১৭
রবির মুশকিল হচ্ছে এই যে, সে তার ‘বস’-এর চেয়ে বুদ্ধিমান। সে বুঝতে পেরেছে এ কেসে সতীশ বর্মন ভুল আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে। রুবি রায়ের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না। অসম্ভব। কারণ রুবি খুনটা করেনি। কিন্তু না বর্মন, না মাইতি— কেউই ওর যুক্তিতে কর্ণপাত করেনি। ফলে সে নিজের বুদ্ধিমতো কিছু তদন্ত করছে। এখন জনান্তিকে বাসুসাহেবের দ্বারস্থ হয়েছে। যদি তাঁর মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া যায়।
এটা বলা বাহুল্য, তাকে লুকিয়ে করতে হচ্ছে।
রবির ব্যবস্থাপনায় আদালতের একটি নির্জন ঘরে এসে বাসুসাহেব ওর মুখোমুখি বসে বললেন, ‘তোমার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরেছি। এ খেলা তুমি-আমি আগেও খেলেছি, রবি। একই শর্তে, একই খেলা আবার খেলতে আমি রাজি। অর্থাৎ আমার প্রাপ্তি— আসামীর বিরুদ্ধে তোমরা চার্জ তুলে নেবে, আর তোমার প্রাপ্তি, প্রকৃত আসামীর পরিচয় এবং প্রমাণ- যাতে তার কনভিকশন হয়। এই তো? বল কী বলতে চাও?’
‘আপনি স্যার, জেরার মুখে সহদেবের ট্যাক্সির নম্বরটা জানতে চাইলেন, কিন্তু প্রশ্নটা নাকচ হয়ে গেল। নম্বরটা আমি জানি, আপনাকে জানালে কিছু সুরাহা হবে?’
‘হবে। তার আগে বল— ট্যাক্সিটা এখন কোথায়?
‘একটা রিপেয়ার গ্যারেজে। সহদেব একটা ছোটখাটো অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ট্যাক্সির মালিক জানে না। জানলে ওকে আর ট্যাক্সি চালাতে দেবে না, এই ভয়ে নিজের খরচেই নিজের জানা ওয়ার্কশপ থেকে নিজের তত্ত্বাবধানে সহদেব ট্যাক্সিটা সারিয়ে নিচ্ছে।’
‘তুমি ট্যাক্সিটা দেখেছ? রিপেয়ার গ্যারেজটা চেন?’
‘আজ্ঞে না, অ্যাকসিডেন্টের পর ট্যাক্সিটাকে আর দেখিনি। তবে শুনেছি, সেটা আছে বচন সিং-এর রিপেয়ার শপে। ইস্টার্ন বাইপাস যেখানে সল্ট লেকের দোরগোড়ায় এসে পড়ছে গ্যারেজটা সেখানে। বচন সিং টেলিফোনে আমাকে বলেছে, সামনের মাডগার্ডটা তুবড়ে গেছে। আর বাঁদিকের হেডলাইটের কাচ ভেঙে গেছে। মাইনর অ্যাকসিডেন্ট। কেন স্যার?’
‘বলছি। তার আগে বলত, ঐ মারুতি সুজুকি গাড়িটা কার? মানে যেটা কালভার্টের নিচে পড়েছিল, যা থেকে ডেড বডিটা পাওয়া গেছে?’
‘ও গাড়িটার মালিক দয়ারামবাবু। ফিল্ম প্রোডিউসার। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে তাঁর একটা ছবির কাজ হচ্ছিল। ঐ মোস্তাক আহমেদ কিছুদিন ধরে গাড়িটা চালাচ্ছিল। স্টুডিওতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, দয়ারামবাবুর নির্দেশে দুপুর দুটো নাগাদ ঐ গাড়িতে আহমেদ দুজন মহিলা ফিল্ম- আর্টিস্টকে পার্ক সার্কাসের দিকে নামিয়ে দিতে যায়। তারা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছায়। তারপর আহমেদ কেন হঠাৎ সল্ট লেকের দিকে যায়, তার সঙ্গে কে ছিল, কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না সব ব্ল্যাঙ্ক! দয়ারামবাবু কিছুই ধারণা করতে পারছেন না।’
‘আর সহদেব কর্মকারের ট্যাক্সিটার মালিক কে? আদালতে সাক্ষী দিতে উঠে ও বলেছিল, লেক টাউনের এক সর্দারজী ট্যাক্সিটার মালিক। তার নাম কী? জান?
‘হরদয়াল সিং! লোকটা এখনো জানে না, তার গাড়ি একটা অ্যাকসিডেন্টে পড়েছে। সহদেব সে খবরটা গোপন রেখেছে।
‘তুমি সহদেবের ব্যাপারে এত খোঁজ-খবর কেন রাখছিলে রবি?’
‘এই মার্ডার কেসটার জন্য নয়, স্যার। সেই বেলুড়ের গহনাচুরির কেসটার ব্যাপারে। মিস রায়ের বিরুদ্ধে সে স্পষ্টতই মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিল। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি তো জানি— সহদেব পুলিশের ভাড়াটে সাক্ষী ছিল না। তাহলে কার স্বার্থে সে মিথ্যা সাক্ষী দেবার জন্য পুলিশের কাছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসে? ‘লাল-পাড়, হলুদ শাড়ি র বর্ণনা দেয়? আমার সিনিয়র অফিসার কথাটা মানতে চাননি, কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, গহনা চুরির কেসের যে মূল আসামী তার সঙ্গে সহদেবের আঁতাত আছে। তারই স্বার্থে ও আদালতে উঠেছিল মিথ্যা সাক্ষী দিতে। রুবিকে ফাঁসাতে। পুলিশের দৃষ্টি বিপথগামী করতে। এজন্য আমি ট্র্যাক রেখে চলছিলাম। দেখতে চাইছিলাম, সহদেব কর্মকারের জীবনযাত্রায় হঠাৎ কোন ‘ছপ্পড়ফোঁড়’ পরিবর্তন এসেছে কি না— লটারিতে বেমক্কা টাকা পেলে যেমন হয়!’
বাসু খুশি হয়ে বললেন, ‘ভেরি গুড! তা ওর সম্বন্ধে কী জানতে পেরেছ ইতিমধ্যে?’
‘সহদেব লোকটা অবিবাহিত। কিন্তু একটি স্ত্রীলোককে নিয়ে লেকটাউনের একান্তে একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকে। মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে তার জান পহচান তো আছেই, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব থাকার সম্ভাবনা। একই কথা রামলগনের বিষয়ে। তবে বেলুড়ের গহনা চুরির কেসের পর সহদেবের জীবনযাত্রায় কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। যেমন হয়নি রামলগন বা আহমেদের জীবনে। টাকাটা ওরা পেলেও এখনো বেমক্কা খরচ করতে শুরু করেনি।’
বাসু বললেন, ‘তোমাকে পর পর কতকগুলি কাজ দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে করতে হবে। দরকার হয়, নোট বইতে লিখে নাও।
রবি পকেট থেকে নোটবই বার করল।
‘এক নম্বর : থানা থেকে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট বানিয়ে নিয়ে চলে যাও বচন সিং-এর রিপেয়ার শপে। ট্যাক্সিটাকে খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে। দুটো পয়েন্ট বিশেষভাবে লক্ষ্য করবে। প্রথম কথা: সামনের দিকের মাডগার্ডটা কি ডেলিবারেটলি তোবড়ানো হয়েছে?
রবি বলে, ‘মানে? ডেলিবারেটলি তোবড়ানো হবে কেন?’
বাসু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একইভাবে বলতে থাকেন, দ্বিতীয় কথা : ট্যাক্সিটার সামনের দিকে, বাঁদিকের বনেটে কোনও নিটোল গর্ত আছে কি না, যা একটা পয়েন্ট 38 ক্যালিবার রিভলভারের গুলিতে হওয়া সম্ভব। তুমি স্লাইড ক্যালিপার্স সঙ্গে নিয়ে যেও। যদি ঐ ছিদ্রটা দেখতে পাও তাহলে বচন সিংকে জিজ্ঞেস কর, ঐ ফুটোটা মেরামত করার নির্দেশ সহদেব দিয়ে গেছে কি না। এনি ওয়ে, আমার যা সন্দেহ তা ঠিক হলে বচন সিংকে অর্ডার দিও রিপেয়ার বন্ধ রাখতে! ট্যাক্সিটা সে ক্ষেত্রে একটা মারাত্মক এভিডেন্স।’
রবি বলে, ‘বুঝলাম। আপনি আশঙ্কা করছেন, ঐ ট্যাক্সিটা করেই রুবিকে কেউ তাড়া করে এবং রুবির আন্দাজে ছোড়া গুলিটা ঐ বনেটে লাগে। কিন্তু এই ডিডাকশনের পিছনে যুক্তি কী?’
‘বাঃ! রুবি তার এজাহারে বলেছিল, মনে নেই— দ্বিতীয় গুলিটা সে পিছনের গাড়ির হেডলাইট লক্ষ্য করে ছোড়ে। আর সে একটা ‘মেটালিক ক্লিংক’ শুনতে পায়।’
‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু সেটা যে ঐ ট্যাক্সিটাই, তা ধরে নিচ্ছেন কী করে?’
‘বলছি। তার আগে তোমার কাজগুলো পরপর লিখে নাও। বচন সিং-এর গ্যারেজে তদন্ত শেষ হয়ে গেলে— তা তুমি বনেটে পয়েন্ট থ্রি এইট বোরের ছিদ্র পাও বা না পাও— সোজা চলে যাবে সহদেবের ডেরায়। সে প্রচণ্ড আপত্তি জানাবে, শুনবে না। তুমি সার্চ-ওয়ারেন্ট দেখিয়ে তার বাড়িটা সার্চ করবে।
রবি বাধা দিয়ে বলে, ‘কিন্তু কী খুঁজব? মার্ডার ওয়েপন?’
‘না। ক্যাশ টাকা। শোন রবি, পুলিশের ভুল হচ্ছিল কোথায় জান? গ্র্যাজুয়েট হবার আগেই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দাবি করা। প্রথম মামলাটা ছিল চুরির, দ্বিতীয়টা খুন। পুলিশ বুঝতে পারেনি, এ দুটো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তুমি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলে— তাই সহদেবের ট্র্যাক রেখেছ! আমার কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছ।… বেলুড়ের গহনা চুরির কেসটার একটা প্রকাণ্ড বড় ব্লু আজ আদালতে সহদেবের জবানবন্দিতে ধরা পড়েছে, সেটা কি নজরে পড়েছে তোমার?’
রবি মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে পুরো এক মিনিট চিন্তা করে বলল, ‘সরি স্যার! ধরতে পারছি না। সহদেব কী এমন মারাত্মক স্টেটমেন্ট করেছে?’
‘পুষ্পা তার ড্রাইভার-কাম-কুককে বোম্বাই সিনেমাজগত থেকে বিতাড়ন করতে যখন বদ্ধপরিকর, অথচ তাকে উপযুক্ত চাকরি খুঁজে দিতে পারছে না, তখন সাময়িক সমাধান হিসাবে আহমেদকে সে প্রমীলার কাছে পাঠিয়ে দেয়। সহদেব তা স্বীকার করেছে। সম্ভবত ওরা দুই বান্ধবী ড্রাইভার এক্সচেঞ্জ করে। একটু খবর নিলেই তুমি তা জানতে পারবে। সহদেব স্বীকার করেছে, পুষ্পার বাড়ি ছাড়ার পর এবং কলকাতা আসার আগে মোস্তাক আহমেদ মাস ছয়েক প্রমীলার ড্রাইভার হিসাবে চাকরি করে। তাই নয়?
—হ্যাঁ, তাই। কিন্তু তা থেকে কী প্রমাণ হয়?’
‘লজিক্যালি স্টেপ-বাই-স্টেপ চিন্তা কর, রবি। গাড়ির ডিকির চাবি আর স্যুটকেসের চাবি দুটোই ছিল মোক্ষম। দুটোই বিদেশে বানানো — অ্যালয় স্টিলের মজবুত ফুলপ্রুফ চাবি। এমনকি দক্ষ চাবিওয়ালারও নাগালের বাইরে। গণপতি, হুডিনি বা পি. সি. সরকার অকুস্থলে ছিলেন এমন তথ্য আমরা পাইনি। তাহলে চুরিটা হল কী ভাবে? একটা চাবি ছিল পুষ্পার কাছে, একটা প্রমীলার কাছে। যে কোন একজনের কাছে দুটোই যদি থাকত তাহলেও না হয় সন্দেহ করা যেত, এক বান্ধবী অপর বান্ধবীর গহনা চুরি করেছে। এক্ষেত্রে সেরকম ব্যতিক্রম সমাধানও মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, দুটো চাবি ছিল দুজনের কাছে। দুজনে সংযুক্ত ভাবে চুরি করবে না- তার কোনও অর্থ হয় না। সুতরাং?
রবি কোনও কথা বলল না। অপ্রয়োজনবোধে।
বাসু আবার শুরু করেন, ‘একমাত্র সমাধান : যে কোন উপায়েই হোক, চোরের হাতে দু-দুটি চাবির ডুপ্লিকেট এসে গিয়েছিল। যা বিদেশে বানানো। গাড়ি ও স্যুটকেসের ক্রেতা যা অরিজিনাল ম্যানুফ্যাকচারারের কাছ থেকে পেয়েছিল! তা যদি ধরে নিই, তাহলে জানতে হয়, ডুপ্লিকেট চাবি দুটো কোথায় ছিল, কার হেপাজতে? কন্টেসা গাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা ছিল ম্যান্ডেভিলা গার্ডেলে, ঘটনাস্থল থেকে দশ-বারো মাইল দূরে— রেন্ট-আ-কার সার্ভিসের তালা-চাবি দেওয়া কী-বোর্ডে। তাই নয়? এটাই বলা হচ্ছে। কিন্তু ঐ সঙ্গে একথা বলা হচ্ছে না যে, সহদেব কর্মকার ছিল ঐ প্রতিষ্ঠানের হেড মেকানিক আর রামলগন সবচেয়ে পেয়ারের ড্রাইভার। ঘটনার অনেক আগে থেকেই ওদের মধ্যে যে কোন একজনের পক্ষে ঐ চাবিটা হস্তগত করা সম্ভব। দুজনে যৌথভাবেও করে থাকতে পারে।’
‘কিন্তু ফরেন-মেক স্যুটকেসের চাবিটা?’
‘ইয়েস। সেটা ছিল আরও দূরে। সুদূর গোয়ালিয়রে প্রমীলার স্টিল আলমারিতে। কিন্তু প্রমীলার জবানবন্দিতে আমরা জেনেছি, অন্তত আমি জেনেছি যে, তার অতি বিশ্বস্ত পরিচারিকা রুক্মিণীকে সে ঘরদোরের চাবি বিশ্বাস করে দিত। এমন কি প্রমীলা যখন দু-তিন মাসের জন্য ফরেন বেড়াতে যায় তখন রুক্মিণীকে আলমারির চাবি দিয়ে যায়। হয়তো ভিতরের সিক্রেট ড্রয়ারের চাবিটা দেয় না— ঠিক জানি না। তার কারণ, প্রমীলা জানে রুক্মিণীর চুরি করার উপায় নেই। তার তিন কূলে কেউ নেই। চুরি করে সে পালাবে কোথায়? বিশ্বস্ততা তার বিবেকপ্রসূত কতখানি, আর কতটা অবস্থা গতিকে তার পরিমাপ হয়নি। রুক্মিণী বালবিধবা। দশ বছর বয়সে সিঁদুর মুছে প্রমীলার সংসারে এসেছে। একান্তভাবে সে প্রমীলার উপর নির্ভরশীল। বাইরের দুনিয়াকে সে বাল্যেই ত্যাগ করে এসেছে। নিতান্ত অসহায় মেয়েটি। অন্তঃপুর থেকে দেখেছে, বোম্বাইয়ের চিত্রজগতের রঙিন খেলা! সমবয়সী যৌবনবতীদের। প্রমীলার, পুষ্পার, আরও পাঁচজনের। এখন তার বয়স পঁচিশ। যাকে বলে ভরা যৌবন! কিন্তু আদিম রিপুর তাড়না তাকে দাঁতে-দাঁত দিয়ে সহ্য করে যেতে হয়েছে। সে খিদমৎগার, পরিচারিকা, নৌকরানি।… বিবেচনা করে দেখ রবি, এই পরিবেশে ছয়মাসের জন্য প্রমীলার গৃহস্থালীতে এসে উপস্থিত হল একজন : লেডি কীলার হিসাবে যে কুখ্যাত। প্রমীলার গাড়ির ড্রাইভার- অতি সুদর্শন মোস্তাক আহমেদ! হয়তো রুক্মিণী তাকে দুবেলা একান্তে আহার্য পৌঁছে দেয়। মালকিনের আদেশে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করতে বলতে যায়। সেই সব একান্ত মুহূর্তে কী ঘটছে আমাদের জানার উপায় নেই। তা প্রমাণ করা যাবে না। আন্দাজ করা যায়। আহমেদ রুক্মিণীকে মোহমুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। হয়তো তাকে বুঝিয়েছিল, ওরা দুজনে চলে যাবে কোনও সুদূর দেশে— প্রমীলার নাগালের বাইরে। ঘর বাঁধবে দুজনে, সন্তান মানুষ করবে, সার্থক হবে রুক্মিণীর নারী জন্ম!’
রবি চুপ করে থাকে; জবাব দেয় না।
বাসুসাহেবই আবার কথা বলে ওঠেন, ‘তা যদি হয়ে থাকে তবে দেশের প্রচলিত আইনের ধারায় সেই আনপড় গ্রাম্য স্ত্রীলোকটি অপরাধী। সে বিশ্বাসহতা। কিন্তু কী প্রচণ্ড প্রলোভনের তাড়নায় সে আহমেদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল একবার ভেবে দেখ, রবি!’
রবি জানতে চায়, ‘তাহলে আপনার থিয়োরি অনুযায়ী কে কে ছিল এই ষড়যন্ত্রে? আই মিন, চুরির কেসটায়?
ডেফিনিট জানি না আমরা। রুক্মিণী ছিল, না হলে সুকৌশলে ডুপ্লিকেট চাবিটা অকুস্থলে উপস্থিত হতে পারে না। রুক্মিণীর সঙ্গে সহদেব বা রামলগনের পরিচয় ছিল এমন তথ্য আমরা পাইনি— যদিও রুক্মিণী আর রামলগন দুজনের আদি নিবাস ছাপড়া জিলা। আমার ধারণা, রুক্মিণী আর আহমেদ যৌথভাবে স্যুটকেসের ডুপ্লিকেট চাবিটা হাতিয়েছিল। আর ডিকির চাবিটা রামলগন অথবা সহদেবের কীর্তি।
আরও লক্ষ্য করে দেখ রবি, বোম্বাই থেকে সদ্য আগত আহমেদ কলকাতার চোরাবাজার থেকে লক্ষ টাকা মূল্যের মুকুটটা উদ্ধার করে মাত্র একুশ হাজার টাকায় প্রমীলাকে হস্তান্তরিত করেছিল…’
রবি বাধা দিয়ে বলে, ‘আপনি বলতে চান, আহমেদ নিজেই ঐ জীবন ব্রহ্মচারীর ছদ্মবেশে…:
বাসুও ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ছদ্মবেশ যে নিয়েছিল একথা তো আমরা জেনেছি একমাত্র প্রমীলার উক্তি থেকে। সেটা কতদূর সত্য তার প্রমাণ কী? আহমেদের সঙ্গে রুবির, রুক্মিণীর এবং পুষ্পার সম্পর্কটা আমরা জানি বা আন্দাজ করেছি, কিন্তু সেই লেডি কীলারের সঙ্গে স্বামী-পরিত্যক্তা প্রমীলা পাণ্ডের সম্পর্কটা কি আমরা আন্দাজ করতে পেরেছি? হয়তো ঐ ছদ্মবেশ, ঐ ছদ্মনাম— সবই প্রমীলার উর্বর কল্পনাপ্রসূত — আহমেদকে আড়াল করতে। আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখ, রবি। তুমি জান কি জান না, জানি না রুবি আমাকে বলেছিল, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সে যখন হোটেলে ফিরে এসে ঘরের চাবিটা চায় তখন কাউন্টারে বসা ছেলেটি ভুল করে ওকে রুক্মিণীর চাবিটা দিয়েছিল…’
রবি বাধা দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সে কথাটা আমিও শুনেছি। কিন্তু তার তাৎপর্যটা কী?’
‘ধর, ঘটনা যদি এইভাবে ঘটে থাকে? বেলা নয়টার সময় ট্যাক্সি নিয়ে পুষ্পা আর প্রমীলা সারদামায়ের মন্দিরের দিকে চলে গেল। রুক্মিণী মোটেলে রইল। তার হেপাজতে তখন তিনটি ঘরের চাবি। সে কী-বোর্ডে দুটো চাবি জমা দিয়ে পুষ্পার ঘরে ঢুকল। পুষ্পার একখানি দামী ছাড়া শাড়ি— যেটা পরে সে এয়ারোড্রাম থেকে এসেছে — পরে, একগলা ঘোমটা দিয়ে নিচে নেমে গেল। কাউন্টারের ভদ্রলোক জানে, সিনেমাস্টার পুষ্পা পাবলিসিটি এড়াতে রাজস্থানী মহিলাদের মতো একগলা ঘোমটা দিয়ে রাস্তায় বের হয়। ফলে একটা হাতব্যাগ নিয়ে ঘোমটা দিয়ে পুষ্পা সেজে রুক্মিণীর পক্ষে ঐ কন্টেসা গাড়ির দিকে যাওয়াতে কারও কিছু সন্দেহ হয়নি। মোটেলের জমাদারনী তার জবানবন্দীতে বলেছিল সে কথা। রুক্মিণীর হেপাজতে এখন ডিকির এবং স্যুটকেসের ডুপলিকেট চাবি। প্রথমটা সে পেয়েছে রামলগন, সহদেব বা আহমেদের কাছ থেকে। দ্বিতীয়টা সে আহমেদের নির্দেশ মতো বোম্বাই থেকে নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এমনটা ঘটে থাকলে রুক্মিণীর পক্ষে গাড়ির ডিকি আর স্যুটকেসের তালা খুলে গহনা, মুকুট আর রিভলভার চুরি করা কঠিন কাজ নয়। এবার সে মোটেলে ফেরার পথে ঐ একগলা ঘোমটা দিয়েই যদি কাউন্টারে তার ‘নৌকরনীর’ চাবিটা চায়- ‘দো-বাই-এক নম্বর কুঞ্জি’ তাহলে বই পড়তে পড়তে কাউন্টার-ক্লার্ক তাকে তাই দেবে। রুক্মিণী এভাবে অনায়াসে রুবি রায়ের ঘরে চলে আসতে পারে। বাথরুমের ওয়াড্রোবে একপাটি ব্রেসলেট রেখে আবার নেমে যায়। চাবিটা কী- বোর্ডে জমা দিয়ে ফিরে আসে পুষ্পা অথবা প্রমীলার ঘরে। এজন্যই যখন রুবি রায় এসে তার ঘরের চাবিটা চায় তখন কাউন্টার-ক্লার্ক অন্যমনস্কভাবে তাকে 2/3 চাবিটা ধরিয়ে দিয়েছিল। রুবি যখন জানায় যে, তার চাবির নম্বর 2/1 তখন কাউন্টার ক্লার্ক একটু হকচকিয়ে যায়। রুবির নাম জানতে চায়। রেজিস্টারে মিলিয়ে দেখে। কী-বোর্ডে তখন দোতলায় তিনটি চাবিই ঝুলছিল। ফলে সে রুবিকে 2/1 চাবিটা দিয়ে আবার গল্পের বইয়ে ডুবে যায়।’
বাসু থামলেন। রবি বসু তথ্যটা হজম করে নিয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে বলছিলেন, সহদেবের আস্তানা সার্চ করতে…
‘হ্যাঁ। খুব সম্ভব গহনা পাবে না। তবে বেমক্কা বেশ কিছু ক্যাশ টাকা পেতে পার। যা সহদেবের মতো ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়িতে থাকার কথা নয়। একশ টাকার নোট যতগুলি পাবে— যদি দু-পাঁচ হাজার ক্যাশও পাও, তাহলে সেগুলি সংগ্রহ করে তার পরিপূরক টাকা ওকে দিয়ে আসবে। স্থানীয় সাক্ষী রেখে, যে নোটগুলি নিলে তার নম্বর লিখে; সাক্ষীর স্বাক্ষর রেখো।’
‘বুঝলাম।’
বাসু বললেন, ‘সবটাই আমার এম্পিরিক্যাল হাইপথেসিস! এমনটা যে ঘটেছিল একথা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে পারব না। এমনকি সাকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স থেকেও। তেমনি তুমিও পারবে না প্রমাণ করতে যে এমনটা ঘটেনি!’
রবি বলে, ‘সুতরাং? সল্যুশন কী?’
‘সল্যুশন তোমার কর্মক্ষমতার। তোমার তদন্তের ফলাফল। তুমি তদন্ত করে প্রমাণ কর, আমার এম্পিরিক্যাল হাইপথেসিসটা ভ্রান্ত। আমি তাহলে নতুন করে আবার ভাবতে বসব। প্রমীলা আহমেদকে যে একুশ হাজার টাকা দিয়েছিল— তার ডিনোমিনেশন যাই হোক তার নম্বর প্রমীলা রাত জেগে টুকে রেখেছে নিশ্চয়। এটুকু সে করবেই। তুমি দেখ, সেই নম্বরী নোটের বেশ কিছু বান্ডিল সহদেবের বাড়ি সার্চ করে উদ্ধার করতে পার কি না।’
রবি জানতে চায়, ‘আহমেদ হত্যার ব্যাপারে আপনার থিয়োরিটা কী?’
‘আগে বল, তোমার থিয়োরিটা কী?’
‘আমার ধারণা : এটা প্রফেশনাল খুনির কাজ। খুনটা যে করেছে সে মোটা টাকার বিনিময়ে তা করেছে।’
‘অর্থাৎ জনার্দন গায়কোয়াড়ের টাকায়?’
‘এছাড়া আর কোনো মোটিভ দেখতে পারেন? আহমেদ অনেক-অনেক মেয়েকে নিয়ে খেলা করেছে। তাদের অনেকে ওকে আজ ঘৃণা করে; যেমন পুষ্পা অথবা রুবি, কিন্তু তারা সেজন্য ওকে খুন করবে না। আই মীন, ডেলিবারেট পূর্বপরিকল্পিত খুন। রাগের মাথায় পাথরের টুকরো ছুড়ে নয়।’
‘বুঝলাম। কিন্তু সেক্ষেত্রে সেই প্রফেশনাল খুনি কেন রুবির গাড়িতে রিভলভারটা ফেলে যাবে? রিভলভারটা মিস্টার গায়কোয়াড়ের। প্রফেশনাল খুনিকে নিয়োগ করলে তিনি কেন নিজের রিভলভারটা তাকে দেবেন? প্রফেশনাল খুনী যে দশ-বিশ হাজার টাকা নিয়ে একজন ধনকুবেরের জীবনের পথের কাঁটাকে সরিয়ে দিচ্ছে সে কি একটা স্মাগলড্ রিভলভার যোগাড় করে আনতে পারবে না? হাত পেতে মালিকের কাছে তাঁরই নামে লাইসেন্সড রিভলভারটা চাইবে? আর ধনকুবের তাই তাকে দেবেন? যাতে পুলিশে সহজেই তাঁকে সন্দেহ করে?
‘তাহলে?’
‘আহমেদ হত্যার ব্যাপারেও আমার একটা হাইপথেসিস আছে। আদালতে তা আমি প্ৰমাণ করতে পারছি না এখন। কিন্তু তুমি যদি আমার ঐ থিয়োরি অনুযায়ী অনুসন্ধান কর, আর তথ্যের যোগান দিতে পার তাহলে প্রকৃত অপরাধীর কনভিকশন না হবার কোন কারণ নেই।’
‘বলুন স্যার, আপনার হাইপথেসিসটা কী?
‘আমি ধরে নিচ্ছি— বেলুড়ে গাড়ি থেকে চুরিটা করেছিল রুক্মিণী; কিন্তু তার মূল নায়ক মোস্তাক আহমেদ। রামলগন সাতে-পাঁচে ছিল না; কিন্তু সহদেব কর্মকার ছিল। সহদেবেরই পরিকল্পনা মতো রেন্ট-আ-কার সার্ভিসের কি-বোর্ড থেকে ঐ কন্টেসা গাড়ির ডিকির ডুপ্লিকেট চাবিটা এনে দেয় রুক্মিণীকে। মূল অপরাধী আহমেদ তখন ঘটনাস্থল থেকে বহুদূরে। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। একাধিক গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে। রুক্মিণী কীভাবে গহনা ও রিভলভারটা চুরি করেছিল তা আগেই বলেছি। পরে সম্ভবত আহমেদ আর সহদেবের মতপার্থক্য হয়েছিল গহনার বখেরা নিয়ে। চোরাই গহনা কোথায় নিরাপদে বিক্রয় করা যায় তা হয় তো ওরা জানত না, অথবা সাহস পায়নি। প্রমীলা পাণ্ডের সঙ্গে যদি আহমেদের কোনও নিবিড় সম্পর্ক থেকে থাকে তবে আহমেদই কোনও আষাড়ে গল্প শুনিয়ে একুশ হাজার টাকায় মুকুটটা প্রমীলাকে বেচে দিয়ে আসে। প্রমীলা পুলিশে যায় না, বাকি গহনা উদ্ধারের আশায়। সম্ভবত এই পর্যায়ে অন্য একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আহমেদ আর সহদেবের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। আহমেদ চেয়েছিল, রুবিকে তার পাওনা আট হাজার টাকা নগদে মিটিয়ে দিয়ে বাকি টাকা দুভাগ করতে— অথবা তিন ভাগ, রুক্মিণীর মুখ বন্ধ করতে। আহমেদ চায়নি, আসানসোলের কেসটা নিয়ে সে ফেঁসে যায়— ঠিক যখন পুষ্পা আর জনার্দনের বিয়ে ঘোষিত হতে চলেছে। সহদেব তাতে রাজি হয়নি। সে ডবল-ক্রস করবে বলে মনস্থ করে। নিজের ট্যাক্সিখানা সল্ট লেক বা লেক টাউনে রেখে সে টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে গিয়ে আহমেদের সঙ্গে দেখা করে। জানায় যে, সে টাকার ভাগ চার না— কোল্ট কোবরা রিভলভারটা পেলেই সে মুকুট বেচা একুশ হাজার টাকার দাবি থেকে সরে আসবে। আহমেদ রাজি হয়ে যায়। বন্ধুকে বলে, ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে বিশ হাজার টাকা নগদে নিয়ে একা যেতে সে সাহস পাচ্ছে না। সহদেব সশস্ত্র থাকলে, সে ভরসা পায়। এটাই চাইছিল সহদেব। মারুতি সুজুকি গাড়িতে দুই মহিলাকে পৌঁছে দিয়ে ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে দুই বন্ধু সল্ট লেকের দিকে রওনা দেয়।
তখন হয়তো বেলা আড়াইটে-তিনটে, ডাইভার্শনের কাছে আহমেদ গাড়ির গতিবেগ খুব কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তখন হয়তো ওখানে বৃষ্টি পড়ছিল— ডাইভার্শান রোড কর্দমাক্ত ও জনমানবহীন। সহদেব বসেছিল, পাশের সীটে। ডাক্তার সান্যাল আদালতে যেভাবে বর্ণনা করেছেন সেভাবেই সহদেব আহমেদকে হত্যা করে এক বিঘৎ দূরত্ব থেকে। একুশ হাজার খুচরো নোটে ভর্তি অ্যাটাচি কেসে রিভলভারটা ভরে নেয়। মৃতদেহ-সমেত মারুতি সুজুকি গাড়িটা ডাইভার্শান রোডের বিপরীত দিকে কালভার্টের নিচে গড়িয়ে দেয়। বলাবাহুল্য, নিজের আঙুলের সব ছাপ মুছে নিয়ে। তারপর হিচ-হাইক করে সে সল্ট লেক বা লেক টাউনে— যেখানে তার ট্যাক্সিটা রাখা ছিল সেখানে ফিরে আসে। রুবির বাড়িতে যায়। দেখে, ছাদে মিস্ত্রিরা কাজ করছে বটে কিন্তু কেউ তাকে নজর করছে না। রুবির বাড়িতে গাড়িটা গ্যারাজ করা ছিল না, ছিল ড্রাইভ-ওয়েতে, তার ড্রাইভারের দিকের কাচটা নামানো। রুবিই বলেছে, সেটা ওঠানো যাচ্ছিল না। সহদেব ইতিমধ্যে রিভলভারের ব্যারেলটা সাফা করেছে। একটা তাজা বুলেট ভরে দিয়েছে। এবার সে সুযোগ বুঝে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রিভলভারটা অস্টিন গাড়ির ড্রাইভারের সিটে নামিয়ে দিয়ে কিছু দূরে অপেক্ষা করে। একটু পরে রুবি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, গাড়িটা গ্যারেজ করতে। ড্রাইভার-সিটে রিভলভারটা আবিষ্কার করে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কী করবে স্থির করে উঠতে পারে না। কিন্তু সহদেব আন্দাজ করতে পেরেছিল, সে কী করবে। থানায় কোন করবে না। করবে তার সলিসিটরকে। আমার পরামর্শটা সে সবার আগে নেবে। সহদেব আরও আন্দাজ করেছিল— আমি ওকে বলব, যন্ত্রটা নিয়ে আমার হেপাজতে দিয়ে যেতে। বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। রুবির অস্টিন গাড়ির পিছন পিছন সহদেব তার ট্যাক্সিটা চালিয়ে নিয়ে আসে। রুবি বার দুই হাত নেড়ে ওকে ওভারটেক করতে বলে; কিন্তু সহদেব ওকে অতিক্রম করে যায় না। সে অপেক্ষা করছিল কতক্ষণে রুবির অস্টিনটা সেই অভিশপ্ত ডাইভারশানটার কাছে আসে। তার কাছাকাছি এসেই ও রুবির অস্টিনটাকে ডানদিক থেকে ঠেশে ধরে। সে যা চেয়েছিল তাই হল : রুবি ওকে ভয় দেখাতে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলে। একটা…. দুটো! তখনই সহদেব ব্রেক কষে। ফিরে যায়। সহদেব আশা করেছিল, আহমেদের দেহের ভিতর থেকে বুলেটটা উদ্ধার করা যাবে— আর ব্যালিসটিক এক্সপার্ট কম্পারেটিভ নাইক্রোস্কোপের টেন্টে প্রমাণ করবেন যে, রুবির রিভলভার থেকেই ফেটাল বুলেটটা নিক্ষিপ্ত। সে স্বপ্নেও ভাবেনি, জনার্দন ঐ মারণাস্ত্রটা বদলে দেওয়ার সুযোগ পাবেন— হ্যাঁ, তাই পেয়েছিলেন, রবি- তুমি জান কি জান না, জানি না…?
রবি বাধা দিয়ে বলল, ‘জানি। তারপর?’
‘সহদেব ভেবেছিল, সে নিপুণহাতে সব কিছু করেছে। একুশ হাজার টাকা তার হেপাজতে ভাগিদার কেউ নেই। আহমেদ মৃত। রুক্মিণীর চোরের মায়ের কান্না ছাড়া কিছু করার নেই। চোরাই কোল্ট-কোবরা রিভলভারটা গছিয়ে দিয়েছে রুবির ঘাড়ে। বেলুড়ের চুরির কেস অথবা আহমেদ হত্যা কেসে তাকে কোনভাবেই পুলিশে জড়াতে পারবে না। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। রুবির দ্বিতীয় বুলেটে ওর ট্যাক্সির বনেটের বাঁদিকে একটা ফুটো হয়েছে। এটা বিশ্রী একটা এভিডেন্স। সহদেব সেটা মেরামত করে নিতে চাইল, সে নিজেই মেকানিক। তাই হাতুড়ি দিয়ে সামনের মাডগার্ডে আর হেডলাইটে আঘাত করে একটা কৃত্রিম অ্যাকসিডেন্টের পরিবেশ তৈরি করে ট্যাক্সিটা বিশ্বস্ত রিপেয়ার গ্যারেজে মেরামত করতে দিয়ে আসে। ট্যাক্সি-মালিকের অগোচরে গাঁটের পয়সা খরচ করে সে ওটা সারাতে দেয়। বিশেষ অনুরোধ থাকে, ফুটোটা বন্ধ করে তাপ্পি লাগানো।
রবি চট করে উঠে দাঁড়ালো। নিচু হয়ে বাসুসাহেবকে প্রণাম করল একটা।
বাসু বললেন, যত রাতই হোক ফোন কোরো আমাকে। আমি জেগে থাকব।’
‘ইয়েস স্যার।’
রাত সাড়ে দশটা।
নৈশাহার সেরে যে যার ঘরে চলে গেছেন। মন্ত্রগুপ্তি বাসুসাহেবের মজ্জায় মজ্জায়। কাউকে কিছু বলেননি। শুধু রানুকে বললেন, ‘তুমি শুয়ে পড়। আমি লাইব্রেরি ঘরে একটু পড়ব।’
রানু বললেন, ‘তিন পেগের বেশি খেও না যেন।’
‘কী আশ্চর্য! আমি পড়ব বলেছি। ড্রিংক করবো তো বলিনি।
‘ওই হলো।’— হুইল চেয়ারে পাক মেরে তিনি শয়নকক্ষের দিকে চলে গেলেন।
টেলিফোন লাইনটা ডাইরেক্ট করাই ছিল। রাত এগারোটা নাগাদ বাজল সেটা। বুঝলেন রবি বোস। তুলে নিয়ে আত্মঘোষণা করতেই ও প্রান্ত থেকে সাড়া দিলেন প্রমীলা পাণ্ডে, ‘জেগে ছিলেন তো স্যার? ডিস্টার্ব করছি না?’
‘না। আমি জেগে জেগে বই পড়ছি। ইন-ফ্যাক্ট একটা ফোন এক্সপেক্ট করছি—’
জানি। ইন্সপেক্টর রবি বোসের। উনি এতক্ষণ এখানেই ছিলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই হোটেল হিন্দুস্থানে। এইমাত্র চলে গেছেন। আপনার প্রথম অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। মানে গহনা চুরির কেসটা। আমি ভাবতেই পারিনি চোরাই গহনাগুলি আমার পাশের ঘরেই রয়েছে- রুক্মিণীর ঐ স্যুটকেসে। রিভলভার আর মুকুট ছাড়া সে সব কিছুই নিজের কাছে রেখেছিল। আহমেদও বোধহয় মনে করেছিল, এটাই সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। তা সে যাই হোক, আহমেদের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই রুক্মিণী কেমন যেন পাগলামি শুরু করে। আমরা তার হেতুটা ঠিক বুঝতে পারিনি। রবিবাবুর ধমকানিতে সে কাঁদতে কাঁদতে সবকিছুই স্বীকার করেছে। চুরি যাওয়া গহনার প্রায় সবটাই উদ্ধার করা গেছে।’
বাসু জানতে চান, ‘রবি কি ওকে অ্যারেস্ট করেছে?’
‘করবে না? বলেন কী!
‘বুঝলাম। কিন্তু মুকুটটা উদ্ধার করতে তুমি যে একুশ হাজার টাকা আহমেদকে দিয়েছিল…?’
‘আজ্ঞে না। সে তো জীবনবাবুকে। জীবন ব্রহ্মচারী।’
‘ঐ হল! তার নোটের নম্বর কি টুকে রেখেছিলে?’
‘নিশ্চয়। লিস্টটার কপি দিয়ে দিয়েছি রবিবাবুকে…’
‘আর কিছু বলবে?’
‘বলব স্যার। আপনার ক্লায়েন্টের কাছে অপরাধী হয়ে আছি। আপনি আমাকে ঋণমুক্ত করুন স্যার! আপনি অনুমতি দিলে কাল সকালে চেকটা দিয়ে আসব।’
‘কত টাকার?’
‘আমি তো ভেবেছি, বিশ হাজার টাকা। আপনি কি বলেন?’ ‘আমার মক্কেল রাজি। এসো, কাল সকালে। গুড নাইট!’
.
রবি ফোন করল রাত বারোটায়।
সে সহদেবকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে গোপন স্থান থেকে নোটের বান্ডিল পাওয়া গেছে। অসংখ্য নম্বরী নোট। কাল সকালেই যাতে রুবি ছাড়া পায় এটা সে দেখবে। শুধু তাই নয় — স্বয়ং ওঁর মক্কেলকে নিউ আলিপুরে পৌঁছে দেবে।
বাসু বললেন, ‘থ্যাঙ্কস! গুডনাইট। তোমার তো ডিউটি খতম হল, রবি। আমার হল না।’
‘সে কী? আপনার আবার কী কাজ বাকি রইল?’
‘বাঃ। ঐ আনপড় ছাপড়া জেলার বালবিধবাটিকে মক্কেল করে নতুনভাবে কেস লড়তে হবে না? লোভে পড়ে ও অন্যায় করেছে বটে, কিন্তু লোভটা তো দেখিয়েছি আমরাই, শিক্ষিত পুরুষমানুষেরাই! বেচারি ধরা পড়ল তো আমারই জন্য। বিনা ফিজ-এ লড়ে প্রায়শ্চিত্তের কিছুটা আমাকেই করতে হবে বৈকি।
***