‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ১২

১২

পরদিন সকালে হোটেল হিন্দুস্থান থেকে প্রমীলা দেবী ফোন করলেন সুকৌশলীর অফিসে। জানালেন, হঠাৎ কিছু অপ্রত্যাশিত ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। সামনাসামনি আলোচনার দরকার। জানতে চাইলেন, কখন, কোথায় আলোচনাটা হতে পারে।

কৌশিক জানালো সে এখনই আসছে।

এলও তাই। হোটেল হিন্দুস্থানের 4/24 ঘরে প্রমীলা ওকে আপ্যায়ন করে বসালেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে জানালেন, গতকাল সন্ধ্যায় প্রমীলা দেবীর পরিচিত একজন অত্যন্ত নামকরা কলকাত্তাওয়ালা তাঁকে ফোন করেছিলেন। এ ভদ্রলোক রাজনীতি মহলে সুপরিচিত। বিধায়ক, পুলিশের জগতেও খাতিরের ব্যক্তি। মুকুট আর গহনাগুলি উদ্ধারের ব্যাপারে প্রমীলা ইতিপূর্বেই তাঁর সাহায্য চেয়েছিলেন, টেলিফোনে। বিশেষ কারণে প্রমীলা তাঁর নামটা জানাতে চাইলেন না। বললেন, ধরে নিন তাঁর নাম ক-বাবু। তা সেই ক-বাবু কাল জানালেন, কলকাতার এক তথাকথিত গডফাদারের কাছে ঐ মুকুট ও গহনা নিরাপদে পৌঁছে গেছে। চোরাই মাল পাচার করার ব্যাপারে ঐ গডফাদার চোর-ডাকাত মহলে ‘মুশকিল আসান’। ক-বাবু খোঁজ পাওয়ার আগেই সোনার গহনাগুলি গলিয়ে ফেলা হয়েছে। তা আর উদ্ধারের কোনও আশা নেই। জড়োয়া গহনাগুলি গলানো হয়নি। গলিয়ে ফেললে পড়তা পোষায় না। ইদানীং তা পালিশ করে মধ্যপ্রাচ্যে চালান করা হয়। ওরা ভারতীয় গহনার ডিজাইন পছন্দ করে। তবে ক-বাবুর বিশেষ অনুরোধে চোর-ডাকাতদের গডফাদার জানিয়েছেন, গহনার মালিক যদি নিজেই অর্ধ-মূল্যে জড়োয়া গহনাগুলি কিনে নিতে রাজি থাকেন এবং পুলিশ কেস উইথড্র করে নেন, তাতে তাঁর আপত্তি নেই। প্রমীলা বলেছিলেন, তিনি সব গহনাই কিনে নিতে চান, তবে নমুনা হিসাবে ঐ মুকুটটা ক্রয় করতে ইচ্ছুক। তিনি জানতে চান, শুধু মুকুটটা বাবদ তাঁকে কত দিতে হবে।

ক-বাবু তখন জবাবে বলেন, ‘তুমি ভুল করছ প্রমীলা-মা। আমি তাদের চিনি না, চোখেও দেখিনি কোনদিন। এ খবর এনেছে আমার কনট্যাক্ট-ম্যান। তুমি যদি ওদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে ইচ্ছুক থাক, তাহলে আমি তাদের হোটেল হিন্দুস্থানে গিয়ে দেখা করতে বলতে পারি। দরাদরি যা করার তুমি সরাসরি করবে। আমার তাতে কোন হাত নেই। মধ্যস্থতাও নেই।’

কৌশিক জানতে চায়, তারপর? আপনি রাজি হয়ে গেলেন? ‘

‘গেলাম। আমি শর্ত করলাম, ভেনুটা হবে হোটেল হিন্দুস্থানে আমার ঘর। রাত আটটায়। গডফাদারের তরফে একজন মাত্র আসবে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ওরা রাজি হল। ঐ সঙ্গে আমাকেও প্রতিশ্রুতি দিতে হল কোন ‘মাংকি বিজনেস’ করব না।’

‘মাংকি-বিজনেস মানে?’

‘আগেভাগে পুলিশে খবর দিয়ে ঐ লোকটিকে ধরবার চেষ্টা করব না, বা কোথাও কোন কন্সিলড টেপ রেকর্ডার লুকিয়ে রাখব না, ইত্যাদি।’

‘তারপর? লোকটা এসেছিল?’

‘হ্যাঁ, পাঙ্কচুয়ালি রাত আটটায়। বছর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়স, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। গোঁফ- দাড়ি দুইই আছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। নাম বললেন, জীবনরতন ব্রহ্মচারী।’

‘ছদ্মনাম নিঃসন্দেহে, কিন্তু দেখে কি মনে হল না, লোকটা ছদ্মবেশে এসেছে?

‘তা তো হলই। সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আগামীকাল, রবিবার, বেলা একটা বেজে দশ মিনিটে সে এই ঘরে এসে মুকুটখানা অক্ষত অবস্থায় ডেলিভারি দেবে, শর্তসাপেক্ষে।’

‘কী কী শর্ত?’

‘এক নম্বর : আজ বেলা একটা দশ মিনিটে সে আসবে। তাকে একুশ হাজার একশ টাকা নগদে দিতে হবে। দু-নম্বর : কোন মাংকি বিজনেস হলে সে এই ঘরের ভেতর আমার লাশ ফেলে দেবে। পকেট থেকে বার করে সে একটা রিভলভার আমাকে দেখালো। তাতে সাইলেন্সার ফিট করা।’

প্রমীলা তখন জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনার কথার গ্যারান্টি কী? আপনি তো অনায়াসে টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যেতে পারেন। মাংকি বিজনেস হবে না, একুশ হাজার একশ টাকাই আমি নগদে দেব— কিন্তু তৎক্ষণাৎ মুকুটটাও আপনাকে হস্তান্তরিত করতে হবে।’

জীবন তখন বলেন, ‘তা হয় না। আমার হাত ফিরি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি যদি দেখি আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে স্টেনগানধারী পুলিশ? মুকুটটা যে চোরাই মাল তার রেকর্ড আছে।’

প্রমীলা বলেন, ‘কিন্তু মুকুটটা যে আপনাদের জিম্মায় আছে তার প্রমাণ কী?’

‘প্রমাণ তো এই মাত্র আপনাকে হাতে-হাতে দেখালাম। চিনতে পারেননি?

পকেট থেকে দ্বিতীয়বার রিভলভারটা সে বার করে দেখায়। বলে, ‘নাম্বারটা কি আপনার লেখা আছে? নাকি আপনার সেই সিনেমা-আর্টিস্ট বান্ধবীর কাছে লেখা আছে? এটাও তো ছিল সেই স্যুটকেসে। ছিল না?’

কৌশিক বলে, তার মানে মিস্টার জনার্দন গায়কোয়াড়ের সেই রিভলভারটাই? কিন্তু সেটা তো চুরি যায়নি বলেছিলেন?’

‘তখন তাই বলেছিলাম, কারণ জনার্দন তাই বলতে বলেছিল। ওটার ক্যারিয়ার লাইসেন্স ছিল না আমাদের দুজনের কারও। তাই পুলিশে আমরা ওটা রিপোর্ট করিনি।’

‘আপনি চিনতে পারলেন?’

‘না। এটুকু বুঝলাম যে, ওটা একটা কোল্ট কোবরা।

‘কোল্ট কোবরা। তার মানে?’

‘অত্যন্ত দামী একটা যন্ত্র। অ্যালুমিনিয়াম-অ্যালয়। মাত্র বিশ-আউন্স ওজন। জন এক জোড়া কিনেছিল। একটা সর্বদা সে নিজের কাছে রাখে, একটা দিয়েছিল পুষ্পাকে। ও জিনিস বাজারে সহজে পাওয়া যায় না।’

‘বুঝলাম। তারপর কী হল?’

‘লোকটা তখন একটা বিচিত্র প্রস্তাব দিল। বলল, মুকুটটা বর্তমানে যার কাছে আছে তাকে নগদ না দিলে সে হাতছাড়া করবে না। তাকে দিতে হবে পনের হাজার…’

প্রমীলা তখন জানতে চান, ‘তাহলে আপনি একুশ হাজার একশ চাইছেন কেন?’

‘কী আশ্চর্য! ঘাটে-ঘাটে পেন্নামী দিয়ে যেতে হবে না? গডফাদারকে, পুলিশকে, ঐ আপনার ইলেকশন জেতা বিধায়ক দাদাকে?’

‘কিন্তু আপনি যে আজ দুপুরে আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবেন না, তার গ্যারান্টি কী?’

‘শুনুন মা, বলছি। আজ দুপুর একটা বেজে দশে আপনার কাছ থেকে টাকাটা নেবার সময় আমি একটা গ্যারান্টি জমা রেখে যাব, যার দাম আমার কাছে ত্রিশ/চল্লিশ হাজার টাকা, আপনার কাছে কিছুই না। তা হলে হবে তো?’

প্রমীলা বলেছিলেন, ‘আপনার প্রস্তাবটা আমি বুঝতে পারলাম না। আপনি যদি একটা চোরাইমাল — ধরা যাক, একটা সোনার বিস্কুট গ্যারান্টি হিসাবে রেখে যান…

জীবন বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘আপনি আমার প্রস্তাবটা ধরতে পারেননি, মা। জিনিসটা এমন যে, আপনার কাছে তার দাম নেই, আমার কাছে আছে। ধরুন চল্লিশ হাজার টাকার ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট আমার নিজের নামে। আমি ওটা পোস্ট আফিসে জমা দিলে আজই ত্রিশ হাজার টাকা পাব। আপনি তা পাবেন না। অথচ এন.এস.সি. একটা লিগাল ডকুমেন্ট- সরকারই তা গ্যারান্টি হিসাবে জমা রাখেন। আপনিও তা চব্বিশ ঘণ্টার জন্য জমা রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনার দেওয়া একুশ হাজার একশ টাকা মেরে দিয়ে আমি ওই এন. এস. সি.-গুলো খোয়াতে রাজি হতে পারি?’

কৌশিক বলল, ‘মনে হচ্ছে আপনি শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মচারীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। তাই কী?’

‘তাই হলাম, মিস্টার মিত্র। ভুল করলাম কি?

‘আমার তা মনে হয় না। আপনি খুবই বুদ্ধিমতীর মতো জিনিসটা ট্যাকল করেছেন। আমার ইন্টুইশন বলছে, আপনি মুকুটটা ফেরত পাবেন।’

প্রমীলা বলেন, পুলিশে আমি খবর দেব না, কিন্তু আপনি কি ওই সময় আমার ঘরে সশস্ত্র লুকিয়ে থাকতে পারেন?’

কৌশিক বললে, ‘না। সেটা মোটেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না। এইসব আন্ডার ওয়ার্ল্ড- এর লোকগুলোর নেটওয়ার্ক কী প্রচণ্ড সুদূর-বিস্তৃত তা আপনার ধারণা নেই। হয়তো— হয়তো কেন, নিশ্চিত আপনি বর্তমানে চব্বিশ ঘণ্টা নজরবন্দি হয়ে আছেন। এই যে আপনি আমাকে ফোন করেছেন, আমি এসেছি— এসব খবর ওরা নিশ্চিত পাচ্ছে। আমার মতে, আপনি ঠিক পথেই চলেছেন। চারটি বিষয়ে সাবধান থাকলে আপনার কোন বিপদ নেই। এক নম্বর : ওরা যাকে মাংকি বিজনেস বলেছে তা করবেন না। অর্থাৎ পুলিশে খবর দিয়ে বমাল লোকটাকে হাতেনাতে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। দু’নম্বর : ভেনুটা কোনো কারণেই পরিবর্তনে রাজি হবেন না। দু-দুটো ট্রানজাকশনই যেন এই হোটেলের এই ঘরে হয়। তিন নম্বর: ও আজ যে গ্যারান্টি-পেপার জমা রেখে যাবে সেটা জেনুইন কিনা খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে। চার নম্বর : আজ একটার সময় ও এলে বলবেন, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি মিস্টার ব্রহ্মচারী। কাল আমার সহকারী হিসাবে একজন বৃদ্ধ জুয়েলার থাকবেন। তাঁকে ভিতরের কথা কিছুই বলা হবে না। তিনি শুধু মুকুটের সোনাটা কষ্টিপাথরে যাচাই করে জানাবেন কতটা ‘পানমরা’ বাদ যাবে। আমার মনে হয় ও এককথায় মেনে নেবে। বুঝবে যে, মুকুটটা যে জেনুইন এটা আপনি যাচাই করতে চাইছেন। ও তাতে রাজি না হলে আপনি গোটা ট্রানজাকশনটা বাতিল করে দেবেন।’

‘তার মানে, আপনি লুকিয়ে থেকে দেখতে চান না?

‘না। তাতে ‘কোল্ট কোবরার’ ছোবল খাবার আশঙ্কা। উইশ য়্যু বেস্ট অব লাক। আজ সওয়া একটায় এবং কাল সওয়া একটায় আপনাকে ফোন করে জেনে নেব।’

কৌশিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনাকে আমার অভিনন্দন মিসেস পাণ্ডে। প্রচণ্ড বিপদেও আপনি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পেরেছিলেন।’

‘য়ু আর ওয়েলকাম।’