‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ১৩

১৩

রবিবার সাতসকালে চায়ের টেবিলে প্রসঙ্গটা তুলল কৌশিক। জনার্দন গায়কোয়াড়ের প্রস্তাবটা। পূর্বরাত্রে সে সবিস্তারে তথ্যটা জানিয়েছিল বাসুসহেবকে। উনি নির্বাক শুধু শুনে গিয়েছিলেন। কৌশিক জানতে চেয়েছিল, ‘আপনি আমাকে কী করতে বলেন? মিস্টার গায়কোয়াড়ের প্রস্তাবে রাজি হব, না প্রত্যাখ্যান করব?’

বাসুসাহেবের জন্য কাল ডিনার-টেবিলে রানু দেবী খই-

দুধের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। বাটিতে জল ঢেলে চুমুক দিয়ে সেটা খেয়ে ফেলে বাসু বললেন, ‘আজ রাতটা দুজনে ভাবতে থাক! কাল সিদ্ধান্ত নিও বরং।’

তাই আজ সাতসকালেই আবার প্রসঙ্গটা তুলেছে কৌশিক।

বাসু বললেন, ‘সমস্যাটা সুকৌশলীর। আমি কেন উপরপড়া হয়ে কিছু সাজেস্ট করতে যাব?’

কৌশিক কিছু বলার আগেই সুজাতা আগ বাড়িয়ে বলে, ‘যেহেতু আমরা অর্থী, আমরা জিজ্ঞাসু, আমরা আপনার সাহায্য চাইছি!’

বাসু রানুর দিকে ফিরে বললেন, ‘আর হাফ কাপ কফি পাওয়া যাবে?’

রানু নির্বিকারভাবে বললেন, ‘না। তাহলে তোমার ঘুম চড়ে যাবে!’

বাসু শ্রাগ করলেন।

সুজাতা হাত বাড়িয়ে কফি-পটটা টেনে নিয়ে মামুর কাপে কফি ঢেলে দিল। রানুর দিকে ফিরে বলল, ‘আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে মামিমা, আপনি ব্যস্ত হবেন না।’

বাসুর কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলেন, আমার মতে জে-জি’র প্রস্তাবে তোমরা এখনই রাজি হয়ে যেও না। কৌশিক তার চাল দিয়েছে— বোড়েটাকে একঘর এগিয়ে দিয়ে আহমেদের মন্ত্রীটাকে ধরেছে। এখন আহমেদের চাল। সে কী চাল দেয় প্রথমে দেখ। আট হাজার টাকা রুবিকে দিয়ে আসে কিনা।’

কৌশিক বলে, ‘কিন্তু জনার্দন চাইছেন তার আগেই আমরা কিছু একটা করি- যাতে আহমেদ ঐ সুযোগটা না পায়।’

বাসু বলেন, ‘কিন্তু সেটা কি অন্যায়-অধর্ম হয়ে যাবে না?’

‘কেন? অন্যায়টা কিসের? আহমেদ তো ঠগ-জোচ্চর। রুবির টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছিল।’

‘সেটা তো কেউ অস্বীকার করছে না, কৌশিক। কিন্তু সে অপরাধের জন্য তুমি তো বিচার করে ওকে একটা শাস্তির বিধান দিয়ে বসে আছ— আট হাজার টাকা আর্থিক জরিমানা। নির্দিষ্ট সময়ে আসামী যদি জরিমানার টাকাটা না মিটিয়ে দেয় তখনই “অনাদায়ে সশ্রম কারাদণ্ডের” প্রশ্নটা উঠতে পারে।’

রানু বললেন, ‘তোমার সওয়াল শুনে মনে হচ্ছে রুবি নয়, ঝানু মল্লিকই তোমার মক্কেল। আর জনার্দন গায়কোয়াড় এক্ষেত্রে আসামী।’

বাসু কফির বাকিটুকু কণ্ঠনালীতে ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘কথাটা যখন তুললেই রানু, তখন বলি : সত্যিই আমার মূল্যায়নে জে-জি হচ্ছে ‘নেভ আর ঝানু : করুণার পাত্র।’

‘কী হিসাবে?’

বাসুসাহেব তাঁর বক্তব্যটা বিশ্লেষণ করে বোঝালেন।

প্রথম কথা : ঝানু মল্লিক রুবির সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। সে জন্য সুকৌশলীর আদালতে তার বিচার আর শাস্তির বিধান হয়েছে। আর্থিক জরিমানা। এক অপরাধের জন্য দুবার শাস্তি দেওয়া যায় না। না আইনে, না বিবেকের নির্দেশে। কিন্তু রুবির প্রতি অন্যায় করা ছাড়া মোস্তাক আহমেদের অপরাধ কতটুকু তার প্রমাণ নেই। আমাদের সামনে দুজাতের তথ্য আছে। একেবারে প্রথম পর্যায়ে শোনা যাচ্ছে, এককালে আহমেদ পুষ্পাকে খাইয়েছে, পরিয়েছে। সত্য-মিথ্যা জানা যায় না। পুষ্পা বাল্যেই পিতৃহীন। কিন্তু সে পুনা ইনস্টিটিউটে পড়েছিল। তাহলে কে তাকে টাকা জুগিয়েছিল? মা? যে মা সন্ন্যাসিনী? তিনি কন্যাকে অভিপূর্বক নী ধাতু অ-এর জগতে পাঠিয়েছিলেন? তাহলে? ফলে, পুষ্পার অতীত জীবন রহস্যময় — পরস্পর-বিরোধী, তথ্যে ঠাসা। কিন্তু কতকগুলি তথ্য অবিসংবাদিত। এক নম্বর : মোস্তাক আহমেদ এক সময় পুষ্পার ড্রাইভার-কাম-কুক ছিল। দু-নম্বর : মোস্তাক আহমেদ অত্যন্ত সুদর্শন এবং লেডি কিলার খ্যাতি লাভ করেছিল। তিন নম্বর : পুষ্পা স্টারলেট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোস্তাক আহমেদ বোম্বাই থেকে বিতাড়িত হয়েছিল কলকাতার টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। পুষ্পার পাবলিসিটি এজেন্টের ব্যবস্থাপনায়। এগুলি অবিসংবাদিত তথ্য!

‘এখন জনার্দন জানাচ্ছেন— আহমেদ ব্ল্যাকমানিতে পুষ্পাকে অব্যাহতি দিতে অরাজি। বিশ হাজার নয়, বোধ করি, পঞ্চাশ হাজার টাকার অফার প্রত্যাখ্যান করেছে সে। পরিবর্তে শাদা টাকায় সে নায়কের পারিশ্রমিক হিসাবে এক লক্ষ টাকার দাবি করেছে। আহমেদ জানে, তা থেকে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা স্রেফ ইনকাম ট্যাক্স বাবদ কাটা যাবে। তবু সে কালো টাকায় পুষ্পাকে অব্যাহতি দিতে রাজি নয়। কেন?’

কৌশিক বললে, ‘হয়তো সে রেকর্ড রাখতে চাইছে- তার পারিশ্রমিক কত। যদি সে এ ছবিতে সাফল্যমণ্ডিত হয় তাহলে পরবর্তী ছবিতে তার ডাক আসবে, তখন তার বাজারদর আর কমানো যাবে না।’

‘হতে পারে। আর মূল হেতুটা তা নাও হতে পারে।

সুজাতা বলে, ‘আমার মনে হয় মামু যা ইঙ্গিত করছেন, সেটাই মূল হেতু।’

‘মামু তো কিছু ইঙ্গিত করেননি। কৌশিক প্রতিবাদ করে।

করেছেন। হয়তো আহমেদ পুষ্পার প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এভাবে দাবি করছে। পুষ্পার সঙ্গে যদি এককালে তার প্রেম-মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকে— উঠেছিল কি না আমরা জানি না— তাহলে এ প্রবণতাটা স্বাভাবিক। বাস্তব জগতে নাই হোক, অভিনয়ের জগতে পুষ্পাকে স্বীকার করতে হবে আহমেদের কাছে : ম্যায় তুমকো প্যার করতি হুঁ।’

রানু চুপ করে শুনে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘মানলাম। হয়তো আহমেদ এক্ষেত্রে করুণার পাত্র। কিন্তু জনার্দন গায়কোয়াড় ‘নেভ’ হল কোন হিসাবে? সে তো কোনও অপরাধ করেনি। একমাত্র অপরাধ : পুষ্পাকে ভালবাসা ছাড়া?’

বাসু কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, ‘কাল রাত্রে তুমি বলেছিলে, আমার মনে আছে : তবু আবার বল তো—ঐ ফার্সি-ভাষায় লেখা কাগজখানা, যার জেরক্সকপি তোমাকে উপহার দিয়েছে, সেটা জনার্দন কোথায় পেয়েছে বলেছিল?’

‘পুষ্পার কাছে!’

‘তাতেই প্রমাণ হচ্ছে জনার্দন গায়কোয়াড় ধোওয়া তুলসীপাতাটি নয়! ‘

‘কেন?’

‘লজিক্যালি ভেবে দেখ। ঐ কাগজখানা সাচ্চা হতে পারে, ঝুঠাও হতে পারে। ঝুঠা হলে ধরে নিতেই হবে যে, মোস্তাক আহমেদ মূল কাগজখানা কোনও মৌলবির মাধ্যমে বানিয়েছে। দু- একজন মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করেছে। তা যদি হয়, তাহলে তার কপি পুষ্পার কাছে থাকতে পারে না। কারণ, অমন জাল বিবাহের দলিল বানাবার প্রেরণা আহমেদ তখনই লাভ করবে যখন সে বোম্বাইয়ের সিনেমাজগৎ থেকে কলকাতায় বিতাড়িত। সে ক্ষেত্রে তার কপি পুষ্পার কাছে থাকবে কেন? অপরপক্ষে যে বিবাহের দলিলের কপি দুল্হা-দুলহ্ন’ দুজনের কাছেই থাকে তা সচরাচর জাল হয় না। তা সাচ্চা! জনার্দন যদি পুষ্পার কাছ থেকে ঐ কাগজটা সংগ্রহ করে জেরক্স করিয়ে থাকে তবে তা সাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অর্থাৎ আহমেদ পুষ্পার প্রথমপক্ষের স্বামী। জনার্দন তাকে চুরির অপরাধে জেলের ভিতর ঢোকাতে চাইছে। সেক্ষেত্রে আহমেদ তার বিয়েতে কোনও বাধা দিতে পারবে না। আজ যদি আহমেদ বেমক্কা খুন হয়ে যায় তাহলে পুলিশ যাই বলুক, আমি তো সন্দেহ করব ঐ টাকার কুমিরটাকে!

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। কৌশিক ফোনটা তুলে শুনল। ফোন করছে রুবি। সল্টলেক থেকে। কৌশিক জানতে চাইল, ‘কী খবর রুবি, এত সকালে?’

‘সুখবর। কাল রাতে ঝানুদা ফোন করেছিল। কথা দিয়েছে, আজ বিকাল চারটের সময় সে আসবে এই সল্ট লেকের বাড়িতে। ডিরেকশন আর ঠিকানা জেনে নিয়েছে। পুরোপুরি আট হাজার টাকাই দেবে। নগদে।

‘বল কী! এতো দারুণ খবর! তা, কী বলল? কৈফিয়ৎ হিসাবে?’

‘ও! সে এক ইন্টারেস্টিং গল্প। বোম্বাই ফিল্ম মার্কা প্লট। ছয় বছর আগে ঝানুদা বোম্বাইয়ে গিয়ে একটা মোটর অ্যাকসিডেন্টের খপ্পরে পড়ে। যথারীতি হেড ইনজুরি। যথাপ্রত্যাশিত ‘অ্যামনেশিয়া’। এ কয়বছর সে শুধু ভেবেছে কে আমি? কী নাম আমার? কোন হতভাগিনী ছিল আমার প্যার-মহব্বৎ-এর দিল-কি-রানী।

‘বুঝলাম। চেনা প্লট।’

* * *

কাল দুপুরে দেড়টার সময় প্রমীলা ফোন করে জানিয়েছেন যে, ব্রহ্মচারী ঠিক সময়েই এসেছিলেন। সিকিউরিটি জমা দিয়ে একুশ হাজার একশ টাকা নিয়ে গেছেন। আজ দুপুরে মুকুটটা ফেরত দিয়ে সেই সিকিউরিটি কাগজখানা ফেরত নিয়ে যাবেন।

কৌশিক জানতে চেয়েছিল, ‘এন. এস. সি.? কার নামে? ওখানে তো ছদ্মনাম চলবে না?’

প্রমীলা বলেছিলেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না। সিকিউরিটি পেপারটা জেনুইন। আমার কাছে তার মূল্য থাক না থাক, যে জমা রেখে গেছে তার কাছে সেটা অমূল্য।’

অসুবিধা হয় না বুঝতে, প্রমীলা সব কথা খোলাখুলি জানাচ্ছেন না। জানাতে চাইছেন না।

কৌশিক সব কথা খুলে বলল বাসুসাহেবকে।

তিনি বললেন, ‘আরে বাবা, প্রমীলা পাণ্ডে একটি বাস্তুঘুঘু। তিনি তোমার মতো টিকটিকিকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচতে পারেন। সব কিছুই তো রেখে-ঢেকে তোমার সাহায্য কিনতে চাইছেন। কোল্ট কোবরা রিভলভারটা যে চুরি গেছে এটাও তো তোমার কাছে গোপন করেছিল প্রথমে। এখনো বলতে চাইছেন না, কী সিকিউরিটি জমা দিয়ে লোকটা বিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেল…’

কৌশিক বাধা দিয়ে বললে, ‘বিশ নয় মামু, একুশ হাজার একশ— ঘাটে ঘাটে পেন্নামী দিতে হবে বলে।

বাসু বললেন, ‘হ্যাঁ, অঙ্কের হিসাবটা আমার মনে আছে। ও তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল যে কারণে সেটাতেই যে তুমি রাজি হলে না।’

‘কোনটাতে?’

‘যতই বুদ্ধি ধরুক, ও স্ত্রীলোক। সম্ভবত ওর কাছে কোন ফায়ার আর্মস নেই। ও তোমাকে অকুস্থলে বডি-গার্ড হিসাবে উপস্থিত রাখতে চেয়েছিল। আর সে জন্যই এক গাদা মিছে কথা বলে গেছে! কিন্তু তুমি আদানপ্রদানের মাহেন্দ্রক্ষণে পর্দার আড়ালে পিস্তল হাতে উপস্থিত থাকতে রাজি হলে না। এবং সেটা ঠিকই করেছ।’

রবিবার ওঁরা যখন লাঞ্চে বসেছেন তখন ফোন করলেন প্রমীলা পাণ্ডে। কৌশিক ওঁর ফোন প্রত্যাশাই করেছিল। উঠে গিয়ে ধরল, ‘কী ব্যাপার? মুকুটটা ফেরত পেলেন?’

‘তা পেলাম। অশেষ ধন্যবাদ।’

‘আমাকে ধন্যবাদ কিসের? এ তো আপনারই কৃতিত্বে। আর রীতিমতো অর্থমূল্যে খরিদ করা। পুষ্পা দেবীকে জানিয়েছেন?’,

‘আমার কী গরজ? শুনুন, মিস্টার মিত্র। মঙ্গলবার, কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে গিয়ে মুকুটটা মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে আনতে যাব। আপনাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে সাক্ষী হিসাবে সশস্ত্র। এবার আসতে রাজি আছেন তো?’

‘আসব। ট্যাক্সিতে নয়। হোটেল হিন্দুস্থানের গাড়ি নিয়ে যাব। বড় বড় হোটেলে অর্থমূল্যে স্পেশাল সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকে। সে ব্যবস্থাও না হয় করা যাবে।

‘এবার তাহলে বলুন, সুকৌশলীকে কী সম্মানমূল্য দিতে হবে?’

‘তাড়াহুড়োর কী আছে? কাজটা সুষ্ঠুভাবে আগে মিটুক।’

‘আপনাকে আরও একটা তাজ্জব জিনিস দেখাব, যেটা দিয়ে আপনার ভালরকম অর্থাগম হবে। সেটা হাতে পেলে নিশ্চয় আপনি আপনার ফি অনেক কমিয়ে দেবেন।’

‘ব্যাপার কী? আপনি যে ক্রমশই রহস্যঘন হয়ে উঠছেন। জিনিসটা কী? ‘

‘একখণ্ড কাগজ। কাল জীবন ব্রহ্মচারী যে সিকিউরিটি রেখে গিয়েছিল তারই জেরক্স কপি। আমি আপনাকে উপহার দেব বলে বানিয়ে রেখেছি। আমার কাছে তার দাম নেই। আপনার কাছে আছে।

‘রহস্য যে ক্রমশই জমাট বাঁধছে। সেটা কী, তা বলবেন না?’

‘এখন নয়। যখন আপনি বিল দেবেন তখন দেখাব!’

লাইনটা কেটে দিয়ে কৌশিক বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বলল, ‘শুনলেন?’

বাসু বললেন, ‘একতরফা’।

কৌশিক সমস্তটা বুঝিয়ে বলল, ‘জানতে চাইল, আন্দাজ করতে পারেন জিনিসটা কী?’ বসু বললেন, ‘আমার কী গরজ? সমস্যাটা যার সে সুকৌশলে সমাধানের কথা ভাবতে থাকুক। এটুকু আন্দাজ করতে পারি ঐ উপহারটা জনার্দন আগেই তোমাকে দিয়েছেন।’

আহারাদির পর বাসুসাহেব কী একখানা বই নিয়ে ইজিচেয়ারে লম্ববান হলেন। রানু জানলা বন্ধ করে ফ্যান খুলে দিবানিদ্রা দিতে গেলেন। সুজাতা কী কেনাকাটা করতে গেছে। কৌশিকের মনটা চঞ্চল ছিল। বিকাল চারটেয় ঝানু মল্লিক সল্টলেকে আসবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এক ঘণ্টা মার্জিন দিয়ে পাঁচটা নাগাদ সে ফোন করতে উঠল। ঠিক তখনই বেজে উঠল টেলিফোন।

‘হ্যালো? কে রুবি? আমি কৌশিকদা বলছি।’

‘কৌশিকদা! কী বলব? এদিকে একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেছে। আমি যে কী করব বুঝতে পারছি না।’

‘ঝানু মল্লিক এসেছিল? চারটের সময়?’

‘না।’

তাহলে বিশ্রী ব্যাপারটা কী হল?’

‘টেলিফোনে বলাটা কি ঠিক হবে?’ আমি… আমি… হঠাৎ একটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি আমার গাড়ির ভেতর।

‘জড়োয়া ব্রেসলেটের দ্বিতীয় পার্টিটা?’

‘না, কৌশিকদা, একটা ইয়ে… মানে, রিভলভার।’

‘সে কী! কোথায় পেলে?’

‘ঐ যে বললাম, আমার গাড়িতে। ড্রাইভারের সিটে। তোয়ালে জড়ানো।

কৌশিক বললে, ‘লাইনটা একটু ধরে থাক রুবি, আমি মামুকে ডেকে আনি।’

বাসু খবর পেয়ে এগিয়ে এলেন। কৌশিককে ইঙ্গিত করলেন, রিসেপশনের এক্সটেনশনে কথোপকথনটা শুনতে। তারপর টেলিফোনে রুবিকে বলেন, ইয়েস। বাসুমামু বলছি। বল, রুবি। ওটা গাড়ির ভিতর খুঁজে পেলে কী করে? গাড়িটা কোথায় ছিল?’

‘গ্যারেজে নয়, ড্রাইভওয়েতে। আমার ড্রাইভার সিটের কাচটা ঠিকমতো বন্ধ হয় না। কেউ জোর করে চাপ দিয়ে নামিয়েছে।’

‘লোডেড? কোনও ডিসচার্জড বুলেট কি আছে ওতে? গন্ধ শুঁকে কী মনে হল…’

‘হ্যাঁ, শুঁকে দেখেছি। শুধু সিঙ্গার-মেশিন তেলের গন্ধ, পুরো লোডেড। ছটা চেম্বারে ছটা গুলি।

‘কী ধরনের রিভলভার?’

‘তা জানি না। আকারে খুব ছোট। ওজনও খুব কম। নাকটা থ্যাবড়া। মনে হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম আর স্টিলের অ্যালয়…’

‘বুঝেছি। কোল্ট কোবরা। তোমার ওখানে বাড়িতে কে আছে এখন?

‘রাজমিস্ত্রিরা ছাতে আছে, কেন?’

ওদের বলে এস, তুমি বের হচ্ছ। রাত্রি বেশি হলে নাও ফিরতে পার। ওরা যেন সজাগ থাকে। দুএকজন নিচের বারান্দাতে শুয়ে থাকুক। তুমি ঐ যন্ত্রটা নিয়ে সোজা আমার বাড়িতে চলে এসে। রাত্রে এখানেই থাকবে। অত রাত্রে বাই-পাস দিয়ে তোমার একা ফেরা ঠিক নয়।’

‘আমি তো সার্কুলার রোড দিয়ে শ্যামবাজার হয়েও ফিরে আসতে পারি?’

কী দরকার? আকাশে মেঘ করেছে। না, রাত্রে তুমি এখানেই থাকবে।

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে ঘড়িটা দেখলেন। সন্ধ্যা ছটা। বিকাল থেকেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। সূর্যাস্ত বোধহয় হয়নি। কিন্তু কালো মেঘের আস্তরণে অস্তগামী সূর্যটা ঢাকা -পড়েছে। ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার।

কৌশিক টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এসে বসল ওঁর মুখোমুখি। বলল, ‘নাকটা থ্যাবড়া। অ্যালুমিনিয়ম আর স্টিলের অ্যালয়! আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন, মামু। এটা কোল্ট কোবরা। কিন্তু কলকাতা বাজারে এটা দুষ্প্রাপ্য। আমি তো একটাও দেখিনি।’

বাসু বললেন, ‘দেখনি। শুনেছ। জনার্দন নাকি একজোড়া কিনেছিল। একটা তার কাছে আছে। একটা চুরি গেছে। তাই নয়?’

কৌশিক বললে, ‘প্রমীলা দেবী যদি সত্যি কথা বলে থাকেন তাহলে চোরাই মালটা আছে জীবনরতন ব্রহ্মচারীর কাছে।’

‘হুঁ। কিন্তু জীবন ব্রহ্মচারীটি কে?’

‘বাঃ! যার কাছে… ও, আপনি বলছেন… লোকটা আসলে কে? আমার আন্দাজের বাইরে। আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন, মামু?’

‘সম্ভবত। দুটো সূত্র থেকে। প্রথমত, রুবি রায়ের বাড়ির ঠিকানা আর সঠিক লোকেশন আমরা ছাড়া বাইরের একজনমাত্র লোকই জানে। দ্বিতীয়ত, প্রমীলা বলেছেন, জীবনলাল যে গ্যারান্টি কাগজটা দিয়ে গিয়েছিল তার মূল্য জীবনলালের কাছে অসীম। তোমার কাছেও তা অত্যন্ত মূল্যবান। তার একটা জেরক্স কপি তোমাকে উপহার দিয়ে ও সুকৌশলীর বিলটা কমাতে চায়।’

‘বুঝলাম।’

‘সম্ভবত। মোস্তাক আহমেদ চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রমীলার কাছে জমা রেখে গেছিল তার আইনত বিবাহের যাবতীয় অরিজিনাল প্রমাণ। প্রমীলার কাছে সে কাগজের কোন মূল্য নেই, কিন্তু পুষ্পা আর জনার্দনের এনগেজমেন্ট অ্যানাউন্সড হলে ঐ কাগজটার মাধ্যমে মোস্তাক আহমেদ জনার্দনের কাছ থেকে বিশ-পঞ্চাশ হাজার আদায় করতে পারবে। চাই কি জনার্দনের ছবিতে পুষ্পার বিপরীতে হিরো সেজে লাখ টাকা কামাবে। টাকাটা পেলে তবেই সে তালাক দেবে। অথচ আহমেদ জানে, প্রমীলা ঐ ডকুমেন্টটা সযত্নে রক্ষা করবে, কারণ সে পুষ্পার প্রতিদ্বন্দ্বিনী। তার উপর প্রমীলা ঐ জেরক্স কপি দেখিয়ে গোয়ালিয়র রাজমাতার সন্দেহভঞ্জন করে ফি-টা পুরো কালেক্ট করতে পারবে।

‘তার মানে, আপনি বলতে চান, রুবি রায়ের গাড়িতে ঐ ঝানু মল্লিক ওরফে আহমেদই রিভলভারটা ফেলে রেখে গেছে?’

‘এ-ছাড়া বিকল্প কোন সমাধান কি তুমি দাখিল করতে পারছ?’

‘কিন্তু ঝানু মল্লিক এ কাজ করবে কেন? রুবি তো বলল, রিভলভারে ছয়টাই তাজা বুলেট।’

‘সেটা তার সিদ্ধান্ত। যন্ত্রটা হাতে পাই, তারপর দেখা যাবে। হয়তো ওটা ব্যবহারের পরে ভাল করে মুছে তৈলাক্ত করে আবার রিলোড করা হয়েছে।’

‘তাহলে খুনটা হয়েছে কে?’

‘সেটাই শুধু জানতে বাকি!