‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ২

কাজকর্ম সেরে বিচারকের খাশ কামরার বাইরে এসে দেখেন জনশূন্য আদালতে একজন মাত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওঁকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেই লোকটা এগিয়ে এল। নিজে থেকেই বলল, ‘আমার নাম প্রসেনজিৎ দত্তগুপ্ত।’

বাসু বলেন, ‘চিনেছি। আপনিই এ মামলার কোর্ট অ্যাপয়েন্টেড ডিফেন্স কাউন্সেল। কী ব্যাপার? আমাকে কিছু বলবেন?’

—’না, বলার কী আছে? আমাকে তুমিই বলবেন, স্যার। আপনাকে একটা প্রণাম করব বলে দাঁড়িয়ে আছি। হাইকোর্টে আপনাকে দেখেছি, দূর থেকে। ল পাশ করার আগেও ক্লাস পালিয়ে আপনার কেস অ্যাটেন্ড করতে গেছি। আপনার আর্গুমেন্ট শুনবার আকর্ষণে।’

প্রসেনজিৎ নত হয়ে ওঁকে প্রণাম করল। বলল, ‘আজকের দিনটা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। কারণ এটাই আমার জীবনে প্রথম কেস। যদিও কেসটা হারব। আর আজ‍ই আপনাকে প্রণাম করার সুযোগ এসে গেল।’

বাসু বলেন, ‘আমার এখানকার কাজ মিটে গেছে। বাড়ি ফিরে যাব। তুমি কী করবে, প্রসেনজিৎ? লাঞ্চ করবে না?’

প্রসেনজিৎ হেসে বলল, ‘আমরা ব্যারিস্টার নই স্যার, উকিল। সকালেই একপেট ভাত খেয়ে আদালতে এসেছি।’

‘কেসটা কেমন বুঝছ?’

‘অ্যাবসোলিউটলি হোপলেস। অথচ মুশকিল কী জানেন, স্যার? আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে, রুবি ঐ গহনাটা চুরি করেছে।

‘রুবি নিশ্চয় ঐ আসামীর নাম। চোরাই মালটা কী? কোথায় পাওয়া গেছে?’

‘একপাটি জড়োয়া ব্রেসলেট। ওর ভ্যানিটি ব্যাগে।’

‘একপাটি? শুনলাম দু-লাখ টাকার গহনা।’

‘বাদবাকি কোথায়, তা পুলিশ এখনো জানে না।’

বাসু বললেন, ‘স্ট্রেনজ্! সব গহনা পাচার করে ও একপাটি ব্রেসলেট ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দেবে কেন? প্রসিকিউশনকে এভিডেন্স সাপ্লাই করার ঠিকা নিয়েছে নাকি?

‘বলুন তো স্যার! কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীটা একেবারে ঝুনো নারকেল। এক চুল টলাতে পারছি না তাকে।’

বাসু বললেন, ‘প্রসেনজিৎ! তুমি একটা নির্জন ঘরে আমাকে নিয়ে যেতে পার? তোমাকে কয়েকটা টিপস দিতাম। মিথ্যে সাক্ষী যারা দেয় তাদের পেড়ে ফেলার বিশেষ কতকগুলো প্যাঁচ আছে।’

প্রসেনজিৎ উৎসাহে লাফিয়ে ওঠে। নাজিরবাবুর কাছে নিয়ে বাসুসাহেবের পরিচয় দিতে তিনি স্বয়ং এগিয়ে এলেন। নত হয়ে নমস্কার করলেন। আর একটি ঘরের তালা খুলে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা কথা বলুন, স্যার। কেউ ডিসটার্ব করতে আসবে না।’

ফ্যানটা খুলে দিয়ে নাজিরবাবু প্রস্থান করলেন দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে।

বাসু ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শোন প্রসেনজিৎ, জেরা যখন করবে তখন ঝড়ের মতো একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাবে। কাগজপত্র দেখবে না, ডাইনে-বাঁয়ে তাকাবে না। সাক্ষীর ভ্রমধ্যে টার্গেট স্থির করে মেশিনগান চালিয়ে যাবে।’

প্রসেনজিৎ বলল, ‘থিওরিটিক্যালি বলা সহজ। কিন্তু বাস্তবে কী হয় দেখলেন তো? সহদেব কর্মকার— মানে ঐ পুলিশের ভাড়া করা সাক্ষী—আমার প্রতিটি প্রশ্নের কী রকম রসিয়ে রসিয়ে জবাব দিচ্ছিল দেখেছেন? আমাকে ‘টন্ট’ করে কবে?

‘তুমি ওকে টন্টিং জবাব দেবার সুযোগ দিচ্ছিলে কেন? অলরাইট। লেটস্ প্লে এ গেম। ধরা যাক, তুমি সহদেব কর্মকার, আর আমি প্রসেনজিৎ দত্তগুপ্ত। আমি তোমাকে জেরা করব। তুমি আমাকে টন্টিংলি’ জবাব দাও দেখি।’

প্রসেনজিৎ উঠে দাঁড়ালো। বলল, ‘রেডি’।

বাসু বললেন, ‘সহদেব তুমি যখন নয়টার সময় ফিরে এলে তখন তুমি বলেছ যে, পুলিশ তদন্ত করছিল। তখন গাড়ির মালিক ফিল্ম-স্টার মিস পুষ্পা সেখানে নিশ্চয় ছিলেন না?’

প্রসেনজিৎ বললে, ‘আজ্ঞে না। সে কথা তো আমি বলিনি! তিনি ছিলেন বৈকি। তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে ছিলেন।

‘তাঁর পরিধানে কী রঙের শাড়ি ছিল?’

‘কী রঙের শাড়ি ছিল? তা আমার মনে নেই!’

‘কী রঙের ব্লাউজ ছিল তাঁর গায়ে?’

‘আমার মনে নেই। তিনি ভিড়ের মধ্যে ছিলেন তো।’

‘কী রঙের পাড় ছিল তার শাড়িতে?’

‘কী আশ্চর্য! আমি তো মানে… তাঁকে এত লক্ষ্য করে দেখিনি।’

‘তখন, মানে সেই রাত নটায় বৃষ্টি পড়ছিল কি?’

‘আজ্ঞে না।’

‘তার মানে পুষ্পাদেবীর গায়ে রেনকোট ছিল না।’

‘আজ্ঞে না।’

‘রাস্তার জোরালো বাতি এবং মোটেলের নিয়ন বাতি তখনো যথারীতি জ্বলছিল।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘পুষ্পাদেবীর বয়স পঞ্চাশের কম?’

‘কী আশ্চর্য! আমি তাঁর বয়স কী করে জানব?’

‘পুষ্পাদেবীর বয়স পঞ্চাশের কম?’

‘বলছি তো স্যার, আমি জানি না।’

পুষ্পাদেবীর বয়স পঞ্চাশের কম? তিনবার একই প্রশ্ন করলাম, সহদেব। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা কর না সহজ প্রশ্নটা। জবাব দাও।’

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ।’

তিনি ঐ আসামীর বয়সীই। দু-পাঁচ বছর এদিক-ওদিক হবে।’

‘আজ্ঞে তাই।’

‘এবার তুমি হুজুরকে বুঝিয়ে বল কী কারণে তুমি পুষ্পাদেবীর মতো সুন্দরী, তরুণী, সুবিখ্যাত চিত্রতারকার পরিধানে কী ছিল জান না, অথচ রেনকোটের নিচে আসামী কী রঙের শাড়ি পরেছিল, কী রঙের ব্লাউজ, শাড়ির কী রঙের পাড় তা লক্ষ্য করেছ, মনে করে রেখেছ। শ্রুতিধর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মতো অনর্গল ভাষায় তা হুজুরকে শুনিয়ে চলেছ। বল, আনসার দ্যাট কোশ্চেন…..’।

প্রসেনজিৎ কিছু বলার আগেই, বাসু চট করে এক পা এগিয়ে ও পাশ ফিরে বলেন, ‘অবজেকশন য়োর অনার, আর্গুমেন্টেটিভ।’

বলেই উনি নিজের জায়গায় ফিরে যান। দেওয়ালে টাঙানো স্যার আশুতোষের একটি ছবিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মি লর্ড! আমি দেখাতে চাইছিলাম, এই সাক্ষী আদ্যন্ত পুলিশের নির্দেশ মেনে তোতাপাখির মতো বুলি কপচিয়ে যাচ্ছে। পুষ্পাদেবীর মতো সুবিখ্যাত চিত্রতারকাকে ও লক্ষ্য করে দেখেনি, অথচ বর্ষাতির নিচে আসামীর শাড়ির পাড় কী রঙের ছিল তা ওর মনে আছে। হাউ? এ কি বিশ্বাসযোগ্য?

প্রসেনজিৎ বলে, ‘ওয়ান্ডারফুল… এ ভাবে…’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমার জেরা শেষ হয়নি। এরপর আমি ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে আসামীকে ঐ ডাকব্যাক বর্ষাতিটা গায়ে দিয়ে পিছন ফিরে ঝুঁকতে বলব। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বলব, আপনি যে প্রোফাইল এখন দেখছেন, য়োর অনার, তাই দেখা যাবে যদি ঐ ভাগ্যহীনার গায়ে আমি এখন চার পাঁচ বালতি জল ঢেলে দিই, তবু ওর শাড়ি বা সায়া সপসপে হয়ে ভিজে যাবে না। বর্ষাতির জন্য তখনো ঐ হতভাগিনীর ভদ্রভাষায় যাকে ‘নিতম্বের প্রোফাইল’ বলে, তা এই অভদ্র, অসভ্য ভাড়া করা সাক্ষী তার পিচুটি-ভরা চোখ মেলে দেখতে পাবে না, য়োর অনার! এতেই প্রমাণিত হচ্ছে : সহদেব কর্মকার ঘটনাস্থলে আদৌ ছিল না। আদ্যন্ত সাজানো বুলি তোতাপাখির মতো কপচিয়ে যাচ্ছে। আমার এই অ্যানালেসিস যদি ভুল হয়, তাহলে মহামান্য সহযোগী সরকার পক্ষের উকিল এই সাক্ষীকে রি-ডাইরেক্ট প্রশ্ন করে প্রতিষ্ঠা করুন— এক : কী কারণে সহদেবের মতো ‘পীপিং-টম’ সুন্দরী চিত্রতারকার সাজপোশাক লক্ষ্য করেনি, অথচ ঐ ভাগ্যতাড়িতার মলিন শাড়ির পাড়ের রংটা পর্যন্ত মনে রেখেছে? দুই : বর্ষাতি গায়ে দেওয়া সত্ত্বেও আসামীর শাড়ি-সায়া ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে কি করে ভিজে সপসপে হয়ে গেল? তিন : বর্ষাতি-পরা মেয়েটির নিতম্বের প্রোফাইল দেখবার মতন রঞ্জন-রশ্মির দৃষ্টি ঐ পীপিং-টম কোথায় পেল!’

প্রসেনজিৎ এগিয়ে এসে ওঁকে দ্বিতীয়বার প্রণাম করল।

বাসু বললেন, ‘নিজের উপর আস্থা রাখ, প্রসেনজিৎ! তুমি প্রাণপাত করে লেখাপড়া শিখেছ, ল পাশ করেছ, ভদ্র শিক্ষিত বংশের সন্তান তুমি— তোমাকে টন্টিং টোনে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে ঐ অভদ্র অসভ্য লোকটা পার পেয়ে যাবে? বিকালে জেরায় ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে। উইশ য়ু বেস্ট অব লাক।’.