অপারেশান অপক্ষেপ
বিশাল একটা হলঘরে প্রায় এক হাজার তরুণ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, গবেষক, শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। হলঘরটি রাষ্ট্রীয় হলঘর, গ্রানাইটের কালো দেয়াল এবং উঁচু ছাদ। ভিতরে হালকা স্বচ্ছ এক ধরনের নরম আলো, বসার জন্যে মেরুন রঙের নরম চেয়ার, সামনে কাঁচে ঢাকা সিলিকনের সুদৃশ্য টেবিল। টেবিলে কাগজপত্র, মাইক্রো কম্পিউটার, কমিউনিকেশন মডিউলের মতো নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। তরুণ বিজ্ঞানী গবেষক এবং শিল্পী সাহিত্যিকেরা নিজেদের ভিতরে নিচু গলায় কথা বলছে, তরল গলায় হাসছে। যদিও এটি রাষ্ট্রীয় হলঘর কিন্তু পরিবেশটি গুরুগম্ভীর রাষ্ট্রীয় পরিবেশ নয়, পরিবেশটি সহজ এবং স্বাভাবিক।
হলঘরে একটু উত্তেজনা দেখা গেল এবং প্রায় সাথে সাথে ভারি গলায় একটি ঘোষণা শোনা যায়। বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু হলঘরে এসে পৌঁছেছেন এবং তিনি এক্ষুনি এই এক সহস্র বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদ এবং শিল্পী সাহিত্যিকের সাথে কথা বলবেন। মেরুন রঙের আরামদায়ক চেয়ারে বসে থাকা তরুণ–তরুণীরা নড়েচড়ে বসল এবং প্রায় সাথে সাথেই তাদের টেবিলের স্বচ্ছ কাঁচে থিরুকে দেখা গেল। শান্ত সৌম্য একহারা চেহারা, পরনে দৈনন্দিন সহজ পোশাক।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক তার আসনে বসে সাথে সাথেই কথা বলতে শুরু করে দিলেন। নরম গলায় বললেন, এটি রাষ্ট্রীয় হলঘর, নানা কাজে আমাকে এখানে আসতে হয়, আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় এবং আনুষ্ঠানিক কথা বলতে হয়। আজ একটা বিশেষ দিন, আমি আগে থেকে ঠিক করেছি এই দিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকবে না, আজ এখানে খোলাখুলি কথা বলা হবে।
উপস্থিত তরুণ–তরুণীরা মহামান্য থিরুর কথা শুনে এক ধরনের আনন্দের মতো শব্দ করল।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, আজকে আমি একটু সময় নিয়ে এসেছি, আমি শুধু তোমাদের সাথে কথা বলব না, আমি তোমাদের কথা শুনব।
উপস্থিত তরুণ–তরুণীরা আবার একটা আনন্দধ্বনির মতো শব্দ করল, বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালকের সাথে কথা বলা একটি দৈনন্দিন ব্যাপার নয়।
থিরু তার সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের সাথে কথা বলা আমার জন্যে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। তোমরা সারা পৃথিবী থেকে বেছে–নেয়া এক হাজার সেরা বিজ্ঞানী গবেষক শিল্পী এবং সাহিত্যিক। তোমাদের কাউকে এখানে জোর করে আনা হয় নি, তোমরা সবাই স্বেচ্ছায় এসেছ। তোমরা সবাই হচ্ছ অপারেশান অপক্ষেপের অংশ।
অপারেশান অপক্ষেপের ধারণাটি নূতন নয়, যারা পৃথিবী নিয়ে ভাবেন তারা অনেকবার এ ধরনের একটা কথা বলেছেন কিন্তু কেউ কখনো সেটি পরীক্ষা করে দেখেন নি। সেই পরীক্ষাটি সহজ নয়। এই প্রথম তোমাদের ব্যবহার করে অপারেশান অপক্ষেপের পরীক্ষা করা হবে।
তোমরা জান অপারেশন অপক্ষেপটি কী এবং কেন সেটা আমরা করছি। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এর জ্ঞান–বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে প্রয়োজনে। ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে বিজ্ঞানীরা, প্রযুক্তিবিদেরা আবিষ্কার করেছেন নূতন শক্তিবলয়। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম খাদ্য। পৃথিবীর সঞ্চিত শক্তি নিঃশেষ হবার পর আবিষ্কৃত হয়েছে নূতন শক্তিভাণ্ডার। পারমাণবিক যুদ্ধে জনারণ্য ধ্বংস হওয়ার পর মহামারীতে দুঃসময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে নূতন জীবন সম্ভাবনা, নূতন ওষুধ, নূতন প্রতিষেধক।
কিন্তু আমরা আমাদের অতীতকে আজ পিছনে ফেলে এসেছি। এখন পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা নেই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, খাদ্যাভাব নেই। প্রকৃতিকে আমরা জয় করেছি, ভূমিকম্প ঝড় বৃষ্টি বন্যার ভয় নেই। আমরা প্রকৃতি থেকে নূতন শক্তি ভাণ্ডার আহরণ করছি, আমাদের শক্তি ফুরিয়ে যাবার আশঙ্কা নেই। কৃত্রিম খাদ্য তৈরি। হয়েছে, পৃথিবীর মানুষকে আর ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হবে না। আমাদের রোগ শোক নেই, দুঃখ কষ্ট নেই, খাদ্যের কষ্ট নেই, পরিবেশকে রক্ষা করা হয়েছে, পরিবেশ দূষণের ভয় নেই। সুস্থ সবল বুদ্ধিমান আবেগপ্রবণ মানবশিশুর জন্ম হচ্ছে, ভালবাসায় তারা বড় হচ্ছে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নত হচ্ছে, শিল্পে সাহিত্যে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এক কথায় পৃথিবীতে মানবসমাজের চাইবার আর কিছু বাকি নেই।
থিরু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আর সেটি হচ্ছে আমাদের পতনের শুরু। আমরা আবিষ্কার করেছি আমাদের মাঝে আর কোনো প্রেরণা নেই। যে প্রেরণা মানুষকে গুহামানব থেকে তাড়না করে এখানে নিয়ে এসেছে, হঠাৎ করে সেই প্রেরণাটুকু হারিয়ে গেছে। আমরা দৈনন্দিন জীবন যাপন করি, নিজেদের বেঁধে দেয়া দায়িত্ব পালন করি, আমরা আনন্দ করি, জীবন উপভোগ করি কিন্তু জীবনকে নূতন কিছু দিই না। আমাদের জীবন গতানুগতিক। গত এক শ বছরে পৃথিবীতে মানবসমাজ নূতন কিছু দেয় নি। মনে হচ্ছে আগামী এক শ বছরেও কিছু দেবে না। আমরা এখন অলস পচনশীল একটা সমাজ।
এই অলস পচনশীল সমাজকে রক্ষা করার জন্যে তৈরি হয়েছে অপারেশান অপক্ষেপ। তোমরা সেই অপারেশান অপক্ষেপের প্রথম পরীক্ষার্থী।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দুই শ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা দ্বীপ আলাদা করে রাখা আছে তোমাদের জন্যে। সেই দ্বীপের দশ হাজার কিলোমিটারের ভিতর থেকে সমস্ত মানুষকে অপসারিত করা হয়েছে। সেই নির্জন দ্বীপে তোমাদের জন্যে ঘর তৈরি হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়ার্কশপ, হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বিদ্যুৎ পানি গ্যাস তাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো তৈরি হয়েছে সাময়িকভাবে। তোমাদের ঘর এক বছরের মাথায় জীর্ণ হয়ে আসবে, দুই বছরের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে। ওয়ার্কশপের যন্ত্রপাতিতে জং ধরবে, ছাদ ভেঙে পড়বে। হাসপাতালের ওষুধ ফুরিয়ে যাবে, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি ভেঙে যাবে। তোমাদের খাবার ফুরিয়ে যাবে, রসদ থাকবে না। পানি গ্যাস বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই দ্বীপটি বেছে নেয়া হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল এলাকায়। এখানে টাইফুন এসে আঘাত হানে, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে যায়, আগ্নেয়গিরির লাভা এসে ডুবিয়ে দেয়, ভূমিকম্পে কেঁপে কেঁপে ওঠে। শুধু তাই নয়, এই যে তোমরা হাসিখুশি তরুণ–তরুণীরা আছ তার মাঝে রয়েছে কিছু টাইম–বম্ব। তোমরা নিজেরাও জান না যারা হঠাৎ করে পাল্টে যাবে ভয়ঙ্কর ক্রিমিনালে। যাদের সহজ সরল হাসির পিছনে জন্ম নেবে লোত, নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতার মোহ।
তোমরা এই এক হাজার তরুণ–তরুণী সেই দ্বীপটিতে বাস করবে। পৃথিবীর সাথে তোমাদের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। সবাই তোমাদের কথা ভুলে যাবে। তোমাদের উপর দিয়ে কোনো প্লেন উড়বে না, কোনো উপগ্রহ তোমাদের ছবি তুলবে না। তোমাদের সাথে কেউ কথা বলবে না, তোমরাও কারো সাথে কথা বলবে না।
তোমাদের কেউ বিদায় জানাবে না, পৃথিবীর সব মানুষের অগোচরে তোমরা সেই দ্বীপে আশ্রয় নেবে। পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতায় তোমরা বেঁচে থাকবে। আমরা সভ্য জগতের মানুষেরা যে সহজ আরামে অভ্যস্ত হয়েছি তোমাদের সেটা থাকবে না। তোমাদের জীবন হবে কঠোর। সেই কঠোর জীবনে তোমরা নিশ্চয়ই জন্ম দেবে একটি নূতন সভ্যতা। পৃথিবীর মানুষ যখন জন্ম দেবে অলস অকর্মণ্য প্রজাতি, তখন তোমরা সৃষ্টি করবে এক তেজস্বী শক্তিশালী জাতি। তোমাদের হাতে জন্ম নেবে নূতন জ্ঞান, নূতন আবিষ্কার, নূতন সমাজব্যবস্থা।
সেই নির্জন দ্বীপে তোমাদের কথা কোনো মানুষ জানবে না। শক্তিবলয় দিয়ে তোমাদের ঘিরে রাখা হবে, সেই বলয় কেউ ভেদ করে আসতে পারবে না। পৃথিবীর ভিতরেই তোমরা জন্ম দেবে নূতন পৃথিবীর। আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পরে, হয়তো তোমরা শক্তিবলয় ভেদ করে ফিরে আসবে এই পৃথিবীতে। মানব–জগৎ পাল্টে যাবে চিরদিনের মতো। সভ্যতার নূতন যুগের সৃষ্টি হবে এই পৃথিবীতে।
গ্রানাইট পাথরের বিশাল হলঘরে এক হাজার তরুণ–তরুণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে বসে থেকে থিরুর কথা শুনতে থাকে। তাদের বুকের মাঝে একই সাথে আশা এবং আশঙ্কা। স্বপ্ন এবং আতঙ্ক। জীবন এবং মৃত্যু।
***
খুব ধীরে ধীরে বিরু ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অপারেশন অপক্ষেপের তিনি হচ্ছেন একমাত্র দর্শক। নির্জন দ্বীপের এক হাজার তরুণ–তরুণীর সাথে তিনিও এসেছিলেন দ্বীপে। দ্বীপের শক্ত পাথরের গভীরে এক শ মিটার নিচে গোপন ভল্টে তার শরীরকে শীতল করে রাখা হয়েছিল গোপনে। পৃথিবীতে তার মৃত্যুর যে খবর প্রচার করা হয়েছিল সেটি সত্যি ছিল না। যে দেহটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেটিও তার শরীর ছিল না।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু নিজের হাতে এই অপারেশান অপক্ষেপ দাঁড়া করিয়েছিলেন। এক শ বছর পর এই অপারেশান অপক্ষেপ কোন স্তরে এসে পৌঁছেছে জানার জন্যে তিনি গত এক শতাব্দী পাথরের আড়ালে ঘুমিয়েছিলেন। এখন তার ঘুম ভেঙেছে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে তার শরীরকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে। তিনি এখন পাথরের আড়াল থেকে বাইরে যাবেন, নির্জন দ্বীপে জন্ম নেয়া এক নূতন সভ্যতাকে নিজের চোখে দেখবেন।
থিরু নিজের বুকের ভিতরে এক ধরনের কম্পন অনুভব করেন। বের হয়ে কী দেখবেন তিনি? উৎসাহী মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত জনপদ, বিশাল সুরম্য অট্টালিকা, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্পর্শে সৃষ্ট নূতন ধরনের পরিবহন পদ্ধতি? নাকি দেখবেন জনমানবশূন্য এক বিশাল ধু–ধু প্রান্তর? প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি জনপদ?
থিরু একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। কী দেখবেন তিনি জানেন না, কিন্তু তাকে এখন বাইরে যেতে হবে, দেখতে হবে এই নূতন সভ্যতা কিংবা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এক শতাব্দী তিনি এই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করে আছেন।
শক্ত পাথরের গভীরে এক শ মিটার নিচের গোপন ভল্ট থেকে একটা অর্ধলোকিত সুড়ঙ্গ দিয়ে তিনি উপরে উঠে এলেন। বাইরে বের হতেই শীতল একটি বাতাস তার শরীরকে স্পর্শ করল, তিনি বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বাইরে তাকালেন। সামনে অপূর্ব কিছু অট্টালিকা, শক্ত গাঁথুনি, অপূর্ব নকশা–কাটা। সন্ধ্যার আবছা আলোতে চিকচিক করছে। দুইপাশ দিয়ে সরু পথ নেমে গিয়েছে। উঁচুতে কাঁচে ঢাকা গোলাকার স্টেশন। রাস্তার পাশে সবুজ দেবদারু গাছ।
থিরু নিশ্বাস বন্ধ করে একবার চারদিকে তাকালেন, না, এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি সভ্যতা নয়। চারদিকে গড়ে ওঠা নূতন একটি সভ্যতার চিহ্ন। তিনি আবার তাকালেন এবং হঠাৎ করে তার মনে হল এখানে কোথাও কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটা কী তিনি হঠাৎ করে ধরতে পারলেন না। ইতস্ততভাবে তিনি আরো কয়েক পা এগিয়ে এলেন এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন চারপাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই! কোথায় গিয়েছে সব মানুষ?
থিরু জনশূন্য রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন। চারপাশে নগরীর সুস্পষ্ট চিহ্ন, রাস্তাঘাট উঁচু অট্টালিকা প্রযুক্তির সুস্পষ্ট ব্যবহার, সবই নিশ্চয়ই মানুষের জন্যে কিন্তু সেই মানুষেরা চোখের আড়ালে। বড় কোনো অট্টালিকায় ঢুকে দেখলে হয় কিন্তু থিরু হঠাৎ করে সেটি সাহস করলেন না। রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন, শীতল বাতাস বইছে, এই দ্বীপটির অবস্থান থেকে তিনি জানেন সোজা সামনে হেঁটে গেলে তিনি সমুদ্রতীরে পৌঁছাবেন। এই দ্বীপটির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল বালুকাবেলা, সেখানে কি এক–দুজন সান্ধ্যকালীন পদব্রাজক পাওয়া যাবে না?
থিরু সমুদ্রতীরে এসে অবাক হলেন, বালুকাবেলার সামনে বিশাল সমুদ্র, তাদের ফেনায়িত তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে, ঝাউগাছে বাতাসের এক ধরনের করুণ সুর কিন্তু এই অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার কেউ নেই। থিরু একাকী বালুকাবেলায় ঘুরে বেড়ালেন, যখন একটি মানুষকেও না পেয়ে ফিরে আসছিলেন ঠিক তখন একটা ঝাউগাছের নিচে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা একজন মানুষকে আবিষ্কার করলেন। মানুষটি এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তার পোশাক জীর্ণ, চেহারায় এক ধরনের খাপছাড়া উদ্ভান্ত ভাব। থিরু সাবধানে এগিয়ে গিয়ে তার কাছাকাছি দাঁড়ালেন, মানুষটি চোখের কোনা দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। থিরু ইতস্তত করে বললেন, আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
মানুষটি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, বল।
আমি এক শ বছর আগে থেকে এসেছি, এক সময় আমি পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলাম।
আমি সেটা আন্দাজ করছিলাম। তুমি এ সময়ের মানুষ হলে তোমার মাথায় নিশ্চয়ই মাস্কিট্রন থাকত।
কী থাকত?
মাস্কিট্রন। মানুষটি তার মাথা ঘুরিয়ে দেখাল বাম কানের একটু উপরে গোলাকার একটি জিনিস লাগানো।
থিরু একটু ঝুঁকে পড়ে সন্ধ্যার আবছা আলোতে মাস্কিট্রন নামের জিনিসটা একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন। জিনিসটা কেমন করে মাথার পাশে লেগে আছে তিনি বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এটা কেমন করে লাগিয়েছ?
খুব সোজা। মাথার খুলিতে চারটা তিন শতাংশ ছিদ্র করে স্ক্রু দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
থিরু একটু শিউরে উঠলেন, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাথার খুলিতে ফুটো করে?
হ্যাঁ। মস্তিষ্কের মাঝে যে ইমপালস দেয়া হয় সেটা যত কাছে থেকে সম্ভব দেয়ার কথা।
থিরু মানুষটির কাছে উবু হয়ে বসে বললেন, দেখ, আমি এক শতাব্দী আগে থেকে এসেছি, তোমাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে এখানে কী হচ্ছে?
মানুষটি এবারে প্রথমবার থিরুর দিকে ঘুরে তাকাল। খানিকক্ষণ এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, সত্যি শুনতে চাও?
হ্যাঁ।
বলছি তোমাকে। বস এখানে।
থি মানুষটির পাশে বসলেন, ঠিক জানেন না কেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে হঠাৎ তিনি এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। মানুষটি তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জান এই দ্বীপে এক হাজার খুব উৎসাহী তরুণ–তরুণীকে পাঠানো হয়েছিল, তারা আমাদের তিন পুরুষ আগের মানুষ।
থিরু মাথা নাড়লেন, তিনি জানেন, মানুষগুলোকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন।
অসম্ভব কষ্ট করে সেই মানুষগুলো নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাদের সন্তানেরা এই দ্বীপটিকে গড়ে তুলেছে। যারা এই দ্বীপটিকে গড়ে তুলেছে আমরা তাদের সন্তান। আমাদের মাঝে অসংখ্য প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর প্রযুক্তিবিদের জন্ম হয়েছিল। তাদের সবার চেষ্টা দিয়ে তৈরি হয়েছে মাস্কিট্রন।
সেটা কী করে?
জীবনকে সহজ করে দেয়। আমরা প্রতিনিয়ত শুধু ছুটে বেড়াতাম, আমাদের জীবন ছিল শুধু কাজ আর পরিশ্রম। চেষ্টা ও খাটাখাটুনি। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন এই পরিশ্রম? কেন এই কাজ? জীবনকে আনন্দময় করার জন্যে। সেই জীবন যদি সহজে আনন্দময় করে দিতে পারি তাহলে কেন আমরা কষ্ট করে খাটাখাটুনি করব? পরিশ্রম করে নিজের জীবনকে শেষ করব?
থিরু জিজ্ঞেস করলেন, মাস্কিট্রন পরিশ্রম ছাড়াই আনন্দ এনে দিতে পারে?
হ্যাঁ। কারণ মাস্কিট্রন সোজাসুজি মস্তিষ্কের সাথে লাগানো। মস্তিষ্কে এটি ইমপালস দিয়ে আনন্দের অনুভূতি দিতে পারে। আমরা অনেক পরিশ্রম করে আমাদের জীবনে আনন্দের যে অনুভূতি সৃষ্টি করব, সেই অনুভূতিটি সোজাসুজি মস্তিস্কে এসে যাচ্ছে। তাহলে পরিশ্রম কেন করব? চমৎকার একটা কবিতা পড়লে যেরকম আনন্দ হয়, সুন্দর একটি ছবি দেখলে যেরকম ভালো লাগে, অপূর্ব সঙ্গীত শুনে বুকের ভিতরে যেরকম আবেগের জন্ম হয় তার সবকিছু আমরা করতে পারি মাস্কিট্রন দিয়ে। আমাদের কবিতা লেখার প্রয়োজন নেই, ছবি আঁকার প্রয়োজন নেই, সঙ্গীত সৃষ্টিরও প্রয়োজন নেই।
থিরু খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষটির দিকে তাকালেন। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, মানুষটি হাত তুলে হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে সামনে তাকাল। থিরু তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখতে পেলেন একটা মোটাসোটা ইঁদুর মাথা নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে আসছে। মানুষটি সাবধানে তার পাশে রাখা মুগুরের মতো একটা গাছের গুঁড়ি তুলে নিয়ে অতর্কিতে ইঁদুরটিকে মেরে বসে। ইঁদুরটির মাথা থেঁতলে রক্ত ছিটকে এসে মানুষটির মুখে পড়ল কিন্তু মানুষটির সেটা নিয়ে কোনো ভাবান্তর হল না। সে মৃত ইঁদুরটির লেজ ধরে নিজের কাছে টেনে এনে চোখের সামনে ঝুলিয়ে সেটিকে পর্যবেক্ষণ করে, থিরু দেখতে পেলেন মানুষটির চোখেমুখে একটা আনন্দের আভা হাজির হয়েছে। সে ইঁদুরটা নিজের পাশে রেখে আমার কথার সূত্র ধরে বলল, একটা সঙ্গীত সৃষ্টি করতে
থিরু বাধা দিয়ে বললেন, তুমি–তুমি ইঁদুরটা দিয়ে কী করবে?
মানুষটি থিরুর দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে বলল, এটা আমার আজ রাতের ডিনার।
থিরু চমকে উঠলেন, ডিনার?
হ্যাঁ। মাস্কিট্রন আমাদের আনন্দ সুখ উল্লাসের অনুভূতি দিতে পারে। কিন্তু আমাদের খেতে হয়
থিরু হতচকিত হয়ে বললেন, এই– এই ইঁদুরটা খাবে?
হা। মাস্কিট্রনটা সেট করব অত্যন্ত উপাদেয় খাবারের অনুভূতির জন্যে। তখন আমি যেটাই খাব সেটাকেই মনে হবে উপাদেয় খাবার। ইঁদুরটা এমনিতেই কচমচ করে খাব–
কাঁচা?
মানুষটা সহৃদয় মানুষের মতো হাসল, রান্না করে জ্বালানি নষ্ট করে লাভ আছে?
থিরুর সারা শরীর গুলিয়ে উঠল। মানুষটি থিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মাথায় যেহেতু মাস্কিট্রন লাগানো নেই, তোমার হয়তে পুরো ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর মনে হতে পারে।
থিরু দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। কাঁচা ইঁদুরকে উপাদেয় খাবার মনে করে, খাওয়ার জন্যে তোমরা মাথার খুলি ফুটো করে স্ক্রু দিয়ে যন্ত্র লাগাচ্ছ? এর সত্যিই দরকার ছিল?
মানুষটি তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এটা তো সত্যিকারের ব্যবহার নয়। এর সত্যিকার ব্যবহার অন্য জায়গায়। এই তো কয়দিন আগে একটি মেয়ের একমাত্র বাচ্চা সাত তালা থেকে পড়ে মারা গেল। যদি মাস্কিট্রন না থাকত সেই মায়ের কী ভয়ানক কষ্ট হত বলতে পার? কিন্তু এখন কোনো সমস্যাই নেই, মাস্কিট্রন সেট করে শিশুর মৃতদেহটি রেখে চলে গেল একটা পার্টিতে আনন্দ করতে!
থিরু হঠাৎ করে শিউরে উঠলেন, প্রথমবার তিনি একটু আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করেন। ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু যেখানে দুঃখ পাওয়ার কথা সেখানে তো দুঃখ পেতে হয়—
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, না আর পেতে হয় না। আমাদের মাঝে এখন আর দুঃখ নেই। এই দ্বীপের প্রতিটি মানুষ এখন গভীর সুখের মাঝে ডুবে আছে। তাদের ভিতরে দুঃখ বেদনা কষ্ট কিছু নেই।
থিরু খানিকক্ষণ মানুষটির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে রাস্তাঘাটে মানুষ নেই কেন?
প্রয়োজন নেই তাই। মানুষ রাস্তাঘাটে যেত কারণ কাজকর্ম করার প্রয়োজন ছিল। এখন শুধু খাওয়া জোগাড় করার জন্যে মাঝে মাঝে বের হতে হয়। বাকি সময়টুকু মানুষ তার ঘরে চুপচাপ শুয়ে মাস্কিট্রন দিয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে।
মানুষটি আড়মোড়া ভেঙে ইঁদুরটার লেজ ধরে টেনে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিই। তুমি কি যাবে আমার সাথে?
থিরু মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যাও। আমি আরো খানিকক্ষণ বসে যাই। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগবে।
ঠিকই বলেছ। যত তাড়াতাড়ি পার একটা মাস্কিট্রন লাগিয়ে নাও, দেখবে জীবনের মাঝে কত আনন্দ লুকানো!
মানুষটি হেঁটে চলে গেল, থিরু সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। গম্ভীর হতাশায় তিনি একটি নিশ্বাস ফেললেন। অপারেশান অপক্ষেপ যেভাবে কাজ করার কথা ছিল সেভাবে কাজ করে নি। এটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থ হয় নি এটি পুরোপুরি উল্টোদিকে কাজ করেছে। মানুষকে নূতন জীবন না দিয়ে যে জীবনটি দেয়া হয়েছিল সেটি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
থিরু দীর্ঘসময় একা একা সমুদ্রের বালুবেলায় বসে রইলেন। ধীরে ধীরে শীতের বাতাস বইতে লাগল, যখন শীতটুকু অসহ্য মনে হল তখন হঠাৎ তিনি কয়েকজন মেয়ের গলা শুনতে পেলেন। কথা বলতে বলতে তারা এদিকে এগিয়ে আসছে। থিরু উঠে দাঁড়ালেন, মেয়েগুলো তাকে দেখতে পেয়ে কথা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে এল। কাছে এলে থিরু দেখতে পেলেন তাদের সবার মাথায় একটি করে মাস্কিট্রন লাগানো।
মেয়েদের ভিতরে একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কী করছ?
থিরু শান্ত গলায় বললেন, আমাকে তোমরা চিনবে না। আমি এই এলাকার নই। সত্যি কথা বলতে এই সময়েরও না!
মেয়েগুলো মাথা নেড়ে বলল, তাই তো দেখছি, তোমার মাথায় মাস্ক্রিট্রন নেই।
না নেই। তোমরা এত রাতে কেন এসেছ?
আমরা এসেছি খাবারের জন্যে। এখানে মাঝে মাঝে বড় ইঁদুর পাওয়া যায়।
থিরুর শরীর আবার কাঁটা দিয়ে ওঠে। তিনি দেখতে পেলেন তাদের একজনের হাতে একটা লোহার রডের মতো জিনিস।
অন্য একটি মেয়ে বড় হাতের মেয়েটিকে বলল, তুমি এটা দিয়ে ইঁদুর মারতে পারবে না। ইঁদুর খুব চতুর প্রাণী, এত সহজে তাকে মারা যায় না।
মেয়েটি বলল, অবশ্যি পারব। আমি কত সহজে এটা দিয়ে আঘাত করতে পারি।
এত সোজা নয়।
তোমরা দেখতে চাও?
দেখাও দেখি।
তাহলে মাস্কিট্রনটা এগার পয়েন্টে সেট কর।
মেয়েগুলো তাদের মাথায় লাগানো মাস্কিট্রন হাত দিয়ে ঠিক করতে শুরু করে, থিরু জিজ্ঞেস করলেন, মাস্কিট্রন এগার পয়েন্ট সেট করলে কী হয়?
বীভৎস রক্তারক্তি বা হিংস্র কাজকর্মগুলোকে পবিত্র কাজ বলে মনে হয়।
থিরু জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি বীভৎস কোনো কাজ করা হবে?
যে মেয়েটির হাতে লোহার রড, সে দুই হাতে শক্ত করে রডটি ধরে থিরুর দিকে এগিয়ে এল। থিরু আতঙ্কে শিউরে উঠে দেখলেন মেয়েটির মুখে সত্যিই কোমল স্নিগ্ধ একটি পবিত্র ভাব।
.
সমুদ্রের বালুবেলায় একটি বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে প্রাতঃভ্রমণকারী একজন মানুষ দ্রুত মাস্কিট্রনটি চৌদ্দ পয়েন্টে সেট করে নিল। মাস্কিট্রন চৌদ্দ পয়েন্টে সেট করা হলে ভীতিকর একটা দৃশ্যকে কৌতুককর বলে মনে হয়।