‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ৬

প্রাতরাশ শেষ করে উনি চেম্বারে এসে বসলেন। রানুও এলেন। রুবি ও

বিশু খাবারের ডিশগুলো সাফ করতে শুরু করল।

বাসু বললেন, রানু, আমার অ্যাড্রেস বুকে দেখ তো রায় সুনীল কুমার, সল্টলেক বি. বি. ব্লক। টেলিফোনে পাও কি না দেখ।

অচিরেই দূরভাষণে যোগাযোগ হল। বাসু জানতে চাইলেন, কী খবর সুনীলও বেবি-সিটার বা মেট্রন জাতীয় কাউকে জোগাড় করতে পারলে?’

সুনীল রায় বলেন, ‘না দাদা। মনোমত একটি মেট্রন জোগাড় করতে আমরা কর্তা-গিন্নি হন্যে হয়ে গেলাম।’

‘বাচ্চাটার বয়স কত? ‘

‘তিন বছর। কেন, আপনার খোঁজে কেউ আছে?’

বাসু সেকথার জবাব না দিয়ে জানতে চান, ‘তোমরা তাহলে দুজনেই চাকরি করতে যাচ্ছ কি করে? কোন আপনজন’ জাতীয় পিসিমা-মাসিমা জোগাড় করেছ নাকি?’

‘নাঃ। মল্লিকা উইদাউট পে ছুটি এক্সটেন্ড করেছে। আমার মনে হয়, এখন একটাই সল্যুশন বাকি। ফার্স্ট স্টেপ— ধর্মান্তর গ্রহণ। সেকেন্ড স্টেপ— দ্বিতীয়বার বিবাহ করা।’

‘সেটা নিতান্তই সাময়িক সমাধান। কারণ এভাবে তো বারে বারে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। দ্বিতীয় পত্নী সন্তানসম্ভবা হলে তৃতীয়বার বিবাহ করতে পার। কিন্তু জানই তো, আইনস্টাইনের মতে বিশ্বপ্রপঞ্চ চতুমাত্রিক। ফোর্থ ডাইমেনশনে গিয়ে ঠেকে যাবে। তার চেয়ে আমি একটা সহজ সল্যুশন দিই, শোন।’

‘বলুন দাদা।’

তুমি একটা গাড়ি কিনবার তাল করছিলে। কিনেছ?’

‘না। কিন্তু হঠাৎ একথা কেন?’

‘আমি একজনকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার অনেক-অনেক কাজ করে দেবে। সকালে ড্রাইভ করে তোমার বাচ্চাকে নার্সারি স্কুলে পৌঁছে দেবে। তারপর তোমাদের দুজনকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে। স্নান করাবে, খাওয়াবে, খেলা দেবে। যতক্ষণ না তোমাদের মধ্যে একজন ফিরে আসছ।’

সুনীল বলে, ‘সবটাই তো হেঁয়ালি দাদা, আমার তো গাড়ি নেই। কী বললাম তখন?

‘গাড়ি নিয়েই এ যাবে। নিজের গাড়ি। ছোট্ট অস্টিন। ফোর সিটার। পেট্রল, রিপেয়ার্স-–সব তোমার, গাড়ির ভাড়া লাগবে না। গ্যারেজের ভাড়া তুমি দাবি করবে না। ও খাবে তোমাদের সংসারে, কিন্তু রান্না করবার সময় পাবে না। থাকবে তোমাদের বাড়িতে। ঐ মেজানাইন ঘরখানায়।

সুনীল একটা ঢোঁক গিলে বলল, ‘ভদ্রলোকের বয়স কত? জানেনই তো দাদা, আমার বউ সুন্দরী আর তার কাঁচা বয়স।’

‘ভদ্রলোক নয়, ভদ্রমহিলা। এও সুন্দরী, কাঁচা বয়স। তবে তোমার কাঁচা বয়সের জন্য আটকাবে না। ও আত্মরক্ষা করতে জানে।’

‘মহিলা! বয়স ঠিক কত?’

‘বয়সের জন্য আটকাবে না। ও তোমার বাচ্চাকে পড়াবে, খেলা দেবে আর ড্রাইভারি করবে। লাইসেন্স অনেকদিনের। হাত খুব স্টেডি। বুঝতেই পারছ। সেলফ-ড্রিভেন-কার ব্যবহার করে, আসানসোল থেকে একা ড্রাইভ করে এসেছে। ওর ইন্টিগ্রিটির সম্বন্ধে আমার গ্যারান্টি রইল। বল, কত মাইনে দেবে?

‘পুরুষমানুষ হলে আমি বলতাম। মহিলা এবং তাঁর বয়সটা জানি না কুমারী, সধবা কিংবা ‘ইয়ে’ কি না তাও জানি না। আমি ফোনটা মল্লিকাকে দিচ্ছি। নিন কথা বলুন।’

মল্লিকা সব কথা শুনে বলল, ‘আমরা কোনও দরাদরি করব না। আপনি যা আদেশ করবেন তাই মাথা পেতে মেনে নেব।’

বাসু বললেন, ‘ও ভাল ছাত্রী ছিল, না হলে আজকাল কেউ ফিজিক্স-অনার্সে চান্স পায় না। বি. এসসি. পরীক্ষার ঠিক আগেই ওর বাবা মারা যান। তোমার কর্তাকে জিজ্ঞাসা কর; বি: এসসি পাশ, উইথ ফিজিক্স অনার্স, টিচার, স্কুলে সদ্য চাকরি পেলে প্রথমে সব মিলিয়ে কত টাকা মাইনে পায়। তার এক টাকা কম হলে আমরা রাজি নই। মেয়েটি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর যেন না পায়।’

মল্লিকা বললে, ‘আমরা রাজি। বিশেষ করে ওর গাড়িটাতে আমাদের অনেক অনেক প্রবলেম সলভড় হয়ে যাবে। ও কবে জয়েন করবে? –

‘ঘণ্টা দুই-তিনের মধ্যে। মানে নিউ আলিপুর থেকে সল্ট লেক পৌঁছতে যতক্ষণ লাগে— হ্যাঁ, ঐ নতুন রাস্তা দিয়েই ওকে যেতে বলব; ইস্টার্ন বাইপাস।… আই নো, আই নো… অতটা সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু ও তো কলকাতার রাস্তাঘাট ভাল চেনে না। আসানসোলে মানুষ হয়েছে। তাই অতটা সময় বলেছি।’

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে রুবির দিকে ফিরে বললেন, ‘ওরা লোক খুব ভাল। মল্লিকা তোমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। ওরা দুজনেই চাকরি করে। কর্তা সরকারি স্কুলের টিচার। গিন্নি অধ্যাপিকা। গ্যারেজের উপর একটা মেজানাইন ঘর আছে। বোধহয় সেটাই তোমাকে দেবে।

কথা বলতে বলতেই ড্রয়ারটা টেনে উনি একটি চামড়ার ব্যাগ বার করলেন। আর ভিতর থেকে বিশখানি একশ টাকার নোট বার করে বাড়িয়ে ধরলেন ওর দিকে। বললেন, ‘নাও ধর।’

রুবির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বললে, ‘এটা কী, স্যার?’

টাকা। দুহাজার। ধর।

‘আমি তো ধার চাইনি।’

আমি তো ধার দিইনি।

ভ্রূকুঞ্চন হয় এবার। বলে : ‘তবে কী? দান?’

‘—তাই কি পারি? আমি তো তোর মামণি নই। এটা অ্যাডভান্স পেমেন্ট। ঐ যে খেসারতটা আদায় করব তার থেকে কিছু অগ্রিম দিলাম তোকে। এই আর কি। আর সেজন্যই তো ঘণ্টা দুই-তিন সময় চেয়ে নিলাম। দু-চারটে জামাকাপড়, চপ্পল, সাবান, তোয়ালেও তো কিনে নিয়ে যেতে হবে। ঐ লালপেড়ে হলুদ শাড়িটাও যে তোর মতো ক্লান্ত। দাও রানু, একটা অ্যাডভান্স পেমেন্টের ভাউচার বানিয়ে দাও দুহাজার টাকার। সুনীলের ঠিকানা আর কলকাতার একটা রোড-ম্যাপের জেরক্স কপি— ঐ বাঁদিকের ড্রয়ারে আছে; ওকে দাও। উইশ য়ু বেস্ট অব লাক।’

রানু একটু পরে এ. এ. ই. আই. এর একটা রোডম্যাপ আর ভাউচার এনে টেবিলের ওপর রাখলেন। পেন-হোল্ডার থেকে কলমটা তুলে নিয়ে বললেন, এইখানে সই কর, রুবি। দু-হাজার টাকার অ্যাডভান্সের রসিদ।’

রুবি কোনও কথা বলল না। নির্দিষ্ট স্থানে সই দিয়ে দুজনকে প্রণাম করে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

রানু টেবিল থেকে একটা ব্লটার উঠিয়ে নিয়ে ঐ অ্যাডভান্স-ভাউচারের ওপর রুবি যেখানে সইটা করেছে সেখানে ‘ব্লট’ করলেন। বাসুর নজর হল।

বললেন, ‘পেনটা লিক করছে না কি?’

রানু বললেন, ‘না। জলটা লবণাক্ত। ও যখন নিচু হয়ে সই করছিল…’