১৪
রাত সাড়ে আটটা। বাসুসাহেব ক্রমাগত অশান্ত পদচারণা করে চলেছেন। সল্ট লেক থেকে নিউ আলিপুর আসতে আড়াই ঘণ্টা লাগতে পারে না। বিশেষত রবিবারে, যেদিন ট্রাফিক জ্যাম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টি নেমেছে সাতটা নাগাদ। এখনো ঝিরঝির করে পড়ছে। সুজাতা কোথায় বুঝি বেরিয়েছিল, ছাতা নিয়ে যায়নি। কাকভেজা হয়ে ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যে সল্ট লেকে বার দুই ফোন করা হয়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই টেলিফোন একটানা বেজে গেছে, নো রিপ্লাই।
রানু বললেন, ‘একটা ভুল হয়েছে তোমাদের। রুবিকে বলে দেওয়া উচিত ছিল, যেন ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে আসার চেষ্টা না করে। ঐ রাস্তাটা বর্তমানে আন্ডার কনস্ট্রাকশন। সন্ধ্যার পর একেবারে যানবিহীন হয়ে যায়।’
কৌশিক বলে, ‘তাছাড়া দু-একটা বড়মাপের কালভার্টের কাজ শেষ হয়নি, ডাইভার্শন দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। এই বর্ষণে তা ভয়ানক পিছল হয়ে ওঠে। ও নিশ্চয় ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে আসছে না।
বাসু বললেন, ‘আমার কিন্তু আশঙ্কা, সেই বাইপাস দিয়েই ও আসছে। আর তাতেই কোনও অ্যাক্সিডেন্ট বাধিয়ে বসেছে। বুঝছ না? ওতো আসানসোলে মানুষ হয়েছে। কলকাতার পথঘাটের কোনটা কখন বর্জনীয় তা কি ও জানে?
কৌশিক বললেন, ‘গাড়িটা বার করি, মামু? বাইপাস দিয়ে সল্ট লেকে সুনীলবাবুর বাড়ি পর্যন্ত যাই, আর সার্কুলার রোড দিয়ে ফিরে আসি।’
সার্কুলার রোড যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দুই বরেণ্য বিজ্ঞানীর নামে চিহ্নিত হয়েছে, এ কথা বাসুসাহেবের মনে পড়ল না এখন। বললেন, ‘আর একটু দেখে যাও বরং…’
কথাটা তাঁর শেষ হল না। গেট দিয়ে ঢুকল রুবির অস্টিন গাড়িখানা। অক্ষত।
সকলেই এগিয়ে এলেন সামনের দিকে। বৃষ্টিটা থেমেছে।
‘এত দেরি হল যে আসতে?’
দরজা খুলে রুবি নামল। মুখ তুলে ওঁদের দিকে তাকালো। তার মুখে হাসি— কিন্তু মুখটা রক্তশূন্য। মনে হল, ও বুঝি আসার পথে কোনও ‘বার’-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে দু-তিন পেগ টেনে এসেছে। ওর দুটো পা-ই টলছে। সুজাতা এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরতে গেল। রুবি দুহাত বাড়িয়ে সুজাতার হাতখানা চেপে ধরল। বলল, ‘একটু জল খাব, সুজাতাদি।’
‘দিচ্ছি। আগে এসে এই চেয়ারে বস ঠিক করে।’
ধরে ধরে একটা বেতের চেয়ারে বসিয়ে দিল।
রানু বললেন, ‘পথে কোনও বিপদে পড়েছিলে নাকি?’
রুবি মুখ তুলে বললে, ‘মৃত্যুর মুখ থেকে সদ্য ফিরে এসেছি, মামিমা।’
বাসু কোনও কথা বললেন না। এগিয়ে এসে রুবির নাড়ির গতিটা দেখলেন। দ্বারের প্রান্তে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়েছিল বিশে। তাকে বললেন, ‘এক কাপ দুধ একটু গরম করে নিয়ে আর তো।’
নিজে চলে গেলেন লাইব্রেরি ঘরের ছোট্ট সেলারে—ব্র্যান্ডির শিশিটা নিয়ে আসতে।
একটু সুস্থ হয়ে রুবি যে কাহিনী শোনাল তা রীতিমতো লোমহর্ষক। ঐ ভুলটাই করেছিল সে। ইস্টার্ন বাইপাসের অসমাপ্ত রাস্তা ধরা। দিনের বেলা শুকনো অবস্থায় সে ঐ পথে বার দুই যাতায়াত করেছে। আশঙ্কা করতে পারেনি, রাত্রে সেটা কী পরিমাণে জনশূন্য ও বিপজ্জনক। প্ৰায় মাঝামাঝি আসার পর ও দেখল, পিছন থেকে একটা গাড়ি ওকে ওভারটেক করতে চাইছে। গাড়িটা বহুক্ষণ ধরেই ওর পিছন পিছন আসছিল। রুবি এর আগেও বার দুই হাত নেড়ে পশ্চাদগামী গাড়িটাকে ওভারটেক করতে ইঙ্গিত করেছে। নিজে গতি কমিয়ে বাঁদিকের প্রান্তে সরেও এসেছে। পীচের রাস্তা ছেড়ে কর্দমাক্ত ‘বার্ম’-এ। কিন্তু ইতিপূর্বে দুবারই গাড়িটা ওর নির্দেশ মেনে ওভারটেক করেনি। এবার একেবারে নির্জন এলাকায় ওর হঠাৎ মনে হল, পিছনের গাড়িটা ওকে অতিক্রম করতে চাইছে না, কেন-কী বৃত্তান্ত বোঝা যায় না, কিন্তু গাড়িটা ওকে বাঁ- দিকের খাদে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে। রিয়ার-ভিয়ু আয়নাটা একটু সরিয়ে দেখল— গাড়িটা অ্যাম্বাসাডার, সম্ভবত ট্যাক্সি, একক চালকের মুখে ফেট্টিবাঁধা, চোখে গগল্স।
হঠাৎ রুবি অ্যাকসিলেটারে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যেতে চাইল। কী আশ্চর্য। তৎক্ষণাৎ পিছনের গাড়িটাও গতিবৃদ্ধি করে ওর পাশাপাশি এসে ডানদিক থেকে ঠেসে ধরতে চাইল! আকারে-ওজনে ওর অস্টিনের চেয়ে অ্যাম্বাসাডারটা অনেক বড়। তাছাড়া পশ্চাদগামী গাড়িটা মাঝরাস্তায়, ও কর্দমাক্ত বাঁদিকের ‘বার্ম’-এ। রুবি এখন ব্রেক কষে গাড়ি না থামালে বড় গাড়িটা ওকে বাঁদিকের খাদে ফেলে দেবে।
কিন্তু গাড়ি থামালেই লোকটা এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এ একেবারে নির্ঘাৎ। উদ্দেশ্য ডাকাতি, না লোকটা ম্যানিয়াক, কে জানে।
হঠাৎ বুদ্ধি খুলে গেল ওর।
ভেবেচিন্তে কিছু করেনি। প্রাণধারণের তাগিদে প্রায় প্রতিবর্তী প্রেরণায় সে তুলে নিল পাশের সীটে পড়ে থাকা রিভলভারটা। অস্টিনের এই মডেলটা রাইট-হ্যান্ড ড্রাইভ। ও বাঁ-হাতে স্টিয়ারিং ধরে পিস্তল-সমেত ডান হাতটা বার করে দিল জানলা দিয়ে। পর-পর দুটো ফায়ার করল। এখন মনে হচ্ছে, প্রথমটা করেছিল রাস্তা বা ওর গতিপথের সমকোণে। দ্বিতীয়টায় হাতটা আরও পিছনদিকে ফিরিয়ে পশ্চাদগামী গাড়ির হেডলাইট লক্ষ্য করে। প্রথম গুলিটা কোথায় গেছে ও জানে না, কিন্তু ওর বিশ্বাস দ্বিতীয়টা পশ্চাদ্ধাবনকারীর গাড়ির সম্মুখভাগে বিদ্ধ হয়েছিল। কারণ রুবি একটা ধাতব শব্দ স্পষ্ট শুনেছিল।
মেয়েটি যে সশস্ত্র, প্রয়োজনে রিভলভার চালাবে, এটা বোধকরি ছিল পশ্চাদ্ধাবনকারীর দুঃস্বপ্নেরও অগোচর। সে এতো জোরে ব্রেক কষেছে যে রাস্তায় ওর টায়ার স্কিড করল— শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেল রুবি। আর তার সঙ্গে সঙ্গে পিছনগাড়ির হেডলাইট প্রচণ্ডভাবে উপর-নিচে আলোর সম্মার্জনী বুলাতে থাকে। দেড় থেকে দুমিনিট পরে আর ও গাড়িটাকে দেখা গেল না। রুবি সমান গতিবেগে ঠাণ্ডা মাথায় চলে আসে পার্ক সার্কাস অঞ্চলের জনবহুল রাস্তার উপর। এতক্ষণে ওর স্নায়ুতন্ত্রীতে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। পথে বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় লোকজন চলেছে, ট্রাফিক পুলিশ রয়েছে, বাস-ট্রাম-গাড়ি সব কিছুই চলছে। ও কিন্তু রাস্তার একপাশে চুপ করে গাড়ি পার্ক করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়েছে। বুকের ধড়ফড়ানিটা একেবারে থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কতক্ষণ তা সে জানে না।
বাসু ওর হাত থেকে মারণাস্ত্রটা নিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, কোল্ট কোবরাই। চেম্বারটা খুলে দেখলেন, দুটো গুলি ছোঁড়া হয়েছে। ব্যারেলের সামনে তৃতীয়টি প্রতীক্ষারত। বাকি তিনটি বুলেট পর-পর অপেক্ষা করছে। ছোট, অস্ত্রটা। অত্যন্ত মারাত্মক।
বাসু কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, ‘পকেটে ডায়েরি বা নোটবই আছে? তাহলে নম্বরটা লিখে নাও : 17474 LW; এবার লোকাল থানায় একটা ফোন কর। ঘটনাটা রিপোর্ট করা দরকার।’
কৌশিক গেল ফোন করতে।
বাসু বললেন, ‘একটা কথা তোমরা পরিষ্কার ভাবে বুঝে নাও। রুবি আমার নির্দেশ মোতাবেক রিভলভারটা সল্ট লেক থেকে নিয়ে আসছিল, ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে। আমার নির্দেশে রিভলভারটা আনছিল, যেহেতু ঐ রাস্তাটা সন্ধ্যার পর বিপজ্জনক। রিভলভারটা কার, কে লাইসেন্স হোল্ডার ইত্যাদি যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দেব আমি। তোমরা কেউ নয়, বুঝলে?’
রুবি জানতে চায়, ‘ওরা আমার জবানবন্দি নেবে?’
চাইবে তো বটেই। আমি বলব, তুমি খুবই শকড়। তাই তোমার হয়ে সব কথাই আমি বলতে চাইব। পুলিশ অফিসার যদি এমন কোনও প্রশ্ন করে- তোমাকে, আমাকে নয়, এবং আমি যদি চাই তুমি জবাব দেবে না তাহলে আমি চোখ থেকে চশমাটা খুলে তার কাচটা মুছতে থাকব, আর তৎক্ষণাৎ তুমি অভিপূর্বক নী-ধাতু অ শুরু করে দেবে?’
রুবি বলে, ‘কী শুরু করে দেব?’
‘সেদিন কী শেখালাম? অভিপূর্বক নী-ধাতু অ, অভিনয়। অভিনব পদ্ধতিতে নিকটে নিয়ে আসা। কার নিকটে? দর্শকদের। কী নিয়ে আসা? যা বাস্তবে চোখের সামনে নেই তাকেই অভিনবরূপে উপস্থিত করা। তুমি প্রয়োজনে হিস্টেরিক হয়ে যাবে, আবোল-তাবোল বকতে শুরু করবে, বা ফেইন্ট হয়ে ব্রাস করে পড়ে যাবে। পারবে না?’
‘পারব।’
কৌশিক ফিরে এসে জানালো, থানা থেকে দুজন অফিসার আসছেন, পনের মিনিটের ভিতর।
বাসু বলেন, ‘এবার একবার হোটেল হিন্দুস্থানে ফোন করে প্রমীলার কাছ থেকে জেনে নাও তো, পুষ্পা কি হোটেল তাজবেঙ্গলে আছে? থাকলে, তার ঘরের নম্বর কত?’
কৌশিক ফোন করে জেনে এল যে, পুষ্পার সঙ্গে জনার্দনের মান-অভিমানের পালা মিটেছে। পুষ্পা বর্তমানে জনার্দনের আলিপুর রোডের প্যালেসে অতিথি। কৌশিক বলে, ‘আপনি এমন কেন আশঙ্কা করছেন মামু যে, রুবিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার অভিনয় করতে হবে?’
‘হবেই— এমন কথা বলছি না, কিন্তু প্রয়োজন হতে পারে। পর-পর ভেবে দেখ। কোল্ট- কোবরা রিভলভারটা পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আগে সম্ভবত ছিল মোস্তাক আহমেদের হেফাজতে। লোকটা ক্রিমিনাল টাইপ। তার তিন-চারটে ছদ্মনাম আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি। গহনাচুরির ব্যাপারে তার একটা বড় ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা — না হলে ঐ কোস্ট কোবরা রিভলভারটা তার হাতে যেতে পারে না। লোকটা জানে, ঐ রিভলভারটার ব্ল্যাক-মার্কেট দাম পনের-বিশ হাজার টাকা। সে কেন ওটা রুবির গাড়িতে বেমক্কা ফেলে রেখে যাবে? একটাই সম্ভাব্য উত্তর : নিশ্চিত সে ঐ রিভলভারে কাউকে খুন করেছে, আর এখন অপরাধটা রুবির ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। খুনের জন্য একটা আসামীকে তো পুলিশের সামনে তুলে ধরতে হবে, না কি? যে মেয়েটা আট হাজার টাকা খেসারত চাইছে তাকে তুলে ধরাই সব চেয়ে ভাল। রুবি নিজেই স্বীকার করেছে যে, ঐ রিভলভারটা সে ফায়ার করেছে— বাইপাস রাস্তায়- কিন্তু একবার না দুবার তার প্রমাণ কী? আহমেদ যাকে হত্যা করেছে তার শব-ব্যবচ্ছেদ করে যদি প্রমাণিত হয় যে, গুলিটা, এই রিভলভার থেকে নিক্ষিপ্ত, তাহলে হত্যাপরাধ সুনির্দিষ্ট ভাবে রুবির ঘাড়ে এসে পড়ে। হয়তো আহমেদ রিভলভারটা ওর গাড়িতে ফেলে দিয়ে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল। সে ‘আন্দাজ করেছিল, রুবি আমাকে ফোন করবে, আমি তাকে ঐ রিভলভারটা নিয়ে সোজা আমার বাড়িতে চলে আসতে বলব- এটাও সে সহজেই আন্দাজ করেছে। তার বাকি কাজ হল ভয় দেখিয়ে রিভলভার থেকে তাকে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য করা। তাই নয়?’
রুবি বললে, ‘মামু, আপনার চশমা-মোছার ‘কিউ’-টার দরকার হবে না। আমি এখনই ‘অভিপূর্বক নী-ধাতু awe’-এর অতি নিকটে পৌঁছে গেছি। বলেন তো এখনই ফেন্ট হয়ে থ্রাস করে পড়ে যাই।’
বিশু এসে জানালো, একটা পুলিশের জিপ এসেছে।