৪
রুবি শৈশবেই মাতৃহীনা। বাপের কাছে মানুষ। আসানসোলে। বাবা ছিলেন মেহনতি মানুষ। লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। সেই দুঃখে মেয়েকে স্কুলে-কলেজে পড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আসানসোলে আপকার গার্ডেন্সে এক ডাক্তারবাবুর গাড়ির ড্রাইভার। ডাক্তারবাবু নিঃসন্তান। ওরা বাপ-বেটিতে থাকত ঐ বিরাট বাড়ির আউট-হাউসে। শুধু লেখাপড়াই নয়, মেয়েকে যত্ন করে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলেন। এছাড়া কলেজে অভিনয় করেও রুবি প্রচুর সুনাম অর্জন করে। পরপর দুবছর বার্ষিক স্যোশালে নাটক-উৎসবে নায়িকার পার্ট করে। স্থানীয় কাগজে ওর খুব সুখ্যাতি বের হয়।
তার পরেই উপর্যুপরি দুর্দৈবের আঘাত। একই বছরে ছয় মাস আগে-পিছে প্রয়াত হলেন ডাক্তারবাবু আর ওর বাবা। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী— রুবি তাঁকে ‘মামণি’ বলে ডাকত— ওকে আউট-হাউসে থেকে পরীক্ষাটা শেষ করতে বললেন। কিন্তু রুবির ঘাড়ে তখন ভূত চেপেছে। যে বহিরাগত নাটক-অভিজ্ঞ ব্যক্তির উপর কলেজের ইউনিয়ন থেকে নাটক পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই লোকটিই ওর মাথা ঘুরিয়ে দিল। তার দৃঢ় বিশ্বাস, রুবি সিনেমা ও টিভিতে সুযোগ পেলে প্রচণ্ড সুনাম করবে। ফিল্ম স্টার! প্রচুর অর্থ, প্রচুরতর গ্ল্যামার। মামণির অজ্ঞাতে ও সেই ভদ্রলোকের কাছে অভিনয় শিক্ষার ক্লাস নিতে থাকে। ভদ্রলোকের নাম জগৎ মল্লিক। খুব চোস্ত হিন্দি বলতে পারেন এতে সন্দেহ নেই। রুবিও হিন্দিতে দড়। জগৎ মল্লিকের ডাক নাম : ঝানু। বলতেন : বম্বের কোনও স্টুডিওতে জগৎ মল্লিককে কেউ চেনে না; কিন্তু ঝানুদাকে সবাই এক ডাকে চেনে।
অস্বীকার করে লাভ নেই রুবি রায় ঐ ঝানু মল্লিকের প্রেমে পড়েছিল। যদিও রুবির বয়স কুড়ি, আর ঝানুর বত্রিশ। কোনক্রমে দুজনে বোম্বাইতে পৌঁছতে পারলেই কেল্লা ফতে। স্ক্রীন টেস্ট, ভয়েস টেস্ট। তারপরেই রুবিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে; বাসুদা, হৃষিদা, মৃণালদা ওকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবেন। নতুন মুখ কে না চায়?
বাবার জমানো টাকার পুঁটুলিটা রুবি তুলে দিয়েছিল তার ঝানুদার হাতে। কথা ছিল, ঝানুদা বোম্বাইয়ে পৌঁছে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করবে। তারপর রুবিকে টেলিগ্রাম করে জানাবে। তখন রুবি একাই বোম্বে চলে যাবে। রেজিস্ট্রি বিয়েটা হবে বোম্বাইতে। রুবির বিশ-ত্রিশটা বিভিন্ন পোজে তোলা রঙিন ফটোও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল ঝানুদা। হৃষিদা-বাসুদাদের দেখাবে বলে।
বলা বাহুল্য, এরপর আর রুবি তার ঝানুদার সন্ধান পায়নি। রুবি কোনক্রমে কলকাতায় বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের স্ত্রীর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে দেখা করে। মৃণাল সেন বলেন, ঝানু মল্লিক নামে তিনি কাউকে চেনেন না— বনফুলের ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ কাহিনীর একটি চরিত্র বাদে। তিনি বোম্বাইয়ে হৃষিকেশ মুখার্জিকেও ফোন করেন— নিজ ব্যয়ে এবং রুবিকে জানান যে, ঝানু মল্লিক নামে বোম্বাই চিত্রজগতে কোনও চরিত্র নেই। তাঁর পরামর্শে রুবি পুলিশে একটা ডায়েরি করে রাখে।
এই হচ্ছে রুবির কপর্দকহীনতার ইতিহাস।
আর গাড়িটা? সেটাও এক বিচিত্র গল্প কথা। ঝানু মল্লিক ওর সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যাবার পর, থানায় এজাহার দেবার পর, সেকথা মামণির কাছে লুকিয়ে রাখা সম্ভবপর হল না। উনি বকাঝকাও করলেন, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেনও প্রচুর। রুবি তখনো জানত না যে, তার দুর্দশার কাল শেষ হয়নি। এ চার বছর সে মামণিকে নিয়ে রোজ সকাল-সন্ধ্যা গাড়ি করে বেড়াতে নিয়ে যেত। সকালে প্রাতঃভ্রমণে, আর বিকালে আশ্রমে, মহারাজের ভাষণ শুনতে বা সমবেত ভজনপূজনে যোগ দিতে। সেটুকুও সহ্য হল না ভগবানের। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মামণি। ক্যান্সার। রুবি প্রাণ দিয়ে সেবাশুশ্রূষা করল। মামণির এক ভাসুরপো এলেন— জেঠিমার সেবা করতে নয়, তাঁর সৎকার এবং সংকারান্তে সম্পত্তির দখল নিতে।
মৃত্যুর দিনতিনেক আগে এক রাত্রে মামণি ওর হাতে তুলে দিলেন একটা টাকার প্যাকেট। বললেন, ‘এটা তোর। আর এই খামখানা রাখ। আমার শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলে এটা শীতলবাবুকে দেখাস। তিনি ব্যবস্থা করবেন।’
সে রাত্রে রুবির কান্নার বিরাম ছিল না।
আশ্চর্য! কাগজ ছিল দুখানা। শীতলবাবু আসানসোলের একজন সিনিয়র উকিল, মামণির স্বামীর বন্ধু। তাঁকে একটি পত্র লিখে উনি অনুরোধ করেছেন অস্টিন গাড়িটির মালিকানা রুবি রায়ের নামে ট্রান্সফার করে দিতে। সংলগ্ন পত্রটি ছিল একটা কাঁচা ‘সেল ডীড’। ডাক্তারবাবুর মৃত্যুর পর রুবির বাবার কাছে নগদে বিশ হাজার টাকা নিয়ে তিনি নাকি আকাশী-নীল ঐ অস্টিন গাড়িটা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। জাল বিক্রয়পত্র। কিন্তু এছাড়া ভাসুরপোর গ্রাস থেকে গাড়িটা উদ্ধার করে রুবিকে দান করার ক্ষমতা শয্যালীন মৃত্যুপথযাত্রিণীর ছিল না। উইল করে দেবার সুযোগ ছিল না আদৌ।
মামণির শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার আগেই ব্লু-বুক জমা দিয়ে নাম পালটানোর ব্যবস্থা করলেন শীতলবাবু। গাড়ির মালিকানা পেল রুবি। কিন্তু আউট-হাউসে থাকার অধিকারটা পেল না। আগে খেয়াল হলে মামণির কাছ থেকে কিছু বাড়িভাড়ার রসিদ করিয়ে নিতে পারত। করেনি। কারণ তার লক্ষ্য-মুখ অপরিবর্তিতই ছিল। ও স্থির করেছিল, প্রথমে টালিগঞ্জে চেষ্টা করবে, টিভি সেন্টারেও। অভিনয় ওকে করতেই হবে। কলকাতার কয়েকজন নামকরা পরিচালক ও প্রযোজকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরবে। ইতিমধ্যে কিছু অর্থোপার্জন করতে হবে তাকে। তারপর বোম্বাই পাড়ি দেবে। মামণির দেওয়া হাজার তিনেক টাকা আর গাড়িখানা নিয়ে দুঃসাহসী মেয়েটি রওনা হয়েছিল গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে কলকাতামুখো।
বেলুড়ের কাছাকাছি পৌঁছে ওর গাড়িতে কী-যেন ট্রাবল দেখা দেয়। পথপার্শ্বের অভিজ্ঞ এক মোটর-মেকানিক ওকে জানালেন, পুরানো মডেলের অস্টিনের স্পেয়ার পার্টস জোগাড় করা অসম্ভব। লেদ-মেশিনে সেই পার্টস বানিয়ে গাড়ি চালু করতে দু-তিনদিন লাগবে।
ঘটনাচক্রে কাছেই ছিল একটা মোটেল। সদ্য গড়ে উঠেছে। বেলুড়ের যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে। রুবি একখানা ঘর ভাড়া নিল। সেখানেই পেল একটা দারুণ খবর। বোম্বাইয়ের বিখ্যাত চিত্রতারকা পুষ্পাদেবী নাকি পরদিন ঐ মোটেলে এসে উঠবেন।
ওমা! সে কী? কেন? বিচিত্র যোগাযোগ।
পুষ্পাদেবী বাঙালি। বাবা নেই। মা আছেন। বেলুড়ের এক আশ্রমে সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন করেন তিনি। সংসারের বাইরে। পুষ্পা প্রায় রুবিরই সমবয়সী দু-এক বছরের বড়। উল্কার বেগে তার গ্ল্যামার বৃদ্ধি হয়েছে। পুনা ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে হৃষীকেশ মুখার্জির একটা বইতে ছোট্ট একটা চরিত্র পায়। দারুণ সুনাম করে তাতে। তারপর বছরখানেকের মধ্যেই পাঁচ-সাতটা ছবিতে কনট্রাক্ট পায়। সম্প্রতি গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের এক দূর সম্পর্কের নওজোয়ান জনার্দন গায়কোয়াড়ের সঙ্গে পুষ্পার এনগেজমেন্ট হয়েছে। জনার্দন ধনকুবের। কোটিপতি। অনেকগুলি মিলের মালিক। বিবাহটা হবে— জনার্দনের ইচ্ছা গোয়ালিয়রে, পুষ্পার ইচ্ছা বোম্বাইতে এখনো তারিখ ও ‘ভেনুটা’ স্থির হয়নি। এ বিবাহে পুষ্পার সন্ন্যাসিনী জননী উপস্থিত থাকতে পারবেন না এ কথা বলাই বাহুল্য। সে আশাও ওরা করে না। তবে মায়ের ‘তথাকথিত’ অনুমতি পেতে ওরা যুগলে বেলুড়ের সারদা আশ্রমে এসে মাকে প্রণাম করে যাবে, এটাই স্থির ছিল। পুষ্পা একদিন আগে এসেছে— মায়ের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করার বাসনা নিয়ে। তার সঙ্গে এসেছে প্রমীলা পাণ্ডে — ওর ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী। প্রমীলা বড়লোকের মেয়ে, বড়লোকের বউ। যদিও স্বামী অন্য স্ত্রীলোকের সঙ্গে অন্যত্র থাকে। পুষ্পা আর প্রমীলাকে দমদম এয়ারপোর্টে রিসিভ করেছে পুষ্পার পাবলিসিটি এজেন্টের লোক মোস্তাক আহমেদ। সংবাদটা প্রেসের কাছ থেকে গোপন রাখতে বেচারির জিব বেরিয়ে গেছে। যাহোক, প্রেসের লোক পুষ্পাকে এয়ারপোর্টে ততটা ঘিরে ধরতে পারেনি। আহমেদ একটা ভাড়া করা লেটেস্ট-মডেল কন্টেসাও হাজির রেখেছিল এয়ারপোর্টে।
সারদা-আশ্রমের নিজস্ব অতিথি-আবাস আছে। কিন্তু সেখানে ঠাঁই হতে পারে না পুষ্পা বা প্রমীলার। দুপক্ষের জীবনদর্শন ও জীবনযাত্রায় আশমান-জমিন ফারাক। তাই পরিচয় গোপন রেখে পুষ্পা এসে উঠেছে ঐ মোটেলে। একটা লাল পাড় সাদা সিল্কের শাড়িও নিয়ে এসেছে, সেটা পরে আশ্রমে যাবে মায়ের সাক্ষাতে। মোটেলটা বড় রাস্তায়, আশ্রম থেকে দূরে নয়। পরদিন জনার্দনের এসে পড়ার কথা। ভায়া দমদম। তাকে রিসিভ করতে এই কন্টেসাখানাই যাবে।
বৈভবের প্রতীক ঐ কন্টেসাখানা আশ্রনে নিয়ে যাওয়াতে পুষ্পা রাজি নয়। সেটা ভাল দেখায় না। বোম্বাই থেকে প্রমীলার মেড-সার্ভেন্ট রুক্মিণীও এসেছে। তার জিম্মার ঘরদোর রেখে ওরা ট্যাক্সি নিয়ে সারদা-আশ্রমে গেল সকালেই। পুষ্পা আর প্রমীলা। দুপুরে ওখানেই প্রসাদ পাবে। মুশকিল হল এই যে, মোটেলের গ্যারেজ-ঘরের মাপ লেটেস্ট-মডেল কন্টেনার চেয়ে ছোট। ম্যানেজার আশ্বস্ত করেছে, তাতে অসুবিধা নেই। গাড়িটা রাস্তার ধারেই পার্ক করা থাকবে। গাড়ির উপর ওয়াটার প্রুফ হুড পরানো থাকবে। আর পাহারাদার থাকবে রাত দশটা থেকে সকাল ছয়টা।
দুর্ভাগ্যবশত পুলিশের মতে চুরিটা হয়েছে সন্ধ্যেরাতে। সেসময় বৃষ্টি পড়ছিল। কন্টেসা গাড়ির চালক গেছিল স্থানীয় সিনেমা হলে ‘শোলে’ দেখতে। মোটেলের একটি জমাদারনি বলে, সেও দেখেছে কে যেন গাড়ির পিছনদিকটা খুলছিল। সন্ধ্যা রাতে। সাতটা-সাড়ে সাতটায়। ও ভেবেছিল যাদের গাড়ি তারাই খুলছে। লক্ষ্য করে দেখেনি। কারণ, জমাদারনির মনে আছে, মেয়েটির পরনে ছিল একখানা জমকালো শাড়ি— যে শাড়ি পরে সে প্রথমে এসেছিল। তাই।
রুবি বিকালে বেরিয়েছিল। রাত আটটায় ফিরে আসে। তখনো চুরির কথাটা জানাজানি হয়নি।
ট্যাক্সি করে পুষ্পা আর প্রমীলা ফিরে আসে রাত নয়টায়। তারপর তাদের নজর পড়ে ব্যাপারটা। কন্টেসা গাড়ির পিছনদিকের ডিকিটা খোলা। পুলিশ আসে সাড়ে নয়টায়। রুবি এসব কিছুই জানে না। রাত সাড়ে এগারোটায় কে যেন তার ঘরে বেল দেয়। ও উঠে গিয়ে দোর খুলে দেখে পুলিশ। বেশ কিছু লোকও এসে ভিড় করেছে। তাদের মধ্যে ছিল ঐ সহদেব কর্মকার। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ঐ তো, ঐ ভদ্রমহিলাই। ঐ দেখুন— যা বলেছিলুম, হলুদ শাড়ি, লাল পাড়, লাল ব্লাউজ।’
বাসু জানতে চাইলেন, আর ব্রেসলেটটা? সেটা কে কেমন করে ঢুকিয়ে দিল তোমার ভ্যানিটি ব্যাগে?’
রুবি বলল, ‘থাক না স্যার ও প্রসঙ্গ। মুক্তি যখন পেয়েই গেছি।’
‘না, না। মুক্তিই পেয়েছ, কিন্তু কেসটা মেটেনি। অন্তত আমার কৌতূহলটা মেটেনি। বল, একপাটি ব্রেসলেট কে কোন সুযোগে তোমার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে দিল?’
রুবি হাসল, বলল, ‘আপনি, আমাকে উদ্ধার করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমি তো স্যার আপনার মক্কেল নই। বলব সত্যি কথাটা?’
‘তুমি চুরি করেছিলে? কেমন করে? কোথায়?’
রুবি আবার শুরু করে, ‘আজ্ঞে না। আমি চোর নই!’