৫
‘—ঘটনার দিন সন্ধ্যায়…..’
‘জাস্ট আ মিনিট : ঘটনার দিন বলতে নিশ্চয় যেদিন চুরিটা হয়, তাই না? সে ক্ষেত্রে সেটা কত তারিখ ছিল? কী বার?’
‘আজ্ঞে হুজুর, তারিখটা ছিল সাতাশে মে, বুধবার এ বছর, মানে এই উনিশ শ’ সাতাশি সন, তেরশ চুরানব্বই; তিথিটা ছিল হুজুর, কৃষ্ণা ত্রয়োদশী। তবে, নখত্তরটা মনে নেই।
বাসু হো-হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘দ্যাটস আ গুড ওয়ান। ফিজিক্স অনার্সের ছাত্রীরাও তাহলে আজকাল তারাশঙ্কর পড়ে। হুঁ। যা বলছিলে বলে যাও। ‘ঘটনার দিন সন্ধ্যায়…..’
‘সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমি মোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঐ মোটর রিপেয়ারিং শপে যাই। সরেজমিনে জানতে, গাড়িটা মেরামত হতে আর কতদিন লাগবে। আকাশ মেঘলা ছিল, তাই ওয়াটার-প্রুফটা হাতে নিয়ে যাই। সত্যি কথা বলতে কি, মোটেলের কাউন্টারে যে ভদ্রলোক বসে থাকেন তিনি কিছু মিছে কথা বলেননি, তাঁর সাক্ষ্যে। তিনি সত্যিই দেখেছিলেন, সন্ধ্যা সাড়ে- পাঁচটা নাগাদ আমাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে। কাঁধে ওয়াটার প্রুফ। তবে আমার শাড়ি-ব্লাউজের রংটা তিনি বোধহয় পুলিশের শেখানো মতো বলেছিলেন। সেকথা ওঁর মনে না থাকাই স্বাভাবিক। যা হোক, আমি কাউন্টারে চাবিটা জমা দিয়ে যাই। চাবির নম্বর 2/1- বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি মোটেলটা দেখেছেন, স্যার?’
‘না, কেন বল তো?’
‘তাহলে একটু বর্ণনা দিই। বুঝতে সুবিধা হবে। একতলায় পাঁচটা গ্যারেজ। রোলিং শাটার। দোতলায় তিনটি সাধারণ ভাড়া দেবার ঘর। প্রত্যেকটিতে সংলগ্ন বাথরুম ও কিচেনেট। আমার ঘরটা ছিল বারান্দার শেষপ্রান্তে। তার নম্বর 2/1, মাঝের ঘরখানা ফাঁকা ছিল। এপাশের ঘরে বাসিন্দা ছিল; কিন্তু কে ছিল তা জানি না। সে ঘরটার নম্বর 2/3; দোতলার বাকি দুটো ঘর ম্যানেজারের কোয়ার্টাস-কাম-অফিস। তিন তলায় পাশাপাশি দুখানি মাত্র ঘর। ভি.আই.পি. রুম এয়ারকন্ডিশন করা। ডবল ভাড়ার। সে দুটি ভাড়া নিয়েছিলেন পুষ্পা আর প্রমীলা।’
রুবি বাসুসাহেবের কাছে স্বীকার করল যে, পুষ্পাদেবীর সঙ্গে আলাপ করার জন্য সে উদগ্রীব ছিল। যদি ওঁর মাধ্যমে বোম্বাইয়ের কোন প্রযোজক বা পরিচালকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু পুষ্পা একেবারে আত্মগোপন করে থাকাই চাইছিলেন। ঘরের বাইরে বার হবার সময় রাজস্থানী কুলবধূদের মতো আকণ্ঠ ঘোমটা টেনে বার হচ্ছিলেন। রুবির তাই সঙ্কোচ হচ্ছিল। সে লক্ষ্য করে দেখেছিল— মোটেল রেজিস্টারেও পুষ্পা সই করেননি। দুটি ঘরই প্রমীলা পাণ্ডের নামে বুক করা।
ঐ রুবি মোটর-রিপেয়ারিং শপে ছিল রাত সওয়া সাতটা পর্যন্ত। আধঘণ্টা টানা বৃষ্টির পর সময়ে বর্ষণের বেগ কিছুটা কমে। রুবি বর্ষাতি গায়ে দিয়ে মোটেলের দিকে ফিরতে শুরু করে। কিন্তু পথে নামতেই আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এল। সে একটা বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীশেডের তলায় আশ্রয় নেয়। মিনিট পনেরো সেখানেই ছিল। ঠিক যখন টিভিতে বাংলা সংবাদ হচ্ছিল। তাই ঐ সময়ের জন্য তার কোনই ‘অ্যালেবাই’ ছিল না। বাস শেডের নিচে আরও লোক ছিল বটে, তবে সবাই ওর অচেনা।
মোটেলে ফিরে আসে আটটা নাগাদ। তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা থেমে গেছে। এই সময় একটা সামান্য ঘটনা ঘটে, যার অবশ্য কোনও তাৎপর্য নেই।…
বাসুসাহেব বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ‘উঁ, হুঁ, হুঁ। তাৎপর্য আছে কি না আমাকেই তা বিচার করতে দাও। আমাকে সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানাও ঐ ব্রেসলেটটার ব্যাপারে।
‘শুনুন তবে। আমি কাউন্টারে এসে চাবিটা চাইলাম। ম্যানেজার ভদ্রলোক কী একটা বই তন্ময় হয়ে পড়ছিলেন। অন্যমনস্কভাবে পিছনদিকে হাত বাড়িয়ে ‘কি-বোর্ড’ থেকে একটা চাবি নিয়ে আমার হাতে দিলেন। আমি চলতে শুরু করেই দেখি, সেটা 2/3 ঘরের চাবি। তাই ফিরে এসে বলি, ‘এটা নয়। আমার চাবির নম্বর 2/1’, তখন ভদ্রলোক চোখ তুলে আমাকে দেখলেন। চাবিটাকেও দেখলেন। তারপর বললেন, ‘এক্সকিউজ মি, আপনার নামটা যেন কী?’ আমি তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম, রুবি রায়। আমার ঘরটা বারান্দার ও প্রান্তে। আমি নিঃসন্দেহ; আমার চাবির নম্বর 2/1’। ভদ্রলোক বললেন, ‘সো সরি।’ বলে 2/3 চাবিটি ফেরত নিয়ে 2/1 চাবিটি আমার হাতে দিলেন। আমি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অকারণেই পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি, ভদ্রলোক কিন্তু তাঁর বইটার পৃষ্ঠায় ফিরে যাননি। সেটা ওঁর গ্লাসটপ-টেবিলে উপুড় করে রাখা আছে। উনি অ্যাটেন্ডেস-রেজিস্টারখানায় কী যেন দেখছিলেন। সে যাই হোক, উপরে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। ভ্যাপসা গরম গেছে সারা দিন। স্থির করলাম, স্নান করব। দরজায় ছিটকিনি দিয়ে বাথরুমে গেলাম স্নান করতে। হোটেলে বা মোটেলের বাথরুম সচরাচর যেমন হয়। টাওয়েল-র্যাকে মোটেলের তোয়ালে, সোপ- হোল্ডারে মোটেলের সাবান। আমি স্যুটকেস থেকে শ্যাম্পু বার করেছিলাম। সেটা রাখব বলে সংলগ্ন কাবার্ডের পাল্লা খুলতে গিয়েই চমকে উঠি। কাবার্ডটা ছোট্ট। মাত্র দুটি কাচের তাক। একটা পাল্লা বন্ধ ছিল, একটা পাল্লা খোলা। দুরম্ভ বিস্ময়ে দেখলাম, নিচের তাকে রাখা আছে একটা জড়োয়া ব্রেসলেট।
‘স্নান করা মাথায় উঠলো। আলোর কাছে এসে ভাল করে পরীক্ষা করলাম। না, নকল জিনিস নয়, সাচ্চা পাথর বসানো সোনার জড়োয়া ব্রেসলেট। লকিং অ্যারেঞ্জমেন্ট নিখুঁত যা নকল ব্রেসলেটে থাকে না।
‘বুঝতে পারি, এ ঘরের পূর্বতন বাসিন্দা স্নানের আগে হাত থেকে ব্রেসলেটটা খুলে রেখেছিলেন। স্নানান্তে সেটা হাতে পরতে ভুলে যান। এক পার্টি কেন? অনেকেই এক পাটি ব্রেসলেট পরে, বিশেষ করে অপর হাতে রিস্ট ওয়াচ পরলে। প্রথমে, স্বাভাবিকভাবে ভাবলাম, ব্রেসলেটটা ম্যানেজারবাবুর কাছে জমা দিই। কিন্তু তখনই মনে হল— ব্রেসলেটটার দাম না হোক পাঁচ-সাত হাজার হবেই। সাচ্চা হীরে-পান্না হলে আরও বেশি হবে। ভদ্রলোককে বিশ্বাস কী? যে মেয়েটির গহনাটা খোয়া গেছে সে হয়তো মনে করতে পারবে না কোথায় খুলে রেখেছিল। তাই স্থির করলাম, পরদিন সকালে লোকাল থানায় চলে যাব। একটা এফ. আই. আর. লজ করে ওটা থানায় জমা দিয়ে রসিদ নেব। শুধু তাই নয়, একজন স্যাকরা ডেকে রীতিমতো ওজন করিয়ে, পাথর গুনতি করে ভ্যালুয়েশন কষে বার করে পাকা কাজ করে রাখব, যাতে আসল ব্রেসলেটটা বদলিয়ে কেউ একইরকম ‘ইমিটেশন’ গহনা না বানিয়ে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে গহনা চুরির অপরাধটা বুমেরাং হয়ে আমার ঘাড়েই ফিরে আসতে পারে। থানা বলতে পারে, আসল গহনার বদলে আমিই ঐ নকলটা জমা দিয়ে গেছি। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া এসে গেল : কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনতলায় চলে যাব। আমি জানতাম, দক্ষিণদিকের ঘরটা পুষ্পার। সে ঘরে বেল দেব। বলব, আমি বিপদে পড়ে ওঁর শরণাপন্ন হয়েছি। উনি একজন বিখ্যাত মহিলা। উনি গহনাটা থানায় জমা দিলে ওসব তঞ্চকতা হবার আশঙ্কা থাকবে না। আমার এই 2/1 ঘরের পূর্ববর্তী বাসিন্দার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেসে আমরা একটা টেলিগ্রাম করব। এই সূত্রে পুষ্পার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবে। আমার সততায় সে মুগ্ধ হবেই। আমি ওর অটোগ্রাফ চাইব। হয়তো ওর বিয়েতে ও আমাকে নিমন্ত্রণ করবে। সে তো দারুণ ব্যাপার। সেক্ষেত্রে সহজেই ওর সাহায্যে বোম্বাই চিত্রজগতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাব…।’
রুবি থামতেই বাসু বলেন, ‘তারপর?’
‘ঐ গল্পটা কার যেন, স্যার? পঞ্চতন্ত্রের না ঈশপের? সেই যে এক কুম্ভকার মনে মনে ভাবছিল রাজা হলে সে কী করবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কাকে যেন ক্যাৎ করে এক লাথি মারল আর তার হাঁড়ি-কলসির স্তূপ…….
‘বুঝলাম। রাত ভোর হবার আগেই এল পুলিশ। তাই তো?’
ইতিমধ্যে বিশুকে নিয়ে রানু ফিরে এসেছেন। বিশু একটা চাকাওয়ালা ট্রলি ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছিল। তাতে ওঁদের তিনজনের ব্রেকফাস্ট। সুজাতা-কৌশিক দু-চারদিনের জন্যে কিসের ইনভেস্টিগেশনে কলকাতার বাইরে গেছে। সুকৌশলীর নিজেদের কাজে।
রুবি চমকে উঠে বলে, ‘এসব কী?’
রানু বলেন, ‘এসব কী মানে? ব্রেকফাস্ট। আমরাও খাব। তুমি বরং ঐ বাথরুমে গিয়ে মুখে- চোখে জল দিয়ে এস। হাজতে কাল রাত্রে তোমাকে এমন কিছু পোলাও-কালিয়া খাওয়ায়নি যে, আজ সকালে অজীর্ণ হবে।’
রুবি হাসতে হাসতে বাথরুমের দিকে চলে যায়।
সেই সময়েই টেলিফোনটা বেজে উঠল।
ব্যারিস্টার সাহেবের চেম্বার বন্ধ থাকলে টেলিফোন লাইনটা ডাইরেক্ট করা থাকে। রানু তুলে নিয়ে শুনলেন। ‘কথামুখে হাত চাপা দিয়ে কর্তার দিকে ফিরে বললেন, ‘হাওড়া থেকে প্রসেনজিৎ দত্তগুপ্ত ফোন করছেন।’
বাসু হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটা গ্রহণ করে বললেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশন্স ইয়াং কাউন্সেলর। দিস ইজ পি. কে. বাসু।’
প্রসেনজিৎ উচ্ছ্বসিত। সে ভাবতেই পারেনি, বাসুসাহেব আজ সংবাদপত্র ঘেঁটে খবরটা ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন। বাস্তবে তা উনি পড়েননি। সিনেমা তারকার গহনা চুরির ব্যাপার বলে সব কাগজেই খবরটা ছাপা হয়েছে। অধিকাংশ সংবাদদাতা তরুণ আইনজীবীর উষ্ণ প্রশংসা করেছে।
বাসু বললেন, ‘মক্কেলকে সব কথা খুলে বলেছ ক্ষতি নেই। কিন্তু আর কাউকে বল না। কৃতিত্বটা তোমারই। দেখ প্রসেনজিৎ, উড়ন-তুবড়ির মাল-মশলা তার নিজস্ব। সে শুধু একটু আগুনের ছোঁয়ার প্রত্যাশায় থাকে। আমি ঐ অগ্নিসংযোগটুকু করে দিয়ে এসেছিলাম মাত্র। ভাল কথা, রুবি রায়ের ব্যাপারটা কিন্তু আমার মতে মেটেনি। সে বেচারি খালাস পেয়েছে বটে, কিন্তু তার হিউমিলিয়েশনের জন্য সে খেসারত দাবি করতে পারে। সে কথা কিছু ভেবেছ?’
‘না, সে কথা তো ও আমাকে কিছু বলেনি।’
ও কেমন করে জানবে ওর অধিকারের সীমা? যা হোক, রুবির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগটা দায়ের করেছিল কে? পুষ্পা?’
‘না, পুষ্পাদেবী বরাবরই ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিলেন। এফ. আই. আর. সই করেছিলেন প্রমীলা পাণ্ডে, কিন্তু সে তো পুলিশেরই পরামর্শে।’
হতে পারে। কিন্তু অভিযোগ দায়ের করেছিল প্রমীলা, সই করেছিল প্রমীলা। আমি হয়তো খেসারত দাবি করব। যেহেতু ও তোমার মক্কেল তাই হয়তো ওরা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চাইবে।
‘ব্যাপারটা মানে? কোন ব্যাপারটা?’
‘কী আশ্চর্য! বিনা দোষে আমাদের মক্কেল দু’দিন হাজতবাস করল। এখন কোথাও চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে হলে ওকে লিখতে হবে যে, ওকে একবার পুলিশে ধরেছিল। প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস হয়েছে— এসবের খেসারত নেই? শোন, তোমার কাছে কেউ যদি অ্যাপ্রোচ করে তুমি বলবে যে, রুবি রায় বর্তমানে আমাদের জয়েন্ট মক্কেল। আমি সিনিয়র, তাই কেসটা তুমি আমাকে রেফার করে দেবে, বুঝলে?’
টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে নজর হয় ইতিমধ্যে রুবি আর রানু এসে বসেছেন টেবিলে। রুবি বলে, ‘সত্যি সত্যি কিছু খেসারত পেতে পারি নাকি?’
‘তার কিছুটা নির্ভর করছে ওদের ইচ্ছার উপর। কিছুটা আমার ওকালতির প্যাঁচে। তোমার পুঁজি এখন কত?’
‘গুনে দেখিনি। বড় মাপের নোট আর একখানাও নেই। পঞ্চাশ, বিশ, দশ টাকার কিছু আছে। আর খুচরো। গুনে দেখতে সাহস হচ্ছে না। কেন স্যার?’
‘তুমি চাকরি খুঁজছো?’
‘নিশ্চয়ই। মাথার উপর ছাদ, নিরাপত্তা, আহার্য আর হাত খরচা। এটুকু হলেই সবরকম সম্মানজনক কাজ করতে রাজি। কলকাতায়।’
খাবারটা খেয়ে নাও আগে। টোস্ট ঠাণ্ডা হয়ে গেলে অখাদ্য হয়ে যায়।