উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

অবশিষ্ট । পঞ্চনদে জাগ্রত ভারত

অবশিষ্ট । পঞ্চনদে জাগ্রত ভারত

তারপর?

তারপর যা হল, আজও ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। এর মধ্যে আর গল্প বলবার সুযোগ নেই, তোমাদের শুনতে হবে কেবল ঐতিহাসিক সত্যকথা।

মহারাজা পুরু বা পর্বতককে দলে পেয়ে চন্দ্রগুপ্ত হয়ে উঠলেন একেবারেই অজেয়।

আলেকজান্ডার ভারতে প্রবেশ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে, ভারত ত্যাগ করেছিলেন খ্রিঃ পূঃ ৩২৬ অব্দে।

তারই দুই বৎসর পরে—অর্থাৎ খ্রিঃ পূঃ ৩২৩ অব্দে ভারতবর্ষের দিকে দিকে রটে গেল, ব্যাবিলনে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।

যদিও এ সংবাদ পাওয়ার আগেই পঞ্চনদের তীরে তীরে উড়েছে চন্দ্রগুপ্তের বিজয়পতাকা, তবু তখনও পর্যন্ত যারা আলেকজান্ডারের প্রত্যাগমনের ভয়ে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারেনি, তারাও একসঙ্গে করলে চন্দ্রগুপ্তের পক্ষাবলম্বন।

তখন চন্দ্রগুপ্তের প্রচণ্ড খড়গাঘাতে পঞ্চনদের শিয়র থেকে ছিন্নমূল হয়ে লুটিয়ে পড়ল গ্রিকদের বিজয়পতাকা।

অবশ্য এজন্যে চন্দ্রগুপ্তকে বহু যুদ্ধ জয় করতে হয়েছিল। তাদের কাহিনি কেউ লিখে রাখেনি বটে, কিন্তু শেষ-পরিণাম সম্বন্ধে সব ঐতিহাসিকেরই এক মত। চন্দ্রগুপ্তের বীরত্বে পঞ্চনদের তীর থেকে গ্রিক প্রভুত্ব হল বিলুপ্ত। বহু গ্রিক তখনও ভারত ত্যাগ করলে না বটে, কিন্তু এখানে তারা আর প্রভুর মতো, বিজেতার মতো বাস করত না।

কিন্তু হতভাগ্য বীর পুরু বা পর্বতক স্বাধীনতার সুখ বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্য করেছিলেন বলে ভারতে প্রবাসী সমস্ত গ্রিকই ছিল তাঁর উপরে খড়গহস্ত। সম্ভবত খ্রিঃ পূঃ ৩১৭ অব্দে ইয়ুদেমস নামে এক গ্রিস দুরাত্মা মহারাজা পুরুকে গোপনে হত্যা করে তাঁর একশো বিশটি হাতি চুরি করে ভারত ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পঞ্চনদের তীর থেকে বিজয়ী চন্দ্রগুপ্ত আবার সসৈন্যে যাত্রা করলেন তখনকার ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ মগধ সাম্রাজ্যে। বলা বাহুল্য এরও মূলে ছিল চাণক্যের মন্ত্রণা।

নন্দরাজের উপরে চাণক্যের জাতক্রোধের একটা কারণের কথা শোনা যায়। চাণক্য ছিলেন মগধরাজ ধননন্দের দানশালার অধ্যক্ষ এবং ধননন্দ ছিলেন অতিদানশীল রাজা। চাণক্যকে তিনি তাঁর নামে এক কোটি টাকা পর্যন্ত দান করবার অধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু চাণক্যের উদ্ধত স্বভাব ও স্বাধীন ব্যবহার সইতে না পেরে শেষটা তিনি তাঁকে পদচ্যুত করে তাড়িয়ে দেন এবং চাণক্যও প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি এই অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না।

দ্বিতীয়বার মগধ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধে জয়ী হলেন। নিহত ধননন্দের সিংহাসন এল তাঁর হাতে। মহা সমারোহে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হল।

কিছুদিন পরে পঞ্চনদের তীরে হল আবার নতুন বিপদের সূচনা।

আলেকজান্ডারের অন্যতম প্রধান সেনাপতি সেলিউকস (উপাধি ‘নিকাটর’ অর্থাৎ দিগবিজয়ী) তখন গ্রিকদের প্রাচ্য সাম্রাজ্যের অধিকারী। সেই দাবি নিয়ে তিনিও আবার খ্রিঃ পূঃ ৩০৫ অব্দে ভারত আক্রমণ করতে এলেন।

কিন্তু আলেকজান্ডারের অনুকরণ করতে গিয়ে সেলিউকস একটা মস্ত ভুল করে বসলেন। আলেকজান্ডার যখন আসেন, উত্তরভারত ছিল তখন পরস্পর বিরোধী ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত, কোনও যথার্থ বড় রাজার সঙ্গে তাঁকে শক্তি পরীক্ষা করতে হয়নি। এবং আগেই বলেছি, তিনিও শক্তিশালী মগধ-রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ না করেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিলেন।

কিন্তু সেলিউকসের আবির্ভাবের সময়ে চন্দ্রগুপ্ত কেবল মগধের অধিপতি নন, তিনি সমগ্র উত্তরভারত বিজয়ী এবং তাঁর অধীনে প্রস্তুত হয়ে আছে তিরিশ-হাজার অশ্বারোহী, নয় হাজার গজারোহী ও ছয় লক্ষ পদাতিক সৈন্য। এর সামনে পড়লে স্বয়ং আলেকজান্ডারই যে দুরবস্থায় পড়তেন, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়।

ভারতে আবার যবন এসেছে শুনেই জাগ্রত সিংহের মতো চন্দ্রগুপ্ত ছুটে গেলেন পঞ্চনদের তীরে। ভারত-সৈন্য বন্যার মতো ভেঙে পড়ল পররাজ্যলোভী গ্রিকদের উপরে এবং ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাদের খড়কুটোর মতন! সিন্ধুনদের কাছে এই মহাযুদ্ধ হয়। গ্রিক ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের ছোট ছোট যুদ্ধেরও বড় বড় বর্ণনা রেখে গেছেন! কিন্তু এত বড় যুদ্ধের কোনও বর্ণনাই গ্রিক ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কারণ এ যুদ্ধ যে তাঁদের নিজেদের পরাজয় কাহিনি! তাঁরা কেবলমাত্র স্বীকার করেছেন, চন্দ্রগুপ্তের কাছে পরাজিত হয়ে গ্রিক সেনাপতি সন্ধি স্থাপন করেন।

সেলিউকসের চোখ ফুটল। তাড়াতাড়ি হার মেনে তিনি নিজের সাম্রাজ্য থেকে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তানকে চন্দ্রগুপ্তের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলেন ক্ষতিপূরণস্বরূপ। ভারতসম্রাটের মন ঠান্ডা রাখবার জন্যে তাঁর সঙ্গে নিজের মেয়েরও বিবাহ দিলেন। এবং চন্দ্রগুপ্ত খুশি হয়ে শ্বশুরকে উপহার দিলেন পাঁচ শত হাতি।

গ্রিকরা ভারত থেকে বিদায় হল। পঞ্চনদের তীর নিষ্কণ্টক!

চন্দ্রগুপ্ত যখন গ্রিকদের বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারণ করেন তখন তাঁর বয়স পঁচিশ বৎসরের বেশি নয়। তারপর মাত্র আঠারো বৎসরের মধ্যে তিনি পঞ্চনদের তীর থেকে যবন প্রভুত্বের সমস্ত চিহ্ন মুছে দেন, প্রায় সমগ্র ভারতব্যাপী অখণ্ড এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন এবং দিগবিজয়ী সেলিউকসকে বাধ্য করেন মাথা নামিয়ে হার মানতে। সেই সুদূর অতীতেই তিনি প্রমাণ করেন, ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি বিশ্বজয়ী গ্রিকরাও ভারতীয় হিন্দু বীরদের সমকক্ষ নয়।

চন্দ্রগুপ্তের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল, বিধর্মীদের কবল থেকে আর্যাবর্তকে উদ্ধার করে তার পূর্ব-গৌরব ফিরিয়ে আনা।

এ ব্রত যখন উদ্যাপিত হল, তখন সিংহাসন আর তাঁর ভালো লাগল না। সেলিউকসের দূত মেগাস্থিনিস স্বচক্ষে দেখে চন্দ্রগুপ্তের বৃহৎ সুশাসিত সাম্রাজ্যের যে উজ্জ্বল ও সুদীর্ঘ বর্ণনা করে গেছেন, আজও তা পাওয়া যায়। কিন্তু এই প্রভুত্বের ও ঐশ্বর্যের বাঁধনও আর তাঁকে বেঁধে রাখতে পারলে না। সেলিউকসের দর্পচূর্ণ করবার পর ছয় বৎসর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। তারপর পুত্র বিন্দুসারের হাতে রাজ্যভার দিয়ে তিনি যখন জৈন সন্ন্যাসী রূপে মুকুট খুলে চলে যান, তখনও তাঁর বয়স পঞ্চাশ পার হয়নি! ভারতের মতো রাজ-তপস্বীর দেশেই এমন স্বার্থত্যাগ সম্ভবপর! পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ও রাজর্ষি অশোকও তাঁর যোগ্য পৌত্র!

জৈন পুরাণের মত ইতিহাস মেনে নিয়েছে। গ্রিক-বিজেতা ও ভারতের স্বাধীন-হিন্দু-সাম্রাজ্যের স্রষ্টা চন্দ্রগুপ্ত সন্ন্যাস গ্রহণ করে মহীশূরে বাস করতেন। উপবাস-ব্রত নিয়ে তিনি দেহত্যাগ করেন।

জন্ম ও রাজ্যলাভ বাংলার পাশে পাটলিপুত্রে, প্রধান কর্তব্যের ক্ষেত্র পঞ্চনদের তীরে উত্তর-ভারত এবং স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ সুদূর দাক্ষিণাত্যে,—চন্দ্রগুপ্তের আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে জড়িত সমগ্র ভারতবর্ষ! প্রত্যেক ভারতবাসী তাঁকে নিজের আত্মীয় বলে গ্রহণ করে চরিত্রগঠন করুক, অদূর ভবিষ্যতে আবার তাহলে ফিরে আসবে আমাদের সোনার অতীত—অতীতের মতো গৌরবোজ্জ্বল নতুন ভারতবর্ষ!