৩
বাসুসাহেবের হাতে এখন কোন কেস নেই। পরদিন সকালে ল-লাইব্রেরিতে বসে একটা চটি বই পড়ছিলেন। বেলে-কাগজে মলাট দেওয়া। যাতে দূর থেকে বোঝা না যায় কী বই। এমন খানকতক মলাট দেওয়া বই আছে ওঁর ল-জার্নালের এক চিহ্নিত ফাঁক-ফোকরে। যার সন্ধান . সুকৌশলীও জানে না। হাতে কাজ না থাকলে বহুবার পঠিত এ বইগুলো উনি আবার পড়েন। লুইস ক্যারলের ‘অ্যালিস’, মার্ক টোয়েনের ‘হাক্ ফিন’, ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’, রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ অথবা সুকুমার রায়ের কোনও বই।
রানু তাঁর হুইল চেয়ারে পাক মেরে ল-লাইব্রেরিতে এলেন। বললেন, ‘একটি মেয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
বাসু বলেন, ‘মর্মান্তিক বারতাটা তো ইন্টারকমেই জানাতে পারতে।’
‘পারতাম। আশঙ্কা হল, তুমি যদি দেখা না কর। মেয়েটি কোন লীগ্যাল অ্যাডভাইস নিতে আসেনি। শুধুমাত্র তোমাকে একটা প্রণাম করতে এসেছে।’
‘শুধুমাত্র প্রণাম করতে? হঠাৎ প্রণাম কেন?’ :
‘তা বলেনি। শুধু বলেছে ওর নাম রুবি রায়। হাজতে ছিল। ছাড়া পেয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’।
‘হুঁ! ওর পরনে কি হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি? লাল পাড়? আর ঐ লাল রঙেরই ম্যাচিং ব্লাউজ?’
রানু অবাক হয়ে বলেন, ‘তুমিও যে পাকা ডিটেকটিভের মতো শুরু করলে। এসব টিকটিকিসুলভ বদ-অভ্যাস তো তোমার ছিল না। কী করে জানলে?’
বাসু বইখানা হাত-সাফাই করে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এলিমেন্টারি ওয়াটসন। মেয়েটির আর দ্বিতীয় পোশাক নেই। আমি জানি। ও কপর্দকহীনা।’
মাথা ঝাঁকিয়ে রানু বললেন, ‘ভুল হল, মিস্টার হোমস্। মেয়েটি একটি স্কাই-ব্লু রঙের অস্টিন চালিয়ে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, গাড়িটা কার?’ ও বললে, ‘ওর’। ও আদৌ কপর্দকহীনা নয়।’
‘আয়াম সরি দেন। তা পেন্নাম করতে দিলে কি ফী লাগে?’
‘লাগে। একশ টাকা। কারুর যদি দাঁতটি নড়ে, চারটি টাকা মাসুল ধরে। প্রণাম করার ইচ্ছে
জাগে, একশ টাকা ট্যাকসো লাগে। বুঝলে? রেফার : সেকশন টোয়েন্টিওয়ান!
‘মানে?’
রেফারেন্স পাবে। চোরের উপর বাটপাড়ি করে, আমিও ওটা মাঝে মাঝে লুকিয়ে পড়ি যে। ‘আবোল-তাবোল।’
বাসুসাহেব হো হো করে হেসে ওঠেন।
* * * * * * * *
প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই বাসু বলেন, ‘কী ব্যাপার? পেন্নাম কেন?
‘আপনি যেন জানেন না?’
‘আমি তো জানি, তুমি জানলে কী করে?’
‘মিস্টার দত্তগুপ্তই বললেন।’
‘অন্যায় করেছে। আইনজীবীদের মন্ত্রগুপ্তি অভ্যাস করতে হয়। বস।’
মেয়েটি বসল। বললে, ওঁর দোষ নেই। সকালে তিনি রীতিমতো আমতা-আমতা করছিলেন। নিশ্চিত জেল হবে বুঝে নিয়ে যখন নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম তখনই হঠাৎ ঘটে গেল একটা অঘটন। আফটারনুন সেশনে প্রসেনজিৎবাবু একটা ‘নোভার’ মতো বেমক্কা জুলে উঠলেন।
‘কিসের মতো? ‘Nova? ‘নোভা’ কাকে বলে তুমি জান?’
‘কেন জানব না?’
‘তুমি কতদূর পড়াশুনা করেছ?’
রুবি নিজের মলিন পোশাকের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল, বি. এস-সি, থার্ড ইয়ার পর্যন্ত। বাবা মারা যাবার পর পরীক্ষাটা দেওয়া হয়নি। ফিজিক্সে অনার্স ছিল…
‘যাক সেকথা। যে কথা বলছিলে…’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রসেনজিৎবাবু কালবৈশাখি ঝড়ের মতো যেন ধেয়ে এলেন। উপর্যুপরি, প্রশ্নের ধাক্কায় সহদেব কর্মকার ফ্ল্যাট। ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব আমাকে বেকসুর খালাস দিলেন। আদালতের সিনিয়ার উকিলের দল মিস্টার দত্তগুপ্তকে অভিনন্দন জানিয়ে ফিরে যাবার পর আমি ওঁকে প্রশ্ন করেছিলাম : ‘ম্যাজিকটা হল কী করে?’
বাসু বললেন, ‘কিন্তু আর একটা ম্যাজিকের সমাধান যে এখনো হয়নি, রুবি। তুমি কপর্দকহীনা, না অস্টিন গাড়িটার মালিক?’
দুটোই সত্যি স্যার। কিন্তু ব্যাখ্যা করতে অনেক সময় লাগবে।’
‘লাগুক না। আমার এখন মক্কেল-টক্কেল নেই। হাতে কোনও কেসও নেই, বল। গল্পটা শোনাই যাক। রানু, মানে আমার বেটার হাফকেও ডাকি। বরং।