‘অভিপূর্বক নী-ধাতু অ’-এর কাঁটা – ১

রবীন্দ্র-সেতুর বদলে বিদ্যাসাগর-ব্রিজ দিয়ে এলে যে এতটা সময় সংক্ষেপে হবে, তা উনি আন্দাজ করতে পারেননি। হাওড়ার জেলা আদালতের আঙিনায় বাসুসাহেবের গাড়িটা যখন পৌঁছলো তখনও মধ্যাহ্ন বিরতির প্রায় আধঘণ্টা বাকি। হাওড়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নীরদবরণ মুখার্জির সঙ্গে ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট : ‘নুন-রিসেস’-এ। কয়েকটি কাগজে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৌশিক কিংবা কোন জুনিয়রকে পাঠিয়েও কাজটা সারা যেত; কিন্তু নীরদবরণের সঙ্গে ওঁর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এককালে। একই রোটারি ক্লাবের মিটিঙে দেখা-সাক্ষাতের সুবাদে। তাই নিজেই এসেছেন, দেখা করে সই নিতে।

ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আছেন শুনে বাসুসাহেব গুটিগুটি সেখানে গিয়ে দর্শকের আসনে বসলেন। পিছন দিকে দর্শকদের ভিড়ে।

যে কোন কারণেই হোক আদালতে লোক হয়েছে যথেষ্ট। শুনলেন, চুরির মামলা। গহনা চুরি। আসামী স্ত্রীলোক। পোশাক-পরিচ্ছদ দীন ও মলিন। কিন্তু রীতিমত সুন্দরী, সুতনুকা। সুঠাম চেহারা। নাক-মুখ খুবই আকর্ষণীয়; আর আশ্চর্য গভীর, অতলান্ত ওর চোখ দুটো। কিন্তু রং খুব ফর্সা নয়। ময়লাই। বয়স আন্দাজ চব্বিশ-পঁচিশ। মলিন বসন সত্ত্বেও তাকে ঠিক ঝি-ক্লাসের বলে মনে হচ্ছে না।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় বসে আছে মাঝবয়সী একজন। মনে হয় খেটে-খাওয়া মানুষ। দাড়ি কামায়নি। টুইলের ডোরাকাটা হাফশার্ট পরনে। প্যান্ট আর চপ্পল। প্রতিবাদীর তরফে সাক্ষীকে যিনি জেরা করছেন তিনি তরুণ-বয়স্ক। সুদর্শন, সুসজ্জিত কিন্তু অনভিজ্ঞ বলে মনে হল বাসুসাহেবের।

উকিলবাবু বললেন, রাতটা ছিল কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী, তাই তো?

—তা তো বলতে পারবো না হুজুর, আমি পাঁজি দেখিনি।

—না, মানে বেশ অন্ধকার ছিল?

—আজ্ঞে না। রাস্তায় জোরালো বাতি জ্বলছিল। তাছাড়া হোটেলের সামনেও নিয়নবাতির সাইনবোর্ডের জোর আলো ছিল। মানুষজন চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

—ও, তার মানে, রাস্তার সব কিছু তুমি দেখতে পাচ্ছিলে?

—আজ্ঞে সে কথা তো বারে বারেই বলছি।

—না, মানে আসামীকে চিনতে পেরেছিলে ঠিক?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। এই নিয়ে তিনবার সে কথা বললাম হুজুর।

—তুমি তখন মোটরগাড়িটা থেকে কত দূরে?

—তা বিশ-পঞ্চাশ হাত হবে, মেপে দেখিনি।

—তুমি ঐখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলে তখন?

—ঐ যে বললাম, তখনো ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি বৃষ্টিটা ধরার অপেক্ষা করছিলাম, গাড়ি-বারান্দার তলায়।

—রাস্তায় তখন আর কেউ ছিল না?

—আজ্ঞে না। শুধু আমারা দুজন। বৃষ্টি পড়ছিল বলে লোকজন-

—তোমায় যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দাও। ফালতু কথা বলবে না। তুমি কী দেখলে? ঐ মেয়েটি সে সময় কী করছিল?

—আবার সেকথা বলব? এইমাত্র তো বললাম….. ঠিক আছে। ঠিক আছে। আবার বলছি। আমি ছিলাম মেয়েটির পিছনবাগে। সে আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। সে গাড়ির পিছনদিকের ডিকিটা খুলে তার ভিতর থেকে একটা স্যুটকেস বার করছিল…।

—জাস্ট আ মিনিট। সে মোটরগাড়ির পিছনের ডিকিটা খুলল কী করে? সেটা খোলাই ছিল, না কি তালা খুলে ডালাটা ওঠালো?

—আজ্ঞে তা বলতে পারব না। আমি যখন ওকে প্রথম নজর করি তার আগেই ও ডিকিটার ডালাটা দুহাতে ধরে তুলেছে। তারও আগে সে কী করেছিল, কীভাবে ডিকিটার ডালা খুলেছিল তা আমি জানি না।

—অলরাইট। তারপরে কী হল?

—মেয়েটি স্যুটকেসটা দুহাতে ধরে রাস্তায় নামালো আর তার ডালাটা খুলল।

—এবারেও সে চাবি দিয়ে খুলল কি না, তা তুমি দেখনি?

—আজ্ঞে কী করে দেখব? আমি তো তখনো তার পিছনবাগে ছিলাম।

—তারপর কী হল?

—স্যুটকেস থেকে কী সব বার করে ও দুপকেটে ভরতে শুরু করে দিল।

—কিসের দুপকেটে?

—আগেই তা বলেছি হুজুর। ওর গায়ে বর্ষাতি ছিল। সেই বর্ষাতির দুপকেটে….

—কীরকম বর্ষাতি ছিল ওর গায়ে?

—ঐটাই কিনা হলপ নিয়ে বলতে পারব না, তবে ঠিক ঐরকম একটা ডাকব্যাক রেনকোট।

আসামীর পরিধানে ঘটনার সময় যে বর্ষাতিটা ছিল বলে বাদীপক্ষ দাবি করেছেন ইতিপূর্বে ই সেটি পিপলস একজিবিট হিসাবে আদালতের দেওয়ালে একটা হ্যাঙারে ঝোলানো ছিল।

—তারপর কী দেখলে বল?

—তারপর মেয়েটি স্যুটকেসটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি গাড়ির ডিকিতে নামিয়ে দিল, আর তখনই গাড়ির ডিকির ডালাটা বন্ধ করে দিল।

—তারপর?

—তারপর সে আমার দিকেই আসছিল। হঠাৎ আমাকে দেখে চমকে উঠল। পাশ কাটিয়ে মোটেলের ভিতর ঢুকে গেল।

—মেয়েটি সেসময় কী রঙের শাড়ি-ব্লাউজ পড়েছিল তা কি তোমার মনে আছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি, লাল পাড়, আর ঐ লাল রঙেরই ব্লাউজ এখনো উনি তাই পরে আছেন।

—তারপর কী হল?

—আজ্ঞে বৃষ্টিটা ধরে গেছে দেখে আমি নিজের কাজে চলে গেলাম।

—রাত তখন কত হবে?

—আজ্ঞে আমি ঘড়ি দেখিনি, তবে এটুকু মনে আছে যে, মোটেল-ঘরে তখন টিভিতে সাড়ে- সাতটার বাংলা খবর হচ্ছে।

—তারপর তুমি থানায় এজাহার দিতে গেলে?

—আজ্ঞে না। তা তো বলিনি। আমি যখন ফিরছি রাত তখন আন্দাজ নয়টা— তখন দেখি মোটেলের সামনে পুলিশের জিপ এসেছে। কীসব তদন্ত হচ্ছে। আমার কৌতূহল হল। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে শুনলাম যে, হোটেলের সামনে দাঁড়ানো একটা গাড়ির ডিকির ভিতর থেকে নাকি গয়না চুরি হয়েছে। এই নিয়ে পুলিশি তদন্ত হচ্ছে। তাই শুনে আমি এগিয়ে গিয়ে ইন্সপেক্টর সাহেবকে জানাই আমি কী দেখেছি।

উকিলবাবু এরপর কী প্রশ্ন করবেন স্থির করে উঠতে পারছিলেন না। উনি নিজের আসনে ফিরে এলেন। আসামীর সঙ্গে নিম্নকণ্ঠে কী যেন আলোচনা করতে থাকেন।

ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব তরুণ আইনজীবীকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি জেরায় আর কোনও প্রশ্ন করবেন?

আসামীর উকিল তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। আবার তার জেরা শুরু করল, তুমি যখন ওর পিছনে ছিলে তখন কী করে বুঝলে যে, সে স্যুটকেসের ডালা খুলছিল?

—কী করে বুঝলাম এ প্রশ্নের কী জবাব দেব, হুজুর? স্বচক্ষে দেখলাম সে নিচু হয়ে স্যুটকেসের উপর ঝুঁকে পড়েছে, দেখলাম ডালা দুটো উঠে গেল, দেখলাম তা থেকে কী সব বার করে নিয়ে পকেটে ভরল। এরপর আপনারে কেমন করে বোঝাই যে, আমি কেমন করে বুঝলাম সে ডালা খুলেছিল?

—তুমি চেয়ার থেকে উঠে হুজুরকে দেখাবে মেয়েটি কী ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝুঁকে স্যুটকেসটা খুলেছিল?

সাক্ষী উঠে দাঁড়াল। বিচারকের দিকে পিছন ফিরে সে সামনের দিকে ঝুঁকে দেখালো ব্যাপারটা। তার হাঁটু ভাঁজ খেল না। তারপর আবার চেয়ারে গিয়ে বসল, বেশ হাসি হাসি মুখে

উকিলবাবু বললেন, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বল তো। তুমি তো তখন জানতে না যে, ঐ গাড়িতেই মেয়েটি আসেনি। তাহলে তুমি একদৃষ্টে ওভাবে ওকে দেখছিলে কেন?

সাক্ষী হাসি হাসি মুখে বললে, ওঁর বয়স পঞ্চাশ হলে নিশ্চয় অত খুঁটিয়ে দেখতাম না হুজুর। ইতিমধ্যে বৃষ্টিতে ওঁর শাড়ি-শায়া ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল। তাই উনি যখন সামনের বাগে ঝুঁকে স্যুটকেস থেকে কিছু বার করছিলেন তখন আমি হুজুর একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিলাম।

—ওঁর পিছনদিকটা?

—আজ্ঞে, শুদ্ধ ভাষায় যাকে …মানে, ইয়ে ‘নিতম্ব’ বলে আর কি!

তরুণ উকিলবাবুর কান দুটি লাল হয়ে উঠল।

সরকারি উকিল ক্লান্তভাবে বলেন, ‘নুন-রিসেস’-এর আগেই কী এই সাক্ষীকে জেরা করাটা শেষ করা যায় না?

বিচারক তরুণ উকিলের দিকে তাকালেন।

সে সপ্রতিভভাবে নিবেদন করল, ‘ইফ দ্য কোর্ট প্লিজ, আমার আর মাত্র দু-তিনটি প্রশ্ন আছে, কিন্তু তা পেশ করার আগে আমি আসামীর সঙ্গে কিছু আলোচনা করতে চাই। মহামান্য আদালতের নিশ্চয় স্মরণে আছে যে, এটা একটা আদালত কর্তৃক অ্যাসাইন্ড কেস। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই এটা আমাকে হঠাৎ গ্রহণ করতে হয়েছে।’

বিচারক বললেন, ঠিক আছে। আপনি মধ্যাহ্ন-বিরতির পরেই বাকি জেরাটুকু করবেন। আদালত অ্যাডজনড হয়ে রইল। আবার দুটোর সময় আদালত বসবে। আসামী পুলিশের জিম্মায় থাকবে।’

বিচারক উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন।

আদালত ফাঁকা হতে শুরু করেছে। বাসুসাহেব এগিয়ে গিয়ে বিচারকের চেম্বারের দরজায় সৌজন্যসূচক করাঘাত করেই পাল্লাটা খুলে ফেললেন। মুখার্জিসাহেব একটা চুরুট ধরাচ্ছিলেন, বললেন, ‘আসুন, আসুন। আপনি পিছনে এসে বসেছেন দেখেছি। চলবে?’

চুরুটের বাক্সটা বাড়িয়ে ধরেন।

বাসু বললেন, ‘নো থ্যাঙ্কস। আমি পাইপাসক্ত। চুরুট চলে না। কেসটা কিসের?’

মুখার্জিসাহেব চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘গহনা চুরির। নাইন্টি পার্সেন্ট চান্স গিলটি ভার্ডিক্ট হবে। তবে আমি চেষ্টা করব আইন-মোতাবেক ন্যূনতম শাস্তি দিতে।’

বাসুসাহেব রীতিমতো চমকে উঠলেন। কেস চলাকালে কোনও বিচারক কখনো এ জাতীয় কথা বলেন না। বলতে নেই। ইনি অবশ্য ‘জজ’ নন ‘ম্যাজিস্ট্রেট’। সে কথাই বললেন বাসু, কেস তো শেষ হয়নি, এখনি গিলটি ভার্ডিক্ট হবে ধরে নিচ্ছেন কেন?’

‘পুলিশ কেসটাকে বজ্র-আঁটুনি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। মেয়েটি কপর্দকহীনা। সরকারি খরচে আদালত একজন ইয়াং লইয়ারকে নিয়োগ করেছে। আমিই করেছি। সিনিয়ররা এসব কোর্ট- অ্যাপয়েন্টেড কেস নিতে চান না। তাছাড়া জুনিয়রদের উৎসাহিত না করলে তারাই বা দাঁড়াবে কী করে?’

বাসু বলেন, ‘সামান্য একটা গহনা চুরির কেসে এত লোক হয়েছে কেন আদালতে?’

‘দুটো হেতুতে। প্রথমত, গহনার মালিক একজন সুবিখ্যাত বোম্বাইওয়ালা চিত্রতারকা, পুষ্পাদেবী। দ্বিতীয়ত, গহনার মূল্য দুই লক্ষাধিক টাকা। দর্শকদের আশা ছিল, চিত্রতারকা আদালতে স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন। তাই এত ভিড়। কিন্তু তিনি আসেননি। কই দিন, কী কাগজে সই দিতে হবে?’