতে পারব না।
যাই হোক। এইভাবে যেতে যেতে বেলা প্রায় দশটা নাগাদ টমটম এসে এক জায়গায় থামল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিড্ডিম আর কত দূরে
বাহাদুর?
বাহাদুর বলল, এই তো এসে গেলাম। এই হল তিড্ডিম। অবশ্য এবার আমাদের হাঁটাপথে আরও কিছুটা যেতে হবে। আমি যেখানে নিয়ে যেতে চাই, সেটা আরও গভীরে।
বললাম, এটাই তো ফরেস্ট। আরও গভীরে?
হ্যাঁ বাবু। এখানে সচরাচর কেউ আসে না।
আর বাক্যব্যয় না করে দু’জনেই নেমে পড়লাম টমটম থেকে।
বাহাদুর একটা শাল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে টমটম বাঁধল। তারপর ঘোড়াটাকে মুক্ত করে অপর একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে খেতে দিল তাকে।
আমি বললাম, বাহাদুর! এবার আমাদেরও একটু জলযোগ সেরে নেওয়া কী বলো? যাক,
হ্যাঁ। বেলা তো হয়েছে অনেক। এখনও হাঁটাপথ বাকি আছে।
আমাদের সঙ্গে কলা, পাউরুটি, ডিম, সন্দেশ ইত্যাদি ছিল। পেট ভরে খেয়ে নিলাম দু’জনে। খাওয়া হলে দু’জনে দুটো কুণ্ডুল ঘাড়ে করে টর্চ ও খাবারের জায়গা নিয়ে এগিয়ে চললাম। একটা পিস্তলও ছিল আমার সঙ্গে। তবে সেটার কথা বাহাদুরকে বলিনি। খুব বিপদে না-পড়লে সেটা ব্যবহার করব না।
যাই হোক, হাঁটাপথে যেতে যেতে নয়ন-মনোহর সৌন্দর্যে অন্তর ভরে উঠল। এ পথে যে বিপদ আছে, এই পথের প্রতিটি পদক্ষেপে যে মরণ হাতছানি দিয়ে ডাকে, তা আমার মনেই হল না।
বাহাদুরের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
প্রকৃতির এমন সালংকারা রূপ এই প্রথম দেখলাম আমি।
বেশ কিছু পথ এসেছি। হঠাৎ হাতে একটা হেঁচকা টান। এমন মারাত্মক টান যে, আর একটু হলেই ছিটকে পড়েছিলাম। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল। হল কী?
বাহাদুর হিসস, করে উঠল। তারপর আঙুল দিয়ে দেখাল সামনের দিকে।
আমি দেখলাম আমার ঠিক চোখের সামনেই সবুজ লতার মতো কী যেন একটা দুলছে। যেন কোনও লতানে গাছের শাখাগ্র একটি। বাহাদুর বলল, সাপ।
সাপ?
হ্যাঁ বাবু। পাহাড়ে যে কত রকমের সাপ আছে। নাম জানি না। আর একটু হলেই ওটা আপনার গায়ে ঠেকে যেত। আর ঠেকলেই সর্বনাশ। নিমেষের মধ্যে চুটিয়ে দিত একেবারে।
আমার হাত-পা তখন হিম হয়ে গেছে। বললাম, ভাগ্যে ধরলে? যাক। ওর তলা দিয়ে না-গিয়ে বরং পাশ দিয়ে চলে যাই চলো।
বাহাদুর বলল, এখন যাবেন কী বাবু? ওর কাছ দিয়ে গেলেই ও চুটিয়ে দেবে। বাহাদুরের কথা শেষ হতে না হতেই সেই লতার মতো সাপটা তিরের মতো সাঁত করে ছিটকে গেল একটা ঝোপের দিকে। যাক। আপদ গেল।
বাহাদুর বলল, খুব সাবধান। ভাল করে চারদিক দেখে পথ চলবেন। তাড়াতাড়ি করবেন না। অযথা বেশি কথা বলবেন না। আসুন, যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে।
ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছে তখন।
বাহাদুরকে আগে দিয়ে আমি ওর পিছু পিছু পথ চলতে লাগলাম।
খানিকটা পথ আসার পরই দেখি পথ রুদ্ধ। একটা মস্ত গাছকে বেড় দিয়ে কতকগুলো পাহাড়ি-ময়াল সোঁ সোঁ শব্দ করছে। গাছের ডালে পাকিয়ে কোনও ময়ালের মুখ নীচের দিকে দুলছে। একটা ময়াল শিকার ধরেছে। সম্ভবত হরিণ শিশু। তার আধখানা গিলেছে, আর বাকি আধখানা গেলবার চেষ্টা করছে।
আমরা পাশ কাটিয়ে একটু বাঁকা পথে সে রাস্তা পরিত্যাগ করলাম। এইভাবে অনেক পথ হেঁটে এক সময় এক জলাশয়ের ধারে পৌঁছলাম আমরা।
আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। বিশ্বের অনন্ত সৌন্দর্য যেন এক সঙ্গে জমা হয়েছে এখানে। প্রকৃতির সে কী রূপ। চারদিকে পাহাড়— পাহাড় আর পাহাড়ের চূড়া। দূরদূরান্তেও পাহাড়ের রেখা। তারই গায়ে গায়ে পুষ্পিত বনভূমি। কত রঙের সমারোহ। আর যে জলাশয়ের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা, সেই জলাশয় পদ্মবনে ভরে আছে। জলাশয়ের আশেপাশে গোলাপের বন। আর জলাশয়ের মধ্যে বড় বড় অতিকায় পদ্মপাতার ফাঁকে ফাঁকে ছোট বড় পদ্মকুঁড়ি ও পদ্মফুলগুলি ফুটে আছে। কত পাপড়ি ঝরে জলের ওপর ভাসছে। যেন ছোট ছোট পাল তোলা নৌকো। দেখে মোহিত হয়ে গেলাম।
সেই জলাশয়ের ধারে একটি পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটি গুহা ছিল। গুহার মুখ এত সংকীর্ণ যে, হামাগুড়ি দিয়ে না-ঢুকলে এর ভেতরে ঢোকার কোনও উপায় নেই।
বাহাদুর বলল, এই গুহার ভেতরেই আমাদের আশ্রয় নিতে হবে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, তা তো নিতে হবে। কিন্তু যদি এর ভেতরে কোনও জীবজন্তু বাসা নিয়ে থাকে তা হলে?
যতদূর জানি গুহাটা নিরাপদ। তবু ঢোকার আগে একবার দেখে নেব বইকী। এই বলে গুহামুখের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখের দু’পাশে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে একটু চেঁচিয়ে উঠল বাহাদুর — আ— হু— আ—।
বাহাদুরের সেই কণ্ঠস্বর পাহাড়ে-পর্বতে ধ্বনিত হয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল। কিন্তু গুহামুখ থেকে কোনও প্রত্যুত্তর এল না। বাহাদুর তখন আমার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল গুহার ভেতর। একটু পরেই হাসিমুখে আবার বেরিয়ে এল সে। এসে বলল, না। ভয় নেই। আসুন ভেতরে আসুন।
আমি বাহাদুরের সঙ্গে গুহার ভেতরে ঢুকলাম। গুহামুখ সংকীর্ণ হলেও ভেতরটা প্রশস্ত। ভেতরে ঢুকে বেশ ভালভাবে গুছিয়ে বসলাম দু’জনে।
একটু পরে আবার কী মনে করে গুহার বাইরে গেল বাহাদুর। তারপর দু’-একটা গাছের ডাল ভেঙে এনে বড় বড় পাথরের চাঁই গুহামুখে জড়ো করে ভেতরে এসে বলল—এবার নিশ্চিন্তে বসে বাইরের দৃশ্য দেখুন। একটু পরেই দেখবেন বুনো হাতির দল জল খেতে আসবে। সে যে কী দৃশ্য, তা আপনি ভাবতেও পারবেন না। সেই দৃশ্য দেখাবার জন্যই আপনাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি।
গুহার ভেতরে বসে বাইরের জলাশয়ের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। বুনো হাতির দল কখন জল খেতে আসবে কে জানে? ততক্ষণে আমরা আমাদের সঙ্গের বাকি খাবারগুলো উদরস্থ করতে লেগে গেলাম।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর, এক সময় বুনো হাতির দলকে দেখা গেল। সামনের একটা খাড়াই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দলে দলে বুনো হাতি সারিবদ্ধভাবে নেমে আসছে দেখলাম। কী চমৎকার তাদের আসবার ভঙ্গি। প্রথমে প্রকাণ্ড চেহারার একটা হাতি, তারপরে তার চেয়ে আকারে একটু ছোট একটি হাতি, তারপরে আরও একটি ছোট হাতি। এইভাবে ঠিক আকৃতি অনুযায়ী পরের পর লাইন দিয়ে আসছে সব। সবার পিছনে একেবারে ছোট্ট হাতিটি। শুঁড় দুলিয়ে সকলে সেই জলাশয়ে নেমে এল। মস্ত জলাশয়। জলে নেমে শুঁড়ে করে জল নিয়ে এ ওর গায়ে ফোয়ারার মতো ছিটোতে লাগল।
এইভাবে সারাক্ষণ ধরে চলতে লাগল তাদের জলক্রীড়া।
ক্রমে দুপুর গড়িয়ে এল।
আমি বললাম, বাহাদুর, এবার ফেরা যাক।
বাহাদুর বলল, এখন কী করে যাবেন? হাতির দল না যাওয়া পর্যন্ত বেরোবার উপায় আছে নাকি? ওরা বড় সাংঘাতিক। একবার যদি দেখতে পায় তো শেষ না করে ছাড়বে না।
বলো কী!
হ্যাঁ।
হঠাৎ বনভূমির ভেতর থেকে একটি ক্রুদ্ধ গর্জন ভেসে এল। সে এমন এক ভয়ংকর ডাক যে রীতিমতো হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেল আমাদের। অমন সাহসী বাহাদুরেরও বুক কেঁপে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়াল হাতির দল। দু’পায়ে দাঁড়িয়ে দু’পা তুলে শুঁড় উঁচু করে প্রত্যুত্তর দিল, হ্যাররো—ও—ও—ও।
বাহাদুর বলল, মনে হচ্ছে সাংঘাতিক একটা বিপদ ঘটবে এবার। জন্তুটা যদি
গুহার ভেতরে আশ্রয় নিতে আসে তা হলে তো বিপদের শেষ থাকবে না। কেন, আমরা তো বেশ নিরাপদ আশ্রয়েই আছি। তা ছাড়া গুহার মুখও তো গাছের ডাল আর পাথর দিয়ে ঘেরা।
তা হলেও ভেতরে ঢুকতে না-পেলে ও কি সহজে চলে যাবে ওর আশ্রয় ছেড়ে? আমরা বেরোলেই আমাদের আক্রমণ করবে।
এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম আমি। বললাম, তা হলে উপায়? উপায় আর কী? লড়াইয়ের জন্য তৈরি হতে হবে।
এমন সময় আবার সেই ডাক।
হাতির দলও তখন রণং দেহি হয়ে তার প্রত্যুত্তর দিল। রাগে শুঁড় দুলিয়ে, অঙ্গ দুলিয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি চালাতে লাগল।
বাহাদুর হঠাৎ বলল, ওই—–ওই—ওই দেখুন।
আমি দেখলাম পাহাড়ের এক উচ্চস্থানে একটা ভয়ংকর জন্তু দাঁড়িয়ে। বৃহদাকৃতির জানোয়ার সেটা। ঘন কালো গায়ের রং। খাড়া খাড়া লোম। চক্ষু রক্তবর্ণ।
বাহাদুর বলল, বাঘ।
বাঘ? বাঘ ওইরকম হয় নাকি?
হ্যাঁ। হিমালয়ের ভয়ংকর অনেক রকমেরই হয়। বাঘের অনেক রকম জাত আছে।
বাঘটা তখন চোখের পলকে সেই উচ্চস্থান থেকে সবচেয়ে বড় হাতিটার পিঠের উপর লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ভেসে গেল হাতির দেহটা। লাল হয়ে উঠল জলাশয়ের জল।
শুরু হল প্রচণ্ড দাপাদাপি আর আর্তনাদ। লেগে গেল ভয়ানক যুদ্ধ। বড় হাতিটা শুঁড়ে করে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করল বাঘটাকে। কিন্তু পারল না।
অন্যান্য হাতিগুলো তখন ছুটে এল। বাঘটা বেড়ালের মতো থাবা গেড়ে হাতির পিঠে বসে ফ্যাস ফ্যাঁস শব্দ করতে লাগল।
উঃ। সে কী ভয়ংকর দৃশ্য।
বাঘটা ততক্ষণে হাতিটাকে চিরে ফালা ফালা করে ফেলেছে।
মাঝারি সাইজের একটা হাতি এসে ততক্ষণে শুঁড়ে করে জড়িয়ে ফেলল বাঘটাকে। তারপর পাকিয়ে ধরে বড় একটা পাথরের ওপর মারল এক আছাড়। সঙ্গে সঙ্গে অপর একটা হাতি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘটার ওপর। তারপর সবাই মিলে লাথির পর লাথি।
বাঘটা প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল একসময়। এবং অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যুবরণ করল।
বড় হাতিটাও ক্ষতবিক্ষত দেহে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
হাতির দল অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইল তাদের দলপতির প্রাণহীন দেহটার দিকে। তারপর সবাই মিলে শুঁড় উঁচিয়ে শেষ প্রণাম জানিয়ে, আবার সারিবদ্ধভাবে চলে গেল যে যার।
আমরাও আর দেরি করলাম না। গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আবার সেই পাহাড়িপথ বেয়ে টমটমের কাছে পৌঁছলাম। কিন্তু কে জানত যে এক বিপদ কাটিয়ে এলেও আর এক বিপদ অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে? গিয়ে দেখলাম শুধু টমটমটাই পড়ে আছে সেখানে। ঘোড়াটা নেই।
বাহাদুর বলল, সর্বনাশ হয়েছে বাবু। ঘোড়াটাকে বাঘে খেয়েছে।
বাঘ!
হ্যাঁ দেখছেন না রক্তের দাগ আর পায়ের ছাপ?
তা হলে ফিরব কী করে?
কী করে আর ফিরব? এই বনের ভেতরেই কোনও একটা নিরাপদ জায়গা দেখে রাত্রিটা কাটাতে হবে। ফেরার কথা ভাবা যাবে কাল।
আমি হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। সত্যি বলছি, এরকম বিপদে পড়ব জানলে এখানে আমি কোনও মতেই আসতাম না।