‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ১৫

১৫

স্থানীয় পুলিশের তদন্ত আধঘণ্টার মধ্যেই শেষ হল। ও. সি. ঐ সময় থানায় ছিলেন। তিনি নিজেই এসেছিলেন। বললেন, সন্ধ্যার পর ইস্টার্ন বাইপাস রাস্তাটা বিপজ্জনক। রাস্তাটা এখনো তৈরি হচ্ছে। শেষ হয়নি। ইদানীং সন্ধ্যার পর কিছু বিপজ্জনক হয়ে পড়ে বটে। গাড়ির যাতায়াত কমে যায়। ঐ এলাকার কিছু সমাজবিরোধী দল বেঁধে কয়েকবার লুটতরাজও করেছে। এছাড়া একজন যৌন রোগাক্রান্ত ‘সেক্সুয়াল ম্যানিয়াক’ গাড়িতে একা মহিলা যাত্রী দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু লোকটা ট্যাক্সিচালক নয়, ফলে রুবির পশ্চাদ্ধাবনকারী সে না হবার সম্ভাবনা। রুবি রিভলভারটা কোথায় পেল, কীভাবে পেল প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে বাসুসাহেব ঝাঁপিয়ে পড়লেন— ও রাস্তাটা সন্ধ্যার পর বিপজ্জনক হয়ে যায় শুনেছি, তাই আমিই ওকে বলেছিলাম, রিভলভারটা সঙ্গে নিয়ে আসতে।’

ও.সি. বলেন, ‘সে তো উৎকৃষ্ট পরামর্শই দিয়েছিলেন— না, আমি জানতে চাইছি রিভলভারটা কার? লাইসেন্সটা কার নামে…?

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, ‘লুক হিয়ার, অফিসার। রুবি রায় আমার ক্লায়েন্ট। আমার নির্দেশে সে সশস্ত্র আসছিল, এ কথা আমি আগেই বলেছি। আপনি যতি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আক্রমণকারীকে ছেড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকেই ফাঁদে ফেলায় উৎসাহী হয়ে পড়েন, তাহলে এই রিপোর্টটা বাতিল বলে ধরে নিন। আমার মক্কেলকে কেউ আক্রমণ করেনি। সে নিরাপদ ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। হল তো?’

ও. সি. বলেন, ‘আপনি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন না, স্যার।’

‘না বোঝার কী আছে? আপনার পরবর্তী প্রশ্নটা তো এই : রিভালভারটার মালিক পি. কে. বাসু হতে পারেন, কিন্তু আপনার কি ক্যারিয়ার লাইসেন্স ছিল?’

ও. সি. নিজে থেকেই বলেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। রিভালভারের প্রসঙ্গ থাক। কিন্তু আপনি নিশ্চিত যে, আপনার ছোঁড়া গুলিতে পশ্চাদ্ধাবনকারী আহত হয়নি?’

এবারও বাসু আগ বাড়িয়ে বলেন, ‘এ কথার জবাব ও কেন দেবে? কেমন করে দেবে? ও তো বলছে, লোকটাকে ভয় দেখাতে শূন্যে গুলি ছুঁড়েছিল। তার বেশি ও জানে না। আপনার সন্দেহ থাকে তাহলে ডি. সি. ট্রাফিককে ফোন করে বলুন ইস্টার্ন বাইপাসে তদন্ত করে দেখতে।’

ঠিক আছে, স্যার, ঠিক আছে। তাই হবে। আমরা তাহলে উঠি।’

* * * * *

পুলিশের জীপটা চলে যাবার পর বাসু বললেন, ‘কৌশিক, তুমি আলিপুরে জনার্দন গাইকোয়াড়ের প্যালেসে একটা ফোন কর তো। বড়লোকের ব্যাপার, হয় কোনও বাটলার অথবা হাউস-মেড ধরবে। তাকে বলবে, বোম্বাইয়ের ফিল্ম আর্টিস্ট পুষ্পাদেবীকে খুঁজছ। ন্যাচারালি ও- পক্ষ তোমার পরিচয় জানতে চাইবে। তখন বলবে, তুমি সুপারফাস্ট- ক্যুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থেকে বলছ। তোমাদের একটা ঘোষিত রেকর্ড আছে : ভারতের চারটি প্রধান শহর— ঐ যে চারটি শহরের তাপমাত্রা প্রতিদিন টিভিতে দেখানো হয়, তার ভিতর চিঠি বিলি করতে ম্যাক্সিমাম ছত্রিশ ঘণ্টা লাগে। পুষ্পাদেবীর নামে একটা আর্জেন্ট চিঠি আছে : বোম্বাইয়ের এন. এফ. ডি. সি.-র চিঠি : কিন্তু হোটেল তাজবেঙ্গলে গিয়ে…

কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, ‘বাকিটা বুঝেছি। পুষ্পা লাইনে এলে কী বলতে হবে…?’

বাসুও বাধা দিয়ে বলেন, ‘না, বোঝনি। পুষ্পা বাড়িতে না-ও থাকতে পারে। তোমাকে জেনে নিতে হবে আজ রাত বারোটার আগে পুষ্পাকে পার্সোনালি কোথায় কখন পাওয়া যাবে। বুঝলে?’

কৌশিক পাঁচ মিনিটের ভিতরেই এসে খবর দিল যে, পুষ্পা গায়কোয়াড় প্যালেসেই আছে। আজ রাত্রে আর বের হবে না। বস্তুত সে এন. এফ. ডি. সি.-র চিঠিখানার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছে।

বাসু বললেন, ‘জানি। সেজন্যই N.F.D.C. বলেছি। সুফারফাস্ট ক্যুরিয়ারে N.F.D.C.-র চিঠি। ওর ডিনারের নিমন্ত্রণ থাকলেও ক্যানসেল করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করত। তুমি গাড়িটা বার কর দিকিন।’

আগেই বলেছি, আলিপুর রোডে গাইকোয়াড় প্যালেস অনেকটা জমি নিয়ে। দুজনে মার্বেল-সোপান বেয়ে উঠে এসে সদর দরজায় কলিংবেল বাজালেন। দ্বার খুলে যে লোকটি অভিবাদন করল সে সম্ভবত গায়কোয়াড়ের বাটলার। অথচ কৌশিককে প্রথমবার যে আপ্যায়ন করে বসিয়েছিল সে লোকটা নয়।

বাসু মুখ খোলার আগেই লোকটি প্রশ্ন করল, ‘সুপারফাস্ট ক্যুরিয়ার?’

বাসু একগাল হাসলেন। স্বীকার-অস্বীকার এড়িয়ে বললেন, মিস পুষ্পা আছেন?’

‘শি ইজ এক্সপেক্টিং য়ু স্যার। আসুন, ওঁকে ডেকে দিচ্ছি।’

ডাকতে হল না। ডোর বেলের শব্দ পুষ্পাও নিশ্চয় শুনেছে। এন. এফ. ডি. সি. থেকে কী প্রস্তাব এসেছে জানতে সে নিশ্চয় খুবই আগ্রহী। পুষ্পা নিজে থেকেই এগিয়ে এল ওপাশের ঘর থেকে। তারপর বাসুসাহেবকে দেখে থমকে যায়। বলে, ‘ও! আপনি। আমি ভেবেছিলাম…’

বাসু একটি বাও করে বললেন, ‘নিতান্ত প্রয়োজনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করেই চলে আসতে বাধ্য হয়েছি, মিস পুষ্পা। তবে বেশিক্ষণ সময় আমি নেব না।’

‘তাহলে এসে বসুন। ইনি?’

‘আমার সহকারী, কৌশিক মিত্র।’

ওরা নমস্কার বিনিময় করল। তিনজনে বসলেন।

বাটলার নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে।

পুষ্পা বলে, ‘এবার বলুন।’

বাসু বলেন, ‘বেলুড়ের কাছে আপনাদের ডিকির ভিতরের স্যুটকেস থেকে যেসব জিনিস চুরি যায় তার ভিতর ঐ মিস্টার গায়কোয়াড়ের দেওয়া কোল্ট কোবরা রিভালভারটা যে ছিল না, তা আমি জানতে পেরেছিলাম মিসেস প্রমীলা পাণ্ডের কাছে। তিনি বলেছিলেন যে, যেহেতু রিভলভারটা লুকানো ছিল ঐ স্যুটকেসটার একটা ফলস্ বটমে তাই চোরের নজরে পড়েনি। কিন্তু তারপর? সেই রিভলভারটা কি বর্তমানে আপনার কাছে আছে? না কি আপনি সেটা মিস্টার গায়কোয়াড়কে ফেরত দিয়েছেন?’

পুষ্পা বেশ অবাক হয়ে গেল। একটু চিন্তা করে বলল, ‘হঠাৎ একথা জানতে চাইছেন কেন? ‘আপনারই স্বার্থে, পুষ্পা দেবী। ঠিক ঐ রকম একটি কোল্ট কোবরায় আজ একটি লোক খুন হয়েছে। আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই, সেটা আপনার রিভলভারে নয়।

এবার আর সময় নিল না। পুষ্পা বলল, ‘না, আমার রিভালভারটা যথাস্থানে নিরাপদেই আছে। আপনি ব্যস্ত হবেন না।’

‘আপনি কাউডলি একবার স্বচক্ষে দেখে এসে আমাকে নিশ্চিন্ত করবেন?’

‘বাট হোয়াই? আপনিই বা এতটা উতলা হচ্ছেন কেন?’

বাসুসাহেব পকেট থেকে রুবির কাছ থেকে পাওয়া রিভলভারটা বার করে দেখালেন। বললেন, ‘আমি জানতে চাই, এই মার্ডার ওয়েপনটা আপনার সেই যন্ত্রটা নয়। প্লিজ গো অ্যান্ড চেক আপ।’

এবার পুষ্পা উঠে দাঁড়ালো। সে যে ঘাবড়ায়নি তরে প্রমাণ দিতে ধীরেসুস্থে চলে গেল পাশের ঘরে।

ফিরে এল এক মিনিটের মধ্যেই। বললে, ‘না, স্যার, ওটা আমার নয়। আমারটা চুরি যায়নি। যথাস্থানেই আছে।’

বাসু বলেন, ‘থ্যাঙ্কস। বুক থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল।’

ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কে যেন কলিংবেল বাজালো।

যেন অন্তরীক্ষ থেকে আবির্ভূত হল বাটলার। খুলে দিল দরজা। এলেন গৃহস্বামী। কিন্তু দোরগোড়াতেই থমকে গেলেন বাসুসাহেবকে দেখে। কৌশিকের দিকেও দৃপাত করলেন; কিন্তু তাকে যে চিনতে পেরেছেন এমনভাব দেখালেন না। বাটলার তাঁর গা থেকে ভিজে ওভারকোটটা খুলে নিয়ে চলে গেল। বৃষ্টি এখনো পড়ছে। জনার্দন দু’পা এগিয়ে এসে বাসুসাহেবকে বললেন, ‘শুভ সন্ধ্যা। সেদিন আপনি কী যেন একটা কথা বলেছিলেন : আহ। মনে পড়েছে : আনঅ্যাপয়েন্টেড ইনট্রুশন। তাই না?’

বাসু সহাস্যে বললেন, ‘আমার মনে হল, ব্যাপারটা আপনি সেদিন ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি, তাই একটা প্র্যাকটিক্যাল ডিমন্সট্রেশন দিতে নিজেই চলে এলাম।’

জনার্দন কিছু বলার আগেই পুষ্পা বলে ওঠে, ‘উনি আমারই স্বার্থে এসেছেন, জন। উনি জানতে এসেছেন যে, আমার রিভলভারটা আমার এক্তিয়ারে আছে কি না।’

‘মানে? তোমার আবার রিভলভার আছে নাকি?’

পুষ্পাকে ইতস্তত করতে দেখে বাসু বললেন, ওঁরা দুই বান্ধবী এবার যখন গোয়ালিয়র থেকে কলকাতা আসেন, তখন আপনি যে কোল্ট কোবরাটা মিস পুষ্পাকে আত্মরক্ষার্থে দিয়েছিলেন উনি সেটার কথাই বলছেন। উনি এইমাত্র ওঘরে গিয়ে দেখে এলেন যে, সেটা ‘যথাস্থানেই আছে।’

জনার্দন বাসুসাহেবকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আপনি এত কথা জানলেন কি করে?’

বাসু পকেট থেকে পুনরায় কোল্ট কোবরা রিভলভারটা বার করে বললেন, ‘এই রিভলভারটার লাইসেন্সি কে জানতে ডি. সি. আর্মস অ্যাক্টের দপ্তরে যেতে হল। দেখলাম, আপনার রিভলবার : সি. সি. বিশ্বাসের দোকানে ডালহৌসি স্কোয়ারে লাস্ট ইয়ার কিনেছেন। কিন্তু একটা নয়, আপনি জোড়া কোল্ট কোবরা কিনেছিলেন। পরে শুনলাম, একটি আপনি নিজে রাখেন, একটি মিস পুষ্পার নামে লাইসেন্স করিয়ে নেন।’

জনার্দন উঠে গিয়ে ভিতর দিকের দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ফিরে এসে বসল। বলল, ‘এত লোক থাকতে মিস পুষ্পার নামে লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছিলাম একথা আপনি কোথায় শুনলেন?

‘না, তা শুনিনি। আন্দাজ করছি। না হলে সেটা পুষ্পা দেবীর ড্রয়ারে থাকছে কী করে।’

জনার্দন পুষ্পার দিকে ফিরে জানতে চাইল, ‘তোমার রিভলভারটা তোমার ড্রয়ারে আছে? আর য়ু শিওর, হানি?’

‘কী আশ্চর্য! এইমাত্র তাই তো দেখে এলাম। দেখে এসে মিস্টার বাসুকে জানালাম।’

জনার্দন মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে গেল। মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে দশ সেকেন্ড কী ভেবে নিয়ে বলল, ‘যন্ত্রটা দেখি, মিস্টার বাসু।’

বাসু পকেট থেকে যন্ত্রটা বার করে চেম্বারটা খুলে দেখালেন। বললেন, ‘লুক, দুটো বুলেট ছোঁড়া হয়েছে। বাকি চারটে ইনট্যাক্ট। ফর য়োর ইনফরমেশন : ঘণ্টা চারেক আগে এটা থেকে যে দুটো গুলি ছোড়া হয়েছে তার একটায় এক হতভাগ্য…’

জনার্দন যেন সাধারণ ভদ্রতার কথাও ভুলে গেল। ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে।

‘দেখি, দেখি,’ বলে যন্ত্রটা প্রায় কেড়ে নিল বাসুসাহেবের হাত থেকে। উঠে দাঁড়াল। সিলিংকে সম্বোধন করে বললে, ‘তাহলে কি আমারটা চুরি গেছে? আই মাস্ট ভেরিফাই।’

কেউ কিছু বলার আগেই রিভলভারটা হাতে নিয়েই সে সদর দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে গেল। অটোমেটিক ডোর ক্লোজারে সদর আবার বন্ধ হয়ে গেল।

ওর এই অভদ্রোচিত ব্যবহারের ব্যাখ্যা হিসাবে পুষ্পা বলল, ও ভয়ানক ইমোশনাল। যেই মনে হয়েছে যে, এটা ওরটা হলেও হতে পারে… ও নিজেরটা গাড়ির গ্লাভ-কম্পার্টমেন্টে রাখে : যখন গাড়ি নিয়ে কোথাও য়ায়… দুটো গুলি ছোঁড়া হয়েছে বলছিলেন, না? কেউ কি মারা গেছে?

‘আমার তাই আশঙ্কা। আজই বিকেল চারটে নাগাদ!’

‘লোকটা কে?’

‘তা এখনো জানা যায়নি।’

‘আপনি সর্বদাই রহস্যময়।’

‘সেটাই স্বাভাবিক। রহস্য নিয়েই আমার কারবার।’

ঠিক তখনই বাইরের দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল জনার্দন, ‘যা আশঙ্কা করেছিলাম। আমার গ্লাভ-কম্পার্টমেন্টটা ফাঁকা। অর্থাৎ কেউ চুরি করেছে। আমাকে এখনি থানায় একটা ফোন করতে হবে।

‘হ্যাঁ। ঐ সঙ্গে ও. সি. আর্মস অ্যাক্টকেও, লালবাজারে। করোলারি জুড়ে দিলেন বাসু।

জনার্দন হাত বাড়িয়ে টেলিফোনটা তুলতে তুলতে বলল, ‘বাই-দ্য-ওয়ে… এটা আপনার এক্তিয়ারে এল কীভাবে?’

‘খুনটা করার পর খুনী রিভলভারটা আমার এক ক্লায়েন্টের গাড়ির ভিতর ফেলে গেছে। আমি যখন দেখলাম, দু-দুটি গুলি ছোঁড়া হয়েছে তখনই তৎপর হলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম,  আপনি নিজেই দুটি কোল্ট কোবরা কিনেছেন এবং একটি মিস পুষ্পাকে প্রেজেন্ট করেছেন। তাই কালবিলম্ব না করে আপনাদের স্বার্থে আমাকে ছুটে আসতে হয়েছে। মিস্টার গায়কোয়াড়, আই নাউ বেগ টু অ্যাপলজাইজ ফর দ্য আনঅ্যাপয়েন্টেড ইন্টুশন।

গাইকোয়াড় টেলিফোন ছেড়ে ছুটে এসে দুহাত চেপে ধরল বাসুর।

বললে, ‘প্লিজ এক্সকিউজ মি। আমি আন্তরিকভাবে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনি আমাদের অশেষ উপকার করলেন।’

.

বাইরে বেরিয়ে এসে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেন বাসুসাহেব। এতক্ষণে পাইপ ধরালেন। গায়কোয়াড় প্যালেসে ঢোকার পর থেকে কৌশিক একটা কথাও বলেনি। গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে বললে, ‘মামু! এটা কী হল?’

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বাসু বললেন, ‘কোনটা ভাগ্নে?’

‘ওর গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে ওর নিজের রিভালভারটা চুরি গেছে কি না সমঝে নিতে ভদ্রলোক কী কাণ্ডটা করল। আপনার হাত থেকে আপনার রিভালভার ওভাবে ছিনিয়ে নিয়ে ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল কেন? কী উদ্দেশ্য ছিল লোকটার?’

‘একটাই সম্ভাব্য উত্তর। রিভালভারটা বদলে দিতে।’

‘তার মানে আপনি জেনে বুঝে এভিডেন্স ট্যাম্পার্ড হতে দিলেন?

‘কিসের এভিডেন্স ভাগ্নে?’

‘খুনের। যে খুনের অপরাধে রাত পোহালে রুবি রায় গ্রেপ্তার হতে চলেছে।’

বাসু বলেন, ‘আমি তো জানি না কেউ খুন হয়েছে। আমি তো আইনত জানি না যে, জনার্দন রিভলভারটা বদলে দিয়েছে।

‘জানেন। আলবাৎ জানেন। আমি বাজি রাখতে পারি— আপনার পকেটে যে রিভলভারটা এখন আছে তার নম্বর হয় : 17473 অথবা 17475।’

বাসু একগাল হেলে বললেন, ‘তোমার বুদ্ধি যে দিন দিন খুলছে ভাগ্নে! কী দারুণ ডিডাক্ট করলে!’

.

পরদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বাসুসাহেব দেখেন, দোরগোড়ায় একটা পুলিশের জিপ। বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে কৌশিক আর সতীশ বর্মন কথা বলছে। সতীশ হোমিসাইডের ইন্সপেক্টর। বহুদিনের চেনা।

বাসু বারান্দায় উঠে এসে বললেন, ‘আরে বর্মনসাহেব যে! এত সকালে কী মনে করে?’

‘আপনি তো ভালই জানেন, স্যার। আপনার মক্কেলকে অ্যারেস্ট করতে। মিস্টার কৌশিক মিত্র ভিতরে খবর দিয়ে এসেছেন, তিনি তৈরি হচ্ছেন।’

বাসু বলেন, ‘চার্জটা কী?’

‘যেন আপনার অজানা। ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার।’

‘মার্ডার? খুনটা হল কে? কখন?’

‘যেন আপনার মক্কেল আপনাকে বলেনি? কাল সন্ধ্যায় যে লোকটা আপনারই মক্কেলের এফ. আই. আর, মোতাবেক : চার বছর আগে ওর ছয় হাজার টাকা নিয়ে বোম্বাই ভেগে গেছিল : জীবন মল্লিক-ওরফে ঝানু মল্লিক-ওরফে মোস্তাক আহমেদ।’

বাসুসাহেবের মুখে ভাবের কোনও পরিবর্তন হল না। কিন্তু কৌশিক বুঝতে পারে তিনি কী পরিমাণ বিস্মিত হয়েছেন। কারণ সে নিজেই তা হয়েছে।

ওঁদের জ্ঞানমতে কোল্ট-কোবরা রিভলভারটা বেলা একটার সময়েও ছিল জীবন ব্রহ্মচারীর কাছে যে জীবনরতন প্রমীলাকে সিকিউরিটি হিসাবে জমা দিয়ে গেছিল পুষ্পা আর আহমেদের শরিয়তী সাদির অরিজিনাল ডকুমেন্ট। যার জেরক্স কপি ইতিপূর্বেই পেয়েছে কৌশিক। এতক্ষণ বাসুসাহেব আর কৌশিক এই থিয়োরি অনুসারেই অগ্রসর হচ্ছিলেন যে, খুনটা করেছে আহমেদ এবং রুবিকে আট হাজার টাকা থেকে বঞ্চিত করতে তার ঘাড়েই অপরাধটা চাপাতে চাইছে। সতীশ বর্মনের স্টেটমেন্ট মোতাবেক সেই গোটা থিয়োরিটাই সে গেল।

কৌশিক মনে মনে ভাবছে : একথা আগে জানলে বাসুসাহেব কিছুতেই জনার্দন গায়কোয়াড়কে ঐ দুর্লভ সুযোগটা দিতেন না- রিভলভারটা বদলে ফেলার।

একটু পরে ভিতর থেকে বেরিয়ে এল রুবি। নির্বিকার। বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললে, ‘হাজতবাসের অভিজ্ঞতা আমার আছে, মামু। ব্যস্ত হবেন না। বাড়ির চাবিটা মামিমাকে দিয়ে এসেছি। আর কৌশিকদা, আপনার একটা কাজ আছে। মল্লিকাদিরা উঠেছে দীঘার ব্লু ভিয় হোটেলে। ওখানে একটা ট্রাঙ্ক কল করে জানিয়ে দেবেন আমি পুনর্মুষিক হয়েছি।’

নিচু হয়ে বাসুসাহেবকে প্রণাম করে বলল, ‘চলি মামু?’

তারপর ইন্সপেক্টর বর্মনের দিকে ফিরে বললে, ‘আমি তৈরি। চলুন।’

বর্মন তাকে বললে, ‘বসুন।’

তারপর বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললে, ‘মিস রায় যে রিভলভারটা কাল রাত্রে আপনাকে হ্যান্ডওভার করেছিলেন সেটা কোথায়?’

‘আমার পকেটে। কেন?’ জানতে চাইলেন বাস্।

‘ওটা মার্ডার-ওয়েপন জেনেও কেন আপনি সেটা থানার ও. সি.কে হ্যান্ডওভার করেননি?’

বাসু বিরক্তভাবে বলেন, ‘কী পাগলের মতো বকছ, বর্মন? রাত আটটায় না ও. সি. না আমি কেউই তো জানতাম না যে, একটা লোক খুন হয়েছে। অথবা ওটা মার্ডার ওয়েপন হলেও হতে পারে।’

‘কিন্তু ওটা আপনার নয়, ওর লাইসেন্স আপনার নামে নয় : তাহলে ওটা আপনার হেপাজতে সারারাত রইল কী করে?’

‘দেখ বর্মন, রিভলভারটা আমার এক্তিয়ারে আসামাত্র আমি লোকাল থানায় জানিয়েছি। ও.সি. স্বয়ং এনকোয়ারি করে গেছেন। রিভলভারটা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি একবারও বলেননি যে, ওটা তিনি নিজের হেপাজতে রাখতে চান। ফলে ওটা আমার কাছে আছে। এতে হয়েছেটা কী?’

‘আপনি এমনভাবে কথাবার্তা বলেছিলেন যাতে থানা অফিসার ধরে নিয়েছিল ওটা আপনারই নামে লাইসেন্স নেওয়া।’

‘সে কী ধারণা করেছিল তা আমি কেমন করে জানব? আমি সে কথা বলিনি। আমাকে সে ও প্রশ্ন জিজ্ঞেসই করেনি।

‘সে জিজ্ঞেস করুক না করুক আপনি তো জানতেন ওটা এভিডেন্স…’

‘এভিডেন্স! কীসের এভিডেন্স?’

‘মার্ডারের।’

‘আবার তুমি পাগলের মতো কথা বলছ, বর্মন। মার্ডার যে একটা হয়েছে তা তোমার কাছে আমি জেনেছি আজ সকালে, এইমাত্র। কাল তা আমি জানতামই না।’

‘ডেফিনিটলি জানুন, না জানুন, আন্দাজ ঠিকই করেছিলেন। আপনার উচিত ছিল, রিভালভারটা থানা অফিসারের কাছে সারেন্ডার করা। বিশেষ করে আপনি যখন ওটার লাইসেন্স হোল্ডার নন।’

‘তুমি প্লিজ আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিও না। আমার কী করা উচিত না উচিত তা তোমার কাছে শুনতে চাই না। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে রিভলভারটা আমার হস্তগত হওয়ামাত্র আমি থানায় ফোন করে জানিয়েছি। কোন পুলিশ অফিসার সেটা আমার কাছে চায়নি, তাই ওটা আমার কাছে সেফ- কাস্টডিতে রেখেছি।’

‘তা আপনি পারেন না। আনলাইসেন্সড রিভলভার নিজ দায়িত্বে রাখতে। এটা আইনত অপরাধ।’

‘তুমি তাই মনে কর? তাহলে এখানে আর সময় শান্তি নষ্ট না করে আদালতে গিয়ে আমার নামে মামলা দায়ের কর। সেখানে তার জবাব দেব।’

‘তার দরকার নেই। এই তো এখন আমি জানাচ্ছি যে, কাল সন্ধ্যায় মোস্তাক আহমেদ এই রিভলভারের গুলিতে হত হয়েছে বলে পুলিশ আশঙ্কা করে। ওটা একটা মেজর এভিডেন্স! আপনি কি ওটা আমাকে হস্তান্তর করবেন?’

‘নিশ্চয়ই। যদি তুমি আমাকে একটা রসিদ দাও। রিভলভারের নম্বর এই দেখ : 17475 LW, দুটো ডিসচার্জড বুলেট আছে এতে। আর চারটে লাইভ ইনট্যাক্ট। ও. কে.?’

‘থ্যাঙ্ক য়ু, স্যার।’