‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ১১

১১

বাসুসাহেব গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়েছেন। রানু খুলে বসেছেন টি.ভি.। সুজাতা আর কৌশিক নিজেদের দ্বিতলের ঘরে বসে আলোচনা করছে— গোয়ালিয়রের রাজমাতার কাছ থেকে যে দায়িত্বটা নিয়ে এসেছে— সে বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কাজে হাত দেওয়াই হয়নি।

বিশে দু-কাপ চা দিয়ে গেল।

সুজাতা বললে, মামু বোধহয় ফিরে এলেন। নিচে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াবার আওয়াজ পেলাম মনে হচ্ছে।

কৌশিক উঠে গিয়ে জানলা থেকে নিচের দিকে দৃষ্টি দিল। তারপর এদিকে ফিরে বললে, ‘তোমার অনুমান ভুল হয়েছে, সু, মামুর ‘পুষ্পক রথ’ নয়। একটা বড় লিমুজিন’— ক্যাডিলাক বা প্লিমাউথ হবে— উপর থেকে বোঝা যাচ্ছে না।’

একটু পরে বিশে আবার উপরে উঠে এল। বললে, ‘একজন দেখা করতে চাইছেন।’

‘কার সঙ্গে?’—জানতে চায় কৌশিক।

বিশে একটা ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে ধরে বললে, ‘আপনার সঙ্গে। ‘

কৌশিক ওর হাত থেকে ভিজিটিং-কার্ডটা নিয়ে দেখল : ‘গায়কোয়াড় অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস্- এর অফিশিয়াল কার্ড। নিচে রিপ্রেজেন্টেটিভের নাম : এম. কে. দস্তুর।

সুজাতা জানতে চায় : ‘কে ইনি? কী মনে হয়?

‘নিঃসন্দেহে জনার্দন গায়কোয়াড়ের দূত। যাই দেখে আসি—’

সুজাতা বাধা দেয়, ‘গেঞ্জি গায়ে যেও না প্লীজ। পাঞ্জাবিটা অন্তত গায়ে দিয়ে যাও।’

‘কেন? অফিস-আওয়ারের বাইরে লোকটা দেখা করতে এসেছে আমার রেসিডেন্সে মামুর ভাষায় ‘আনঅ্যাপয়েন্টেড ইন্ট্রশন।’ পাঞ্জাবি পরতে যাব কেন?’

‘আমার অনুরোধে’- সুজাতা সহাস্যে বললে।

‘সেটা আলাদা কথা,’ জবাব দিল কৌশিক, পাঞ্জাবিটা মাথায় গলাতে গলাতে।

নিচে এসে দেখে বিশে আগন্তুককে সুকৌশলীর অফিসঘরে যত্ন করে বসিয়েছে। ফ্যানটাও খুলে দিয়েছে। কৌশিক ঘরে প্রবেশ করতেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘আমি দস্তুর। মিস্টার জে. গায়কোয়াড়ের পার্সোনাল সেক্রেটারি। বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে টেলিফোন না করেই এসেছি। আপনি যে দেখা করলেন এ জন্য কৃতজ্ঞ।’

কৌশিক করমর্দন করে ইংরেজিতেই বললে, ‘ঠিক আছে, বসুন। বলুন কী ব্যাপার?’

ভদ্রলোক পুনরায় আসন গ্রহণ করে পকেট থেকে একটি লম্বাটে খাম বার করে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমার বলার কিছু নেই। স্যার এই চিঠিটা আপনাকে পাঠিয়েছেন। কাইন্ডলি পড়ে দেখুন।

সুদৃশ্য লেফাফা। বাঁদিকে নিচে প্রেরক, অর্থাৎ জনার্দন গায়কোয়াড়ের নাম-ঠিকানা ছাপা। কৌশিক লক্ষ্য করে দেখল— খামটা শুধু আঠা দিয়েই সাঁটা হয়নি, ছোট একটি গালা-মোহর করা হয়েছে। রক্তিম বৃত্তের মাঝখানে মনোগ্রাম করা দুটি অক্ষর জড়াজড়ি করে আছে : জে/জি।

কৌশিক তার টেবিলে এসে বসেছে এতক্ষণে। কাটার দিয়ে খামটা খুলে চিঠিখানা বার করে টেবল-ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। জে. জি.-র লেটারহেডে হাতে-লেখা ইংরেজি চিঠি :

‘ডিয়ার মিস্টার মিত্র,

আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। অবিলম্বে। আপনার-আমার দুজনের স্বার্থেই। সৌজন্যের নির্দেশে আমারই আপনার বাড়িতে হয়তো যাওয়া উচিত— যেহেতু প্রস্তাবটা আমিই তুলেছি, কিন্তু বিশেষ কারণে সাক্ষাৎকারটা আমার গরিবখানায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। গাড়ি নিয়ে আমার একান্ত সচিব যাচ্ছে। আপনি যদি ঐ গাড়িতে চলে আসতে পারেন— যাতায়াত বাদে আধঘণ্টা সময় নষ্ট করে— তাহলে কৃতার্থ হব। বলাবাহুল্য, আপনার প্রফেশনাল কী মেটাব, তা আপনি আমার প্রস্তাব নিন বা না নিন। নেহাত যদি তা সম্ভবপর না হয় সেক্ষেত্রে আমিই আপনার বাসাতে যাব। আজ রাত্রেই। কটার সময় গেলে আপনার অসুবিধা হবে না তা পত্রবাহকের মারফত জানাবেন।

‘একটা অনুরোধ : ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে, অন্তত আমাদের সাক্ষাৎ হওয়ার সময় পর্যন্ত।’

‘নমস্কার ও শুভেচ্ছাসহ। প্রতীক্ষারত।’

‘ভবদীয়,’

‘জে/জি’

চিঠিখানা পড়া শেষ করে কৌশিক মুখ তুলে বলল, ‘চিঠিতে মিস্টার জে/জি কী লিখেছেন তা কি আপনার জানা আছে?

মিস্টার দস্তুর একগাল হেসে এবার চোস্ত হিন্দুস্থানীতে যা বললেন তার বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ, ‘দূত শুধু অবধ্য নয়, অবোধ্য! আমার মুখ খোলা বারণ, স্যার। আমাকে আদেশ করা হয়েছে আপনি রাজি হলে আপনাকে আলিপুরে নিয়ে যেতে। না হলে, আপনার মৌখিক জবাবটা জেনে যেতে।’

‘ঠিক আছে। আপনি বসুন। আমি তৈরি হয়ে আসছি।’

‘থ্যাঙ্কু য়ু স্যার!’

কৌশিক সহাস্যে প্রশ্ন করে, ‘আমি আপনার সঙ্গে যেতে রাজি হলে আমাকে ধন্যবাদ জানাবার পারমিশনটা তাহলে আপনার স্যার দূতকে দিয়ে রেখেছেন?’

দস্তুর সহাস্যে নীরব রইল।

আলিপুরের ‘গায়কোয়াড়-কাসল’ অনেকটা জমি নিয়ে। দ্বিতল প্রাসাদ। সামনে বড় একটা সবুজ ঘাসে ছাওয়া লন। তার একটা অংশে কিছু বেতের চেয়ার-টেবিল। সে অংশটায় সবুজ রঙের কাঠের একটা পারগোলা বা ‘চন্দ্রাতপ’ লতানে জুঁই আর ব্যোগনভ্যালিয়ার জড়াজড়ি করে গন্ধবর্ণের সমাহার ঘটিয়েছে। কিছু দূরে একটা কৃত্রিম ফোয়ারা। বার্ড-বাথ। মর্মর-নগ্নিকা। গেট থেকে একটা নুড়ি বিছানো পথ এসব বেষ্টন করে পোর্চের নিচে এসে থেমেছে।

.

প্রকাণ্ড গাড়িটা এসে তার তলায় দাঁড়াতেই ছুটে এল উর্দিধারী খিদমদার। গাড়ির দরজা খুলে অ্যাটেনশনে দাঁড়ালো।

‘আসুন স্যার!’ —এবার এগিয়ে এল আর একজন। আন্দাজ করা গেল সে বাটলার।

একান্ত সচিব নমস্কারান্তে বিদায় নিল। বাটলার কৌশিককে নিয়ে এসে বসালো ড্রইংরুমে। প্রকাণ্ড হল-কামরা পার হয়ে এই ছোট্ট ঘরটি। হল কামরার উপরে সিলিং থেকে ঝুলছে কাট-গ্লাসের শ্যান্ডেলেয়ার। দেওয়ালে বড় বড় পোর্ট্রেট-পেন্টিং। নিঃসন্দেহে গৃহস্বামীর পূর্বপুরুষদের। কামরাটা সোফা-সেট দিয়ে সাজানো। এই বড় ঘরটি অতিক্রম করে বাটলার ও কে যে ঘরে নিয়ে এসে বসালো সেটা অনেক ছোট। একান্ত সাক্ষাৎকারের উপযোগী। খান-চারেক গদি আঁটা সোফা, মাঝে আস্বচ্ছ কাচের একটা টেবিল। টেবিল ফ্যান আছে, চলছে না। ঘরটা বাতানুকূল করা। বাটলার ওকে নিয়ে এসে বসালো সেই ঘরে। বলল, ‘আমি স্যারকে এত্তালা দিয়ে দিচ্ছি।’

সবাই দেখা যাচ্ছে, জনার্দন গায়কোয়াড়কে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছে। হুজুর বা রাজাসাহেব জাতীয় সম্বোধন নয়।

একটু পরেই এলেন জনার্দন। পরনে পায়জামা, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি ঢিলে-ঢালা আলখাল্লাজাতীয় পোশাক— তার কোমরে রঙিন দড়ি দিয়ে বাঁধা। ড্রেসিং-গাউন নয় তা বলে। কারণ, পোশাকটি হাই-কলার এবং তা মাথা গলিয়ে পরতে হয়। হয়তো এটা ওদের খানদানী দর্জি-ঘরানার একটা আবিষ্কার।

জনার্দন করমর্দন করলেন না। যুক্ত করে নমস্কার করে বললেন, ‘আপনি যে আসতে রাজি হয়েছেন এজন্য ধন্যবাদ। কি জানেন মিস্টার মিত্র, আমি চাইনি যে, কেউ আন্দাজ করুক আপনাতে আমাতে সাক্ষাৎ হয়েছে।

কৌশিক নির্বিকারভাবে বললে, ‘সেক্ষেত্রে আপনার উচিত ছিল মিস্টার দস্তুরকে ট্যাক্সি নিয়ে যেতে বলা।’

জনার্দন মাথা নেড়ে বললেন, ‘কারেক্ট। ওদিকটা আমার খেয়াল হয়নি। যা হোক, কী ফরমায়েশ করব বলুন? চা না কফি? অথবা ঠাণ্ডাই কিছু?’

কৌশিক এবারও গম্ভীরভাবে বললে, ‘আমি সৌজন্যসাক্ষাতে আসিনি, মিস্টার গায়কোয়াড়। পানাহারের তো কোনও প্রয়োজন নেই।

‘তাই কি হয়? আপনি দ্বিতীয়বার এলেন অধমের গরিবখানায়। প্রথমবার তো কোনওরকম আপ্যায়ন করার সুযোগই আমি পাইনি।’

কৌশিক সবিস্ময়ে বলে, ‘দ্বিতীয়বার! আমার তো যতদূর স্মরণ হয়, আপনার এই প্রাসাদে এই প্রথমবারই এলাম।’

‘না, আমি আমাদের গোয়ালিয়রের গরিবখানার কথা বলছি। আপনি সস্ত্রীক সেখানে পায়ের ধুলো দিতে গেলেন, অথচ আমি তখন অনুপস্থিত। ক্যা আপসোস কি বাৎ!’

কৌশিক সামলে নেয় নিজেকে। বুঝতে পারে, সমস্ত সাবধানতা সত্ত্বেও রাজমাতা তথ্যটা পুত্রের কাছে গোপন রাখতে পারেননি। বলে, ‘সে তো আপনার মায়ের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম আপ্যায়নের ত্রুটি তিনি হতে দেননি কোনরকম।’

‘শুনে আশ্বস্ত হলাম। তাহলে তথ্যটা সঠিক। আপনারা দুজনেই গোয়ালিয়র ঘুরে এসেছেন।’

তৎক্ষণাৎ নিজের ভুলটা বুঝতে পারে কৌশিক। জনার্দন নিশ্চিতভাবে তথ্যটা জানত না। আন্দাজ করেছিল মাত্র। তার মানে, গোয়ালিয়র রাজবাড়ি থেকে ট্রাঙ্ককলে যে ব্যক্তি খবরটা ওঁকে জানিয়েছে সে ওদের চেহারার বর্ণনাই শুধু দিতে পেরেছিল। পরিচয় নয়।

কৌশিক আরও সাবধান হয়ে যায়।

‘তা মায়ের দেওয়া কাজটার কতদূর কী হল? কিছু ডকুমেন্টারি এভিডেন্স যোগাড় করতে পারলেন?’

‘কিসের?’

‘কিসের আবার? যে দায়িত্বটা গ্রহণ করেছেন, তার। মিস পুষ্পা বিবাহিতা কি না।’

কৌশিক বললে, ‘এক মক্কেলের গোপন কথা দ্বিতীয় মক্কেলের সঙ্গে আলোচনা করায় যে সৌজন্যের নিষেধ এই প্রাথমিক শিষ্টাচারটাও কি আপনার জানা নেই?’

জনার্দন অফেন্স নিলেন না। বললেন, কিন্তু আমরা যে মা আর ছেলে।’

কৌশিক এবার প্রতি-আক্রমণ শুরু করল, তার মানে আপনি প্রকারান্তরে বলতে চান যে, আপনি যে প্রস্তাবটা জানাবার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন সে বিষয়ে আপনার মায়ের সঙ্গে আমি খোলাখুলি আলোচনা করতে পারি? যেহেতু আপনারা মা আর ছেলে?’

জনার্দন হাসলেন। বললেন, ‘দ্যাটস এ গুড রিটার্ন।’

নিচু হয়ে সেন্টার টেবিলের তলায় একটা পুশ বাটন টিপলেন। তৎক্ষণাৎ হল-কামরার দিক থেকে এসে উপস্থিত হল উর্দিপরা একজন খিদমৎগার। জনার্দন তাকে দাক্ষিণাত্যের কোনও ভাষায়- সম্ভবত তেলুগু কিছু নির্দেশ দিলেন। লোকটা ঝুঁকে সেলাম করল। ওপাশে সরে গিয়ে দেওয়াল-জোড়া ট্যাপেস্ট্রি-পদাটা সরিয়ে দিল। দেখা গেল, সেদিকে আছে মেহগনি কাঠের একটা লীকার ক্যাবিনেট আর ফ্রিজ। লোকটা নিপুণ হাতে সার্ভ করল : স্কচ হুইস্কি, দুটি গ্লাস, এক প্লেট কাজুবাদাম এবং পোর্সেলিনের পাত্রে বরফ-কিউব আর টংস।

মাঝের টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে দিয়ে পুনরায় সেলাম করে নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে। জনার্দন বললেন, ‘আইয়ে সাব! শওখ ফরমাইয়ে। ‘

কৌশিক একটা কাজু তুলে মুখে দিল। বলল, ‘আমি যে গোয়ালিয়র গিয়েছিলাম এটা না হয় গোয়েন্দা মারফৎ জেনেছেন, কিন্তু আমি মদ্যপান করি কি না তা আপনি জানলেন কি করে?’

জনার্দন সহাস্যে বলেন, ‘আন্দাজে!’

গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে পুনরায় বলে, আন্দাজটা ভুল হয়েছে বলতে চান?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আংশিক! আমি ড্রিংক করে থাকি— তবে পার্টিতে অবসর সময়ে, স্ফূর্তি করার ইচ্ছে হলে। অথবা কারও বাড়িতে সৌজন্যসাক্ষাতে গেলে। নট ডিউরিং প্রফেশনাল ডিউটিজ। আবার বলি মিস্টার গায়কোয়াড়, আমি সৌজন্যসাক্ষাতে আসিনি।’

জনার্দন এবারও অফেন্স নিলেন না। কিন্তু গম্ভীর হয়ে গেলেন। নিজের হাতেই মদের বোতলটা পিছনের ক্যাবিনেটে রেখে ফিরে এসে বসলেন নিজের আসনে। গম্ভীরভাবেই বললেন, ‘ঠিক আছে! তাহলে কাজের কথাটা শুরু করা যাক।

তৎক্ষণাৎ বাধা দিল কৌশিক, ‘জাস্ট এ মোমেন্ট, সার! কাজের কথাটা আমরা আলোচনা করব বাইরে— আপনার বাগানে, ঐ পারগোলার নিচে বেতের চেয়ারে বসে।

জনার্দন বিস্মিত হলেন। অথবা বিস্ময়ের একটা অভিব্যক্তি—বাসুসাহেবের ভাষায়—‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’ করলেন।

বললেন, ‘হঠাৎ এ প্রস্তাব?’

‘প্রস্তাবটা যখন গোপন— আপনি চিঠিতে তাই বলেছিলেন— তখন তা চারদেওয়ালের বাইরে খোলামাঠেই হওয়া ভাল। কথায় বলে : দেওয়ালেরও কান আছে।’

এবারও মাথা নেড়ে জনার্দন বললেন, ‘কারেক্ট! কথাটা আমার খেয়াল হওয়া উচিত ছিল। দেওয়ালের কান থাক-না-থাক কনসিল্ড টেপ-রেকর্ডিং-গ্যাজেট থাকতে পারে। এক্ষেত্রে তা যদিও নেই, তবু আমি আপনার প্রস্তাবে এককথায় রাজি। চলুন।’

ওঁরা দুজনে বাইরে এসে বাগানে বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। জনার্দন শুরু করলেন, ‘প্রথমেই আপনার কাছে একটা প্রতিশ্রুতি চাই। আপনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করুন অথবা প্রত্যাখ্যান করুন— কথাটা শুধু আমাদের দুজনেরই মধ্যেই গোপন থাকবে। রাজি?’

কৌশিক তৎক্ষণাৎ বললে, ‘আজ্ঞে না! রাজি নই! আপনি যে প্রস্তাব দেবেন তা আমার বিজনেস পার্টনারকে বাড়ি ফিরেই জানাব। এবং জানাব মিস্টার পি. কে. বাসুকে

জনার্দন একদৃষ্টে ওর দিকে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার বিজনেস পার্টনারকে জানাতে চাইবেন, একথা আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু মিস্টার বাসুকে কেন? সুকৌশলী কি একটা পৃথক প্রতিষ্ঠান নয়?’

‘হ্যাঁ, তাই। তবে আমরা একটা ইউনিট হিসাবে একত্রে কাজ করি। মিস্টার বাসুর কাছ থেকে আমি কিছুই গোপন করতে পারব না।’

‘তাহলে তো চলবে না। সে ক্ষেত্রে এখানেই থামতে হবে আমাকে।’

‘থামুন! তার মানে আমাদের আলোচনার এখানেই শেষ। আপনি কাইন্ডলি আপনার ড্রাইভারকে ডেকে পাঠান। আমি কোনও কনসালটেশন ফি দাবি করছি না।’

জনার্দন নতনেত্রে আবার দশ সেকেন্ড কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘অল রাইট। আই এগ্রি! কিন্তু কথা দিন, এটা আপনি প্রেসকে জানাবেন না, বাইরের কাউকেও জানাবেন না।

‘শিওর। কথা দিলাম।’

পুনরায় শুরু করলেন জনার্দন, ‘গোয়ালিয়রের রাজ পরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব নিকট নয়। আমার ঠাকুর্দার জেঠামশাই প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে গোয়ালিয়রের সিংহাসনে বসতেন। আমরা রাজপরিবারের রিস্তেদারমাত্র। তবু আমার মাকে ওখানকার সবাই রাজমাতা বলে, আমাদের বাড়িটাকে বলে প্যালেস। রাজপুত্র না হলেও আমি আমার স্বর্গত পিতৃদেবের জ্যেষ্ঠপুত্র। আমার নানান জাতের বিজনেস আছে। এমনকি হিন্দি ফিলম বেনামে প্রডিউস করা। ফলে মাসিক-ব্যবস্থায় আমাকে কিছু গোয়েন্দাকে নিয়োগ করতে হয়। নানান রকম তথ্য-সংগ্রহ করতে। কেমন করে জেনেছি তা জানতে চাইবেন না, কিন্তু আমি জানতে পেরেছি : আপনি আজ দুপুরে টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে একটা টেলিফোন করেছিলেন। বেলা একটা চল্লিশে। ঠিক বলছি?’

‘এটা আপনার প্রস্তাব নয়। আপনার গেয়েন্দা পরিবেশিত একটা তথ্য। তা সঠিক হতে পারে, ভুলও হতে পারে। এ পর্যায়ে তা আমি স্বীকার বা অস্বীকার করব কেন? বলে যান!’

‘আলোচনার খাতিরে ধরে নিচ্ছি, আমার সংগৃহীত তথ্যটা সঠিক। আপনি ওখানে মোস্তাক আহমেদকে টেলিফোনে ডেকে নির্দেশ দেন যে, সে অর্থাৎ তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু ঝানু মল্লিক যেন আগামীকাল বিকাল চারটের ভিতর নিউ আলিপুরের একটা বিশেষ ঠিকানায় মিস্টার বাসুর মক্কেল মিস রুবি রায়কে নগদে আট হাজার টাকা পৌঁছে দেয়। কারেক্ট? আয়াম সরি। আলোচনাটা একটা প্রস্তাবে পরিণত হওয়ার প্রয়োজনে ধরে নেওয়া যাক এটা কারেক্ট! ঠিক আছে?’

‘বলে যান।’

জনার্দন যখন বাগানে উঠে আসেন তখন ছোট্ট একটা অ্যাটাচি কেস হাতে নিয়ে এসেছিলেন। এবার সেটা বাড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এতে দশ-বিশ আর পঞ্চাশ টাকার নোটে নগদে বিশ হাজার টাকা আছে। আমার প্রস্তাব : এটি আপনি গ্রহণ করুন। আট-দুগুনে ষোলো হাজার হচ্ছে মিস রুবি রায়ের কমপেনসেশন। বাকি চার হাজার সুকৌশলীর সার্ভিস চার্জ!’

অ্যাটাচি কেসটা খুলে ধরলেন জনার্দন। সত্যিই সেটা খুচরো নোটে বোঝাই। ডালাটা বন্ধ করে সেটা মাটিতে নামিয়ে রেখে জনার্দন বললেন, ‘প্রস্তাব তো পেশ করেছি। এবার বলুন? আপনি রাজি?’

‘রাজি হব কি করতে? ষোলো হাজার টাকা মিস রায়কে পৌঁছে দেওয়ার পারিশ্রমিক হিসাবে নিশ্চয় আপনি চার হাজার টাকা আমাকে দিচ্ছেন না। পরিবর্তে আপনি কী চান?

‘পরিবর্তে আর কিছুই চাইছি না আমি। ঐটুকুই আমার প্রস্তাব : মিস রায় তার ঝানুদার কাছ থেকে আট হাজার টাকা নেবে না। আমার কাছ থেকে পরিবর্তে ষোলো হাজার টাকা নেবে।’

‘ব্যস?’

‘ইয়েস! ব্যস! এটুকুই আমি চাইছি।’

এবারে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কৌশিক বলে, ‘অলরাইট! আমি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এবার আপনিও কিছু প্রতিশ্রুতি দিন। তাহলেই আমি আপনার প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে পারি।

‘বলুন? কী প্রতিশ্রুতি চাইছেন?’

‘এই আর্থিক লেনদেনের করোলারি হিসাবে আপনি ভবিষ্যতে কোনদিন চাইবেন না, রুবি রায় তার ঝানুদার বিরুদ্ধে ছয় হাজার টাকা চুরির মামলাটা দায়ের করুক। অথবা আপনি পুলিশ কেস হিসাবে আদালতে মামলাটা তুললে রুবি কোনও সাক্ষী দেবে না? আপনার উকিল তাকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তুলবে না? সমন ধরাবে না! এগ্রিড?’

জনার্দন আবার নতনেত্রে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন মিস্টার মিত্র, সেটাই আমার পরিকল্পনা। কিন্তু কেন জানেন? ঐ লোকটা উঁচিয়ে আছে! আমাদের বিয়ের তারিখ ঘোষিত হলেই ও আমাদের দুজনকে উকিলের চিঠি দেবে। দাবি করবে : ও হচ্ছে পুষ্পার প্রথম পক্ষের স্বামী?’

‘কথাটা সত্যি?’

‘না! সত্যি নয়! মিথ্যা! একটা হিমালয়াত্তিক মিথ্যা! এই দেখুন—’

অ্যাটাচি কেসের ভিতর থেকেই উনি টেনে বার করলেন একখণ্ড কাগজ ও টর্চ। আলো জ্বেলে কাগজটা মেলে ধরলেন কৌশিকের সামনে। সেটা আদ্যন্ত দুর্বোধ্য হরফে লেখা

কৌশিক বলে, ‘কী এটা? এতো উর্দু! আমি উর্দু জানি না।’

উর্দু নয়, ফার্সি। এটা হচ্ছে মোস্তাক আহমেদের মুসলিম বিবাহের দলিলের একটা জেরক্স কপি। পুষ্পার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি আমি। এটা জাল! এই জাল দলিলে উল্লিখিত মৌলবী, যিনি ওদের বিয়ে দিয়েছেন তিনি বেহস্তে গেছেন। যে দুজন তথাকথিত সাক্ষী আছেন তাদের একজন মৃত, অপরজন আহমেদের পেটোয়া লোক! আদালতে এ দলিল দাঁড়াবে না; কিন্তু একটা স্ক্যান্ডাল তো হবে। সেটাই চাইছে মোস্তাক! পুষ্পার উপর প্রতিশোধ নিতে

কৌশিক বলে, ‘আপনি তো বিশহাজার টাকা আমাকে দিতে চাইছেন। ওটা মোস্তাককে দিলে সে রাজি হবে না?’

‘না। সে নগদ এক লাখ টাকা চায়।’

‘এক লক্ষ! তাতে আপনি রাজি নন?’

‘না! কারণ এক লাখ টাকা সে ব্ল্যাক মানিতে নেবে না।’

‘মানে? এ তো তাজ্জব কথা বলছেন মশাই। হোয়াইট মানি চাইছে?’

‘হ্যাঁ, তাজ্জবই! শুনুন তাহলে :

জনার্দন প্রযোজক হিসাবে একটা টেকনিকালার হিন্দি ছাত্র তুলবার আয়োজন করেছেন। কাহিনীর স্বত্ব ক্রয় করা হয়েছে, স্ক্রিপট্ প্রায় তৈরি। পরিচালক হিন্দি ছবির জগতে একজন সফল ব্যক্তিত্ব। নায়িকা পুষ্পা। মোস্তাক আহমেদের দাবি, সেই ছবিতে পুষ্পার বিপরীতে তাকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে দিতে হবে। মোস্তাক সুদর্শন, ভয়েস-টেস্টিং-এ বহুদিন আগেই সে উৎরেছে। ছোটোখাটো দু-চারটে চরিত্রে অভিনয়ও করেছিল এককালে। তারপর সুযোগ না পেয়ে সিনেমা জগতের নেপথ্যে সরে গেছে। জনার্দন তাকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে দিতে রাজি হতে পারেন না নানান হেতুতে। প্রথম কথা, পুষ্পা তাতে কোনোমতেই রাজি নয়। মোস্তাক এককালে তার কুক-কাম-ড্রাইভার ছিল। আজ সে খ্যাতনামা তারকা। ফলে সেই প্ৰাক্তন রাঁধুনীর সঙ্গে প্রেমের দৃশ্য অভিনয় করতে পুষ্পা রাজি হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার নায়িকা বদল করলে মোস্তাক রাজি নয়! সে এক ঢিলে তিন পাখি মারতে উদ্যত। প্রথমত লাখ টাকা পারিশ্রমিক, দ্বিতীয়ত সিনেমার জগতে নতুন করে ফিরে আসার সম্ভাবনা। শেষ কথা : পুষ্পার সঙ্গে প্রেম করার সুযোগ, হোক না কেন তা অভিনয়!’

কৌশিক বললে, ‘ঠিক আছে। আপনার প্রস্তাবটা শুনলাম। এখনি কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। আমাকে রুবির সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে। অ্যাটাচি কেসটা আপনি উঠিয়ে নিন, মিস্টার গায়কোয়াড়। আমি কাল আপনাকে টেলিফোন করে জানাব।’

‘কাল বিকাল চারটের আগেই নিশ্চয়। আমি চাই না, আপনার মক্কেলের সঙ্গে তার ঝানুদার সাক্ষাৎ হোক।’

‘বুঝলাম। কিন্তু আপনি যা চাইছেন তাতে রুবি রাজি হবে কি না— ইয়েস, ইয়েস, বাড়তি আট হাজার পেলে— সেটাও তো আমাকে জেনে নিতে হবে।’

‘অলরাইট সার! আমি প্রতীক্ষায় থাকব। আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। কিছুটা কমপেনসেট করতে দিন। একটা ছোট্ট গিফট দিই।’

‘ছোট্ট গিফ্‌ট! কী সেটা? আগে শুনি?’

‘পুষ্পার বিয়ের এই জাল দলিলের জেরক্স কপিটা। এটা আমার মাকে পাঠিয়ে দিয়ে ও তরফ থেকে আপনি মোটা ফি আদায় করতে পারবেন। গোয়ালিয়রে মা অনায়াসেই ফার্সিতে দক্ষ ‘রিডার’ যোগাড় করতে পারবেন। বিবাহের দলিলটা জাল না সাচ্চা তা তদন্ত করে দেখতে পারবেন। এটা কাইন্ডলি নিয়ে যান। আপনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করছেন অথবা করছেন না তার সঙ্গে এই ছোট্ট উপহারটির কোনও সম্পর্ক নেই। প্লিজ, অ্যাকসেপ্ট ইট অ্যান্ড সে : গুড-নাইট!’

‘গুড-নাইট’! —কৌশিক হাত বাড়িয়ে কাগজখানা নিল।