বাইশ
না!
ডাইভিং বোর্ডে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা রয় হাত দুটো বাড়িয়ে দিল-এবং পাকড়াল আমাকে। পড়ে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলেছে।
বোর্ডে আঘাত করল হাঁটুজোড়া আমার। মুখ থুবড়ে পড়লাম পাটাতনটার ওপরে। সারা দেহে বয়ে গেল ব্যথার তীব্র স্রোত। তবে আমি একদম নিরাপদ।
দু’জনেই আমরা বিপদমুক্ত।
পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, দস্তুরমত হাঁফাচ্ছি। এবার সাবধানে উঠে দাঁড়িয়ে মইয়ের দিকে চললাম।
রয় দাঁত বের করে হাসল।
‘মুসা, আমরা এক দল হয়ে যাই, এসো!’
‘খাইছে, ঠিক আছে,’ সায় জানালাম।
নিচ থেকে ছেলে-মেয়েদের হর্ষধ্বনি কানে আসছে। সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। চিৎকার-চেঁচামেচি, শিস আর হাততালির শব্দে কান পাতা দায়।
ধীরেসুস্থে মাটিতে নেমে এলাম। মি. লয়েড এবং আরও কয়েকজন টিচার ছুটে এলেন আমার উদ্দেশে। রবিন দাঁড়িয়ে ছিল মইয়ের গোড়ায়, জড়িয়ে ধরল আমাকে।
কিন্তু আমার এখন কথা বলার মত অবস্থা নেই।
একটা কথাই জানতে চাই শুধু: আমি কি পরাজিত করতে পেরেছি অপয়া ক্যামেরাটাকে?
.
দৌড়তে দৌড়তে বাসায় এলাম। উঠে এসেছি নিজের কামরায়। কেমন পাগল-পাগল লাগছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। মনে হচ্ছে মাটির দু’ফিট ওপরে ভেসে রয়েছি। গোটা দেহ কাঁটা দিচ্ছে।
ক্যামেরাটায় তোলা ছবিগুলো ডেস্কে ছড়িয়ে রেখেছিলাম। কামরার ওপাশে ধেয়ে গিয়ে তুলে নিলাম সব কটা।
সবার ওপরে কিশোরের ছবি। ওটা তুলে নিয়ে চোখের কাছে ধরলাম।
রক্তচক্ষু উধাও। চোখের লাল আভা দূর হয়েছে ছবিটা থেকে।
পাল্টে গেছে সারার ছবিও। দেখা যাচ্ছে মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠেছে ও। লেআপ শুট করার জন্য।
‘খাইছে!’ চিৎকার ছেড়ে বাতাসে ঘুসি ছুঁড়লাম। ‘হয়েছে! আমি পেরেছি!’
ওর ছবিটা রেখে ববি আর এমারটা দেখলাম। ওদের চামড়া এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সবুজ নয়! এবং শেষ ছবিতে ফারিহাকে একদম সুস্থ-স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ওর মুখে এখন আর হলদে, কাঁটাময় ভ্রমরের রোম নেই!
কামরা জুড়ে এক পাক নেচে নিলাম। বাতাসে মুঠো ছুঁড়লাম আরও ক’বার।
ভৌতিক ক্যামেরাটাকে কি সত্যিই হারাতে পেরেছি আমি? সেল ফোনটা তুলে নিয়ে হাসপাতালে মাকে ফোন করলাম।
‘মা, ফারিহা কেমন আছে?’ প্রশ্ন করলাম।
জানতাম মা কী বলবে: ‘ভাল আছে। আজব ওই চুলগুলো হঠাৎ করে নিজে-নিজেই পড়ে গেছে। ববি আর এমাও সুস্থ। আমি আর তোর বাবা ফারিহাকে বাসায় নিয়ে আসছি।’
খাইছে, জানতাম, জানতাম আমি।
কিশোরকে ফোন করলাম। কয়েকদিন পর কথা হলো দু’বন্ধুর। ওর আর কোন রাগ নেই আমার ওপর। জানাল শীঘ্রি রবিনকে নিয়ে আসবে আমার বাসায়। আবেগে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। গলা বুজে এল কিশোরেরও। অতি কষ্টে কান্না চাপলাম দু’জনেই।
কিশোরের সঙ্গে কথা শেষে, আমার ছবিটা দেখলাম, মাথা নিচে দিয়ে মৃত্যুমুখে পতন হচ্ছে যেটায়। কিন্তু ছবিটাকে ফলতে দিইনি আমি। আর তাতেই কুফা ক্যামেরাটার জাদু কেটে গেছে।
এবং আমি ওটার অশুভ প্রভাব কাটাতে পারায়, ওটার ক্ষতিকর প্রতিটা কাজ উল্টে গেছে।
এখন আর একটা কাজই বাকি। ভুতুড়ে ক্যামেরাটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে, অন্য কেউ যেন ওটাকে আর খুঁজে না পায় এবং ব্যবহার করতে না পারে।
কাজটা কীভাবে করব তা-ও জানি।
ড্রেসারের সব বাতিল জিনিসপত্র বের করে বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম একে-একে। এবার ক্লজিটের গোপন জায়গা থেকে সাবধানে বের করে আনলাম ক্যামেরাটা।
এটা আমার আইডিয়া…
যারই ছবি তুলেছে তারই অনিষ্ট করেছে এই ক্যামেরাটা। তাই আমার যা করতে হবে তা হলো, ক্যামেরাটাকে দিয়ে ওটার নিজেরই ছবি তোলাতে হবে। তার ফলে ওটা নিজেই নিজের মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে!
পানির মত সহজ ব্যাপার, তাই না?
এতে কাজ হবে, জানি আমি। হতেই হবে।
আমার ড্রেসারের মাথায় নামিয়ে রাখলাম ক্যামেরাটাকে। এবং লেন্সটা তাক করলাম আয়না লক্ষ্য করে।
ভিউফাইণ্ডার পরখ করলাম। নিখুঁত। ক্যামেরাটা আয়নায় নিজের ত্রুটিবিহীন ছবি নিতে তৈরি।
এখন আমার কাজ হলো স্ন্যাপশটটায় যেন কিছুতেই আমি ধরা না পড়ি তা নিশ্চিত করা।
ক্লজিট থেকে এক ধাতব কোট হ্যাঙ্গার নিলাম। ওটাকে টেনে-টেনে লম্বা করে প্রায় সরল এক লাইন বানালাম।
এবার সরে গেলাম একপাশে। পেছনে হেলে পড়লাম। আয়নায় কোনমতেই আমার প্রতিবিম্ব যেন না পড়ে।
ধীরে-ধীরে… সাবধানে…হ্যাঙ্গারটাকে বাড়িয়ে দিলাম ক্যামেরাটার দিকে।
এবং হ্যাঙ্গারের ডগাটা নামালাম… আরেকটু…যতক্ষণ অবধি না ওটা শাটার বাটন দাবাল।
ঝলকানি!
হ্যাঁ! আয়নায় নিজের ছবি নিয়েছে ভুতুড়ে ক্যামেরা।
আমার পরিকল্পনায় কি কাজ হবে?
শ্বাস চেপে, চারকোনা ফিল্মটা চেপে ধরলাম। চোখের
সামনে তুলে ওটাকে ডেভেলপ হতে দেখছি।
‘আয়…আয়…’
এবার সভয়ে আঁক করে উঠলাম।
‘খাইছে!’
স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি ছবিটার দিকে। চোখে দুটো করে দেখছি নাকি?
দৃষ্টি নামালাম-এবং আর্তনাদ ছাড়লাম।
‘খাইছে, নাআআআআ!’
আমার ড্রেসারের ওপর পাশাপাশি বসে রয়েছে দু-দুটো অপয়া ক্যামেরা!
***