অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইস্কুলে পড়ি; ষোল বছর বয়স! বিশ্বাস হয়, বিশ্ববিখ্যাত অবনীন্দ্রনাথ তাকে প্রথম দর্শনেই। পূর্ণ দু ঘণ্টা ধরে ভারতীয় কলার নবজাগরণের ইতিহাস শোনালেন?
সত্যই তাই হয়েছিল। আমার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে গিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের কাছে তিন মিনিট যেতে না যেতেই তিনি হঠাৎ সোৎসাহে এক ঝটকায় হেলান ছেড়ে খাড়া হয়ে বসে আমাকে সেই প্রাচীন যুগের কথা–কী করে তিনি ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করলেন, সে ছবি দেখে দ্বিজেন্দ্রনাথ কী বললেন, হ্যাভেলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ, টাইকানের সঙ্গে তাঁর সহযোগ, ওরিয়েন্টাল সাসাইটির গোড়াপত্তন, নন্দলাল অসিত কুমারের শিষ্যত্ব, আরও কত কী যে বলে গেলেন তার অর্ধেক লিখে রাখলেও আজ একখানা সর্বাঙ্গসুন্দর কলা-ইতিহাস হয়ে যেত।
আর কী ভাষা, কী রঙ। আজ যখন পিছন পানে তাকাই তখন মনে মনে দেখি, সেদিন অবনীন্দ্রনাথ কথা বলেননি, সেদিন যেন তিনি আমার সামনে ছবি এঁকেছিলেন। রঙের পর রঙ চাপাচ্ছেন; আকাশে আকাশে মেঘে মেঘে সূর্যাস্ত সূর্যোদয়ের যত রং থাকে তার থেকে তুলে নিয়ে ছবির এখানে লাগাচ্ছেন, ওখানে লাগাচ্ছেন আর যতই ভাবি এরপর আর নতুন নতুন রং বানিয়ে ছবির উপর চাপাচ্ছেন।
আর কী উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তাঁর সুখদুঃখ, তার পতন-অভ্যুদয়ের অনুভূতি অজানা অচেনা এক আড়াই ফোঁটা ছোকরার মনের ভিতর সঞ্চালন করার প্রচেষ্টা। বুঝলুম তিনি তাঁর জীবন দিয়ে ভালোবেসেছেন ভারতীয় কলাশিল্পকে আর ‘আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’ প্রদীপ্ত করে দিয়েছেন আমাদের দেশের নির্বাপিত কলাপ্রচেষ্টার অন্ধ-প্রদীপ।
***
তার পর একদিন তিনি এলেন শান্তিনিকেতনে। সেখানেও আমি কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল এবং নন্দলালের কৃতী শিষ্যগণ তাঁর চতুর্দিকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আম্রকুঞ্জে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন, বিশ্বকবিরূপে, শান্তিনিকেতনের আচার্যরূপে। আর সেদিন রবীন্দ্রনাথ যে ভাষা দিয়ে অবনীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনে আসন নিতে অনুরোধ করলেন সেরকম ভাষা আমি রবীন্দ্রনাথের মুখে তার পূর্বে কিংবা পরে কখনও শুনিনি। রবীন্দ্রনাথ সেদিন যেন গদ্যে গান গেয়েছিলেন, আমার মনে হয়, সেইদিনই তিনি প্রথম গদ্য কবিতা আরম্ভ করলেন। দেশবিদেশে বহু সাহিত্যিককে বক্তৃতা দিতে শুনেছি, কিন্তু এরকম ভাষা আমি কোথাও শুনিনি– আমার মনে হয়, দেবদূতরা স্বর্গে এই ভাষায় কথা বলেন– সেদিন যেন ইন্দ্রপুরীর একখানা বাতায়ন খুলে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে উর্বশীর বীণা গুঞ্জরণ করে উঠেছিল।
***
অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আমি উত্তরায়ণের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি– অবনীন্দ্রনাথ সদলবলে আসছেন। আমাকে চিনতে পারলেন বলে মনে বড় আনন্দ হল।
তখন আমাদের সবাইকে বললেন, ‘জান, বৈজ্ঞানিকরা বড় ভীষণ লোক আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে দেয়। এই দেখ না, আজ সন্ধ্যায় আমি দক্ষিণের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো মেঘ এসে বাসা বাঁধছে ভুবনডাঙার ওপারে, ডাকবাংলোর পিছনে। মেঘগুলোর সর্বাঙ্গে কেমন যেন ক্লান্তির ভাব আর বাসা বাঁধতে পেরে তারা একে অন্যেকে আনন্দে আলিঙ্গন করছে।’
রথী শুনে বলেন, ‘মেঘ কোথায়? এ তো ধানকলের ধোঁয়া!’
এক লহমায় আমার সব রঙিন স্বপ্ন বরবাদ হয়ে গেল। তাই বলছিলুম, বৈজ্ঞানিকগুলো ভীষণ লোক হয়।(১)
সে যাত্রায় যে কদিন ছিলেন তিনি যে কত গল্প বলেছিলেন, তরুণ শিল্পীদের কত অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন তার ইতিহাস, আশা করি, একদিন সেই শিল্পীদের একজন লিখে দিয়ে আমাদের প্রশংসাভাজন হবেন।
***
আবার সেই প্রথম দিনের পরিচয়ে ফিরে যাই।
আমি তখন অটোগ্রাফ শিকারে মত্ত। প্রথম গগনেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করলুম আমার অটোগ্রাফে কিছু এঁকে দিতে। তাঁর কাছে রঙ তুলি তৈরি ছিল। চট করে পাঁচ মিনিটের ভিতর আকাশে ঘন মেঘ আর তার ফাঁকে ফাঁকে গুটিকয়েক পাখি এঁকে দিলেন।
এর কয়েকদিন পূর্বে শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা কলকাতায় এসে বর্ষামঙ্গল করে গিয়েছে। গগনেন্দ্রনাথ ছবি এঁকে দিয়ে বললেন, ‘পাখিরা বর্ষামঙ্গল করছে।’
অবনীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করতে তিনি বললেন, ‘তুমি নিজে ছবি আঁকো না কেন?’
আমি সবিনয়ে বললুম, ‘আমি ছবি দেখতে ভালোবাসি।’
বললেন, ‘দাও তোমার অটোগ্রাফ। তোমাকে কিছু-একটা লিখে দিচ্ছি, আর যেদিন তুমি তোমার প্রথম আঁকা ছবি এনে দেখাবে সেদিন তোমার বইয়ে ছবি এঁকে দেব।’
বলে লিখলেন, ‘ছবি দেখে যদি আমোদ পেতে চাও তবে আকাশে জলে স্থলে প্রতি মুহূর্তে এত ছবি আঁকা হচ্ছে যে তার হিসাব নিলেই সুখে চলে যাবে দিনগুলো।
‘আর যদি ছবি লিখে আনন্দ পেতে চাও তবে আসন গ্রহণ করো এক জায়গায়, দিতে থাকো রঙের টান, তুলির পোঁচ। এ দর্শকের আমোদ নয়, স্রষ্টার আনন্দ’।(১)
———— ১. পাঠক, অবনীন্দ্র যে ভাষায় বলেছিলেন তার সন্ধান এতে পাবেন না।