‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ৭

রুবি চলে যাবার ঘণ্টাখানেক পরে বাজল টেলিফোনটা।

রানু শুনে নিয়ে ‘কথামুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন, ‘প্রমীলা পাণ্ডে। তোমাকে খুঁজছে। কথা বলবে?’

বাসু ইতিমধ্যে খবরের কাগজটা তুলে নিয়েছিলেন। সেটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘আমার এমন কিছু বয়স হয়নি রানু যে, প্রমীলা রাজ্য থেকে কেউ আহ্বান করলে সাড়া দেব না।’

রানু বললেন, ‘একথার জবাব পরে দেব, নাও কথা বল—’

বাসু টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘নমস্কার প্রমীলা দেবী। বলুন, আমি পি. কে. বাসু কথা বলছি।’

‘নমস্কার, স্যার। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাপ চাইছি। আমি হাওড়ার উকিল মিস্টার প্রসেনজিৎ দত্তগুপ্তকে ফোন করেছিলাম, তিনিই বললেন, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’

‘কী ব্যাপারে?’

‘রুবি রায়ের ব্যাপারে। সে কি আপনার মক্কেল?’

‘হ্যাঁ। প্রসেনজিৎ আমার সঙ্গে এ বিষয়ে যুক্ত আছে। কিন্তু ‘রুবি রায়ের বিষয়ে আইন-সংক্রান্ত আলোচনা আমি কোনও আইনজীবীর সঙ্গে করতে ইচ্ছুক। আপনার কোন অ্যাটর্নি আছেন, যিনি আপনার ব্যবসাসংক্রান্ত কাজকর্ম দেখেন?’

‘আজ্ঞে না। আমার ব্যবসায়িক ও আইনসংক্রান্ত কাজকর্ম আমি নিজেই দেখে থাকি।’

বাসু বললেন, ‘মিস রায়ের তহবিল একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ও এই শহরে কাজ খুঁজতে এসেছিল, কিন্তু এখন ওর পক্ষে কোন কাজকর্ম পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। কারণ বেকসুর খালাস পেলেও একটা বিশ্রী পুলিশ-রেকর্ড ওর বায়োডাটায় কালিমা লেপন করেছে।

‘আই অ্যাপ্রিশিয়েট। সেজন্য আমি তাকে কিছু অর্থ দান করতে চাইছিলাম, তাই মিস্টার দত্তগুপ্তকে ফোন করায়…’

‘বুঝেছি, বুঝেছি, কিন্তু দান তো সে নেবে না।’

‘নেবে না?’

‘আজ্ঞে না। যদি আদৌ কিছু নেয়, তো নেবে ‘ক্ষতিপূরণ’…।’

‘সে তো ঐ একই কথা।’

‘আজ্ঞে না। এইজন্যই বলছিলাম, আপনি আপনার অ্যাটর্নিকে পাঠিয়ে দিন। চ্যারিটি আর কমপেনসেশন শব্দ দুটির পার্থক্য যিনি বুঝতে পারেন।

‘আপনি ভুল করছেন, মিস্টার বাসু। ঐ দুটি ইংরেজি শব্দের পার্থক্য বুঝতে গেলে ল পাস করতে হয় না। সত্যি কথা বলতে কি, মেয়েটি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় আমি কিছুটা বিবেকের দংশন অনুভব করছি। রুবিকে দেখতে অনেকটা আমার ছোট বোনের মতো…’

‘এই দেখুন! আপনি যদি আপনার অ্যাটর্নিকে কথা বলার সুযোগ দিতেন, তাহলে এসব খেজুরে প্রসঙ্গ আদৌ উঠতো না। ওকে দেখতে আপনার ছোটবোনের মতো না সতীনের মতো এটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়।’

‘সতীনের মতো! হোয়াট ডু য়া মীন?’

‘কী মুশকিল! ও একটা কথার কথা। আপনিও জানেন, আমিও জানি যে, হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট পাস হবার পর ‘সতীন’ শব্দটা পেত্নী, শাঁখচুন্নির মতো অলীক অবাস্তব হয়ে গেছে।… কী হল? আপনি লাইনে আছেন?’

‘হ্যাঁ আছি। ‘দান’ই হোক অথবা ‘ক্ষতিপূরণ’, আমি আপনার মক্কেলকে কিছু টাকা দিতে চাই আপনার অফিসে গিয়ে দিয়ে আসতে চাই। কখন আপনার সময় হবে? আজ বিকালের দিকে?’

‘কলকাতায় আপনি আছেন কোথায়?’

‘হোটেল হিন্দুস্থান, লোয়ার সার্কুলার রোডে।’

‘ওটা এখন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড। সে যাক, আর আপনার বান্ধবী? মিস পুষ্পা? এবং তার হবু বর?

‘পুষ্পা আছে তাজবেঙ্গল হোটেলে, আর জনার্দন ওদের আলিপুরের রেস্টহাউসে। কিন্তু এসব কথা উঠছে কেন?

‘এমনিই। আপনি বিকাল তিনটের সময় আসতে পারবেন?’

‘পারব। তখনই অন্যান্য কথা হবে। নমস্কার।

বাসু ফোনটা নামিয়ে রাখার পর রানু বললেন, ‘তুমি ইচ্ছে করে ভদ্রমহিলাকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছিলে কেন বল তো? লোয়ার সার্কুলার রোডকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড না বললে মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয়ে যায় না।’

‘যায় রানু, যায়। এ শহরে অনেক-অনেক রাস্তা আছে যেগুলি রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা পার্টির খাতিরে নামকরণ করেছে। অল্প যে কয়টি ব্যতিক্রম আছে তার মধ্যে পড়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, আচার্য জগদীশচন্দ্র, বিবেকানন্দ রোড, নেতাজী সুভাষ বা…’

‘বুঝেছি। কিন্তু সতীনের প্রসঙ্গ তুলে এঁকে খোঁচা দিলে কেন? তুমি তো জান, প্রমীলাদেবীর স্বামী অন্য একটি মহিলার সঙ্গে অন্যত্র থাকেন!’

‘সো হোয়াট? এটা তো উইমেন্স লিব-এর যুগ। প্রমীলাদেবী বদলা নিতে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে থাকলেই পারেন।

‘যার এখনো তেমন কিছু বয়স হয়নি? প্রমীলা রাজ্য থেকে ডাক এসেছে শুনলে যে এখনো চুলবুল করে ওঠে?

* * * * *

কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময়েই এলেন তিনি। বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশ যে কোন অঙ্ক হতে পারে। ‘বায়সকৃষ্ণ’ থেকে ‘দুগ্ধালক্তক’ যে কোন রং— মাথায় ওটা দেহসংলগ্ন কুত্তলসম্ভার অথবা ‘ফরেন মেক উইগ’ বলা শক্ত। বিউটি শপ ওঁকে আদ্যত্ত রূপান্তরিতা করে দিয়েছে— যেটা পরিবর্তন করতে পারেনি— হাই হিল খুটখুট সত্ত্বেও— সেটা ওঁর উচ্চতা।

সৌজন্য বিনিময়ান্তে বাসুসাহেবের ভিজিটার্স সীটে বসে বললেন, ‘আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই আমি কিন্তু একটা কাজ করেছি। জনার্দনকে সাড়ে তিনটের সময় এখানে আসতে বলেছি।’

‘কিন্তু সাড়ে তিনটে কেন? আপনার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো ছিল তিনটেয়?’

‘সেই জন্যেই। জনার্দনের রাজত্ব নেই, কিন্তু পূর্বপুরুষের রাজ-মেজাজটা আছে। ও এসে পড়ার আগে যাতে আমি আমার কথাগুলো বলতে পারি সে জন্যই এই আধঘণ্টার মার্জিন।’

‘সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন মিস্টার গায়কোয়াড়কে আদৌ আসতে বললেন কেন?’

‘সৌজন্যবোধে। গহনা যা খোয়া গেছে তা আমার এবং পুষ্পার। জনার্দন না মনে করে আমি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছি।’

‘তা কেন মনে করবেন উনি? বিয়েটা তো এখনো হয়নি। এনগেজমেন্ট হয়েছে মাত্র। আর গহনাগুলো কিছুটা আপনার, অধিকাংশই পুষ্পাদেবীর।

‘সত্যি কথা, কিন্তু অধিকাংশই জনার্দনের দেওয়া উপহার।’

‘ঠিক আছে। বলুন, প্রথমে বলুন তো চুরিটা কখন হল। কীভাবে হল?’

‘মেয়েটি যখন বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে, তখন ধরে নিতে হবে ঐ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীটার কী যেন নাম…?’

‘সহদেব কর্মকার—’

ইয়েস। সহদেব কর্মকারের সাক্ষ্যের কোনো মূল্য নেই। সে ক্ষেত্রে চুরিটা সন্ধে সাড়ে সাতটার বদলে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টার মধ্যে যে কোন সময়ে হয়ে থাকতে পারে। কারণ কন্টেসা গাড়িটাকে ওখানে রেখে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে দুজনে আশ্রমে যাই। সকাল নয়টা নাগাদ। দুপুরে সেখানেই ‘কণিকা’-মাত্র প্রসাদ পাই। ‘কণিকামাত্র’ বলছি— কিছু মনে করবেন না— আমরা অন্য জাতির খাদ্যে অভ্যস্ত। তারপর পুষ্পা মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করল। আমি ট্যাক্সিটা নিয়ে বেলুড়-মন্দির দেখে এলাম। সন্ধ্যা ছয়টার সময় আশ্রম থেকে বের হই। পথে একটা চীনে রেস্তোরাঁয় নৈশাহার সারি। ওদের বার-লাইসেন্স ছিল না। ফলে আমরা আদৌ ড্রিংক করিনি। মোটেলে ফিরে এলাম রাত সাড়ে আটটায়। তখনই আমার নজরে পড়ল পিছনের ডিকিটা বন্ধ নেই। আমার সন্দেহ হল। টানতেই ডালাটা খুলে গেল। দেখি সর্বনাশ হয়ে গেছে। তখন…

‘জাস্ট এ মোমেন্ট। এই পর্যায়ে কয়েকটা সন্দেহভঞ্জন করে নিই। প্রথম কথা, দুই লক্ষ টাকার গহনা গাড়ির ডিকিতে কেন রেখে গেছিলেন? কেন নয়, মোটেলের ঘরে।’

‘মোটেলের ঘরে ইয়েল-লক ছিল না। অলড্রপ আর সাধারণ তালা। যার ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় আছে ঐ ম্যানেজারের কাছে। খানদানি হোটেলে সচরাচর যেমন স্ট্রংরুম থাকে এখানে তা ছিল না। অথচ লক্ষ্য করে দেখি, কন্টেসা গাড়ির পিছনে লাগেজ কেরিয়ারের গা-তালা রীতিমতো মজবুত। ফরেন-মেক হাই-গ্রেড স্টিলের চাবি। তাই সেই চাবিটা আমরা খুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। রামলগনের কাছে ছিল শুধু দরজার আর ইগনিশনের চাবি।

‘রামলগন বলতে নিশ্চয় ঐ কন্টেসা গাড়ির ড্রাইভার? তাকে কতদিন ধরে চেনেন আপনারা?’

‘না, তাকে আদৌ চিনতাম না। পুষ্পার যে পাবলিসিটি এজেন্ট আছে তার কলকাতা অফিসের একজন— মোস্তাক আহমেদ — যে হোটেল বুক করেছিল, সে লোকটাই রেন্ট আ-কার সার্ভিসে কন্টেসাও বুক করেছিল।’

‘ঐ মোস্তাক আহমেদকে কতদিন ধরে চেনেন আপনারা?’

‘সে বহুদিন। আগে সে বোম্বাইয়ে পুষ্পার সঙ্গে থাকত। কম্বাইন্ড-হ্যান্ড হিসাবে। লোকটার রান্নার হাত দারুণ। তখনো পুষ্পার তেমন নামডাক হয়নি। পরে পুষ্পা ওকে এখানে ওর পাবলিসিটি এজেন্টের কাছে বদলি করে দেয়।’

‘ঐ রামলগন সারাদিন কোথায় ছিল?’

‘আমরা দুজন ট্যাক্সি নিয়ে আশ্রমে চলে গেলাম সকালের দিকে। রামলগন সারাদিন বস্তুত ছুটিতেই ছিল। গাড়িতে বা এদিক-ওদিক। দুপুরে একটা পাঞ্জাবি ধাবায় গিয়ে খেয়েছে। ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখেছে। সে বলছে, চুরির কথা সে কিছুই জানে না।’

‘তাকে বলেননি যে, গাড়িতে অত্যন্ত দামী জিনিস আছে?’

‘মুখে বলিনি। কিন্তু সে হয়তো আন্দাজ করেছিল। যখন ওর চাবির রিঙ থেকে ডিকি-লক- এর চাবিটা আমরা খুলে নিলাম।’

ডিকি-লক-এর ডুপলিকেট কোনও চাবি ছিল না?’

‘না। অন্তত রামলগনের কাছে ছিল না। পুলিশে এনকোয়ারি করে দেখেছিল। ডুপ্লিকেট ছিল ‘রেন্ট-আ-কার সার্ভিসের দপ্তরে। ম্যান্ডেভিলা-গার্ডেন্সে তাদের অফিস। সে অনেক অনেক দূর বেলুড় থেকে।’

‘কিন্তু এত গহনা নিয়ে কলকাতা এসেছিলেন কেন আপনারা?’

‘সেকথা উহ্যই থাক না, স্যার।’

‘বুঝলাম। গোল্ড অ্যাক্ট বা ইনকাম ট্যাক্স। তা পরদিন মিস্টার গায়কোয়াড়ের রিঅ্যাকশন কী হল?’

‘সে তো ক্ষেপে আগুন। ওর সবচেয়ে রাগ : কেন আমরা বোকার মত পুলিশে গেলাম। যদিও পুলিশে খবরটা দিয়েছিলাম আমি, ওর সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল পুষ্পার উপর। মায়ের সঙ্গে দেখাটা পর্যন্ত করল না। পরের ফ্লাইটেই গোয়ালিয়র ফিরে যেতে চেয়েছিল। আমরা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আটকেছি। গায়কোয়াড়ের একটা গেস্ট হাউস আছে আলিপুর রোডে। পুষ্পা সেখানে উঠতে রাজি হল না। মান অভিমান আর কি। সে উঠেছে তাজ বেঙ্গলে। দেখুন, দুলাখ টাকাটা কিছু নয়। না জনার্দনের কাছে, না পুষ্পার কাছে। কিন্তু ওর ভিতর একটা মাঙ্গলিকী ছিল : একটা ‘রাণী-মুকুট’। প্রাক্-ব্রিটিশ যুগের। মোঘল সম্রাটদের কাছ থেকে পাওয়া। ঐতিহাসিক মূল্য বাদ দিলেও শুধু সোনা আর পাথর মিলিয়ে সেটারই দাম একলাখ টাকা। তার মূল্য নিক্তি কষে হবার নয়। বস্তুত সে কারণেই আপনার কাছে আসা। ওয়ান অব দ্য থ্রি রিজস।

‘তিনটে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছন? কী কী?

‘একটা তো ঐ রুবি রায়ের ব্যাপারটা মেটানো। দু-নম্বর : শুনেছি, আপনার আন্ডারে ‘সুকৌশলী’ নামে একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। আপনার মাধ্যমে আমরা তাঁদের প্রফেশনালি এনগেজ করতে চাই। অন্তত ঐ মুকুটটা উদ্ধারের ব্যাপারে। পুলিশের উপর আমাদের আস্থা নেই।

‘বুঝলাম। আর তিন নম্বর উদ্দেশ্য?’

‘সেটা একটু ডেলিকেট, স্যার। প্রথম দুটোর দায়িত্ব আপনি নিতে রাজি হলে তারপর সে প্রসঙ্গটা তুলতে চাই।’

তখনই বেজে উঠল ইন্টারকম। রানু জানালেন, মিস্টার জনার্দন গায়কোয়াড় এসেছেন। তাঁকে কি অপেক্ষা করতে বলা হবে?’

প্রমীলা হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলেন, ‘না’।

বাসু ইন্টারকমে বললেন, ‘না, না, ওঁকে আসতে বল। আমরা বস্তুত ওঁর জন্য অপেক্ষা করছি।’

পরমুহূর্তেই দরজাটা খুলে গেল। জনার্দন গায়কোয়াড়ের দেহাকৃতি রাজপুত্রেরই মতো। দীর্ঘদেহী, মধ্যাক্ষম, তবে মুখে বসন্তের দাগ। দাড়ি-গোঁফ কামানো। বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে পালিশ। দ্বারপ্রান্তে একটা বিচিত্র ‘বাও’ করলেন। তারপর অগ্রসর হয়ে এসে করমর্দনের জন্য দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করে দিলেন।

বাসু উঠে দাঁড়ালেন, করমর্দন করে বললেন, ‘গুড আফটারনুন। বি সীটেড প্লীজ।’

প্রমীলাও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। জনার্দন সেদিকে ফিরে মার্কিনী ঢঙে বললেন, ‘হ্যালো বিউটিফুল। য়ু লুক বিউটিফুলার দিস ইভনিং।

তিনজনেই আসন গ্রহণ করলেন। জনার্দন গায়কোয়াড়ের প্রতিটি মিনিট বোধকরি মূল্যবান। তিনি সরাসরি আলোচ্য প্রসঙ্গে এলেন। মিসেস পাণ্ডের দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমি যখন ফোন করেছিলে তখন আমি ছিলাম না; কিন্তু তোমার রেকর্ডেড ফোন-মেসেজ শুনে বুঝলাম তুমি আমাকে এখানে সাড়ে তিনটেয় আসতে বলেছ। ঐ সেই যে মেয়েটি গহনা চুরি করেছিল তার বিষয়ে কী-একটা সেটলমেন্ট করতে। তাই নয়?’

প্রমীলা তাঁর উইগ-সমেত মাথাটা নেড়ে বললেন, ‘মেয়েটা আদৌ চুরি করেনি। তুমি ভুল বলছ জনার্দন।’

‘করেনি? তুমি কেমন করে জানলে?’

‘করলে সে বেকসুর খালাস পেত না।’

জনার্দন বিচিত্র হাসলেন। সে হার্টি বাক্যের চেয়ে বাঙায়। এবং ব্যঙ্গময়।

তারপর বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, ‘তা আপনি এ কেসে কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন, মিস্টার বাসু? আমি তো শুনেছিলাম, মেয়েটি কপর্দকহীনা, তাই আদালত নিজের খরচে একজন জুনিয়র উকিলকে নিয়োগ করেছিল।

‘ঠিকই শুনেছেন।’ —বললেন বাসু।

‘আর নির্দোষ প্রমাণিত হবার পরে মেয়েটি হাজত থেকে বেরিয়ে এসেই আপনার মতো ক্যালকাটা বারের এ-ওয়ান ব্যারিস্টারকে এমপ্লয় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি পেয়ে গেল?’

বাসু বললেন, ‘কী জানেন মিস্টার গায়কোয়াড়—– অর্থ-কৌলিন্যের দম্ভে যারা ‘হ্যাভ নটস’- দের মাথায় চাঁদির পয়জার মারতে সদা-উদ্যত তাদের বিরুদ্ধে বিনা ফিতেই আমি কিছু কিছু কেস নিয়ে থাকি।’

জনার্দন গম্ভীর হয়ে গেলেন।

প্রমীলা একতরফা অনেকক্ষণ বকবক করে গেলেন। কীভাবে প্রসেনজিৎ দত্তগুপ্ত প্রমাণ করেছেন সহদেব কর্মকার ঘটনাস্থলে আদৌ ছিল না।

জনার্দন হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘আর ঐ মেয়েটি বোধহয় স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল : একটা স্টর্ক উড়তে উড়তে আসছে। তার ঠোঁট থেকে ঝুলছে একটা পুঁটুলি। তাতে একপাটি ব্রেসলেট। মায়েরা যেমন সারস পাখির কল্যাণে পেটের ভিতর খোকাখুকু পায়, ঐ বেকসুর খালাস পাওয়া মেয়েটিও তেমনি তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর…. ‘

প্রমীলা ধমকে ওঠে : ও জন! ডোন্ট বি ভালগার!

জনার্দন বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বলেন, ‘লেটস বি সিরিয়াস, স্যার। মক্কেলের তরফে আপনার বক্তব্যটা কী?’

‘সেটা আপনাদের লীগাল-কাউন্সেলের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’

‘নো! উই আর সরি। আপনার যা বলার আমাদেরই বলতে হবে। বলুন?’

‘অল রাইট। বলছি : মিসেস প্রমীলা পাণ্ডে একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন যে, আমার মক্কেল দুই লক্ষ টাকার গহনা চুরি করেছে। সেই অভিযোগ মোতাবেক আমার মক্কেল দুই রাত্রি হাজত বাস করেছে। তার বায়োডাটায় একটা দাগ পড়ে গেছে। সে আনএমপ্লয়েড, ঐ কারণে চাকরি পাচ্ছে না।’

জনার্দন বাধা দিয়ে বলল, জাস্ট এ মিনিট, স্যার। প্রমীলা পাণ্ডে একটা কেস এফ. আই. আর করেছিল মাত্র।’

‘না। দ্যাটস নট দ্য হোল টুথ। ইন্সপেক্টর যখন সহদেব কর্মকারের নির্দেশমতো মধ্যরাত্রে আমার মক্কেলকে ঘুম থেকে টেনে তুলল, তখন মিসেস পাণ্ডে নতুন করে আর একটি এফ. আই. আর. লজ করেছিলেন।

‘দ্যাটস অলসো ইজ নট দ্য হোল টুথ, স্যার, আপনি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন যে, মধ্যরাত্রে ইন্সপেক্টর মিস রুবি রায়ের ঘরটা সার্চ করার সময় ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর এক পাটি চোরাই গহনা উদ্ধার করেছিল….

‘দ্যাট এগেন ইজ নট দ্য হোল ট্রুথ, স্যার, মামলার রায়ে আদালত বলেছেন, ‘একপাটি গহনা আসামীর ব্যাগে কেউ হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, অপরাধটা তার ঘাড়ে চাপাতে।’

জনার্দন ব্যঙ্গের হাসি হাসে। বলে, ‘সে প্রসঙ্গ তো আগেই আলোচিত হয়েছে। সম্ভবত কোন পথভ্রান্ত সারস পক্ষী। শুনুন, স্যার, প্রমীলা ঐ মেয়েটিকে চিনত না। কোনও বিদ্বেষবশে সে বলেনি : ঐ চোর। ঐ চোর। ইন্সপেক্টর নিজ হাতে নতুন করে FI.R.টা ড্রাফট করে দিয়েছিল। F.I.R.-এর ভাব-ভাষা সব কিছুর জন্য ইন্সপেক্টর দায়ী। প্রমীলা শুধু স্বাক্ষর দিয়েছে। দেশে কোন আইন নেই যাতে প্রমীলাকে এজন্য দায়ী করা চলে। সে আরক্ষা বিভাগের নির্দেশে অভিযোগে স্বাক্ষর করেছিল মাত্র। ‘দান’ হিসাবে প্রমীলা ঐ চোর মেয়েটিকে যদি কিছু দিতে চায় তো সে আলাদা কথা। ‘খেসারত হিসাবে আমরা এক নয়া পয়সা দিতেও বাধ্য নই। এটাই আইনের শেষ কথা।’

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমি আপনাদের ডাকিনি। অবশ্য মিসেস পাণ্ডে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন। আপনারটা নিতান্তই অ্যান অ্যাপয়েন্টেড ইনট্রুশন।’

গটগট করে এগিয়ে গেলেন তিনি। ধীরে নির্গমন দ্বারটি খুলে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

জনার্দন এবং প্রমীলা দুজনেই দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন।

জনার্দন বললেন, ‘আপনি স্যার, আমাকে ভুল বুঝেছেন।

‘আজ্ঞে না! আপনিই আমাকে ভুল বুঝেছেন। আইনের শেষ কথা আমি আপনার কাছে

শিখতে রাজি নই। এবার আসুন আপনারা।’

জনার্দন মনস্থির করে। প্রমীলার হাত চেপে ধরে বলে, ‘অলরাইট। চলে এস প্রমীলা।’