‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ১০

১০

দুপুরবেলা। বেলা একটা। বিশে ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে দিল। অর্থাৎ লাঞ্চ রেডি।

রানুদেবীর সংসারে পাকা ব্যবস্থা। দুপুরে যদি বাড়িতে লাঞ্চ খেতে চাও তবে ঠিক একটায় এসে ডাইনিং টেবিলে বসতে হবে। না যদি পার, তাহলে প্যান্টিতে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকবে। সেলফ-হেল্প পদ্ধতিতে নিজে বেড়ে নিতে হবে। বিশুকে ডাকা চলবে না। তার তখন বিশ্রাম। বিশের ভাষায় : ‘অফ ডিউটি’।

চারজনে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলেন।

বিশে পাতে পাতে গরম ভাত বাড়তে থাকে। বাসু বলেন, ‘খেতে খেতে বল, কোন কোন রাজ্য জয় করে এলে।’

কৌশিক বলে ‘এক নম্বর ড্রাইভার রামলগন দোসাদ। বিহারী। ছাপড়ার অধিবাসী। সেখানে কেউ থাকে না। দশবছর কলকাতাবাসী। ক্রিমিনাল রেকর্ড কিছু নেই। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। কলকাতায় বহু জায়গায় চাকরি করেছে। ড্রাইভার হিসাবে। অতি দক্ষ ড্রাইভার। ঐ রেন্ট-আ-কার সার্ভিসের মালিক জয়কৃষ্ণবাবুর মতে দোযের মধ্যে রগচটা আর মদ্যপ। সাড়ে তিন বছর কাজ করছে ওঁর কাছে। নিদাগ সার্ভিস রেকর্ড। সাতাশে মে চুরির প্রসঙ্গে মালিকের সঙ্গে সে বচসা করে। মালিকের মতে, তার উচিত হয়নি গাড়ি ছেড়ে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখতে যাওয়া। রামলগন তা মানে না। তার মতে সে রীতিমতো পার্টির কাছে ছুটি নিয়ে গেছিল। তাছাড়া ডিকি চাবি যখন পার্টি ওর কাছ থেকে চেয়ে নেয়, আর তার ডুপ্লিকেট চাবি যখন স্বয়ং জয়কৃষ্ণবাবুর কী-বোর্ডে, তখন তার কোনও দায়িত্ব নেই। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। রামলগন এককথায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে যদুবাজারে হরদয়াল সিং-এর গ্যারেজে নাম লিখিয়েছে। হরদয়ালের আট-দশটা ট্যাক্সি খাটে। তার একটা ইদানীং রামলগন চালায়। রামলগন কিছুটা মনমরা। কন্টেসা থেকে ট্যক্সি। রীতিমতো অবনতি। তার জীবনযাত্রায় আর কোন পরিবর্তন হয়নি। সে এখন প্রমথেশ বড়ুয়া সরণিতে পাঞ্জাব ক্লাবের কাছাকাছি একটা মেসে থাকে। ড্রাইভারদের মেস।

দ্বিতীয়ত সহদেব কর্মকার। উচ্চমানের মোটর মেকানিক। নানান জাতের গাড়ির কলকব্জা বিষয়ে ওয়াকিবহাল। দীর্ঘদিন সংযুক্ত ছিল প্রমথেশ বড়ুয়া সরণির এ. এ. ই. আই. ক্লাবের রিপেয়ার গ্যারেজের সঙ্গে। কোথাও কোন মেম্বারের গাড়ি মাঝরাস্তায় বিকল হলে টেলিফোনে দুঃসংবাদটা ক্লাবে আসে। ডাক পড়ে সহদেবের। কালিঝুলি মাখা ওভারঅলটা জড়িয়ে টুলবক্স নিয়ে সহদেব রওনা হয়ে যেত মোটর সাইকেলে। হয় গাড়ি মেরামত করিয়ে মালিককে বলত, ‘এবার স্টার্ট দিয়ে দেখুন স্যার।’ নাহলে ব্যবস্থা করত ‘হলিং’-এর। বলত, ‘হাসপাতালে না গেলে এ রোগের চিকিৎসা হবে না, স্যার।’ একদিন হেড-মেকানিকের সঙ্গে তর্ক আর ঝগড়াঝাটি করে চাকরি ছেড়ে দেয়। রামলগনের সঙ্গে দোস্তি ছিল। রামলগনই তার রেন্ট-আ-কার কোম্পানির মালিক জয়কৃষ্ণবাবুকে বলে-কয়ে ওকে নতুন চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়। মেকানিকের চাকরি রেন্ট-আ-কার কোম্পানির সাত-আটখানা গাড়ি। সহদেব তাদের ‘ফ্যামিলি-ফিজিশিয়ান’। ঐ কন্টেসাখানা মালিকের ‘পাটরানী।’ তাই ওটা যখন ভাড়া খাটতে যায় তখন তাঁর দক্ষতম ড্রাইভার রামলগন সেটা চালায় আর সহদেব কর্মকার হেল্পারের পরিচয়ে সঙ্গে থাকে। ফলে ঘটনার দিন, অকুস্থলে সহদেবের উপস্থিতির মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। লোকটা বুদ্ধিমান। কথাবার্তায় চৌখস। ইতিপূর্বে কোনও আদালতে পুলিশ পক্ষে সাক্ষী দিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সহদেব ঐ দিন দুপুরে রামলগনের সঙ্গে এক পাঞ্জাবী ধাবায় আহারাদি সারে। কিন্তু একসঙ্গে ম্যাটিনি শোতে শোলে দেখতে যায়নি। বইটা তার এগারোবার দেখা। রামলগনের সঙ্গে সেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ট্যাক্সি চালাচ্ছে।

তৃতীয়ত মোস্তাক আহমেদ। টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিওর হ্যান্ডিম্যান। কোনও কোম্পানিতে চাকরি করে না। ফ্রি-ল্যান্সার। সবাই ওকে চেনে। যে কোন ডাইরেক্টর বা প্রডিউসার ঐ স্টুডিওতে ফ্লোর ভাড়া নিলে, অর্থাৎ ইনডোর শুটিং করতে এলে, আহমেদের খোঁজ করেন। আহমেদ সেট সাজানো থেকে নানান সেট-রিকুইজিট যোগাড় করার বিষয়ে ওস্তাদ। রেন্ট-আ- কার এর মালিক জয়কৃষ্ণবাবুর সঙ্গেও তাই তার খাতির। ফিল্ম কোম্পানির প্রয়োজনে সে মাসে তাঁকে পাঁচ-সাত হাজার টাকার বিজনেস দেয়। ঐ সূত্রে রামলগন বা সহদেবকেও হয়তো আহমেদ চেনে, তবে কোনও অন্তরঙ্গতা বা দোস্তির প্রমাণ নেই। ঘটনার দিনে, বুধবার, মোস্তাক আহমেদ সারাদিন ছিল টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। একাধিক গণ্যমান্য প্রত্যক্ষদর্শী তাকে দেখেছেন ফ্লোরে কাজ করতে, সকাল থেকে সন্ধ্যা।

এমন সময় বাজল ডোরবেল।

কে এল এমন অসময়ে?

এল রুবি রায়। এসেই বলল, ‘মামিমা, আমি কিন্তু দুপুরের খাওয়া খেয়ে এসেছি। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।’

রুবি রায় খুব খুশি। সল্ট লেকের চাকরি তার খুব ভাল লেগেছে। মল্লিকাদি একেবারে মাটির মানুষ। কর্তাটিও তাই। আর বাচ্চাটা কাঁদতে জানে না। রুবির কোলে আসতে একটুও আপত্তি করেনি। ওদের সল্টলেকের বাড়িটা এখনো শেষ হয়নি। ছোট্ট, দোতলা হবে। ওঁরা আপাতত একতলায় আছেন। চারিদিকে ভারা বাঁধা। দোতলার গাঁথনি হচ্ছে। গাড়িটা গ্যারেজেই থাকছে। কিন্তু রুবি রায়কে ওঁরা মেজানাইনে থাকতে দেননি। অন্তত আপাতত নয়। কারণ জানলায় এখনো গ্রিল বসেনি। ও একতলার বৈঠকখানাতেই রাত্রে শুচ্ছে সোফা-কাম-বেডে। দুপুরে অবশ্য মেজানাইন-ঘরে একটা চৌকিতে বিশ্রাম নেয়। মল্লিকার ছুটি নেওয়াই ছিল। কর্তা পাঁচদিনের ছুটি নিয়েছেন। তার সঙ্গে ইদল-ফেতর আর রবিবার জুড়ে সাতদিনের ছুটিতে ওঁরা বাসে দীঘা বেড়াতে গেলেন। বাড়ির চার্জে রইল রুবি। অবশ্য দোতলার একটা অংশে তার্পলিন ঝুলিয়ে বাসোপযোগী করে কয়েকজন হিন্দুস্থানী মিস্ত্রিও থাকে। ভয়ের কিছু নেই। তারা বিশ্বাসী লোক।

রুবি ওদের এসপ্ল্যানেডে দীঘা-গামী বাসে তুলে দিয়ে ভাবল, বেলাবেলি নিউ আলিপুর ঘুরে যাবে। চাকরিটা যে ওর দারুণ পছন্দ হয়েছে একথা কৃতজ্ঞচিত্তে জানাতে।

বাসু বললেন, ‘তুমি এসে গেছ ভালই হয়েছে। না হলে টেলিফোনে তোমাকে ডেকে পাঠাতে হত।’

‘কেন মামু?’

কৌশিক আর সুজাতার দেখাদেখি সে ওঁকে মামু ডাকতে শুরু করছে। রানুকে মামিমা। একটা আত্মীয় সম্বোধন করতে না পারলে কেমন যেন পর পর মনে হয়।

‘প্রমীলা দেবী একটা অফার দিয়েছেন— ঐ ক্ষতিপূরণবাবদ। আদালতের বাইরে উনি কেসটি মিটিয়ে নিতে চান। আমাকে চেকটা দিয়ে গেছেন। আমি বলেছি, তোমাকে জিজ্ঞেস করে তারপর তাঁকে জানাব যে ওটা আমরা নেব কি নেব না।’

‘কত টাকার চেক?

‘পাঁচ হাজার।

‘পাঁ-চ-হা-জা-র।’

বাসু বললেন, ‘টেনে টেনে উচ্চারণ করলে টাকার অঙ্কটা বেড়ে যাবে না, রুবি। সোজাসুজি বল, ‘এটা আমি নেব, না ফেরত দেব।’

‘ফেরত দেবেন? কী বলছেন? আমার যে এখন টাকার ভয়ানক দরকার।’

‘জানি। তবু আমি এটা এখনি…… অবশ্য এই মুহূর্তেই সিদ্ধান্তটা না নিলেও চলবে। সোমবার বেলা দুটো পর্যন্ত সময় আছে।’

‘কেন?’

‘সে তোমার বুঝে কাজ নেই।’

রানু বলেন, ‘দুপুরে খেলে কোথায়?’

‘একটা হোটেলে। মল্লিকাদি খরচের টাকা দিয়ে গেছেন।’

‘এখানে চলে এলেই পারতে? হোটেলে খাওয়ার কী দরকার?’

টেবিলের ওপর গোছা করে রাখা ছিল কৌশিকের আনা রঙিন ফটোগ্রাফগুলো।

রুবি জানতে চায়। এগুলো কী? ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ?’

সুজাতা বলল, ‘না রুবি। এগুলো ছবি তোলার ছবি।’

‘তার মানে?’

বাসুসাহেব পাইপ ধরিয়েছেন। বলেন, ‘অভিপূর্বক নী ধাতু অ মানে কী জানো?’

রুবি অবাক হয়। বলে, অভিপূর্বক নী ধাতু অ? কোন সংস্কৃত কথার ডেরিভেটিভ?’

‘একজ্যাক্টলি। যা তোমার অ্যাম্বিশন। যার কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে তুমি ঘর ছেড়ে পথে নেমেছ রুবি : অভিপূর্বক নি-ধাতু অ = অভিনয়। এগুলো বম্বে ইনডোর স্টুডিওর ভিতর অভিনয়ের ছবি। অন্তত একজন অভিনেত্রীকে চিনবে : পুষ্পা। দেখ না।’

রুবি ছবির বান্ডিল তুলে নিল। দেখতে দেখতে সে তন্ময় হয়ে গেল। প্রত্যেকটি ছবি সে খুব খুঁটিয়ে দেখল। তারপর মুখ তুলে বলল, ‘প্রত্যেকটি ছবিতে একজন সুদর্শন পুরুষের মাথায় ঢেড়া চিহ্ন দেওয়া আছে দেখছি। কেন?’

কৌশিক বললে, ‘ঐ লোকটাকে আমরা খুঁজছি।’

‘কী আশ্চর্য! ঐ লোকটাকে যে আমিও খুঁজছি কৌশিকদা।’

কৌশিক সোজা হয়ে বসে। বলে, ‘মানে? তুমি মোস্তাক আহমেদকে খুঁজছ কেন?

‘মোস্তাক আহমেদ নয়। ওর নাম : ঝানু মল্লিক। আসানসোল সদর পুলিশ স্টেশনে ওর নামে ডায়েরি করেছি, চার-পাঁচ বছর আগে। ও আমার সর্বস্ব : হাজার ছয়েক টাকা নিয়ে বোম্বাই পালিয়ে যায়। তারপর আর ওকে খুঁজে পাইনি।

কৌশিক ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘তুমি নিশ্চিত? তুমি ছাড়া আর কেউ ওকে চিনবে?’

‘কেন চিনবে না? অন্তত দশ-পনেরো জন ছেলেমেয়ে— আসানসোল কলেজের স্যোশালে যারা নাটকে অভিনয় করেছিল তারা সবাই চিনবে। কারণ ও ছিল আমাদের ড্রামা ডাইরেক্টর। প্রফেসর জগদীশ মিত্র চিনবেন। যতীন দত্ত চিনবে। যতীন ছিল স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সেক্রেটারি।’

কৌশিক বললে, ‘এস দিকিন আমার সঙ্গে। আমি ফোনে যোগাযোগ করে দিচ্ছি। তুমি ওকে বল ছয় হাজার টাকা চার বছরে অন্তত সাড়ে আট হাজার হয়েছে সুদে-আসলে। রবিবার বিকালের মধ্যে টাকাটা মিটিয়ে না দিলে তুমি আইনত ব্যবস্থা নেবে। বেশ কড়া মেজাজে বলবে। বুঝেছ?

‘শিওর।’

তারপর হঠাৎ কী ভেবে কৌশিক বলল, ‘না। ফোনটা তুমিই কর। এই নাও নাম্বারটা। টেকনিশিয়ান স্টুডিওর।

ওপারে সাড়া জাগতেই রুবি বলল, ‘মিস্টার মোস্তাক আহমেদকে কাইন্ডলি একটু ডেকে দেবেন?’

লোকটা জবাব দিল না। অস্পষ্ট শোনা গেল তার কণ্ঠস্বর। অর্থাৎ টেলিফোনের কথামুখে হাতচাপা দিয়ে সে বললে, ‘আমেদদা, তোমাকে কে খুঁজছেন। মহিলা কণ্ঠ।

একটু পরেই বেশ ভারিকে গলায় কে যেন বলল, ‘মোস্তাক আহমেদ। কে বলছেন?’

‘আমার নাম রুবি রায়। আসানসোলের রুবি রায়। কলেজ স্যোশালে ‘বিজয়া’-তে বিজয়ার রোল করেছিলাম, আপনার ডাইরেকশনে। আপনি…’

‘কী আবোলতাবোল বকছেন ম্যাডাম! আমি আসানসোলে কখনো যাইইনি। সেখানকার কোন রুবি রায়কে আমি চিনি না।’

‘হ্যাঁ চেনেন। তখন আপনার নাম ছিল জগৎ মল্লিক। আপনি আমার ছয় হাজার টাকা… ‘

‘কাজের সময় অহেতুক আমাকে বিরক্ত করবেন না প্লীজ। আপনার নিশ্চয় কিছু ভুল হচ্ছে। আমার নাম মোস্তাক আহমেদ। জগৎ মল্লিক বা পূরবী রায়কে আমি চিনি না।’

‘পূরবী রায় নয়, রুবি রায়।

‘অল দ্য সেম টু মি।— ও-প্রান্তে টেলিফোনটা ধারক যন্ত্রে ফিরে গেল। কৌশিক এতক্ষণে এক্সটেনশনে দুপক্ষের কথাই শুনেছে। সেও এবার ফোনটা নামিয়ে রাখে। রুবিকে প্রশ্ন করে, তোমার আইডেন্টিফিকেশনে কোন ভুল হলো না তো, রুবি? তুমি টালিগঞ্জে গিয়ে স্বচক্ষে ওকে দেখলে চিনতে পারবে?

‘কোন প্রয়োজন নেই, কৌশিকদা। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। লোকটা সব জেনে বুঝে ন্যাকা সাজছে। ঐ লোকটাই জগৎ মল্লিক, ঐ ঝানু মল্লিক। গলার আওয়াজেও ওকে চিনেছি।’

কৌশিক বললে, ‘অল রাইট। আমি দেখছি। অন্য জাতের ওষুধ দিতে হবে।’

টেলিফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করতে এবার মোস্তাক নিজেই ধরল। হয়তো সে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে ওখানে কাছাকাছিই ছিল। মোস্তাক বলল, ‘টেকনিশিয়ান স্টুডিও। কাকে খুঁজছেন?

‘মিস্টার মোস্তাক আহমেদ। এক্ষণি টেলিফোনে কথা বলছিলেন। ধারে-কাছেই আছেন নিশ্চয়।

‘আমি মোস্তাক আহমেদ। আপনি কে বলছেন?’

‘আমি ভবানীভবন মিসিং-স্কোয়াড ইউনিটের ইন্সপেক্টর আব্দুল কাদের বলছি।’

‘আমাকে খুঁজছেন কেন?

‘একটু আগে আপনি একটি মহিলার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছিলেন, তাই নয়? উনি এখান থেকেই ফোন করছিলেন। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। কী? বলছিলেন না?’

একটু দেরি হল জবাবটা দিতে। তারপর বললে, ‘হ্যাঁ, সাম মিস অথবা মিসেস পূরবী দেবী…’

‘একজ্যাক্টলি। ঐ মিস বা মিসেস পূরবী দেবীর ছয় হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে সাম মিস্টার জগৎ মল্লিক ওরফে কাপ্তেন ঝানু মল্লিক চার বছর আগে আসানসোল থেকে নিরুদ্দেশ হয়। আপনি কি ঐ মিস বা মিসেস পূরবী অথবা কাপ্তেন জগৎ বা ঝানু মল্লিককে চিনতে পারছেন? মসিয়োঁ মোস্তাক আহমেদ?

‘আপনি এসব কী বলছেন, স্যার? আমি ওঁদের কাউকেই…’

‘লুক হিয়ার মসিয়োঁ আহমেদ! আমি আপনাকে কাল বিকাল চারটে পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে যদি আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু মিস্টার জগৎ বা ঝানু ঐ মিস অথবা মিসেস পূরবী দেবীকে আট হাজার টাকা ফেরত না দেয় তাহলে…’

মোস্তাক আহমেদ বাধা দিয়ে বলে ওঠে, ‘আপনি আমার কথাটা শুনুন, স্যার…. আমি এদের কাউকেই চিনি না… আমি…’

‘আমার কথাটা শেষ হয়নি মসিয়োঁ আহমেদ। কাল বিকাল চারটের মধ্যে মিস রায়কে আট হাজার টাকা ফেরত না দিলে আমি ঝানু মল্লিকের কোমরে দড়ি বেঁধে আসানসোলে নিয়ে যাব। আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে। প্রফেসর জগদীশ মিত্র তাকে চিনবেন, ওদের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের যতীন দত্ত সে এখন আসানসোলে ডি. এস. অফিসের আপার-ডিভিশন ক্লার্ক, ঝানু মল্লিককে সনাক্ত করবে। সুতরাং আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে বলুন যে, ঐ মিস রায়কে কাল বিকাল…

‘আপনি আমার কথাটা শুনুন স্যার, রুবি রায়ের ঠিকানাটা পর্যন্ত…’

‘নাউ য়ু আর টকিং মসিয়োঁ আহমেদ। কী নাম বললেন? রুবি রায়? পূরবী রায় নয়, তাহলে? একটা কাগজ পেনসিল নিন। মাদমোয়াজেল রুবি রায়ের টেলিফোন নম্বরটা লিখে নন।’

সুনীল রায়ের সল্টলেকের নম্বরটা ওকে শুনিয়ে দিল।

আহমেদ বললে, ‘কিন্তু কাল কী হবে, স্যার? কাল পরবের দিন। ইদল-ফেহতর।’

আরে সে তো আপনার-আমার। সেই কাফেরের বাচ্চা ঝানু মল্লিকের কাছে আবার পরবের দিন কী?’

‘না, না, তা বলছি না, বলছি যে, কাল তো ব্যাঙ্ক বন্ধ। পরশু রবিবার। সোমবারের আগে…’ ‘আরে মশাই, সে আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু বুঝবে। আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনি বন্ধুকে খবরটা দিয়ে দেবেন, টেলিফোন নম্বরটা জানিয়ে দেবেন। ব্যস, আপনার ডিউটি খতম। প্রয়োজনে ঝানু মল্লিকই মিস রায়ের কাছে টেলিফোনে ক্ষমা চেয়ে নেবে, সোমবার পর্যন্ত সময় চেয়ে নেবে। কিন্তু আপনাকে… আই মীন ফিল্ম-আর্টিস্ট পুষ্পা দেবীর এক্স-কম্বাইন্ড হ্যান্ড মোস্তাক আহমেদসাহেবকে আমি আর একটা কথা বলতে চাই। আপনি শুনছেন?’

‘ইয়েস, স্যার। বলুন।’

‘গোয়ালিয়রের গায়কোয়াড় ফ্যামিলির মুকুটটার দাম লাখ টাকার উপর। সেটা ঐ ঝানু মল্লিকের ছিঁচকে চুরির পেটি কেস নয়। হঠাৎ গা-ঢাকা দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনার উপর কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশে প্লেন ড্রেসে নজর রাখছে, আর আমাদের এই কথোপকথনটাও থানায় টেপরেকর্ড হয়ে থাকল কিন্তু। ফর ফিউচার এভিডেন্স।’

মোস্তাক আহমেদ কোন জবাব দেবার সুযোগ পেল না। কারণ তার আগেই কৌশিক টেলিফোনটা ধারক অঙ্গে নামিয়ে রেখেছে।

বাসু বললেন, ‘গুড ওয়ার্ক।’

সেদিনই সন্ধ্যাবেলা।