১৬
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিনয় বসাকের আদালতে সেদিন দর্শক সমাগম অপ্রত্যাশিত। সচরাচর আদালতে এত লোক সমাগম হয় না। এক্ষেত্রে হয়েছে একটি বিশেষ হেতুতে।
‘সংবাদপত্রে ঐ হত্যামামলা নিয়ে দুজাতের ‘রিপোর্টাজ’ হয়েছে। একজন সাংবাদিকের মতে জনশ্রুতি এই যে— আসামী ছিল মৃত ব্যক্তির ‘পহেলি পেয়ার’। তখন লোকটার নাম ছিল ঝানু মল্লিক। আসামীর সর্বস্ব অপহরণ করে ঝানু আত্মগোপন করে। দীর্ঘদিন পরে বঞ্চিতা মেয়েটি এভাবে প্রতিশোধ নিতে সমর্থ হয়েছে। অপর সাংবাদিকের মতে, অপরাধের মূল হেতু আরও গভীর। মৃতব্যক্তি জনৈকা বিখ্যাত বোম্বাইমাকা চিত্রতারকার প্রথমপক্ষের স্বামী। চিত্রতারকা এখন এক ধনকুবেরকে বিবাহ করতে চলেছেন— তাই প্রফেশনাল খুনীকে দিয়ে পথের কাঁটা সরানো হয়েছে মাত্র। নামোল্লেখ না করেও সাংবাদিক চাতুর্যের সঙ্গে বোম্বাইমার্কা চিত্রতারকাকে চিহ্নিত করেছেন।
এই কারণেই আদালতে এত লোকসমাগম
এটাই দিনের প্রথম মামলা। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর সম্মুখে রাখা ফাইলটি দেখে পড়লেন : স্টেট ভার্সেস মিস রুবি রায়। বাদীপক্ষে আছেন পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নিরঞ্জন মাইতি এবং তাঁর সহকারী অ্যাডভোকেট অতুল দাশ, আর প্রতিবাদীর পক্ষে পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল এবং তাঁর জুনিয়র, অ্যাডভোকেট প্রসেনজিৎ দত্তগুপ্ত।
নিরঞ্জন মাইতি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘রেডি ফর দ্য প্রসিকিউশন।’
বাসুও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘রেডি ফর দ্য ডিফেন্স।’
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘বাদীপক্ষ তাঁর প্রথম সাক্ষীকে ডাকতে পারেন।’
মাইতি পুনরায় গাত্রোখান করে বললেন : ইক দ্য কোর্ট প্লিজ, প্রথম সাক্ষীকে আহ্বানের আগে আমি একটি প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে চাই। কেসটি জটিল : অপরাধ যে সংঘটিত হয়েছে এটা হয়তো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না; কিন্তু আসামীকে কেন সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িত করা হচ্ছে সেই যুক্তির চুম্বকসার আগেভাগে দাখিল করলে মামলাটা সহজবোধ্য হবে, য়োর অনার।’
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘ প্রাথমিক শুনানীতে এ জাতের প্রারম্ভিক ভাষণের রেওয়াজ নেই। যা হোক, আপনি একটি অতিসংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতে পারেন।’
‘থ্যাঙ্কস, য়োর অনার। বাদীপক্ষ আশা রাখেন যে, প্রমাণ করবেন, মৃত মোস্তাক আহমেদকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে মাত্র এক বিঘত দূরত্ব থেকে। মোস্তাক নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের লোক ছিল এ দাবি কেউই করছে না, কিন্তু তাই বলে এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুও তার পাওনা নয়। আমরা আশা রাখি প্রমাণ করব, পূর্বপ্রতিশ্রুতিমতো মোস্তাক আসামীর সল্ট লেকের বাসায় আসে। রবিবার, একত্রিশে মে, বিকাল চারটায়। সে এসেছিল আসামীর পাওনা মতো আট হাজার টাকা তাকে মিটিয়ে দিতে। ঘটনাচক্রে আসামী বাড়িতে সম্পূর্ণ একা ছিল এবং তার একটা অস্টিন গাড়ি আছে। আহমেদ যখন ব্যাগ খুলে আসামীকে তার পাওনা আট হাজার টাকা গুনে দেয়, তখন আসামী দেখতে পায় ব্যাগে আরও দশ-বারো হাজার টাকা আছে। তখনি সে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কী উদ্দেশ্যে জানা যায় না, ঠিক কোথায় যাচ্ছিল তাও না, কিন্তু আমরা আশা রাখি প্রমাণ করব, ওরা দুজন ইস্টার্ন বাইপাস ধরে দক্ষিণ দিকে আসতে থাকে। ওরা আসছিল আহমেদের মারুতি সুজুকি গাড়িতে। তখন বৃষ্টি পড়ছিল, রাস্তায় যানবাহন ছিল না। একটি বড় কালভার্টের কাছে আহমেদ গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়, ডাইভারশনের রাস্তাটা ঠিকমতো চিনে নিতে। ঠিক তখনই আসামী রুবি রায় তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে বার করে একটি চোরাই কোস্ট-কোবরা রিভলভার। মাত্র এক বিঘৎ দূরত্ব থেকে আহমেদকে গুলি করে হত্যা করে। ওর ব্যাগ থেকে বাকি টাকা বার করে গাড়িটাকে কালভার্টের খাদের দিকে ঠেলে দেয়। ডাইভারশন- রোডের বিপরীত দিকে থাকায় তা নজরের বাইরে পড়ে থাকে। এরপর সল্ট লেকের দিকে আসা কোনও গাড়িতে চেপে— কিছুটা হেঁটে, কিছুটা হিচ-হাইক করে সে সল্ট লেকে ফিরে আসে। টাকাটা লুকিয়ে ফেলতে। তখন আন্দাজ সাড়ে পাঁচটা। আসামী এইসময় সহযোগী বিবাদীপক্ষের অ্যাটর্নি পি. কে. বাসুকে একটি টেলিফোন করে। জানায় যে, সে একটা রিভলভার কুড়িয়ে পেয়েছে। বাসুসাহেব তাকে তৎক্ষণাৎ নিউ আলিপুরে চলে আসতে বলেন, ঐ তথাকথিত কুড়িয়ে পাওয়া রিভলভারটি সহ। আসামী মিস রায় সে আদেশ যথারীতি পালন করে। কিন্তু টাকাটা গোপন করতে তার যথেষ্ট সময় লেগে যায়। সে নির্ভয়ে তার অস্টিন গাড়িতে ঐ জনমানবহীন ইস্টার্ন বাইপাস ধরেই যায়। কারণ তার হেপাজতে ছিল একটা লোডেড রিভলভার। কোনও নির্জন স্থানে সে দ্বিতীয় একটি গুলি ছোড়ে এবং টেলিফোন করার দু-তিন ঘণ্টা পরে নিউ আলিপুরে এসে পৌঁছায়। আমাদের অনুরোধ, মাননীয় বিচারপতি এই জঘন্য অপরাধের জন্য আসামীকে কঠিনতম শাস্তি প্রদান করবেন। দ্যাটস অল, য়োর অনার।’
ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব প্রতিবাদীপক্ষকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কোনও প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে চান?’
বাসু বললেন, ‘নো। থ্যাঙ্ক য়ু, য়োর অনার। বাদীপক্ষ তাঁদের প্রথম সাক্ষীকে ডাকতে পারেন।’
প্রসিকিউশনের তরফে প্রথম সাক্ষী সার্জেন ডক্টর অতুলকৃষ্ণ সান্যাল। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে জানালেন যে, মোস্তাক আহমেদের মৃত্যু হয়েছে রবিবার, একত্রিশে মে, বিকাল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে। মৃত্যুর হেতু একটি পয়েন্ট থ্রি এইট বুলেট। যা তার মাথার অকসিপিটাল অস্থির বাম অংশ দিয়ে করোটিতে প্রবেশ করে এবং পেরিটাল অস্থির ডানদিকে গিয়ে আঘাত করে। ডাক্তার সান্যাল একটি মনুষ্য-করোটির বড় ছবি টাঙিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। অনুমান করা শক্ত হয় না যে, মৃত ব্যক্তির অগোচরে কেউ রিভলভারটা তার মাথার পিছন দিকে এনে গুলি করে। হত্যাকারী ড্রাইভারের বাঁদিকে বসেছিল এবং সে ডান-হাতে রিভলভারটা চালকের মাথার পিছনে নিয়ে এসে ট্রিগার টেনে দেয়। যে গাড়িতে মৃতদেহ পাওয়া গেছে তা রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ বলেই সাক্ষী এই জাতীয় অনুমান করেছেন। মৃত্যু তৎক্ষণাৎ হয়েছিল। রিভলভারটি, সাক্ষীর মতে, মৃত ব্যক্তির মাথার মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে ছিল। প্রবেশ পথে পোড়া বারুদের চিহ্ন থেকে কেমিক্যাল পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ হিসাবে ব্যালিসটিক এক্সপার্টের সঙ্গে যৌথভাবে এই তাঁর সিদ্ধান্ত।
মাইতির প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী আরও জানালেন যে, ‘ফেটাল বুলেট’, অর্থাৎ সীসার গোলকটি তিনি মৃতের খুলিতে পেয়েছেন। সেটা বার করে ব্যালিসটিক এক্টপার্টকে দিয়েছেন।’
প্রত্যাশিতভাবে এরপর ব্যালিসটিক এক্সপার্টের সাক্ষ্য দেবার কথা। কিন্তু মাইতি তাঁকে না ডেকে বিভিন্ন সাক্ষীর মাধ্যমে তাঁর থিয়োরি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। ও. সি. সে রাত্রের অভিজ্ঞতা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। তিনি স্বীকার করলেন বাসুসাহেবের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তাঁর ভ্রান্ত ধারণা হয়েছিল যে, অস্ত্রটা বাসুসাহেবের। তাই তার নম্বরটা টুকে রাখেননি। আরও বললেন, থানায় ফিরে গিয়ে তিনি ডি. সি. ট্রাফিকের অফিসে ফোন করে ঘটনাটা জানিয়ে দেন। ট্রাফিকের এক ইন্সপেক্টর জানালেন রাত দশটায় তিনি মারুতি গাড়ি এবং মৃতদেহটি আবিষ্কার করেন। তৎক্ষণাৎ তিনি হোমিসাইডকে সংবাদ দেন। হোমিসাইডের ইন্সপেক্টর সতীশ বর্মন মৃতদেহ দেখতে আসেন। ফোটো তোলা, মৃতদেহ এবং ভাঙা গাড়ি অপসারণ করতে করতে রাত ভোর হয়ে আসে।
কৌশিক লক্ষ্য করে দেখে এদের কাউকেই বাসুসাহেব জেরা করলেন না। প্রসেনজিৎকে বললেন জেরা করতে। কারণটাও বুঝতে পারে। বাসুসাহেবের আস্তিনের তলায় লুকানো আছে রঙের টেক্কাখানা : ব্যালিসটিক এক্সপার্টের সাক্ষ্য। তাকে জেরা করে উনি প্রমাণ করবেন যে, মৃতদেহের ভিতর যে সীসার গোলকটি পাওয়া গেছে তা 17475 L. W. পিস্তল থেকে নিক্ষিপ্ত নয়।
ফলে রুবি নির্দোষ।
মাইতির পরবর্তী সাক্ষী জনার্দন গায়কোয়াড়। মাইতি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় প্রতিষ্ঠা করলেন। তারপর পিপলস এক্সিবিট নং A অর্থাৎ 17475 L. W. নম্বরের কোল্ট- রিভলভারটি দেখিয়ে জানতে চাইলেন সেটির লাইসেন্স হোল্ডার তিনি কিনা। জনার্দন স্বীকার করলেন। জানালেন যে তাঁর গাড়ির সামনের দিকে গ্লাভ-কম্পার্টমেন্ট থেকে সেটা চুরি হয়ে যায়। ঠিক কবে তা বলতে পারছেন না। তবে মে মাসের সাতাশ তারিখের আগে নয়। প্রতিবাদী পক্ষের অ্যাটর্নি যখন তাঁর বাড়িতে গিয়ে ওই রিভলভারটি দেখান, তখন তাঁর সন্দেহ হয় যে, তাঁর গাড়ির ড্যাশ-বোর্ড থেকে তাঁর রিভলভারটি হয়তো চুরি গেছে। তিনি বাড়ির বাইরে এসে নিজের গাড়ির ড্যাশ বোর্ডে খুঁজে দেখেন। অবহিত হন যে, তাঁর রিভলভারটি চুরি গেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ থানার সে খবর জানান।
মাইতি বাসুসাহবের দিকে ফিরে বললেন, ‘য়োর উইটনেস।’
অর্থাৎ ‘জেরা করুন।
বাসু এবারও প্রসেনজিৎকে ইঙ্গিত করলেন।
প্রসেনজিতের জেরায় গায়কোয়াড় স্বীকার করলেন যে, তিনি পূর্ববৎসর এক জোড়া কোল্ট- কোবরা রিভলভার কিনেছিলেন। একটি থাকত তাঁর শয়নকক্ষে, একটি গাড়ির ওই গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে; অপর রিভলভারটির নম্বর 17474 L. W. 1 সেটা তাঁর বাড়িতেই আছে।
প্রসেনজিৎ বাসুসাহেবের কাছে থেকে ঘটনার পরম্পরা ইতিপূর্বেই শুনেছে। সে প্রশ্ন করে ‘আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্সে বললেন যে, মিস্টার বাসু যখন আপনাকে ওই 17475 L. W. নম্বর রিভলভারটা দেখালেন তখনই আপনার সন্দেহ জাগল যে, আপনার গাড়ি থেকে অপর রিভলভারটা চুরি গেছে। তাই আপনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন গাড়িতে খুঁজে দেখতে। তাই নয়?’
‘হ্যাঁ। তাই বলেছি আমি।’
‘কিন্তু যাবার সময় আপনি মিস্টার বাসুর হাত থেকে রিভলভারটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তাই নয়?
‘ছিনিয়ে নিইনি। তবে হ্যাঁ, ওটা ওঁর হাত থেকে তুলে নিয়ে গেছিলাম। ‘
‘কেন? আপনার গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে অন্য একটি রিভলভার চুরি গেছে কি না দেখবার জন্য বাসুসাহেবের হাতের রিভলভারটা ওভাবে নিয়ে গেলেন কেন?
মাইতি আপত্তি জানান; ‘অবজেকশন, য়োর অনার। আর্গুমেন্টেটিভ।’
বিচারক রুলিং দেবার আগে প্রসেনজিৎকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কেন ও প্রশ্নটা করছেন তা একটু বুঝিয়ে বলবেন?
‘ও, সার্টেনলি, যোর অনার! বাদীপক্ষ যে কোন কারণেই হোক ব্যালিসটিক এক্সপার্টকে সাক্ষী দিতে ডাকছেন না। আদালত জানেন যে, মিস্টার গায়কোয়াড়ের একজোড়া কোল্ট-কোবরা ছিল, তার একটি চুরি যায়। অথচ আদালত জানেন না, পিপলস্ একজিবিট নম্বর A অর্থাৎ ওই 17475 L. W. রিভলভারটি মার্ডার ওয়েপন কি না। আমরা জানি যে, ওই রিভলভারটা মিস্টার বাসুর জিম্বায় পুরো বারো ঘণ্টা ছিল- শুধু ওই দু-তিন মিনিট সেটা ছিল অন্যের দৃষ্টির আড়ালে বর্তমান সাক্ষীর একান্তে। প্রশ্নটা আদৌ আর্গুমেন্টেটিভ নয়, য়োর অনার, আমরা সাক্ষীকে নিজ স্বীকৃতিমতে তাঁর একটি আচরণের ব্যাখ্যা দিতে বলেছি মাত্র। ‘
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘দ্য অবজেকশন ইজ ওভাররুলড। প্লিজ আনসার দ্যাট কোশ্চেন।
জনার্দন বলেন, ‘সে সময়ে আমি উত্তেজিত ছিলাম। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, আমার গাড়ি থেকে রিভলভারটি চুরি গেছে কি না জানবার জন্য এটা হাতে করে নিয়ে যাওয়ার কোন যুক্তি ছিল না।
প্রসেনজিৎ একটা বাও করে বললে, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা আবেদন রাখছি, আদালতের নির্দেশে মিস্টার গায়কোয়াড়ের অপর রিভলভারটি সংগ্রহ করা হোক এবং প্রতিবাদীপক্ষের একজিবিট হিসাবে চিহ্নিত হোক।
এবারও আপত্তি জানালেন মাইতি।
বিচারক বললেন, ‘বাদীপক্ষ কীভাবে তাঁদের কেস সাজাবেন, অর্থাৎ পরপর তাঁদের সাক্ষীদের আহ্বান করবেন সে বিষয়ে আদালতের কোনও বক্তব্য নেই, কিন্তু এই পর্যায়ে আমি মিস্টার পি পি-র কাছে জানতে চাইছি যে, তাঁর সাক্ষীর তালিকায় কি সেই ব্যালিসটিক এক্সপার্টটি আছেন, যাঁর হাতে ডাক্তার সান্যাল ফেটাল বুলেটটা হস্তান্তরিত করেন?’
মাইতি উঠে দাঁড়ান, ইয়েস, য়োর অনার। তিনিই আমার পরবর্তী সাক্ষী।’
‘সে ক্ষেত্রে বর্তমান সাক্ষীকে সাময়িকভাবে অপসারিত করে আদালত ওই ব্যালিসটিক এক্সপার্টকে দু-একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক।’
তাই ব্যবস্থা করা হল। ব্যালিসটিক এক্সপার্টের নাম ইন্সপেক্টর জিতেন বসাক। বিচারকের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন যে, অটপ্সি সার্জেন তাঁকে যে ফেটাল বুলেটটি দিয়েছেন তার সাহায্যে কোনক্রমেই বলা যাবে না যে, সেটি কোন রিভলভার থেকে নিক্ষিপ্ত। খুলির ভিতর দিক থেকে সীসার গোলকটি করোটি ভেদ করতে পারেনি; কিন্তু মসৃণ হয়ে গেছে এবং তার আকৃতি বদলে গেছে। কম্পারেটিভ মাইক্রোস্কোপে তার গায়ে পিস্তল-ব্যারেলের কোন দাগই এখন দেখা যাচ্ছে না। শুধু এটুকুই বলা যায় যে, সেটি 38 ক্যালিবারের রিভলভার থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
কৌশিক একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখল বাসুসাহেবের দিকে। দেখে বোঝা গেল না যে, তাঁর আস্তিনের তলা থেকে রঙের টেক্কাখানা কখন বেমালুম খোয়া গেছে। এবং তাতে তিনি কতটা বিচলিত।
বিচারক প্রসেনজিতের আবেদন নাকচ করে দিলেন।
পরবর্তী সাক্ষী : সহদেব কর্মকার।
প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মাইতি তার নাম, ধাম, বয়স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করলেন। সহদেব স্বীকার করল যে, সে দীর্ঘদিন ধরে মোস্তাক আহমেদকে চিনত। আহমেদ যখন বোম্বাইয়ে থাকত, প্রথমে পুষ্পাদেবীর কম্বাইন্ড হ্যান্ড হিসাবে, পরে মিসেস প্রমীলা পাণ্ডের ড্রাইভার হিসাবে। সহদেব নিজেও তখন বোম্বাইয়ে থাকত। একজন ফিল্ম আর্টিস্টের গাড়ি চালাত। পুষ্পাদেবীর বাড়িতে প্রায়ই তাকে আসতে হত। এই সূত্রে মোস্তাকের সঙ্গে পরিচয়। পরে সে কলকাতায় চলে আসে। আহমেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব কোনদিনই ক্ষুণ্ণ হয়নি। ঘটনার দিন সকালে আহমেদ ওকে জানিয়েছিল তাকে বিকালে চারটে নাগাদ সল্ট লেকে যেতে হবে। এক পাওনাদারকে কিছু টাকা মেটাতে। সহদেবকে সে অনুরোধ করেছিল তার গাড়িতে নিয়ে যেতে… কে পাওনাদার, কত টাকা তা সহদেব জানে না।
মাইতি প্রশ্ন করেন, ‘তোমার গাড়ি মানে? কী গাড়ি?’
‘না হুজুর। আমার আবার গাড়ি কোথায়? আমি মেকানিক। এখন ট্যাক্সি চালাই। লেকটাউনের এক সর্দারজীর ট্যাক্সি।’
মাইতি জানতে চান, ‘মোস্তাক আহমেদ কি তোমার ট্যাক্সি নিয়ে সল্ট লেকে যায়?’
—আজ্ঞে না হুজুর। আমি শ্রীরামপুরের এক পার্টি পেয়ে ট্যাক্সি নিয়ে দুপুরের দিকে কলকাতার বাইরে চলে যাই। ফিরে আসি, রাত দশটা নাগাদ। যতদূর জানি, আহমেদ টেকনিশিয়ান স্টুডিওর একখানা মারুতি সুজুকি গাড়ি নিয়ে সল্ট লেকে গেছিল। তবে সে কথা হলপ নিয়ে বলতে পারব না।’
মাইতি প্রসেনজিতের দিকে ফিরে বললেন, ‘জেরা করতে পারেন।
হঠাৎ প্রসেনজিৎকে বাধা দিয়ে বাসু জেরা করতে উঠলেন। সকাল থেকে এই প্রথম। সহদেবকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি এখনি বললে, আহমেদকে তুমি অনেকদিন ধরে চেন, তাই না? তা কত বছর?’
সহদেব তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিমুখে বললে, ‘বছরের ঠিক হিসাব দিতে পারব না, হুজুর। ডায়েরি লেখার অভ্যাস তো নেই। তা পাঁচ-সাত বছর হবে…
‘সে যখন আসানসোলে থাকত— হিন্দু পরিচয়ে ঝানু মল্লিক নামে, তখন তাকে চিনতে?’
‘আজ্ঞে না, হুজুর। ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ বোম্বাইতে। ও তখন পুষ্পাদেবীর কম্বাইন্ড-হ্যান্ড ছিল। গাড়ি চালাতো। রান্নাও করত।’
তার মানে, মিসেস পাণ্ডের গাড়ির ড্রাইভারি চাকরিটা নেবার আগে?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ হুজুর।’
‘মিসেস প্রমীলা পাণ্ডের কাছে আহমেদ আন্দাজ কতদিন চাকরি করে আর কবে সে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় আসে?’
সহদেব একটু ইতস্তত করে বললে, ‘সাল-তারিখ আমার মুখস্ত নেই হুজুর। মিসেস পাণ্ডের বাড়িতে মাত্র মাস ছয়েক চাকরি করেছিল আহমেদ। তারপর চলে আসে কলকাতায়। টালিগঞ্জে ওই সিনেমার স্টুডিওতে কাজ নেয়। ঠিক কবে তা বলতে পারব না হুজুর।’
‘তুমি এখন ট্যাক্সি চালাও বললে, তাই না?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘তোমার ট্যাক্সির নম্বরটা কত?’
সহদেব নড়ে চড়ে বসল। মাইতি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দিকে ফিরে বললে, ‘এ সব নেহাত অবান্তর খেজুরে কথা নয়, হুজুর?’
মাইতির হঠাৎ খেয়াল হয়। আপত্তি দাখিল করেন।
বিচারক সে আপত্তি মেনে নেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘মধ্যাহ্ন বিরতির সময় হয়ে গেছে। ওবেলা অন্য একটা জরুরী কেস আছে। ফলে এই মুলতুবি মামলা পুনরায় কাল সকাল দশটায় শুরু হবে। আসামী পুলিশ প্রহরায় থাকবে।
বিচারক উঠে তাঁর চেম্বারে চলে গেলেন। আদালত খালি হতে শুরু করল। বাসুসাহেবও খাতাপত্র গুছিয়ে তুলছিলেন, হঠাৎ নজর হল, ইন্সপেক্টর রবি বসু এগিয়ে আসছে। রবি বাসুসাহেবের ফ্যান তথা অনুগ্রহভাজন (‘ঘড়ির কাঁটা’ দ্রষ্টব্য)। হোমিসাইডেই আছে, তবে বর্মনের চেয়ে জুনিয়র। রবি হাত তুলে বাসুসাহেবকে নমস্কার করে কিছু বলবার উপক্রম করতেই বাসুসাহেব বললেন, ‘তোমাকেই খুঁজছিলাম রবি। বল, কোথায় বসে কথা হতে পারে?’
রবি বললে, ‘ব্যাপারটা জরুরী, স্যার! এবং অত্যন্ত গোপন! আসুন, আমি ব্যবস্থা করছি।’